#একজোড়া_পায়রা
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট২২
-হাই বুশরা।কেমন আছো?
আমার ডাকে বুশরা পেছন ঘুরে তাকায়।মেয়েটার চেহারা দেখলেই রাগে পিন্ডি জ্বলে।আগে শয়তানি করছিস মানা গেলো কিন্তু বিয়ের পরেও এমন শয়তানি তো মানা যায় না।আর কাজ পাও না।শুধু আমার আর শুভ্রর সংসারে আগুন লাগানোর ধান্দা।মাঝে মাঝে মন চায় বসিয়ে দিই কানের গোড়ায় এক চড়।
-জ্বী ভালো।তুমি?
বুশরার কথায় আমার ধ্যান ভাঙে।কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলি,,
-জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। আমিও ভালো আছি।
-কিছু বলবে?
-হুম অনেক কিছুই বলবো।
-হিয়ালি না করে বলবে যা বলার?
-অনেক কিছুই তো বলার আছে।কোনটা দিয়ে শুরু করবো বুঝে উঠতে পারছি না।
-ওলেএ আমাল ধুয়া তুলসী পাতা
থুতনীতে ধরে কথাটা বলি বুশরাকে।বুশরা হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে বলে,,,
-অসভ্য মেয়ে।আসছে ঢং করতে।
-অহ আচ্ছা।মানলাম আমি অসভ্য আর অন্যের সংসারে আগুন লাগানো খুব সভ্য মানুষের কাজ?
-মা..মা..মানে?What do you mean Megh?
তোতলিয়ে বলে বুশরা।আমি গড়গড় করে বলি,,,
-বিয়ের আগে তুমি শুভ্রকে পছন্দ করতে।তাই শুভ্রের কাছে আমার নামে অনেক কু কথা বলেছো মেনে নিয়েছি।কিন্তু বিয়ের পরও এগুলো করে কি তুমি আমার সংসার ভাঙতে চাচ্ছো?কি পাও এগুলা করে।সত্য করে বলবা বুশরা তুমি কি এখনো শুভ্রকে পছন্দ করো?সতীনের ঘরে আমার আপত্তি নেই।তুমি চাইলে আমার সতীনও হতে পারো।তুমি কাজ করবে আর আমি বসে বসে খাবো।ডিল?
আমার কথা শুনে বুশরা নাক সিটকোয় আর ওর বান্ধবীরা মুখ চেপে হাসতে লাগে। ঘৃণ্য গলায় বুশরা বলে,,,
-ছি! মেঘ তোমার মাইন্ড কত চিপ!আমি কেন তোমার সংসার ভাঙতে যাবো?
-হাবভাব আচার আচরণে তো তাই বুঝা যায় বুশরা।
-প্রমাণ আছে?
-প্রমাণ ছাড়া মেঘ কিছু বলেনা বুশরা।
কথাটা বলে আমি শুভ্রকে ফোন লাগাই।বিজি দেখায়।ক্লাসে আছে বোধহয়। আমি আবার ফোন লাগাই।চতুর্থ বারের মতো কল দিলে সে কল রিসিভ করে।
-জানোনা এখন ক্লাস?
-আমি দরকার ছাড়া ফোন দিই কখনো?
-কি দরকার?তাড়াতাড়ি বলো।
আমি ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে উনাকে বলি,,,
-তোমাকে আমার আর অর্কের কথা বলা ভিডিও করে নেগেটিভ মেসেজ কে করেছিলো?
উনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেন না।উলটো আমায় বলেন,,,
-মেঘ আমি তোমায় ঝামেলা করতে না করেছিলাম।তুচ্ছ একটা বিষয়কে এত বড় করার কোনো মানে হয় না মেঘ।
-কথায় কথা বাড়ে।আমি আপনাকে যা প্রশ্ন করেছি ঠিকঠাক জবাব দিন।আমার আর অর্কের রিলেশন আছে এই কথা কে বলেছিলো।
-বুশরা।
-হইছে।আপনি যান ক্লাস নেন।
উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ফোন কেটে দিই।
-শুনলে তো? শুভ্রকে এখনো ভালো লেগে থাকলে বলো আমি সতীনের ঘর করতে রাজী আছি।শুধু সব কাজ তোমার করতে হবে।
আমার কথা শুনে বুশরা কিছু বলে না।ভেংচি কেটে চলে যায়।ও যেতে না যেতেই ফুল ফিক করে হেসে দেয়।আমি ওকে আলতো করে চড় মেরে বলি,,,
-হাসির কি আছে?
-কিভাবে ইনডায়রেক্টলি অপমান করলি। হাসবো না তো কি করবো?বাই দ্যা ওয়ে মেঘ তুই কি আসলেই সতীনের ঘর করবি?
