এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৩
“ওর মাঝে এতোটা স্বাভাবিকতা’টাই আমার কাছে বড় চিন্তার বিষয়।” শিল্প ডাক্তারের সাথে তনুর বিষয়ে কথা বলতে এসেছে।
“আপনি কেনো এতো চিন্তা করছেন? আপনি কি আপনার মিসেসের সম্পূর্ণ সুস্থতা কামনা করেন না?”
“কি বলছেন! ব্যপারটা এমন না।” একটু থামলো শিল্প, ডাক্তারের চোখেমুখে উৎসুকতা। একবার জোরে শ্বাস নিলো শিল্প। বললো,
“প্রতিটা মেয়ের জীবনে মাতৃকালীন সময়টা খুবই সেনসিটিভ। যেকোনো মেয়ে নিজের সন্তানকে নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা করে থাকে। সেখানে তনুর এতো বড় এক্সিডেন্ট। কিন্তু তার ব্যবহারে বোঝা ভার।”
“সি রিমেম্বার এভরিথিং, আপনাদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে। আই হোপ সে এসব বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না। শারীরিক কোনো সমস্যা এখন নেই। তবে মানসিক সমস্যার কথা বলা যাচ্ছে না। সময়ের সাথে তা প্রকাশ পাবে। তাছাড়া সে আপনাদের চিনতে পারছে। প্রত্যেকের সাথে কথা বলছে। হোপ সি রিয়েলি ওয়ান্ট হারসেল্ফ টু রিক্যুয়ার।”
“মেবি।”
“ডোন্ট ওয়্যারি, হোয়াটএভার ইউ আর সাসপেক্ট দ্যাট ক্যানবি জাস্ট ইয়োর ইমাজিনেশন।”
“ওকে ডক্টর।”
“এন্ড উই আর হেয়ার ফর ইউ সো চিল।”
ডক্টরের কেবিন থেকে বের হতেই কপালে দুটো আঙুল দিয়ে চেপে ধরলো শিল্প। ভীষণ যন্ত্রণা করছে মাথা। কেনো জানি তনুর ব্যবহারে ভয় করছে শিল্পের। যেখানে তনুর রাগ করার কথা, উত্তেজিত হবার কথা সেখানে তনুকে বড্ড নিষ্প্রাণ লাগছে। এই নিয়ে শিল্পের মনে ভয় হচ্ছে। কখন যেন কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডব শুরু হবে। ভেতরে অপরাধবোধের খচখচানিটা তো আছেই। মাঝে মাঝে প্রকট হয়ে অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে।
শিল্প কেবিনে প্রবেশ করলো। আজ সারাদিন নিবেদিতা হসপিটালে। তনুর সাথে লেগে আছে বলতে গেলে। শিল্প তেমন সুযোগ পায়নি কথা বলার। কেবিনে নিবেদিতাকে না পেয়ে অবাক হল শিল্প। বাথরুমের ছিটকিনি ভেতর তেকে বন্ধ। খুব সম্ভবত তিনিই ভেতরে।
শিল্প তনুর বেডের কাছাকাছি রাখা টুলে বসলো। তনু চোখ বন্ধ কর আছে। শিল্প মন ভরে তার শুষ্ক মুখশ্রী দেখতে থাকলো। শব্দহীন বসে আছে সে, যদি শব্দ হয় তনু জেগে যায়, শিল্পকে দেখলে যদি রিয়েক্ট করে। আরেকটা ভয় ভেতরে দানা বাঁধছে, তনু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়! সেদিন হয়তো তার কোনো দোষ ছিলনা প্রত্যক্ষভাবে। তবে পরোক্ষভাবে সে দোষী।
এতো চিন্তার মাঝে তনু কখন চোখ মেলে তাকিয়েছে খেয়াল করেনি শিল্প। তার দৃষ্টি তনুর দিকে হলেও চিন্তার জগত তাকে অন্য ধ্যানে নিয়ে গিয়েছে।
“কি দেখছেন?” ভাঙা ক্ষীণ কন্ঠ তনুর। শিল্প আপন ধ্যান থেকে বেরিয়ে এলো। হকচকিয়ে বললো,
“ঘুম কি ভাঙিয়ে দিলাম?”
“ঘুমাইনি তো, শুধু চোখ বন্ধ করে ছিলাম।”
“ওহ্।” শিল্প মাথা নিচু করে বসে আছে।
“আপনার কি হয়েছে? তখন থেকে দেখছি ঠিকঠাক কথা বলছেন না!”
