এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৮

সোহানের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। রাগ নিয়ে বসে আছে শিল্পের বেডের পাশে। কিন্তু আশেপাশের বেডের দিকে নজর দিলেও শিল্পের দিকে তাকাচ্ছে না। শিল্পের দুই বেড পরে একজন বৃদ্ধ ভর্তি আছে, ভাঙা পা ঝুলিয়ে রাখা। তখন থেকে আহ্ উহ্ করে চলেছে। রুমের প্রতিটা মানুষ একবার বিরক্তির চোখে তাকাচ্ছে সেদিকে। সোহানও দেখলো দু-তিনবার। বৃদ্ধের পাশে কোনো আত্মীয়ের দেখা নেই।
সোহান কথা বলছে না এই নিয়ে শিল্পও বিশেষ কিছু বলছে না। চুপচাপ হসপিটালের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

“আমার কি পরিমাণ রাগ হচ্ছে যদি তোকে বোঝাতে পারতাম।” সোহান না পেরে নিজেই কথা বললো।
“আমি বুঝতে পারছি।”
“ঘোড়া বুঝিস তুই। আমাকে আগে কেনো জানাস নি সব।”
“জানালে কি হত? তুই আমাকে জীবনেও এই কাজ করতে দিতি না।”
“অবশ্যই দিতাম না। তুই পাগল হলে কি হবে আমি তো না।”
“আমি পাগল না। একজন পাগলপারা বাবাকে সাহায্য করেছি জাস্ট। মেয়েটির দুটো কিডনি নষ্ট। রেস্টুরেন্টে মেয়েটির মামা ফোনে কথা বলার সময় আমি শুনতে পাই। নিজে থেকে জিজ্ঞেস করি। রক্তের গ্রুপ সেম হওয়ায় নিজে থেকেই দিতে রাজি হই।”
“অঙ্গ বিক্রি ইসলাম মনোনীত না জানিস না।”
“আমি বিক্রি করিনি, দান করার উদ্দেশ্য ছিল আমার। আমি মাঝে একবার ঢাকা গেছিলাম মনে আছে, একচ্যুয়ালি সেদিন সব পরিক্ষা নিরিক্ষার পর কিডনি ট্রান্সফার সম্ভব। আমিও দিতে রাজি ছিলাম এবং বিনিময় নিতে রাজি না হওয়ায় মেয়েটির বাবা অবাক হয়, নিজে থেকে আমার খোঁজ খবর নেয়। তখন তনুর কথা জানতে পারে। আমাকে পুরো টাকা দিতে চাইলে আমি নেইনি। তবে যখন ধার হিসেবে দিতে চাইলো তখন আর না করিনি। আমার লক্ষ্য নিজের পাপের বোঝা কমানো আর মেয়েটিকে সাহায্য করাই ছিল। এনার অফিসে কাজও দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি ঢাকা যেতে রাজি না তাই মেয়েটির মামা এখানকার একটা কোম্পানিতে ঢুকতে সাহায্য করলো। এই যা। টাকাটা কিন্তু আমি চাইনি।”

“নিজের ক্ষতি কি কোনো মানুষ করে, বল?”
“একজন মানুষের ভালো ভাবে বাঁচতে একটা কিডনিই যঠেষ্ট।”
“আর তোর কিডনি যদি নষ্ট হয়?”
“আগাম কথা কেন বলিস। হলে হবে, মৃত্যু থাকলে মরবো না? আজব।”
“আমাকে কি একবার বলা যেত না।”
“বললে করতে দিতি না। জানিস মেয়েটার বয়স খুব অল্প। এবার এইচএসসি ক্যান্ডিডেট। আল্লাহ আমাকে উসিলা করে পাঠিয়েছে মাত্র। ভালো কাজে মনে প্রশান্তি আসে রে।”
“হুম। রিলিজ কখন দিবে?”
“আজকেই নিবো।”
“সেলাইয়ের কি অবস্থা?”
“ছিড়ে গেছে সেলাই।” বড় করে শ্বাস ছাড়লো সোহান।
“আচ্ছা আমি কি তনুর সাথে কথা বলবো?”
“না। ওকে একা থাকতে দে।”
“তাহলে তো ওর ভুল ভাঙবে না।”
“তনু নিজের জায়গায় একদম ঠিক আছে। যেকোনো মেয়ে ওর মতো ব্যবহার করতো। কিন্তু চিন্তার বিষয় যা ছিল তা আর নেই, সবটা মনে পড়ে গেছে ওর এই শান্তি।”
“হুম।”
“আমাকে আবার অফিসে যোগ দিতে হবে। কিছুদিন যাক তারপর তনুর সাথে কথা বলা যাবে।”
“এই শরীরে অফিস যাবি।”
“যেতে তো হবেই।”

————–

কয়েকদিন পরের কথা। অনেকদিন পর নুযহাতের সাথে দেখা তনুর। তনুর অসুস্থতার খবরই নুযহাতকে তনুর বাড়ি নিয়ে আসে। তনু খুশি হয়। মন খুলে দুই বান্ধবী গল্প করে। নুযহাত একফাঁকে তনুকে পড়ালেখার ব্যপারে জিজ্ঞেস করে।

