#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট২৫

-দাদি এইটা কি পিঠা?
-আমগো দেশে এডারে কয় কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা।

দাদি বসে মুঠা পিঠা বানাচ্ছিলো।পাশে শুভ্র বসে তা দেখছিলো।শুভ্রের কথার দাদির এমন জবাবে শুভ্র ফিক করে হেসে দেয়।হাসতে হাসতে বলে,,,

-কি বললে দাদি?আবার বলো তো!
-আরে কইলাম না এডা কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা।ভর্তা, চিনি দিয়া ভরায় খায়।ফিরিজে রাইখা তেলে ভাইজাও খাবার পারবি।স্বাদ লাগে ভালাই।
-সাপের বীণ বলের মতো বানানোর পরেই কি খাওয়া যায় আপনার এই কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা?
-মেঘ তোর জামাই এবা হাবাইতা(কোনো কিছু দেখলেই খেতে মন চায় এই টাইপের মানুষ) ক্যান রে!তোর হ্বরি(শ্বাশুড়ি)কি পেটে কইয়া কিছু খায় নাই?
-খালাম্মা কিছু খাইতে পাই নাই।সব বমি করে ফেলে দিছি।

রান্নাঘর থেকে আমার শ্বাশুড়ি মা হেসে বলেন।আজ সকালে এসেছে সবাই।বিভিন্নরকম পিঠা বানিয়ে এনেছেন দাদি নাতিন জামাইয়ের জন্য।আবার সাথে চালের গুঁড়িও এনেছে।সেগুলো দিয়ে এখন মুঠা পিঠা বানাচ্ছে আর শুভ্র পাশে বসে তা দেখছে।বাসাটা বেশ ভরা ভরা লাগছে।সবাই হৈ হুল্লোরের মাঝেও আমি কাঁদছি।জ্বী আমার দাদি আমায় পেঁয়াজ কাটটে দিয়েছেন।নাতিন জামাইকে সে বিভিন্ন রকম ভর্তা দিয়ে মুঠা পিঠা খাওয়াবেন।তারই পেঁয়াজ ছিলে কাটটে হচ্ছে আমায়।কেন রে ভাই?চিনি দিয়ে মুঠা পিঠা খাওয়ালেই তো হয়!শুধু শুধু কেন আমার এত্তগুলো পেঁয়াজ ছিলে কাটটে হবে?কখন যে আবার শীল নড়া নিয়ে বসতে বলে দাদি!শুভ্র আবার দাদির কাছে বিচার দিয়ে বসেছে আমি নাকি তাকে কিছুই রান্না করে খাইয়াই না।শাস্তি সরূপ দাদি আমায় পেঁয়াজ কাটটে দিয়েছেন।উহহ!আগে শুভ্রকে কি না বলতো!আর এখন মাথায় তুলে নাচে। আর একমাত্র নাতনিকে পেঁয়াজ কাটটে দেন।

-মেঘ একটু আয়।

রুম থেকে ভাইয়ার ডাক।না জানি কি করছে এতক্ষণ ধরে!কাজ ফেলে আমি যাই কিভাবে?ডাকে সাড়া না দেওয়ায় ভাইয়া আবার ডাক দেয়।

-কিরে!ডাকছি না?
-আমি কি তোমার মতো বসে আছি?তোমার গার্লফ্রেন্ড কাজ দিয়েছে কতগুলা দেখো না?
-পাঁচ মিনিট!আয় না!

ঘরে গিয়ে দেখি ভাইয়া একটা মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে।মেয়েটার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

-হুম বলো ভাইয়া।

আমার ডাক শুনে ভাইয়া দৌড়ে আমার দিকে আসে।

-দেখ না!একটু অহনাকে বুঝা!

কথাটা বলে আমার হাতে ফোন ধরিয়ে দেয় ভাইয়া।ফোন হাতে নিতেই অহনা রাজ্যের নালিশ আমার কাছে দিয়ে বসে।আমি চুপচাপ তার নালিশ শুনি।মুল কথা হচ্ছে অহনার ফ্যামিলি বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছে।কিন্তু ভাইয়া এই মুহুর্তে বিয়ে করতে রাজি না।ও ক্যারিয়ার আরেকটু গুছিয়ে নিতে চায়।

-আমার অন্য কারও সাথে বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ভাইয়ের ক্যারিয়ার গুছানো শেষ হবে!
-মেঘ ওকে উল্টোপাল্টা কথা বলতে প্লিজ বন্ধ করতে বল।
-করে নে না বিয়ে!

