এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৭

পৃথিবী শুধু জীবিত দের জন্য। এখানে মৃতদের কোনো ভাগ নেই। তারা শুধু নিছক অতীত, ভবিষ্যতের গ্যাড়াকলে হারিয়ে যায় সবকিছু থেকে। মাঝে মাঝে স্মৃতির পাতায় কড়া নাড়ে ভিষণ করে। তবে সেটুকুই খানিক মনে পড়া ফের দুনিয়ায় মোহে আটকে পড়ে জীবন সকল।
মনুষ্য তুমি কার লাগি করো হায়,
দুনিয়ায় মরে গেলে মৃতের কোনো দাম নাই।

তিয়াসার জীবনের গল্প এখানেই সমাপ্ত। সময় সন্ধানে স্মৃতির পাতায় হয়তো কখনো এক দুবার মনে পড়ে যাবে। হ্যাঁ ওই মেয়েটাই তো, আরে দাপিয়ে বেড়াতো, হ্যাঁ সেই তো ভার্সিটির সুন্দরীদের একজন ছিল, ওমুকের গার্লফ্রেন্ড ছিল, এখন সে কই? নাই হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করবে না, কেমন আছো? করলেও উত্তর আসবে না।

—————–

শিল্প তনুর বাড়ির সামনে দাঁড়ানো। সোহানের দোকান থেকে ফোন আসায় সঙ্গে আসেনি সে। শিল্পের মনে কেমন যেন ভয় দানা বেঁধেছে। তনুর সামনাসামনি হতে মন চাচ্ছে না। এমন যদি করা যেত সে হারিয়ে যেত কোনো অজানা জায়গায়, কেউ চিনতো না কারও কাছে অপরাধী হতে হতো না। আহ্ জীবন যা ভাবি তা যে ঘটে না, যা চাইনা ভাবিনা তা নিয়ে পার হয়ে যায় জীবনের গল্প।

কলিংবেল বাজাতেই লতিকা দরজা খুলে দিলো। দরজার সামনে শিল্পকে দেখে খুশী হলো বলা যায়। কুশল বিনিময় শেষে জানায় নিবেদিতা বাড়ি নেই, তনু নিজের ঘরে আছে। লতিকার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তনুর ঘরে প্রবেশ করলো শিল্প। দরজা লাগানো ছিল না, ভারি পর্দা দিয়ে আবৃত দাঁড়। তনু তখন জানালার ধারে চেয়ারে বসা। দৃষ্টি সেই আকাশ গহীনে। জানালাও পুরোপুরি খোলা ছিল না। ভারি পর্দায় দুই তৃতীয়াংশ আবৃত ছিল। ঘর আবছা আঁধারে ছেয়ে আছে। জানালর ক্ষীণ আলো দিনের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। ঘর গুমোট হয়ে আছে।
শিল্প ডাকে, “তনু।” তনু তাকায় একবার উদাসীনভাবে ফের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শিল্প তনুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

“কেমন আছো তনু?” ফের প্রশ্নে অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকলো তনু। বললো,
“কে আপনি?” চমকে উঠলো শিল্প।
“কে আমি মানে! চিনতে পারছো না আমাকে?” তনু ডানে বামে মাথা নাড়ালো। উত্তর হলো না।
“তুমি মজা করছো, তাইনা?”
“আমি মজা করবো কেনো?” শিল্প অসহায় বোধ করলো ভাবলো তনু রেগে আছে।
“তুমি নিশ্চয় রেগে আছো তাইনা এতোদিন আসিনি বলে। আমি এখানে ছিলাম না তনু। ঢাকা গিয়েছিলাম আসার মতো সুযোগ ছিলনা।” তনু আবারো চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলো। একবার ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে, আবার কপালের দাগ মুছে যাচ্ছে। শিল্প বুঝতে পারছে না তনু এমন কেনো করছে। কিছু বলছেও না, ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেলো শিল্পের মেরুদণ্ড বেয়ে।
শিল্প ভাবলো বসে কথা বলা যাক। তনুর সামনাসামনি বিছানায় গিয়ে বসলো। বসতেই হাতে কিছু জিনিস অনুভব করলো। হাতে নিতেই দেখলো ছোট বাচ্চাদের কিছু জামাকাপড়, খেলনা, ঝুনঝুনি, কাপড়ের একজোড়া জুতা পাশে একটা বক্স। শিল্প প্রতিটা জিনিস হাতে নিয়ে দেখছিল।

হঠাৎ তনু এগিয়ে এসে তার হাত থেকে জিনিসগুলো কেঁড়ে নিলো। প্রচন্ড ক্ষীপ্ত দেখালো তাকে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছিল তনু। শিল্প অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। বলে,
“কি হয়েছে তনু? শরীর খারাপ লাগছে? এমন করছো কেনো?”
“তুমি কেনো এসেছ? কেনো?”
“আমি কেনো এসেছি! আমার কি আসার অধিকার নেই?” একটু থেমে বললো শিল্প।
“না নেই কোনো অধিকার নেই তোমার। কিসের অধিকার নিয়ে এসেছ? এসব দেখছো, এসব আমি আমার অনাগত ছোট্ট সোনার জন্য কিনেছিলাম। এ বাসায় তোমার বাসায় সবখানে, অল্প অল্প করে ছোট্ট প্রাণের জন্য পৃথিবী সাজাচ্ছিলাম। তোমরা কি করলে, ওকে দুনিয়ায় আসতেই দিলে না।”
“এসব বলো না তনু, ওর ভাগ্যে দুনিয়া দেখা ছিল না। দুনিয়ায় আসার আগেই সে আল্লাহর প্রিয় হয়ে গেছে।”
“আমাকে তোমার এসব কথায় ভোলাতে পারবে বলে মনে করেছ? তোমার জন্য আমার সন্তান দুনিয়ায় আসেনি। তোমার জন্য।” শিল্পের কলার ধরে ঝাঁকাতে লাগলো তনু। বিস্ময়ে মুখে কথা রুচলো না শিল্পের। তবুও মিনমিন করে বললো,
“আমার জন্য!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার জন্য। তোমার জন্য আমার সব শেষ, জীবন নরক বানিয়েছ তুমি আমার। কেনো এসেছ? দেখতে এসেছ মরেছি না বেঁচে আছি।”