“কিরে পড়ালেখাতে বেশ ধিল দিয়েছিস। আর কি করবি না পড়াশোনা?”
“কে বললো তোকে ধিল দিয়েছি রোজই তো পড়তে বসি।” খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো তনু। নুযহাত ভাবলো মজা করছে তনু।
“মজা করার জায়গা পেলি না তাইনা।”
“ওমা মজা কেনো করবো!” তনু অবাক হয়ে বলে।
“মজা করছিস না তো বলছিস যে পড়াশোনা রোজ করিস। মিথ্যা কেনো বলছিস?”
“মিথ্যা কেনো বলবো! দাঁড়া বিশ্বাস হচ্ছে না তো। আমি আমার বই এনে দেখাচ্ছি।”

তনু তড়িঘড়ি করে পাশের রুমে প্রবেশ করলো। তার পড়ার জন্য মূলত ছোট্ট স্টোর রুমের মতো রুমটা। তার ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সকল বই এই রুমে জায়গা করে নিয়েছে। পশ্চিমা জানালায় ঝলমলে আলো। দিনের শেষাংশে বসা ভার। রোদের তাপে ঘরটাতে হিটারের কাজ করে। তনু টেবিলে বইগুলো কাপড় দিয়ে ঢাকা দেখলো। কাপড় সড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত বই খুঁজতে শুরু করলো। তনুর পিছুপিছু নুযহাতও এসেছে এই রুমে। তনুর এরূপ হাইপার হওয়া দেখে যারপরনাই সে অবাক, হালকা আতঙ্কিত।
তনু পাগলের মতো বইগুলো নাড়াচাড়া করতে শুরু করলো। নুযহাত ধরনের ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কি খুঁজছিস তনু? এমন করছিস কেনো?”
“আরে জয়কলির বই গুলো কই গেলো। পাচ্ছি না তো।”
“তুই জয়কলির বই কেনো খুঁজছিস?” নুযহাতের ভয় যেন সত্যিতে পরিণত হলো।
“গাধা সামনে এডমিশন না?”
“কিহ্! কি বলছিস?”
“ধুর সর তো খুঁজতে দে। টেবিলেই তো ছিল পাচ্ছি না কেনো। লতিকা মা, মা আমার বই পাই না কেনো?”

তনু পাগলের মতো বই উলটপালট করতে শুরু করলো। নাহ্ নেই, এখানেই ছিল। সে রোজ এখানেই রাত্রি বেলা পড়ে। তবে কি বইগুলো নিজের রুমে রেখে দিয়েছে। তনু আবার দৌড়ে নিজের রুমের দিকে গেলো। নুযহাত সেখানেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে গোছানো টেবিলটার বিধ্বস্ত অবস্থা।

তনু নিজের রুমে গিয়েও বই খুঁজে পায় না। এতে ওর মাথা খারাপ হবার জোগাড়। নিবেদিতা বাসায় নেই। তনুর এমন অবস্থায় ভয় পেয়ে যায় লতিকা। নিবেদিতাকে ফোন করলেও পাওয়া যায় না, অটো ম্যাসেজ আসে আ’ম বিজি এট মিটিং, কল মি লেটার। লতিকা দিক বেদিক না ভেবে শিল্পকে কল করে। শিল্প দুদিন হলো জয়েন করেছে অফিসে। লতিকার ফোন পেয়ে রিসিভ করতেই ভয় পেয়ে যায় লতিকার কান্না শুনে। কান্নার জন্য তেমন কিছু বলতে পারছে না লতিকা। আর যা বলেছ তার কিছুই বোঝেনি শিল্প। এমারজেন্সি ঘন্টাখানেকের লিভ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে তনুর বাড়ি উদ্দেশ্যে।

