এক পা দুপা
সিজনঃ২
পর্বঃ ২
কাজের মাঝেই রাকার ফোন আসে। ফোনে তার জন্য চমক অপেক্ষা করছিল। তনু চোখ মেলেছে, তনুর জ্ঞান ফিরেছে! কতোদিন! কতোদিন পর? সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে মিথ্যে বলছে রাকা। আবার মনে হচ্ছে ঘুম ভাঙলেই সব শেষ, আবারো চোখ বুজে থাকবে তনু হাজার ডাকলেও খুলবে না।
“ভাই ডক্টর বলছে তনু এখন বিপদমুক্ত। কিন্তু মানসিক অবস্থা কেমন সেটা বোঝা যাচ্ছে না। বেশি সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরেনি। এখন ঘুমাচ্ছে।” শিল্পের মন যাই যাই করে।
“স..সত্যি বলছো বোন। ও..ওর জ্ঞান ফিরেছে?” কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে শিল্প।
“মিথ্যে কেনো বলবো! তুমি কি আসতে পারবে?”
“মনে হয় পাড়বো নারে। ওয়ার্কিং হাওয়ার এখনো শেষ হয়নি।”
“তাও একটু বলে দেখো।”
“কোনো বিশেষ প্রয়োজন? মানে কোনো সমস্যা হয়েছে কি?” উদ্বিগ্ন স্বরে বলে শিল্প।
“না ওকে কেবিনে দিবে তুমি দেখো আসতে পারো কিনা।”
“দেখছি আমি।” ভেতর থেকে খুশির জোয়ারে ভাসলেও প্রকাশ করতে পারছে না শিল্প। এতোদিন এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল সে। তবে আজ কেনো জানি ভয় লাগছে। তনুর সামনে দাঁড়াতে ভয় করছে।
শিল্প ছুটির জন্য কথা বললেও ছুটি মিলল না। অনেকবার রিকুয়েষ্ট করার পরও তাঁরা রাজি হলো না। তাই একরাশ উদ্বিগ্নতা আর ভালোলাগা নিয়ে কাটলো কর্মদিবস। মাঝে রাকার সাথে কানেক্ট থেকেছে। তবে আজ ভিষণ রকমের অন্যমনস্ক দিন কেটেছে। কাজে ভুল হয়েছে অনেক। একবার পানি দিতে গিয়ে পড়ে যায় একজনের উপর। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিল লোকটি। থাপ্পড় মারতে উদ্যত হয়েছিল। দুর্ব্যবহার সাথে ম্যানেজারের সামনে অপদস্ত হতে হয়েছে বেশ। ম্যানেজার বেজায় রাগ, সম্ভবত মাস শেষে কিছু টাকা কাটা পড়বে।
রাস্তায় চলার পথে এসব এলোমেলো ভাবনারা উঁকি দিতে থাকলো। হসপিটালে পৌঁছানোর পর অনেকের মুখের দেখা মিলল। নিবেদিতা, সোহান, করিম সাহেব, এককোণে অযত্নে ফেলে রাখার মতো নাজমার দেখাও পেলো শিল্প। তনুর মাথার কাছে লতিকা বসা। কেবিনে নেওয়া হয়েছে তনুকে। ভারি ভারি যন্ত্রপাতি নেই আশেপাশে। তবে এখনও নিথর কেনো তনু?
