এক পা দুপা
সিজনঃ ২
পর্বঃ ১০

“কে? কে মারা গিয়েছে?” তনুর কথায় শিল্পের ধ্যান ভাঙলো। তনুর মিটমিট করে চোখ খুলেছে। অজানা আশংকায় মনটা ছটফট করতে থাকলো। শাহেদ বাকা হাসলো। ক্লেশের হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আপনি কি কিছুই জানেন না মিস?”
“কি বিষয়ে?”
“ভিক্টিমের বিষয়ে?”
“কে ভিক্টিম? উনি কি বলছে শিল্প?” শিল্পের মুখে কোনো কথা নেই। সে অংক মেলাতে ব্যস্ত। আসলে বোঝার চেষ্টা করছে হয়েছে কি।
“ম্যাডামের দেখি কিছুই মনে নেই।” শাহেদের কথায় তনু বারবার শুধু শিল্পের দিকে তাকাচ্ছে। শিল্প তখনো নিষ্ক্রিয়। তনুর চোখেমুখে তখন চিন্তার ভাঁজ।
“আপনি আজ কোথায় গিয়েছিলেন? আপনার যদি কলেজে যাবার ছিল তবে অন্যপথে কেনো হাঁটলেন?’
” আমি কলেজে? আ আমি আমি তো বাড়িতেই ছিলাম। এই আপনি কিছু বলুন, কিছু বলছেন না কেনো? আমি বাড়িতেই ছিলাম তাইনা, বলুন।”
“আপনি বাড়িতে ছিলেন? হাসালেন। কেনো মিথ্যে বলছেন। যদি বাড়িতেই থাকতেন তবে কলেজ রোডের পাশের রোডে আপনাকে পাওয়া গেলো কেনো?”
“আমি জানি না, কিছুই জানি না। আমি বাড়ি যাবো, চলুন বাড়ি যাবো। শুনছেন।” অনবরত হাত ঝাকাতে শুরু করলো তনু। শিল্প খানিক ধাতস্থ হলো। ভাবলো এই মুহুর্তে তাকে ভেঙে পরলে চলবে না। সব জানতে হবে।

“আমাকে পুরো ঘটনাটা বলুন। মাঝ থেকে বললে কেমনে বুঝবো। তাছাড়া তনু কেনো এমন কাজ করবে? তনু তো তার ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল।” শেষের দিকে শিল্পকে খানিক অস্থির দেখালো। চোরা চোখে একবার তনুর মুখের দিকে তাকালো। কোনো পরিবর্তন নেই, সেই মায়াবী মুখ, কারুকার্য খচিত মুখশ্রী, আজকে যেন একটু বেশিই বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।
“কেনো না, অবশ্যই বলবো। কিন্তু আপনার কথায় আপনি নিজেই ফেঁসে গেলেন। উনি কিন্তু কিছু স্বীকার করছে না।”
“আমরা কি বাইরে গিয়ে কথা বলতে পারি?”
শাহেদ একবার তনুর দিকে তাকালো তারপর কি মনে করে বললো, “আচ্ছা চলুন।”
শিল্প তনুকে বলল, “তুমি একটু বস আমরা আসছি।”
তনু জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছ? আমি এখানে একা বসে থাকব! আমি একা থাকতে পারবো না।” শিল্প বলল, “আমি এইতো বাইরে দাঁড়িয়ে আছি তুমি চিন্তা করোনা এখানে অনেক মানুষ আছে। একটু বসো প্লিজ।”
“কি হয়েছে আমাকে বলো, উনি কি বলছে?”
“কিছু না আমি দেখছি। তুমি শুধু অপেক্ষা করো।” তনুকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে শিল্প শাহেদকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। লোকে লোকারণ্য, গমগম করছে পরিবেশ। কত শত মানুষ, কত আর্তনাদ তাদের। বাইরে গিয়ে গিয়ে শিল্প শাহেদকে সকল কথা বলতে বলল।
“আপনি প্লিজ আমাকে একটু ক্লিয়ার করবেন সব?”