তনুর বাড়ি এসে সবকিছু শান্ত দেখে অবাক হয়ে যায়। তনু তার নিজের রুমে তখন গভীর ঘুমে। এখানে খানিক আগে কিছু হয়েছিল বোঝার উপায় নেই। কিছুসময় তনুর পাশে বসে কাটায় সে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তনু একটু মুচকি হাসে ঘুমের মাঝে। শিল্প তনুকে দেখে লতিকার সাথে ড্রইংরুমে এলো।
“কি হয়েছিল তনুর?”
নুযহাত তখনও ছিল। সে নিজে থেকে বলতে শুরু করে, ” সব ঠিক ছিল। আমরা গল্প করছিলাম, হঠাৎ ওকে পড়ার কথা বললাম, বললাম পড়ালেখা কি আর করবি না। তখনও খুব স্বাভাবিক আচরণ করলো বললো সে নাকি রোজ পড়াশোনা করে। আমি বললাম মিথ্যা কেনো বলছিস। তখনই উঠেপড়ে লাগলো বই খুঁজে আমাকে দেখাবে। বই না পেতেই মাথা খারাপ হতে শুরু করলো ওর। খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিল। কেমন অস্বাভাবিক একজন লাগছিল ওকে তখন।”
শিল্প মনোযোগ দিয়ে শুনলো পুরোটা। কিছু ভাবনা হয়তো নিছক তবুও ওর মনে ভয় দানা বাঁধতে শুরু করলো।
“আর কি কিছু করেছে? মানে উত্তেজনার শুরুটা কখন বা কেমন করছিল।”
“প্রচুর অস্থির হয়ে উঠেছিল। নিজের দিকে কোনো খেয়াল নেই পাগলের মতো বই খুঁজছিল। আর একটা কথা ও এডমিশন দেওয়ার জন্য কেনা বইগুলো খুঁজছিল।”
“এডমিশনের বই!”
“হ্যাঁ। জয়কলির বইয়ের কথায় বারবার বলছিল।”
শিল্পের মুখ এবার গম্ভীর হয়ে এলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেই বললো, “একবার ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে। মা আপনি ওর খেয়াল রাখবেন। আমাকে সব আপডেট জানাবেন, কেমন আছে, কি করছে সব এ টু জেড। আমাকে এখন যেতে হবে।”
“কি বলো বাবা এখনই যাবে, কিছু নাস্তারও ব্যবস্থা হলো না।”
“না না ওসব ভাববেন না আমি তো এ বাড়িরই ছেলে, ওসব নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি তো বেশি সময়ের জন্য আসিনি।”
“বাবা তোমার শরীর?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। নুযহাত বোন তোমার হয়তো অনেক ঝামেলায় পড়তে হলো”
“না না কি বলেন ভাইয়া। ও আমার ফ্রেন্ড।”
“তাহলে বোন আরেকটু সাহায্য করতে হবে। ওকে পারলে একটু সময় দিও। একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেও। আসলে আমিই করতাম কিন্তু আমাকে বিশেষ সহ্য করতে পারছে না। উত্তেজিত হচ্ছে। তাই যদি তুমি একটু সাহায্য করতে। ওকে সহজ করতে সময় দেওয়া দরকার।”
“আমি বুঝতে পারছি। সমস্যা নেই আমি নিজের মতো চেষ্টা করবো।”

কথা শেষ করে বেরিয়ে পড়লো শিল্প। তনু জানতেও পারলো না তার জীবনের বিবর্তন গুলো সম্পর্কে। সে এখন নিশ্চিন্তে স্বপ্নে বিচরণ করছে।

————–

শিল্পের সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে কাজ। নিজের কাজে খুব মনোযোগী আগে থেকেই সে। এই কাজের পাশাপাশি আরো ভালো পজিশনের কাজ খুঁজে ফাঁকে ফাঁকে। শিল্পের পাশের চেয়ারে মধ্যবয়স্ক আমিনুল নামক একজন ব্যক্তির চেয়ার। লোকটি রোজ লেট করে আসে অফিসে। রোজ রোজ লেট করে এসে দাঁড়াবে শিল্পের চেয়ারের পাশে। রোজকার মতো আজও তাঁর একই হাবভাব। কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন,
“ইউসুফ সাহেব, খবর ভালো?”

শিল্পের প্রচন্ড বিরক্ত লাগে লোকাটাকে। পান মুখে কথা বলায় মাঝে মাঝে উচ্ছিষ্ট ছিটে আসে শরীরে। কিছু বলতে পারে না কিন্তু হাবভাবে বিরক্ত ভাব প্রকাশ করে। তবুও লোকটি যেমন তেমনই। শিল্পের মনে হয় লোকটি ইচ্ছে করেই বিরক্তির তোয়াক্কা করে না। এর জন্য অফিসের অর্ধেক লোক তাঁকে এড়িয়ে চলে।

“জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“বুঝলেন ভাই, লেট করে আসার মজাই আলাদা। বস আপনাকে নোটিস করবে, সহজেই বসের নজরে পড়বেন। হয়তো একটু-আধটু বকাঝকা খাবেন। সে আর নতুন কি, এমনেও বকে না হয় লেট করেই বকা খেলাম। কি বলেন ভাই।”
“হুম।”
“তা ভাই বিয়ে সাদি করবেন না। আমার এক চাচাতো ননদ আছে, হেব্বি সুন্দরী। আপনার সাথে মানাবে, সেটিং টেটিং করিয়ে দিবো নাকি।” লোকটি এমন ভাব করলেন যেন কৌতুক করছে।
“ভাই আমি বিবাহিত।” বিরক্তি নিয়ে বললো শিল্প। এই লোকের রোজকার অভ্যেস। প্রথমে চাচাতো মামাতো ননদের গপ্প বলবে তারপর শিল্প নিজের বিবাহিত হবার কথা জানাবে তখন বলবে ভুলে গেছি বয়স হয়েছে কিনা। ডিজগাস্টিং।
“ও হ্যাঁ বলেছিলেন তো। কি অবস্থা দেখেন ভুলে যাই সব। বয়স হচ্ছে তো।”

তখনই শিল্পের ফোন বেজে উঠলো। তনুর নাম্বার থেকে ফোন। অবাক বিষয়!

চলবে…
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here