গলায় কথা আটকে যায় শিল্পের। কি বলবে সে? প্রতিনিয়ত ভয় দানা বাঁধছে তার মনে। মনে হচ্ছে এই বুঝি তনু উত্তেজিত হবে, সেদিনের কথা বলবে। বলবে শিল্পের জন্য সবটা হয়েছে। তার ভাবনাকে আংশিক সত্য করে জানতে চায় তনু।
“আমি হাসপাতালে কেনো? কি হয়েছিল আমার?” তনুর কৌতুহলী দৃষ্টির পানে শিল্পের সংকুচিত দৃষ্টি। তনু কি সেদিনের ঘটনা সব ভুলে গেছে? বাচ্চার কথাও! কিন্তু তাদের সবাইকে মনে রেখেছে। কি হচ্ছে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
“তোমার কিছু মনে নেই?” শিল্প প্রশ্ন করলো।
“কি মনে নেই?” প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন তনুর। শিল্প কেমন থতমত খেলো। বাথরুমের দরজার দিকে তাকালো একবার। নিবেদিতা বের হলে ভালো হতো।
“না মানে..”
“এমন করছেন কেনো? মাও ঠিকমতো কিছু বলছে না। কি হয়েছে সবার! সবাইকে কেমন অপরিচিত লাগছে।”
“তেমন কিছু না, এসব তোমার মনের খেয়াল শুধু।”
“তাহলে বলুন আমি এখানে কেনো?”
“বলেছি না ছোটখাটো এক্সিডেন্ট। আবার কেনো ছেলেটাকে জ্বালাচ্ছো।” বের হয়ে তাড়াহুড়ো করে বললেন নিবেদিতা। শিল্প তনু উভয়ে তাঁর দিকে তাকালো। মায়ের কথা মনঃপুত না হওয়ায় আবারো শিল্পের পানে তাকালো।
“আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি।” শিল্প বুঝতে পারছে এক্সিডেন্টের সময়টুকুর কথা মনে নেই তনুর। কেনো মনে নেই তা ভাবার কোনো ইচ্ছা বা সময় নেই শিল্পের হাতে। এখন মূল চিন্তার বিষয় তনুকে এই মুহুর্তে কিছু বোঝানো।
“কেনো এসব নিয়ে ভাবছো তনু, কি হয়েছে কেনো হয়েছে না ভেবে, তুমি ভালো আছো এটুকু ভাবো।” কিছু সময় শিল্পের দিকে তাকিয়ে থাকলো তনু। পরক্ষণে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে বললো,
“তুমি বুঝবে না, বুঝবে না আমার অস্থিরতা।”
তনু এই প্রথম শিল্পকে তুমি করে বললো। কিন্তু তা নিয়ে শিহরিত হতে বা আনন্দিত হতে পারলো না। সত্যি কেউ কারও অনুভুতি বোঝে না। শিল্প নিজের মাঝে কতো গভীর ক্ষত নিয়ে ঘুরছে তা যদি কাউকে একবার দেখাতে পারতো। সম্ভব না, কোনদিন সম্ভব হয়না কাউকে নিজের কষ্টের অনুভুতি ভাগ করা।
আজ নিবেদিতা তনুকে একটু সময়ের জন্য ছাড়ছে না। শিল্প তনুর সাথে একা কথা বলার সুযোগ পায়নি। তা নিয়ে যদিও শিল্পের মাঝে ক্ষোভ নেই কারণ সে দোষী। মা মেয়েকে ভেতরে রেখে কেবিনের বাইরেই রাতটুকু পার করে দিলো। এ রাতেও ঘুম এলো না চোখে। এলোমেলো ভাবনায় কেটে গেল বৃহৎ পরিসরে ক্ষুদ্র রাত। পরেরদিন সকালেই পুরো টাকা জমা দিতে হবে। তবেই তনু ছাড়পত্র পাবে। বিশাল সময় পার করে ফিরবে তার আপন নীড়ে। কতোটুকু স্বাভাবিক হবে তাদের জীবন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তনুর ভুলে যাওয়া। সেকি বাচ্চার কথাও ভুলে গিয়েছে? তবে তাদের যে চেনে বড়! এ নিয়ে শিল্পের অস্থিরতার শেষ নেই। কাউকে মনের দোলাচল প্রশ্নের কথা প্রকাশও করতে পারছে না। সবার অভিমত যা হয় ভালোর জন্য হয়। তনু সেসব ভুলে যদি এগিয়ে যেতে পারে তবে তাই সয়। তবুও কোথাও খচখচানি থেকে যায়।
সকালে সবাই হাসপাতালে হাজির। আজকে তনু বিগত দু’মাস লড়াই শেষে বাড়ি ফিরবে। সকলের কাছে ইদের দিন অপেক্ষা কম কিছু না আজকের দিন। সোহান আসার পর থেকেই শিল্পের খোঁজ করে। নিবেদিতা জানায় নামাজ থেকে ফেরেনি সে। সোহানের মনে মনে চিন্তিত হয়। টাকার জোগাড় কোথা থেকে হলো জানা হলো না। আদৌ কি কোনো জোগাড় করতে পেরেছে? আবার কোনো খারাপ পথে পা বাড়ায়নি তো?