ভাইয়াকে বলি আমি।আমার কথা শুনে ভাইয়া অনেকটা ভড়কে যায়।মুহুর্তেই তার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করে।

-আচ্ছা করলাম বিয়ে, কিন্তু পরে তো দাদি বলবে বিয়া করছোত বউরে খিলাবি কি!

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ভেংচি কেটে বলি,,,

-এহ!বউরে খিলাবি কি!তুই তো তাও চাকরি করিস।আর তোর বোনকে যে বেকার শুভ্র বিয়ে করলো তখন?তোর বোন কি এতদিন শুভ্রর চাকরি হওয়ার আগে না খেয়ে ছিলো?আর শোন রিজিকের মালিক আল্লাহ।তিনি মানুষের রিজিক ঠিক করে রেখেছে।তাই কি খাওয়াবে তা নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।
-খুব তো বয়স্ক মানুষের মতো জ্ঞান দিলি!
-আছে দেখেই দিলাম।তোর মতো তো মাথামোটা না আমি।
-উফফ তোমরা দুই ভাইবোন কি শুধুই ঝগড়া করবে?

অহনার কথায় আমরা চুপ হই।অহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তীব্র অভিমান জড়ানো কন্ঠে ভাইয়াকে বলে,,,

-থাক মাহি।অনেক বিরক্ত করেছি।আর করবো না বিরক্ত।বিয়ের ডেট ফিক্সড হলে জানাবো নি।স্পেশাল গেস্ট হিসেবে আসিয়ো।আল্লাহ হাফেজ।

অহনা ফোন কেটে দেয়।ভাইয়া তীব্র বিরক্তি নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারে ফোনটা।

-ঢং!বিছানায় ঢেল দিলি কেন?এতই যদি বড়লোকি ভাব দেখানোর ইচ্ছা থাকে তাহলে ফ্লোরেই ঢেল দিতি!
-আমি তোর থেকে সাড়ে আট বছরের বড়।রেস্পেক্ট মি
-আমার ঠেকা!

কথাটা বলে আমি ভেংচি কেটে চলে আসি।এসে দেখি শুভ্র আর শিশির সোফায় বসে ভাপ দেওয়া মুঠা পিঠা সস দিয়ে খাচ্ছে।আমায় দেখে শুভ্র হেসে বলে,,,

-কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা খাই!
.
-কিরে ছেমড়ি তুই কই গেছিলি?ভর্তা করবো কেরা?
-সস দিয়ে খাচ্ছে খাক না!

বিরক্তি নিয়ে বলি আমি।দাদি আমায় ধমক দিয়ে বলেন,,,

-হ্যাত!জামাই মানুষ সস মস দিয়া কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা খাইবো ক্যা?এতগুণা পিঁয়াইজ কি তোরে হুদাই ছিলাবার কাটবার দিছিলাম?শীল নড়া আন ভর্তা করবি।

যা ভয় করেছিলাম তাই ই।অগত্যা!শীল নড়া নিয়ে বসলাম নবাবের জন্য ভর্তা করার জন্য।সকাল থেকে খেটে খুটনে পোলাও মাংস রান্না করলাম!সবাই ওই পিঠাই খাচ্ছে।শুধু ভাইয়া বাবা খেলো আমার রান্না।আর শুভ্র তো…কি বলবো।তার ভাষ্যমতে ভাত খেতে খেতে জিহ্বায় ছাতা পরে গেছে।তাই সে সারাক্ষণ পিঠা খাবে।খাক যত খুশী খাক পিঠা!মুঠা পিঠা মানে কুত্তা ঢেলাইনা পিঠা অবশ্য ভর্তা দিয়ে খেতে খারাপ না।মা রান্নাঘরে চিতই বানাচ্ছে।আমার শ্বাশুড়ি মা তা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছেন।তিনিও আমার মতো পিঠা অত পান না বানাতে।শিখে যাচ্ছে এখান থেকে পরে নাকি আমার শ্বশুর মশাইকে পিঠা বানিয়ে খাওয়াবেন।

কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলতে উঠে যাই।দরজা খুলে দেখি পাকনা বুড়ি আনহা একরাশ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাথে ভাবি।

-আরেহ ভাবি!
-শুনলাম তোমার বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে!
-জ্বী।ভিতরে আসুন।

আনহা আর ভাবি ভেতরে আসেন।আমার দাদি মানুষজন অত পছন্দ করেন না।আনহা আর ভাবিকে দেখে নাক সিটকোয় বলেন,,

-এরা আবার কারা?
-পাশের বাসার ভাবি।
-তোর এত মাইন্সের লগে খাতির বাজান লাগবো ক্যা?আইতে না আইতেই সঙ্গী বানায় লইছে!
-মা!দয়া করে চুপ থাকুন।শুনলে কি ভাববে!

