এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ৬
“কিন্তু তুই বিরাট ভুল করেছিস?”
“কি ভুল করেছি।”
“তনুর সাথে আমায় বিয়ে দিয়ে ঠিক করিসনি। তোর আমার মতো খুঁত যুক্ত মেয়ে খুঁজতে হতো।”
“তাহলে কি তুই ভালো থাকতি?”
“এখন কি খুব ভালো আছি?”
“তোর ভালোর জন্য তো করেছি।”
“এতো কিছুর মাঝে ওই মেয়েটা কি পেলো। আমার পাপের বোঝা ওকে বয়ে বেড়াতে হলো। বাবা যদি জোর না করতো, পিতৃত্বের দাবি নিয়ে সামনে না দাঁড়াতো তবে আজ তনু ভালো থাকতো।”
“কে বললো তনু ভালো থাকতো। ওর সাথে আরো খারাপ কিছু ঘটতে পারতো।”
“পারতো? আবার অনেক ভালো কিছুও হতে পারতো। এমনও হতে পারতো রূপকথার রাজকুমার আসতো ডানাযুক্ত সাদা ঘোড়ায় চড়ে। ওকে নিয়ে যেতো মেঘের বাড়িতে। থাকতো সুখে শান্তিতে।”
“তুই কি পাগল হয়ে গেছিস, কি বলছিস সব?”
“আমার আর ভালো লাগছে না রে। মনে হচ্ছে অনেক দুরে কোথাও চলে যাই, অনেক দুরে। যেখানে কেউ চেনে না, কোনো অতীত নেই। যা আছে তা শুধু আমি।”
“কি আবোলতাবোল বকছিস!”
“আবোলতাবোল না। তনুর কাছে আবারো দোষী আমি। এতো দোষ ক্ষমাযোগ্য না।”
“সেদিন তোর দোষ ছিল না। তাছাড়া এই দুই মাস তুই যা করেছিস…”
“ওসব কিছুই না। আমার শাস্তি ওসব। একটা ভালো মেয়েকে কষ্ট দেবার শাস্তি। আমি ওর যোগ্য না রে।”
“তুই এখন কি করতে চাইছিস?”
“কিছু না, এখন যা করার তনু করবে। আমি ওকে আটকেও রাখবো না ছেড়েও দেবো না। আগের মতো ওর কাছে আমার কাছে থাকার ভিক্ষাও চাইবো না। ওর সুখ আর নষ্ট করতে চাইনা।”
“তুই পাগল হয়ে গেছিস।”
“হয়তো।”
ঝিলের অপরপাশে মেঘ জমছে। এ মেঘের বৃষ্টি স্থায়ী নয়। ক্ষণিকের জন্য মেঘ করবে, বড় ফোঁটায় মিনিট পাঁচেক বৃষ্টি ঝরবে। তারপর, তারপর মেঘ হারিয়ে যাবে। তখন আকাশ পরিষ্কার দেখাবে, রোদ ঝলমল করবে। শিল্পও কি সেই মেঘের মতো তনুর জীবনে? সেভাবেই কি হারিয়ে যাবে সময়ের ব্যবধানে।
“তিয়াসা খুব ভালো মেয়ে ছিল। একটু অহংকারী ছিল বটে। বড়লোকের মেয়েরা একটু আধটু অহংকারী হলে দোষের কিছু নেই। আমাদের সম্পর্ক বেশ চলছিল। আমার প্রতি ওর আচরণ স্ত্রীর মতো ছিল। সব বিষয়ে জিজ্ঞাসা, সব বিষয়ে চিন্তা। ভালোও বাসতো পাগলের মতো। যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো কে বেশি ভালোবাসে, চোখ বুঁজে বলতে পারতাম তিয়াসা। আচ্ছা ভালোবাসা কি খারাপ? কি হতো তিয়াসার সাথে যদি বিয়ে হতো? আমাদের ছোট্ট সুন্দর সংসার হতো। আমাদের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রী সম্পর্কের থেকে আলাদা ছিল না কখনোই।”
“তুই এখন এসব কেনো বলছিস?”