শিল্প এলো ঘন্টাখানেক পর। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তনুর ডিসচার্জ হওয়ার সব ফর্মালিটি পূরণ করেই কেবিনে এসেছে।
সোহান শিল্পকে আসতে দেখেই বাইরে টেনে নিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় ছিলি?”
“তনুর ডিসচার্জ করালাম। এখন আমরা যেতে পারবো।”
“আর টাকা?”
“দিতে পেরেছি বলেই তো ছাড়লো। নয়তো কি ছাড়তো।”
“কোথা থেকে পেলি।”
“বললাম না একজন সাহায্য করেছে।”
“কে?”
“চিনবি না।” শিল্পের খামখেয়ালীপনায় বিরক্ত হলো সোহান।
“পেঁচানো কথা বলবি নাতো। চিনবো না মানে কি?”
“চিনবি না মানে চিনবিনা, পেঁচালাম কই।”
“তুই কি কোনো খারাপ পন্থায় টাকা গুলো পেয়েছিস?” সোহানের সন্দেহবাতিক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করলো শিল্প। বললো,
“এতোটাও খারাপ হয়ে যাইনি রে।” শান্ত স্বরে বললো সে। শিল্পের উত্তরে কি ছিল জানা নেই তবে সোহানের ক্লেশ মাখা প্রশ্ন যেন ক্ষতে জর্জরিত হলো। প্রিয় বন্ধুর অসহায় মুখ দেখে নিজেরও আত্মা বিগলিত হলো।
সকাল সকাল বের জবার জন্য তাড়া দেয় শিল্প। সব ঠিকঠাক করে বের হবার সময় নিবেদিতা জানালো তনুকে নিজের কাছে রাখবে। না সে জিজ্ঞাসা করেনি সরাসরি নিজের মতামত জানিয়েছে। সবাই একবার শিল্পের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। শিল্প কোনো উত্তর দেয়না। তনু বারবার শিল্পের দিকে তাকায়। শিল্প একবারও তনুর মুখের দিকে তাকায় না। শুধু তনু না কারও দিকেই সে তাকায় না। ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “তাই হবে।”
“তুমি চাইলে আমাদের ওখানেই থাকতে পারো।”
“না না সমস্যা নেই। কিছুদিন আমিও একটু ব্যস্ত থাকবো।” তনু ভিষণ অবাক হলো সাথে বাকিরাও। নিবেদিতা স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, “যেমন তোমার ইচ্ছা।”
সবাইকে পিছু ফেলে নিজে আগে আগে এগিয়ে গেলো শিল্প। পিছু পিছু সবাই আসতে লাগলো। আগে থেকে রিজার্ভ করা গাড়িতে উঠলো তনু। ভাড়ার টাকা নেই তার কাছে, নিবেদিতাকেই পরিশোধ করতে হবে। তখনও শিল্পের মুখে তাকিয়ে ছিল তনুু। নিবেদিতা আর লতিকা দুপাশে বসলো। শিল্প বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে।
“এসব কি ঠিক হলো?” সোহানের প্রশ্নে অবাক হলো শিল্প।
“কোন সব!”
“নাটক করবি না। তনুর সাথে এখন তোর থাকা উচিৎ। তোদের সম্পর্কের উন্নতির জন্য হলেও।”
“সম্পর্ক! সম্পর্ক খুব খারাপ জিনিস জানিস। সম্পর্কে জড়ানো একদমই উচিৎ না।”
“কি বলছিস তুই! কি হয়েছে তোর?”
“কিছু না থাক তুই। আপু তোমরা বাড়ি যাও আমি তনুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে রেস্টুরেন্টে যাবো।”
শিল্প কারও দিকে না তাকিয়ে উঠে গেলো গাড়িতে। তনুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো শিল্পকে গাড়িতে উঠতে দেখে। কিন্তু কি হয়েছে তার এই চিন্তা খচখচ করছ মনে।
সোহান এগিয়ে চলা গাড়িটার দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখতে থাকলো। গাড়ি দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে গেলেই রাকাদের দিকে তাকালো। তাঁরা বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে।
“খালাম্মা আমি নিয়ে যাচ্ছি চলুন।”
“না না বাবা ঠিক আছে। আমরা ওই হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পৌঁছে যাবো।” আর পিছু ফিরলো না কেউ। নুয়ে পড়া দেহ টানতে টানতে এগিয়ে গেলো তাঁরা। করিম সাহেবের বয়স যেন দ্বিগুণ বেড়েছে। এইতো নাজমা কিছুদিন আগে বেশিদিন না এইতো দু’মাস, কতোটা দাম্ভিক অহংকারী ছিল আর আজ। ভগ্ন মৃতপ্রায় মন নিয়ে এগিয়ে চলেছে। রাকা তো সেই কবেই মরে গেছে। সোহান দেখছে একটা প্রাণবন্ত স্বচ্ছল পরিবারের বিচিত্র রূপ।
চলবে…
মেহবুবা তানজীম