-ফালতু কথা।আমি বাঙালি মেয়ে বুঝলি?বাঙালি মেয়েরা আর কি পারুক বা না পারুক জামাইকে অন্য কারও সাথে শেয়ার করতে পারে না।শুভ্র শুধুই আমার।
★
গাড়ির ঝাঁকিতে আমার ঘুম ভাঙে।চোখ খুলে নিজেকে শুভ্রের বুকে আবিষ্কার করি।আর পাঁচটা বারের মতো এইবারও উনি আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন।সিলেট যাচ্ছি আমরা।আমার পরীক্ষা কালকে শেষ হয়েছে।শুভ্র তিনদিনের ছুটি নিয়েছে।তাই দেরি করিনি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেরদিনই চলে আসলাম।সব গুছিয়ে নিতে মাঝখানে একদিন লেগে গেলো এই যা!আমি এর আগে এত লং জার্নি করিনি।মাঝখানে প্রচুর বমি করেছিলাম।ক্লান্তি শরীরটা নিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।গায়ে দেখি উনার জ্যাকেট।ঠান্ডা লাগছিলো তাই হয়তো গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।গুগল ম্যাপে দেখলাম সিলেটের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি।পাঁচ থেকে দশমিনিটের মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবো।শুভ্রকে ডাক দিই।উনি চমকে ঘুম থেকে উঠেন।সবে ঘুমিয়েছিলেন হয়তো!ইশ বেচারার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।ঘুম ঘুম চোখে উনি বলেন,,,
-কি হয়েছে মেঘ?
-সিলেট মনে হয় এসে গেছি।
-তুমি বুঝলে কিভাবে?
-যুগ মর্ডান হয়েছে মশাই!গুগল করলেই সব জানা যায়।
উনি হাই তুলে লম্বা একটা মোচড় দিয়ে উঠে ব্যাগগুলো নামাতে লাগেন।রাত্রি থাকায় রাস্তায় খুব একটা গাড়িঘোড়া নাই।তাই ইজিলিইই আসতে পেরেছি সিলেট।উনি ব্যাগ নামিয়ে বোধহয় পাঁচ মিনিট বসতে পেরেছিলেন।তারমধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই।বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাড়ে চারটার মতো বেজে যায়।আর মাত্র আধ ঘন্টা।একটু পরই ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যাবে আর আজান দেবে।ফজরের নামাজটা পড়েই একবারে ঘুম দিই।আমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসি।ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি উনি বিছানায় মরার মতো পড়ে আছেন।আমি গিয়ে উনাকে টেনে তুলি ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসার জন্য।কিন্তু উনি সেই আবার বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেন।বিয়ের পর আমি অনেকটা জোরজবরদস্তি করেই উনাকে নামাজ পড়া ধরিয়েছিলাম।এখানে এসে যে আমার ধরিয়ে দেওয়া অভ্যাসটা গেছে তা আমি তার আলসেমিতেই বুঝতে পারছি।আমি পাশে থাকা বোতল থেকে পানি নিয়ে উনার মুখে পানি ঝাপটা দিই।অনেকটা বিরক্তি নিয়েই উনি জেগে উঠেন।
-নামাজ পড়ে এসে যত মন চায় ঘুম দিও।এখন যাও ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসো।
অনেকে হয়তো আমাদের ডাকাডাকি শুনে কনফিউজড হয়ে যাবে।এক সময় তুমি আর একসময় আপনি ডাক শুনে কনফিউজড হওয়াই স্বাভাবিক। আসলে আমি নিজেও জানি না এই লোকটাকে আমি কখন কিভাবে ডাকি। হঠাৎ করেই এই লোকটাকে তুমি আবার হঠাৎ করেই আপনি ডেকে ফেলি আমি।উনি একরাশ বিরক্তি নিয়ে ওয়াশরুমে যান।ফ্রেশ হয়ে একেবারে ওযু করে বের হন।উনি হাত পা মুছতে মুছতে মুছতে ফজরের আজান দিয়ে দেয়।আমি নামাজে দাঁড়াই। আমার পাশে উনি নামাজে দাঁড়ান।দুইজন একসাথে নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম যখন ভাঙে তখন দেখি ঘড়ির কাঁটায় দুপুর সাড়ে বারোটা।তাড়াহুড়ো করে উঠে ফ্রেশ হতে যাই। পনেরো মিনিটে একবারে গোসল করে বের হই।এসে দেখি উনি সেই মরার মতো ঘুমাচ্ছেন।উনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমি রান্নাঘরে যাই।সব এলোমেলো। কিভাবে কি রান্না করবো আমি বুঝে উঠতে পারি না।চুলোর পাশে একটা ঝুড়িতে পাস্তার প্যাকেট পাই।কড়াইতে পানি দিয়ে পাস্তা সেদ্ধ করতে বসিয়ে দিই।সাড়া রান্নাঘর খুঁজে পেঁয়াজ, মরিচ, ডিম আর তেল ছাড়া আর কিছুই পেলাম না।অগত্যা তা দিয়েই কোনো রকমে চালিয়ে দিই দুপুরের খাবার।
দুপুরের খাবারে পাস্তা পেয়ে শুভ্র বলে,,,
-শুধু কষ্ট করে পাস্তা করতে গেলে কেন?ডিমভাজিতেই চলে।
-ডিমভাজিতে চলে মানে?