“জ্ঞান সকালেই ফিরেছিল শুধু। ডাক্তার বললো কাল সকালের মাঝে পুরোপুরি জ্ঞান ফিরবে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের মাঝে তনুকে পাবো।” শিল্পের দিকে এগিয়ে রাকা বললো। সবাই শিল্পের দিকে তাকালো। সবার মুখে প্রশান্তির হাসি। লতিকা সরে শিল্পকে জায়গা করে দিলো।
“সমস্যা নেই মা, আপনি বসুন।”
“না বাবা, ঠিক আছে।”
“আমরা একটু পর বেরবো। যেকোনো আপডেট আমাদের জানাবে সে যতোই রাত হোক।” নিবেদিতা বললেন। শিল্প মাথা নেড়ে সায় জানালো।
“আর হ্যাঁ যখনই জ্ঞান ফিরুক না কেনো, তুমি সাথে সাথে জানাবে। আমরা অনেকটা সময় অপেক্ষা করেছি, কোনো রেসপন্স করেনি তনু।” কঠোর নিবেদিতার চক্ষু সিক্ত হয়ে উঠলো।
“আরে আন্টি এতো কেনো ভাবছেন। ডাক্তার তো বলেছে ইনজেকশন পুশ করেছেন। সকালের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। তনু সুস্থ হয়ে যাবে আন্টি, আল্লাহ ভরসা।” ধির কন্ঠে বললো রাকা, আড়চোখে মায়ের দিকে ঘৃণাভরে তাকালো। আরো সংকুচিত হয়ে এলো নাজমা। শিল্পের বাড়ির প্রত্যেকের মাঝে অপরাধবোধ কাজ করে। নিবেদিতা যদিও এখন তাদের দোষ দেয়না। তবে শিক্ষিত ভাষায় মাঝে মাঝে আরো বাড়িয়ে দেন শিল্পদের ভেতরের অপরাধবোধের জলন্ত লাভা।
“আমি নিজের হাতে ক্ষতি করেছি মেয়েটার। তোমরা বুঝবে না আমার ভেতরের কষ্ট।” তনুর কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন নিবেদিতা। যাবার আগে শিল্পকে বলে গেলেন, “মেয়েটাকে দেখে রেখো শিল্প। তোমায় ভরসা করছি কেনো জানিনা, তবে এই শেষ বার।” তৎক্ষনাৎ কোনো উত্তর দিতে পারে না শিল্প। লতিকাও শিল্পের মাথায় একবার হাত ছুঁয়ে পিছু পিছু চলে যায়।
“ভাই ভেবো না বেশি। আমার এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কোনো সমস্যা হলে ডেকো। বাবা আসুন।” ঘুমন্ত রক্তিমকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো রাকা। করিম সাহেব অসুস্থ শরীরে এগিয়ে এলেন শিল্পের দিকে। সকলের চোখেমুখে রূগ্নতা। ডেবে গেছে চোখ যুগল, কূপের মতো গর্ত হয়ে আছে। করিম সাহেবের চোয়াল ভেঙে এসেছে, এ বয়সে এতো সবকিছু শরীরে সয়ছে না। শিল্পের কাঁধে হাত রেখে শক্তি দেবার চেষ্টা করলো সে। শিল্পও বাবার হাতের উপরে হাত রাখলো। কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলের কেবিন থেকে করিম সাহেব।
নাজমা মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে নিলে শিল্প ডেকে উঠে, “আম্মা।” থেমে যায় নাজমার পা। চোখ ভর্তি হ্রদ নিয়ে তাকালেন শিল্পের দিকে।
শিল্প কোনো বাক্যব্যয় ছাড়া জড়িয়ে ধরলো নাজমাকে। নাজমা কেঁদে দিলেন জোরে জোরে। নেড়ে দিলেন ছেলেন মাথা। মায়ের কাঁধে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলো শিল্প।
“আমাকে মাফ করে দে বাবা, মাফ করে দে।” নাজমা দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। শিল্প হাতের কবজি দিয়ে মুছে ফেললো চোখ। সোহান তখনও সোফায় বসা। সবাই বেরিয়ে যেতেই সে এগিয়ে এলো।
“টাকার জোগাড় কতোদুর।”
“হয়ে গেছে।”
“কিভাবে করলি?” ভ্রু কুঁচকে গেলো সোহানের।
“ওই একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছি।”
“কে দিলো তোকে এতো টাকা?”
“তুই চিনবি না।” শিল্প এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো।
“আমি চিনবো না! কিছু কি লুকাচ্ছিস? তোর দৃষ্টিতে এতো লুকোচুরি কেনো?”
“আরে বেশি ভাবছিস, তেমন কিছুই না।”
কেবিনে নার্স আসতেই থেমে গেলো ওরা। ধামাচাপা পড়ে গেলো টাকার কথা এ পর্যায়ে।
সবাই বেরিয়ে যেতেই তনুর পাশে বসলো শিল্প। তনুর হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদলো কিছুসময়। বয়ে গেলো চোখের জল, ভিজে গেলো তনুর হাত। মনে হলো কেঁপে উঠলো তনু। চমকে ওঠে সেদিকে তাকালো শিল্প। কিন্তু তনু নিশ্চল। শিল্পের চোখে আবারো আষাঢ়ে বৃষ্টি।
“আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি হয়নি তনু। আমি আর কতো শাস্তি পাবো। তুমি তবে ফিরবে আমার কাছে তনু? আমার ধৈর্য্য যে ফুরিয়ে এলো।”
বেলা যে নেমে এলো, তুমি এলে না?