মা দাদিকে কথাটা বলেন।দাদি ভেংচি কাটে।ভাগ্যিস দাদি রান্নাঘরে ছিলো না হলে আনহা আর ভাবির সামনে কি বলে বসতো আল্লাহই জানেন।
নাস্তা নিয়ে গিয়ে দেখি আনহা শুভ্রের কোলে বসে ওর সাথে পিঠা খাচ্ছে আর ভাবি আমার শ্বাশুড়িমার সাথে কথা বলছেন।

-আন্তি দাল দাল!মাম দাও।

আনহার কথা শুনে আমি ওর জন্য পানি আনতে যাই।ওর জন্য আলাদা গ্লাস রেখে গেছেন ভাবি।হাইজেনিকের ব্যাপারে আনহা পুরো ভাইয়ার মতো হয়েছেন।সব জায়গায় সব জিনিস খায় না।এইটুকু বাচ্চার মধ্যে বেশ ভালোই খুতখুতানি আছে।আমি গিয়ে আনহাকে পানি দিই।শুভ্রের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলি,,,

-ভর্তা দিয়েছিলে নাকি?ঝাল ঝাল বললো!
-একটু দিয়েছিলাম আর কি!
-এই টুকু বাচ্চাকে দিতে গেছেন উনি ভর্তা দিতে!আক্কেল জ্ঞান যে কবে হবে!

সবাই এক হওয়ায় আড্ডার আসর বেশ জমে উঠেছে।দাদি পুরোনো দিনের গল্প জুড়ে বসেছেন।আমায় অপমান করতে যেন দাদি একটু বেশিই পছন্দ করেন।মাঝে মাঝে ভালো লাগে আবার মাঝে মাঝে খুব কষ্টও দেয়।এত হৈ হুল্লোড়ের মাঝে ভাইয়া মুখ গোমড়া করে বসে আছে।আমি প্রথমে খেয়াল করিনি কিন্তু শুভ্র ঠিকই খেয়াল করেছে।আমায় জিজ্ঞাস করেছিলো আমি কিছু জানি কি না।কিন্তু সব কি আর শুভ্রকে বলা যায়?সত্যি বলতে ভাইয়ার এমন মন খারাপ করে চুপচাপ থাকা আমার খুব খারাপ লাগছে।ঝগড়া মারামারি যাই করি।হাজার হলেও ভাই তো!অহনার জন্য চিন্তা হচ্ছে হয়তো।ভাবতেছি অহনা আর ভাইয়ার রিলেশনের কথা বাবাকে বলেই দেবো।ঘুরতে এসেছে।মন মেজাজ নিশ্চয়ই ভালো থাকবে।তারই সুযোগ নিয়ে বলে দেবো ভাইয়া অহনার রিলেশনের কথা।

-এইযে ছেমড়ি!কতদিন আর মাইন্সের পোলাহান লই নাচবি?বাচ্চা নিবার পারোস না?পুতির মুখ দেইখা মরি

দাদির কথায় ধ্যান ভাঙে আমার।লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে লাজুক হাসি।পাশে দেখি শুভ্ররও একই অবস্থা।লাজুক হেসে বলি,,

-দাদি আমরাই তো বাচ্চা আর কি বাচ্চা নেবো?
-এহ!আইছে!দামড়া বড় পোলাহান।তোর বয়সে তোর বাপ ফুপুগোরে জন্ম দিয়া বড় কইরা ইশকুলে পাঠাইছি।তোর ছোট চাচায় তহন হাঁটে।কেরা জানতো ওই গেন্দা পোলা হাঁটতেই হাঁটতেই খোদার কাছে যাইবো গা!

দাদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন।আমার বাবার ইমিডয়েট ছোট ভাই ছিলো।পানিতে ডুবে মারা যান।দাদির ধারণা তার জন্যই চাচা মারা যান।সে যদি চাচাকে চোখে চোখে রাখতো তাহলে চাচা আজ আমাদের সাথেই থাকতো। হঠাৎ করে দাদির কথার কথায় তার কথা উঠায় দাদি আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে দেন।

চলবে,, ইনশাআল্লাহ

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here