“বলতে ইচ্ছে করছে, আজ বলি… তনুকে আমি কোনদিন ঠকাতে চাইনি। অতীতে কি ছিল তা বর্তমান ভবিষ্যতে আনতে চাইনি। তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ আর ওর সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের সম্পর্ক ভালো চলছিল। আমি সত্যি ভালো থাকতে শিখছিলাম। হঠাৎ করে তিয়াসার আগমন সব এলোমেলো করে দিলো। না আমি আর ওর দিতে ঝুঁকিনি। এমন নয় ওর কাছে ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ওকে এভোইড করতে পারিনি। কাউকে ভালোবাসতে সময় লাগেনা হয়তো কিন্তু ভুলে যাওয়া কঠিন। কখনো ভোলাও যায়না। আমাদের মাঝে যেটুকু সাক্ষাৎ হতো তা তিয়াসার জোরাজোরিতে। আমার মনে ওর জন্য থাকা ভালোবাসাগুলো প্রচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। আমি…আমি ওকে এড়িয়ে যেতে পারতাম না। আমি তিয়াসাকে বোঝাতাম আমরা এখন আলাদা পথের যাত্রী সেও সহমত প্রকাশ করতো কিন্তু কে জানতো ওর মনে লুকিয়ে ছিল ভয়ংকর সব প্ল্যান।”
“আমি বুঝতে পারছি, তুই থাম।”
“তুই বুঝতে পারছিস না। তিয়াসা যখন তনুকে আমাদের সম্পর্কে উল্টোপাল্টা বোঝাচ্ছিল তনু একবারও, একবারও আমাকে জানায়নি। নিজের মনে ভেতরে সব রেখে দিয়েছিল। হ্যাঁ ওর সাথে অহেতুক, ঠিকমতো জাজ না করেই খারাপ আচরণ করেছিলাম। মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলাম। মুখের কথা ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব না, রাগে মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে যায়। আমিও সেদিন টেমপার কন্ট্রোল করতে পারিনি। সেদিন তিয়াসার সাথে বিষয়টা নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল। বাড়িতে ফিরে তনুর সাথে কি হলো আমি খারাপ আচরণ করে ফেললাম। আমি চাইনি এমন করতে, অনেক কিছুই আমরা করতে চাইনা কিন্তু করে ফেলি। তারপর থেকে তিয়াসার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেই। হালকা এড়িয়ে চলি। বাট ততোদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। সব আমার হাতের বাইরে ছিল। যেটুকু আমার করার ছিল আমি চেষ্টা করেছি আজও করে যাচ্ছি।”
“তুই তনুকে ভালোবাসিস?” কথাটায় শিল্পের উত্তেজনা কমে এলো। সে ধির কন্ঠে বললো,
“বাসি, ও মেয়েই এমন যাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না। কোনদিন স্বীকার করতে পারিনি। ভয় হতো স্বীকার করলেই যদি সেও হারিয়ে যায়। আজ দেখ যা ভয় করেছি তাই ফলছে।”
“কিছুই হয়নি এখনও সব ঠিক আছে। তুই শুধু তনুর সামনে যা।”
“যদি ওর বাচ্চার কথা মনে পড়ে যায়! তাহলে ও হয়তো আমায় আর ভালোবাসবে না। আমি বোধহয় কারও ভালোবাসা পাবার যোগ্য না তাই বারেবারে হারিয়ে ফেলি।”