-মানে সকালে দুইটা ডিমভাজি খেয়ে আমার সারাটাদিন ইজিলি চলে যায়।তাই বললাম আর কি!
-সারাদিনে আর ক্ষুদা লাগে নাই?
-লাগছে।ঐ হাল্কা পাতলা খুদা লাগছে।তখন বাইরের হাল্কা খাবারে কাজ চালিয়ে নিয়েছি।
যাক গে শুভ্রের কথায় বোঝা গেলো যে উনি রান্না নিয়ে খুব একটা ঝামেলা করবেন না।যা দেবো তাই খেয়ে উঠবেন।এই টুকু আশা করা যায়।শ্বশুরবাড়িতে থাকতে আমি রান্না করিনি তেমন একটা।আমার শ্বাশুড়ি মা ই সব করতেন।আমি শুধু তাকে কাজে হেল্প করতাম।হলে থাকতে তো ডাইনিংয়েই গিয়ে খেতাম। আর মেসে থাকতে বুয়া এসে রান্না করে যেত আমরা শুধু ভাত রান্না করে খেয়ে উঠতাম।তাও এশাই করতো ভাত।রান্না বান্নায় আমি একবারে কাঁচা।অত রান্না পাই না শুনে অনেকেই বলে স্মার্ট হওয়ার জন্য চাপা মারছি।আর বলবে না ই বা না কেন?আজকালকার বেশি মেয়েরাই মনে করে রান্না না জানা স্মার্টনেস।তাই এই বিষয়টা নিয়ে মেয়েরা বেশি চাপা মারে।আমি আবার চাপা মারতে পাই না খুব একটা।চাপা মারা ব্যাপারটা আমার কাছে ক্ষ্যাত লাগে।আর যারা চাপা মারে তাদের তো আমার একেবারে বস্তির মানুষ মনে হয়।
★
আপাতত যা যা প্রয়োজন সব কিনে নিই।পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি যথেষ্ট ভালো আছেন।আমায় একেবারে নিজের ছোটবোনের মতো দেখেন।যাবতীয় কেনাকাটা তাকে নিয়েই করি।কলেজে একবেলা ক্লাস আর একবেলা পরীক্ষা থাকায় শুভ্রও সময় হয়ে ওঠে না আমার সাথে গিয়ে কেনাকাটা করার।হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে যা কিনার কিনে নিও।রাস্তাঘাট খুব একটা না চিনায় পাশের ফ্ল্যাটের ভাবিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।উনার একটা মেয়ে আছে।নাম আনহা। আড়াই বা তিন বছরের মতো হবে বয়স।ভিষণ চঞ্চল।একমিনিটও যদি স্থির হয়ে বসতে পারে।ভাবিকে কোনো কাজ করতে দেয় না।তাই পিচ্চিটাকে ম্যাক্সিমাম টাইম আমার কাছেই রাখি।এমনিতেও আমার মেয়ে বাবু খুব পছন্দের।আমি আমাদের ফ্ল্যাটে এনে বাচ্চাটাকে সাজিয়ে দিই।আনহা আবার সাজগোজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।লিপস্টিক নেইলপালিশ দিয়ে যদি কোনো জায়গায় বসিয়ে দিই তাহলে সে ওখানেই চুপচাপ বসে থাকবে যাতে লিপস্টিক নেইলপালিশ নষ্ট না হয়।আনহার আবার চকলেট খুব পছন্দ।আমিও যেহেতু চকলেট খুব পছন্দ করি তাই ঘরে সব সময়ই চকলেট থাকে।তাছাড়া আমি রাগ করলে শুভ্র সেই চকলেট দিয়েই আমার রাগ ভাঙায়।তাই আমি আরও বেশি করে রাগ করি।
আমি রান্না ঘরে কাজ করছিলাম আর আনহা ডাইনিংপ্লেসে চেয়ারে বসে ওর ট্যাবে কার্টুন দেখছিলো।অনেকক্ষণ ধরেই এসেছে আনহা।আমি কাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করি,,,
-আনহা!ক্ষুধা লেগেছে?
আনহা কোনো কথা বলে না।ঠোঁটটা পাখির ঠোঁটের মতো করে আঙুল দিয়ে দেখায় যে সে লিপস্টিক দিয়েছে।তাই এখন কিছু খাওয়া যাবে না।আমি হেসে দিই আনহার কান্ডে।ডাব্বা থেকে বিস্কুট একটা বাটিতে দিয়ে আনহার হাতে দিই খাওয়ার জন্য। কিন্তু সে খাবে না।আমি মুচকী হেসে বলি,,,
-চিন্তা করতে হবে না আপনাকে বুড়ি।আমি খাওয়া শেষ হলে আবার আপনাকে লিপস্টিক দিয়ে দিবো।
চলবে,,,ইনশাআল্লাহ