তনু উন্মাদের মতো আচরণ করছে। এলোপাথাড়ি আঘাত করছে শিল্পকে। শিল্প কিছুই বলছেনা, তনুকে আটকাচ্ছেও না। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কি করবে বা করা উচিৎ কিছুই আসছে না মস্তিষ্কে।
“তুমি কেনো এসেছ? চলে যাও আমার জীবন থেকে। একেবারে চলে যাও, দরকার হলে মরে যাও। আমার আর ভালো লাগছে না। সব বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে। শুধু তোমার জন্য, আমার সব শেষ। কেনো, কেনো যে তোমাকে ছেড়ে দিলাম না সেদিন। কেনো সুযোগ দিলাম?” এবার তনু নিজের মাথা চাপড়াতে শুরু করলো। গলায় ঝুলিয়ে রাখা ওড়না মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। মাথার চুলগুলো এক লহমায় এলোমেলো হয়ে গেছে। তনুকে বর্তমানে বদ্ধ উন্মাদ বৈ অন্য কিছু ভাবনা কঠিন।

“তুমি চলে যাও, চোখের সামনে থেকে যাও। আর সহ্য হচ্ছে না তোমাকে। যাও চোখের সামনে থেকে, বের হও।” তনু রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো শিল্পকে। তনুর চেঁচামেচিতে লতিকা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়ে জামাই থাকায় ভেতরে যেতে ইতস্তত বোধ করছিলেন। শিল্পকে ধাক্কিয়ে বের করে দিতে দেখে চমকে গেলেন তিনি।
“কি করছো তুমি তনু?” তনুকে ঝাঁপতে ধরে লতিকা। অপরাধী দৃষ্টিতে শিল্পের দিকে তাকায়। শিল্প নিঃস্প্রহ, নিঃস্বার। তাকে দেখে মনে হচ্ছে শ্বাস নিচ্ছে না, মুখখানা কেমন অন্যরকম দুঃখে দুঃখিত।

“বাবা কিছু মনে করো না মেয়েটার মাথা ঠিক নেই। তুমি সোফায় গিয়ে বসো, আমি ওকে শান্ত করে আসছি।” তনু ফুঁসে উঠলো যেন।
“না সে কোথাও বসবে না। দাঁড়ায় আছো কেনো লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই। চলে যেতে পারছো না।”
শিল্প একবার ছলছল চোখে তনুর দিকে তাকায়। তনুর চোখে তখন অগ্নি ঝরছে, শিল্পের মনযন্ত্রণা তার চোখে পড়ছে না।
“যাও, বের হও।”
“তনু, শান্ত হো মা।”

শিল্প টলমল পায়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। বিবশ হয়ে আসছে তার সকল ভাবনাগুলো। সে জানতো খারাপ কিছু হবে, তবে এতোটা ভাবেনি। মনে যতো যন্ত্রণার পাহাড় ছিল আজ তা দ্বিগুণ হলো। এতো বড় বোঝা কেমনে বয়বে সে।

———–

লতিকা তনুকে জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিলো। মেয়েটা অনবরত কাঁপছে। তনুর এমন অবস্থা লতিকা কি করবে বুঝতে পারছে না। শিল্পও বেরিয়ে গেলো। কি হবে ছেলে মেয়ে দুটার ভবিষ্যৎ?
লতিকা নিবেদিতাকে সংক্ষিপ্ত বিবরণে সব জানিয়ে তনুর কাছে এলো। তনু চুপচাপ মাথা নামিয়ে বসে আছে। এখনো কাঁপছে, কম্পন দৃশ্যমান। লতিকা তনুর মাথায় হাত রাখলো। তনুর হাতে ছোট্ট জামাগুলো।

“তনু, এমন কেনো করলে?” তনু নির্বিকার। হঠাৎ তনুর হাতে জামায় রক্ত দেখে চমকে উঠলো লতিকা।
“রক্ত! রক্ত এলো কোথা থেকে।” তনুও চমকেছে বেশ। তার অভিপ্রায় তেমনই ছিল।
“কোথাও কেটেছে মা, দেখি কোথায় কাটলো। এতো রক্ত! আমি তো খেয়ালই করিনি।” লতিকা শশব্যস্ত হয় দেখতে লাগলো। তনু যন্ত্রের মতো বললো।
“আমার তো কোথাও লাগেনি।”
“তবে কি…”
কথা আটকে এলো লতিকার। তনুরও বোধহয় বোধদয় হলো তখনই।

———-

রাস্তায় এসে সোহানের ফোনে ডায়াল করলো শিল্প। টলমল করছে তার পা, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা ঘুরে উঠলো রৌদ্র তাপে। ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দ কানে আসলো। কিন্তু উত্তর দিতে পারলো না। পৃথিবী ঘুরতে শুরু করলো। চোখ বন্ধ হবার আগে দেখতে পেলো লোকজন এগিয়ে আসছে তার দিকে।

চলবে…
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here