এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
#পর্ব_১৪
লেখা_সাইফুল_ইসলাম
সাজু আর রামিশা যে টেবিলে বসে আছে। তাদের ঠিক তিনটা টেবিল পরে গুটিশুটি মেরে বসে আছে আলাউদ্দীন। তার চোখে রাগের আগুন ঝড়ে পড়ছে, কারণ এইমাত্র রেস্টুরেন্টের মধ্যে অনেক যুবক প্রবেশ করেছে। সম্পুর্ণ রেস্টুরেন্ট এখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ, এই মুহূর্তে গুলি করার রিস্ক নেওয়া বোকামি।
কাজের জন্য নিজেকে বিপদে ফেলার কোনো ইচ্ছে আলাউদ্দীনের নেই। দরকার হলে অপেক্ষা করবে সে, রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে বাহিরে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। কারণ এখন যদি গুলি করতে যায় তবে এই যুবকদের হাতে ধরা পড়তে হবে।
একপ্রকার বাধ্য হয়ে বেরিয়ে গেল আলাউদ্দিন।
সাজুর আঘাতপ্রাপ্ত হাতের দিকে তাকিয়ে রামিশা চুপ করে রইল। ক্ষনিকের জন্য সে সাজুর প্রতি রাগ করে ছিল, পুতুল ওভাবে কথা না বললে হয়তো এমনটা হতো না।
– সাজু ভাই, যখন গুলি লেগেছিল তখন আপনি অজ্ঞান হয়ে গেছেন নাকি শ
– না, তবে তীব্র ব্যথা ছিল। গুলি লাগার পরে আমি অনেকক্ষণ স্বাভাবিক ছিলাম। পরে অবশ্য আর কিছু মনে নেই।
– আপনি কীভাবে বুঝতে পেরেছেন আমার উপর কেউ আক্রমণ করতে পারে?
– সন্দেহ হচ্ছিল। তবে তোমার উপর আক্রমণ হবার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু সে তোমাকে হাতের কাছে পেয়েও হত্যা করেনি।
– কেন?
– ওদের দলের একটা লোক পুলিশের হাতে বন্দী। তাকে খুন করার চেষ্টা করছে তাদের কন্ট্রাক্টকারী, কিন্তু সে চায় লোকটা বেঁচে থাকুক। আমি সেই লোকটার জন্য সামান্য রক্তের ব্যবস্থা করেছি তাতেই নাকি সে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে।
– এসব আপনি কীভাবে জানেন?
– রাব্বি কল করেছিল আমাকে।
– রাব্বি কি সেই খুনি?
– হ্যাঁ।
– আমাকে যে ছেলেটা সাহায্য করেছে তার নাম রবিউল ইসলাম। সত্যি বলতে তিনি যদি আমাকে না নিয়ে আসতেন তাহলে জানি না কি হতো।
– রাব্বি বলেছিল যে তুমি নাকি একটা ভালো ছেলের হেফাজতে আছো। তবে তিনি এতটা বেশি উপকার করবে ভাবিনি।
– আপনার উপর এমন একটার পর একটা হামলা হচ্ছে এখন কি করবেন?
সাজু এবার ছবির প্রসঙ্গে গেল। রামিশার মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো ওয়ালপেপারে সেই ছবিটি এখনো আছে।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– করেন।
– এই ছবিটি কি তুমি কাউকে দিয়েছ? শুধুমাত্র তোমার কাছেই কিন্তু এই ছবিটি আছে, তাছাড়া আর কারো কাছে নেই।
– কেন বলেন তো?
– মাহিশা নামের মেয়েটার লাশ যে ফ্ল্যাটে পাওয়া গেছে সেখানে এই ছবিটি ছিল। সেম ছবিটি কেউ একজন কম্পিউটার প্রিন্ট করে সেখানে রেখে দিয়েছে।
– বলেন কি? আপনার ছবি সেখানে।
– তুমি ভালো করে মনে করে দেখো তো।
– ছবিটি আমার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করা আছে সাজু ভাই।
– কিহহ?
– আপনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন আমি এটা পোস্ট করেছিলাম। তাই হয়তো আপনি দেখতে পাননি বা জানেন না।
সাজু মনে মনে ভাবলো এটা তার আগেই খুঁজে দেখা দরকার ছিল। রামিশার ফেসবুক আইডি খুঁজলেই সে জানতে পারতো।
– তারমানে খুনি তোমার আইডি থেকে ছবিটি ডাউনলোড করে নিয়েছে।
– কিন্তু কেন সাজু ভাই?
– আমাকে বিপদে ফেলতে।
– মাইগড।
– আমি তোমাকে এখান থেকে বেরিয়ে তোমার বোনের বাসায় নিয়ে যাবো। তুমি সেখানে থাকবে, দিনে বা রাতে কখনো বাসা থেকে বের হবে না।
– আমি আপুর বাসায় যাবো না।
– তাহলে?
– আপনি অসুস্থ, যেকোনো সময় বিপদে পড়তে পারেন তাই আমি আপনাকে একা এভাবে বের হতে দেবো না। আমি আপনার সঙ্গে থাকবো, যদি বিপদ হয় দুজনেই একসঙ্গে বিপদে পরবো।
সাজুর মোবাইলে একটা মেসেজ এলো। নাম্বারটা অপরিচিত কিন্তু খবরটা গুরুত্বপূর্ণ।
” রেস্টুরেন্টে আপনার শত্রু আছে, সাবধান। ”
সাজু চারিদিকে তাকাতে লাগলো। দ্রুত খাবার শেষ করালো তারা, চারিদিকে অনেক যুবকদের সে দেখতে পাচ্ছে। এদের মধ্যে কে সেই খুনি তা জানা অসম্ভব। রামিশাকে নিয়ে সাজু ভাই আস্তে করে বেড়িয়ে গেল।
লিফট ব্যবহার না করে তারা সিঁড়ি দিয়ে নামলো। মেইন গেট দিয়ে বের না হয়ে পিছনের একটা ছোট্ট গেট দিয়ে বের হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে আলাউদ্দীন যখন আবারও উপরে গেল তখন দেখে সেখানে কেউ নেই।
★★
সকাল বেলা সাজুর ঘুম ভাঙলো মোবাইলে কল আসার কারণে। গতকালের সেই ওসি সাহেব কল দিয়েছে, সাজু ঘুম ঘুম চোখে রিসিভ করলো।
– ওসি সাহেব উত্তেজিত হয়ে বললেন, সাজু সাহেব আপনি কোথায়?
– আমি আমার এক বড়ভাইয়ের বাসায়।
– মেয়েটার খুনিকে পাওয়া গেছে। সে গতকাল রাতে আমাদের একটা স্বীকারোক্তির ভিডিও দিয়ে নিজে আত্মহত্যা করেছে।
সাজুর চোখের ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গেল।
– কি বলছেন? রাব্বি আত্মহত্যা করেছে?
– ওর নাম তো রাব্বি না, সেই খুনিটার নাম হচ্ছে আলাউদ্দীন। খুব খারাপ মানুষ, বেশ কিছু মামলা আছে তার নামে। সে নিজের মুখে বলেছে ওই মেয়েকে সেই হত্যা করেছে। তারপর আপনার উপর আক্রমণ করা, আপনার ছবি সেই বাসায় রেখে যাওয়া সবকিছু স্বীকার করেছে।
– অসম্ভব।
– আপনি থানায় আসুন আমি আপনাকে সেই ভিডিও দেখাচ্ছি। আর সিসিটিভি ফুটেজ দেখবেন বলেছিলেন, সেটাও দেখে যাবেন।
– ঠিক আছে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সাজু। তার সামনে লিয়াকত আলী হাসান ও তার স্ত্রী এবং রামিশা।
এই সেই লিয়াকত আলী, যার সঙ্গে সাজুর প্রথম এই রহস্য বের করার কাজে পদচারণ। লিয়াকত সাহেব ডিবিতে চাকরি করে, ঢাকাতেই থাকে।
– সাজু বললো, আমাকে আপনার অনেক সাহায্য করতে হবে ভাই। বেশ কিছু মোবাইল নাম্বারের তথ্য বের করে দিতে হবে। কাকে কল করা হয়েছে কার কাছ থেকে কল এসেছে, সবকিছু আমার জানতে হবে।
– তোমার কাছ থেকে যতটুকু জানলাম তাতে করে মামলা বেশ জটিল। কিন্তু এটাকে ডিবির দায়িত্বে দিলে মনে হয় বেশি ভালো হতো। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার নাম্বার দিও আমি অফিসে গিয়ে বের করে দেবো।
– নাম্বার কিন্তু অনেক গুলো ভাই।
– মানে?