আঁধারে ঢাকিলো শোভা, তুমি তবু এলে না?
আকাশে চাঁদ দেখ ওই, তুমি পাশে নেই মোর,
নিভৃতে যতনে দুঃখ, কাটিছেনা পাপের প্রহর।
সেভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে শিল্প। পাখির কলতানে ঘুম ভাঙে তার। প্রভাতের আলো ফোঁটার আগেই মসজিদ অভিমুখে হাঁটতে থাকে সে।
———–
ঘড়িতে তখন সাতটার ঘন্টা ধ্বনি। কিন্তু ঘরে তো কোনো ঘড়ি নেই। একটা ঘড়ি কিনতে হবে ঘরের জন্য। এখনকার দিনে ঘড়ি ছাড়া কি ঘরে থাকা যায়? শিল্পের কোনো দিকে নজর নেই। এতো পাখির কলতান কোথা থেকে? তবে কি এখনো সাতটা বাজেনি। গাড়িঘোড়ার আওয়াজ দেখি আসছে না। বাইরে কোনো রিকশার ক্রিংক্রিং ধ্বনি নেই, নেই দলবেঁধে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া নরনারীর কলতান।
ভারি আঁখি পল্লব মেলে তাকায় তনু। চোখ মেলতেই সাদা দেয়াল চোখে পড়ে। অপরিচিত একটি রুম। তনু এপার ওপাশ তাকায়। কেউ নেই আশেপাশে। বাইরে থেকে যত্রতত্র মানুষের কথার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
“এখানে কেনো আমি?” তনু নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো। দরজা দিয়ে সবুজ ড্রেস পরিহিতা একজন রমণীকে ঢুকতে দেখে সেদিকে তাকালো সে। মনে হলো তনুর তাকানোতে চমকে উঠেছে রমণী। যেমনভাবে সে ভেতরে প্রবেশ করেছে ঠিক তেমনি বেরিয়ে গেলো।
————
শিল্প মসজিদ থেকে বেরিয়ে একটা কাজে গিয়েছিল। কাজ শেষ করে ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। খুব দ্রুত পা চালিয়ে হাসপাতালে এসেছে। পুরোটা সময় হেঁটেই যাতায়াত। পকেটে এখনো সেই একশো টাকার নোট। ভয়ে ভাঙায়নি, তাহলেই শেষ হয়ে যাবে। প্রয়োজন পড়ে না তেমন, প্রয়োজন পড়লেও ব্যবহার করে না। খাবার বাড়ি থেকেই আসে। এখন আর আগের মতো ভালো ভালো খবার তৈরি হয়না। দোকানেও কিছু ধারদেনা হয়ে আছে। এতো ঋণের বোঝা টানা বড় কষ্টের। সবচেয়ে বড় কষ্ট দায়িত্ব। যখন তোমার মুখ চেয়ে আরো কিছু মুখ তাকিয়ে থাকে তখন তোমার নিজেকে ভাবার সুযোগ থাকে না। বাস্তবতা জীবনের সফল শিক্ষক। বাস্তব-ই মানুষকে মনুষ্যত্ব শেখায়। শেখায় বেঁচে থাকার লড়াই।
কেবিনের কাছে আসতেই রাকার হাসিমুখ নজরে আসে। অনেকদিন পর এমন প্রাণবন্ত হাসি দেখতে পেলো বোনের মুখে।
“কিরে আপু, এতো জলদি?”
“ভেতরে যাও। তোমার জন্য চমক আছে।” শুনতেই দ্রুত পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল শিল্প। সরাসরি তাকালো তনুর বেডের দিকে।
তনু..তনু চোখ মেলেছে! নিবেদিতা তার হাত ধরে কাঁদছে। লতিকা অপরপাশে বসা, মাথা নেড়ে দিচ্ছে। সোহান হাসিমুখে পাশ এসে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে বলল, “অবশেষে।”
শিল্পের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। এই বুঝি স্বপ্ন ভেঙে গেলো।
হঠাৎই তনু তাকালো তার দিকে। চমকে উঠলো শিল্প, সাধারণ চমক না। ভেতর থেকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো।
“এতো শান্ত কেনো তনু? এতো প্রাণহীনতা কেনো ও চোখে।” উত্তর এলো না। আজ শিল্পের মনও কোনো উত্তর দিলো না। শুধু ক্ষণে ক্ষণ চিনচিনে ব্যথার উদ্রেগ ঘটালো।
চলবে…
মেহবুবা তানজীম