“এসব ভাবিস না। কি হয়েছে বা কি হবে তা নিয়ে না ভেবে কি হচ্ছে তা নিয়ে ভাব। অতীত আমাদের ছেড়ে চলে যায় ভবিষ্যতের নাগাল পাই না কিন্তু বর্তমান, বর্তমান সবসময় আমাদের সাথে থাকে। ভুলে যাস না। তনু তোরই আছে।”
“হুম।”
“এবার ওঠ, চল। দেবদাসের ঘোরা বাদ দে। চিঠিটা উড়িয়ে দে ঝিলের জলে। অতীত মুছতে না পারলেও দুরে সরিয়ে তো দিতে পারবি।”
শিল্প চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলো লেখাগুলো। যদি আজ তিয়াসা ওর পাশে থাকতো তবে এতো ঘটনার উৎপত্তি হতো না। তাদের দেখে সবাই আগের মতো বলতো হোয়াট আ কাপল ইয়ার, মেড ফর ইচ আদার। মিথ্যা সব মিথ্যা, কেউ জানে না কে তোমার জীবনসঙ্গী হবে। কাউকে তুমি যতোই চাও যতোই ভালোবাসা, সে তোমার হবেনা যদি না সে ভাগ্যে থাকে। শিল্প উড়িয়ে দিলো চিঠিটা। বাতাসে বেগে ফটফট শব্দে উড়তে থাকলো চিঠি। পানিতে পড়তেই ভিজতে থাকলো পাতা। ভিজতে থাকলো পাতায় লেখা প্রতিটা শব্দ। ভিজতে থাকলো সব আর্তনাদ, জ্বালা, যন্ত্রণাময় অতীত সাথে সেই মানুষটা যে হারিয়ে গেছে আকাশের গহীনে। বড্ড অনুভুতি দিয়ে সাজানো ছিল তিয়াসার শেষ লেখা চিঠিটা। খুব সহজ ছিল চিঠিটার বাক্যগুলো, কিন্তু মিশে ছিল কষ্ট, হতাশা, দীর্ঘশ্বাস।
———-
কি বলে সম্মোধন করা যায়? প্রিয় বলে! আচ্ছা সম্মোধন ছাড়া চিঠি লেখা যায় না? আমি সম্মোধন ছাড়ায় তো লিখছি। তবে কি তা চিঠি হবে না? তোমায় প্রিয় বললে অনেকে অনেক কথা রটাবে। বলবে সে তোমার প্রিয় নয়, তার উপর কোনো অধিকার নেই তোমার। অনধিকার চর্চা নেহাৎ তোমার উপরেই ভারি পড়বে।
লোকে বলবে তাতে কি, তুমি তো আমার প্রিয়ভাজন। না হয় অন্তরেই রইলে তাই আর সম্মোধন করলাম না। এতো কথা বলছি রাগ করলে? রাগ করো না বুঝলে, তোমার রাগ যে মানতে পারিনা। আগেও পারতাম না। সেই দিনগুলোতে, সুবর্ণ দিন। কতো সুন্দর সাজানো গোছানো। কি দোষ ছিল আমার? আমিও তো ভালোবেসে ছিলাম। রোজ কতোটা সময় একসাথে কাটাতাম। ঘুরতে যেতাম, ফুচকা খেতাম। ভার্সিটির প্রতিটি চত্তর জানে তোমার আমার মিলনের ছন্দ। কতো স্মৃতি কিভাবে ভুলি বলো। তোমার কি মনে আছে আমাদের বিয়ের কথা? আচ্ছা সেটা কি আদৌ বিয়ে ছিল। কই আমি তুমি দুজনেই তো কবুল বলেছিলাম। সাক্ষী ছিল আমাদের বন্ধুরা। হ্যাঁ রেজিস্ট্রি হয়নি, কাজীর সামনে বসেও কবুল বলিনি। তাই বলে কি বিয়ে হয়নি? আচ্ছা মুখে বলা কবুলের মতো কি তালাকও মুখে মুখে দিয়েছিলে? আমরা তো স্বামী স্ত্রীর মতো ছিলাম বলো। এতো এতো স্মৃতি কিভাবে ভুলি। তুমি জানো যখন রায়ানের সাথে আমার বিয়ে হলো তখন কতোটা মানসিক অশান্তিতে ছিলাম আমি? জানোনা তুমি, কিছুই জানো না। আমায় জোর করে বিয়ে দিলো, পাঠিয়ে দিলো দেশ ছেড়ে অনেক দুরে। তোমার স্মৃতির শহর থেকে অনেক দুরে। আমার পাগলামি বাড়লো। আমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন করা হলো। পাগলের ডাক্তার! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার কাউন্সেলিং চলছিল। একসময় আমার সোনা আমার গর্ভে এলো। সে সময়টুকু আমি ভালো ছিলাম। সবাই ভাবলো আমি ভালো হয়ে গেছি। আমিও ভাবলাম, এইতো ভালোই তো হয়েছি। কিন্তু না, অসুখটা ক’দিনের জন্যে বেড়াতে গেছিলো। দেশে ফিরে তোমায় দেখতেই কেমন হুরহুর করে ফিরে এলো। যখন শুনলাম তুমি বিয়ে করেছ, আমার কি যে হলো…আআমি বোঝাতে পারবো না। আমি আবার সেই পাগল তিয়াসা হয়ে গেলাম। এবার আমার সঙ্গে রায়ানও সঙ্গ দিলো। সে আমায় কখনোই পছন্দ করতো না, আমি বুঝতাম। ভালোবাসা কে না চায়, আমিও চাইতাম। ভাবলাম ক্ষতি কি, আমি তোমায় পাবো রায়ান তনুকে। কিন্তু ভুলে গেছিলাম সব তাসের ঘর, আমার আর কিছুই নেই।
তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো? আমি কি বেশি কথা বলছি? আমার মনে যে অনেক কথা। আমি কখনোই চাইনি তোমাদের বাচ্চাটা দুনিয়ার মুখ দেখার আগে চলে যাক। আআমি আমি আসলে…আসলে চেয়েছিলাম তোমাকে। এসবে আমি আমার সোনাটাকে হারিয়ে ফেলেছি শিল্প, হারিয়ে ফেলেছি। আমার আর কিচ্ছু নেই, কেউ নেই, ভালোবাসা নেই আমি নিঃস্ব। আচ্ছা ভালোবাসলে কি মানুষকে নিঃস্ব হতে হয়? তবে কেনো মানুষ এই হারাম সম্পর্কে লিপ্ত। যা আবার হবার নয়, কেনো তার পিছু ছুটতে থাকে সবাই? আমিও ছুটেছি, পিছুটান ছাড়তে পারিনি। পিছুটানের গ্যাড়াকলে সব হারিয়েছি। আমি নিঃস্ব আজ, শুনতে পাচ্ছো তুমি আমি নিঃস্ব। আচ্ছা এখন কি তনু আমাকে ক্ষমা করবে? করবে না তাইনা। তবুও কি ও জাগলে একটিবার বলবে আমার কথা!
আমি তোমার সামনে আসতে চাইনা। কথা বলতেও ইচ্ছে করেনা। তাই চিঠি লিখতে বসলাম। হঠাৎ করে যদি মরে যাই। আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। একটা টাইম মেশিন থাকলে বেশ হতো। আমি আবার অতীতে যেতে পারতাম। অতীতের সব ভুলগুলো মুছে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কিছুই করা হবে না। সব ঘটে গেছে কিছুই বদলাবেনা।
এই তুমি কি শেষ বারের মতো একবার ভালোবাসি বলবে? আচ্ছা থাক বলতে মন না চাইলে বলো না বললেও আমি শুনতে পাবো না। আমাদের টেলিপ্যাথি যোগাযোগ কবেই ছিন্ন হয়েছে।
তুমি কি আমাকে একটা চিঠি লেখবে? পারলে ক্ষমা করো।
ইতি
অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ।
——-
ডুবে গেলো চিঠিটা, ভিজে গেলো প্রতিটা শব্দ। হারিয়ে গেলো তিয়াসার লেখা শেষ চিঠিটি। এগিয়ে গেলো শিল্প সামনের দিকে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি ছাপিয়ে। আর কিসের পিছুটান? তবে অজানা রয়ে গেলো শিল্প কি ফিরতি চিঠি লেখেছিলো?
চলবে..
মেহবুবা তানজীম