– ৭/৮ টা নাম্বার চেক করতে হবে। পরবর্তীতে সেই সংখ্যা বাড়তে পারে।
– ঠিক আছে হয়ে যাবে। একটু সাবধানে থেকো আর ঢাকার মধ্যে যেকোনো বিপদ হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।
– আচ্ছা।
– আমি জানি তুমি আমাকে জানাবে না, কারণ তুমি নিজের বিপদের কথা কাউকে বলো না।
– এবার বলবো সমস্যা নেই।
★★
পরপর তিনবার ভিডিওটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন সাজু। রক্তাক্ত আলাউদ্দীন নিজের হাতে মোবাইল নিয়ে রেকর্ড করেছেন।
সে বলছে,
” বাগেরহাট থেকে ওই মেয়েকে আমিই তুলে নিয়ে এসেছি। তারপর ওই বাসায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ফেলেছি কিন্তু লাশ গুম করতে পারিনি। যার সঙ্গে লাশের বিষয় কথা হয়েছে সে লাশ গুম না করে পালিয়ে গেছে। আমার ভুল হয়ে গেছে, আমার এমন মারাত্মক ভুলের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি, আমি জানি আমার বিচার হবে। আদালত হয়তো আমাকে ফাঁসি দিয়ে দেবে, আর সেজন্য বারবার উকিলদের কষ্ট করতে হবে। তাই আমি নিজেই আত্মহত্যা করতে চাই, আমাকে ক্ষমা করবেন। ”
চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে সাজু।
– ওসি সাহেব বললো, আমরা শুধু শুধু আপনাকে সন্দেহ করেছি অথচ আসামি নিজের মুখে সব স্বীকার করে নিলো।
– একটা কথা বলি স্যার।
– বলেন।
– খুনটা আলাউদ্দীন করে নাই।
– মানে?
– এটা একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারবে যে এই রেকর্ড তাকে দিয়ে জোর করে করানো হয়েছে। আপনি ভালো করে দেখুন আলাউদ্দীন রক্তাক্ত অবস্থায় আছে। তাকে নিশ্চয়ই কেউ প্রচুর মারধর করে এমন স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।
– তাহলে খুনি?
– আমার বিশ্বাস আপনি নিজেও জানেন সেই খুনির নাম। কিন্তু আপনিও এই মামলা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করতে চান না তাই ভিডিওটা বিশ্বাস করে এই মামলা ক্লোজ করতে চান।
– আমি জানবো কীভাবে? যদি সত্যি সত্যি জানি তাহলে তো গ্রেফতার করতাম।
– গতকাল হাসপাতালে আপনি আমার সঙ্গে কার কথা বলিয়ে দিয়েছেন? সত্যি সত্যি কি সে কোনো রাজনৈতিক নেতা, নাকি অন্য কেউ।
– আমি আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না।
– আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন স্যার। আপনার মুখ দেখে গতকাল বেশ ভয়ে যবুথবু হয়ে গেছেন সেটা মনে হচ্ছিল। সত্যি সত্যি যদি রাজনৈতিক কোনো নেতা হতো তাহলে আপনার আরও খুশি হতেন। নেতাদের আদেশে কাজ করতে পারার আনন্দ আপনার চোখেমুখে ভাসতো।
– তেমন কিছু নয়।
– এই মামলার ঘটনায় আপনিও আমার কাছে অবিশ্বাসী হয়ে গেলেন স্যার। মংলা থানার সেই দারোগা সাহেব যেমন আমাকে মারার ষড়যন্ত্র করেছে। আপনি তেমন করে আসল লোকটাকে আড়ালে রাখতে চাইছেন।
– দেখুন আমরা আইনের মানুষ। সাক্ষী প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সবকিছু করে থাকি। আলাউদ্দীন নিজের মুখে সব স্বীকার করেছে তাই এটাকে অবিশ্বাস করে নতুন করে তদন্তে নামা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে সাব্বিরের বাবাকে গ্রেফতার করার কাজ চলছে।
– উত্তর বাড্ডার যেই ফ্ল্যাটে লাশ পাওয়া গেছে সেই ফ্ল্যাটের মালিকের বাসা গুলশানে তাই না?
– হ্যাঁ।
– সেই লোকটা গতকাল কল করেছিল তাই না?
– মানে?
– আমি আপনার ফাইল দেখে জানলাম আপনি সেখানে ওই মালিকের বিষয় কোনো তথ্য লেখেন নাই। ম্যানেজারের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু সেই বাসার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো চিন্হ নেই। হয়তো আপনাদের মধ্যে গোপনে কথা হয়েছে কিন্তু আপনি সেটা গোপনেই রাখতে চান।
– চুপচাপ।
– আপনার থেকে এমনটা আশা করিনি স্যার।
– ওই লোকটা খুবই ভয়ঙ্কর সাজু সাহেব। আমি চাইনা এটা নিয়ে আমার নিজের কোনো ক্ষতি হোক। আপনার ও উচিৎ নিজেকে বাঁচাতে এই মামলা থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
– ভয়ে?
– আপনি কিন্তু প্রায় ফেঁসে যাচ্ছিলেন, তিনি যদি এই কাজটা না করতেন তাহলে আপনার এখন স্থান হতো জেল হাজতে।
– খুনটা রাব্বি করেছে এটা শিওর, তাই না?
– হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আমি চাইলে কিছুই প্রমাণ করতে পারবো না। আপনার ভাগ্য ভালো যে তিনি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছেন। নাহলে শুধু রাব্বিকে রক্ষা করতেন।
– মানুষকে বিপদআপদ থেকে রক্ষা করার মালিক আল্লাহ, আমি সেই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাবো। আমি আশা করবো আপনি তার সঙ্গে আমাকে একটু দেখা করার ব্যবস্থা করে দিবেন।
– কোনো লাভ হবে না।
– লোকসান নাহয় আমারই হোক।
সাজুর মোবাইলে কল এসেছে। ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে কলটা রিসিভ করলো সাজু।
– কে বলছেন?
– আপনার বুদ্ধি সত্যি প্রশংসনীয়। আপনি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান?
– হ্যাঁ চাই। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে আপনি কোনো রাজনৈতিক নেতা নয়।
– ঠিকই বলেছেন, আমি সেরকম কেউ নয় তবে সবাই ওটাই জানে। কারণ ক্ষমতা দিয়ে আমি তারচেয়ে বেশি কিছু করতে পারি।
– আপনি ঠিক এই মুহূর্তে কীভাবে কল দিলেন?
– ওইযে বললাম, ক্ষমতা দিয়ে।
– সম্ভবত ওসি সাহেব আপনাকে কনফারেন্সে রেখে আমার সঙ্গে কথা বলছে।
– হতেই পারে। কারণ সে যদি না করে তাহলে দুদিন পরে তার কোনো আত্মীয় থাকবে না।
– আমার পরবর্তী টার্গেট আপনি।
– আমি তোমাকে সত্যিই বাঁচাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমার উপকারের কথা স্বীকার করো নাই। বরং আমার পিছনে লাগার চেষ্টা শুরু করে দেবে তাই না?
– আমি সবার উপকার গ্রহণ করি না।
– রাব্বির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাও?
– হ্যাঁ চাই।
– সদরঘাট চলে যাও। রাব্বি সেখানেই আছে, তুমি সেখানে গিয়ে যেকোনো একটা বরিশালগামী লঞ্চে উঠে পড়বে। রাব্বি সেই লঞ্চে উঠবে, তারপর সেখানে তার সঙ্গে কথা বলে নিও।
– আপনি কি আমাকে বিভ্রান্ত করছেন?
– মোটেই না, রাব্বির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হলে চলে যাও। তোমাকে দেখে রাব্বিও সেই লঞ্চে উঠে যাবে। একটা কথা মনে রেখো, এবার যদি রাব্বি তোমাকে লাশ বানিয়ে দেয় সেখানে আমার কোনো নিষেধ থাকবে না।
কি আশ্চর্য কান্ড, গতকাল রাব্বিকে আমি নিজে বলেছিলাম তোমাকে বাঁচাতে। আর আজ আমি নিজে চাইবো সে তোমাকে মেরে ফেলুক। অদ্ভুত।
চলবে…