শাহেদ বললো, “অবশ্যই, করবো বলেই তো আসা।আপনার ওয়াইফ কে কলেজের অপর দিকে একটা রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে আপনি নিশ্চয় জানেন।”
“জ্বি।”
“আপনার ওয়াইফের প্রায় কাছাকাছি একজন মেয়েকে জখম অবস্থায় পাওয়া গেছে। মেয়েটির নাম তৃষ্ণা দাস। মেয়েটিকে নিয়ে একটা কেস করা ছিল। সম্ভবত আগেরদিন তার বাবা তার নামের কেস নিয়ে এসেছিল। মেয়েটি আগেরদিন থেকে নিখোঁজ ছিল। এন্ড টুডে সি ডাই।”
“এখানে তনুর কি ভূমিকা? তনু কি করেছে? মেয়েটি নিখোঁজ ছিল আগে থেকে। তাকে অন্য কেই কিপন্যাপ করতে পারে বা অন্যকিছু।”
“আপনি কিভাবে জানলেন মেয়েটি কিডন্যাপ হয়েছিল?” শাহেদের দৃষ্টিতে কৌতুক তবে তা অবশ্যই মজা করার জন্য না। শিল্প হতভম্ব, সে শুধু কথার কথা বলেছে।
“দেখুন, আনি অযথা আমাদের সন্দেহ করছেন। এই নামের কাউকে আমরা চিনিই না আর তো কিডন্যাপ। তনু এসবের সাথে যুক্ত না।”
“কি করেছে সেটা তো তিনিই বলতে পারবেন।”
“আশ্চর্য! আপনি কি জানেন তনু অসুস্থ। খুব বেশিদিন হয়নি কোমা থেকে ফিরেছে।”
“জানি, বলেই বাইরে এসেছি কথা বলতে।”
“তাহলে আপনি বলছেন কেনো তনু দোষী। যেখানে ওই মেয়েটি আগে থেকেই কিডন্যাপড্ অর নিখোঁজ ছিল।”
” জ্বি এইজন্যই আমি বলেছি আপনার ওয়াইফ মার্ডার কেসের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। যদিও তখনও ভিক্টিম বেঁচে ছিল বাট নাও সি ডাইড।”
“আপনি সরাসরি তনুকে ব্লেম করছিলেন। কেনো?”
“এক্সুয়ালি সেটা আমার দোষ। সামনের মানুষের বিভ্রান্ত চেহারা দেখতে এনজয় করি। তাছাড়া এখনও কিছুই বলা যাচ্ছে না। আপনার ওয়াইফ কলেজে না গিয়ে আরেক রোডে কি করছিল? মেয়েটি তার কাছাকাছি পড়ে ছিল বা সেখানে কি ঘটনা ঘটেছে সবটা জানতে হবে। বাট আপনার ওয়াইফ কিছু বলতে চাইছে। বরং সে অস্বীকার করলো। সেটা কি ভালো লক্ষণ বলুন।”

শিল্প বুঝতে পারছে তারা বেশ ভালোভাবে ফেঁসে গিয়েছে। তনু কখনোই এমন কাজ করবে না। তাহলে কি কেউ তাদের ফাঁসাচ্ছে? তবে মোস্ট ইম্পর্টেন্ট তনু কলেজ না গিয়ে ওই রাস্তায় কেনো গিয়েছিল?
“আমরা ধারণা করছি মেয়েটা রেপড। তাছাড়া অনেক অত্যাচার করা হয়েছে তাকে।”
“কিহ্! মাই আল্লাহ। নিশ্চয় বলবেন না এসব আমরা করেছি।”
“করতেও পারেন।”
“আশ্চর্য! আপনার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।”
“জ্বি, আমরা এখন প্রমাণই সংগ্রহ করবো। মেয়েটির পরিবার বেশ ধনী। উপর লেবেলে হাত আছে ভালোই।”
“আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?”
“না সাবধান করছি।”

“কিন্তু আমরা কোনো দোষ করিনি। সত্যি বলতে আমি নিজেও গোলকধাঁধায় আটকে আছি। সেখানে কি ঘটেছে জানা নেই আমার। কিন্তু তনু কিছু করেনি এটা বলতে পারবো। তনুর মতো মেয়ে এমনকিছু করতেই পারে না।”
“অপরাধী কি আপনাকে বলে অপরাধ করবে? যাই হোক আমাকে লাশের কাছে যেতে হবে। আপনারা এখনকার মতো বাড়ি যেতে পারেন। খবরদার শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমি সঠিক সময়ে আপনার মিসেসের সাথে দেখা করবো। আসছি, আল্লাহ হাফেজ।”
শিল্প শাহেদের যাবার পথে একবার তাকিয়ে ভেতরে চলে আসে। তনু তখন নতুন আসা একটা রোগীর দিকে তাকিয়ে আছে। রোগী একজন বাচ্চা। সম্ভবত কানে গোল পুঁথি ঢুকেছে।

শিল্প তনুকে ডাকলো। তনু আধবোজা চোখে তাকালো।
“বাসায় যাবো।”
“হুম, যাবো চলো।”
শিল্পের হাত ধরে কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে হাঁটতে থাকে তনু।
“ওই বাচ্চাটা কি কাঁদছিল, আরেক বাচ্চার সাথে খেলছিল, সেই বাবু নাকি কানে পুঁথি ঢুকিয়েছে। কি সাংঘাতিক বলেন? আমার বাচ্চাকে আমি সবসময় নিজের কাছে রাখবো, কারও কাছে দিবো না, আচ্ছা।” শিল্পর পা আচমকা থেমে গেলো। কৌতুহলী তাকালো তনুর দিকে।
“বলুন, আচ্ছা। বলুন।” তনু লজ্জাজনক হেসে বললো।
“কি বলছো তনু, কিসের বাচ্চা?”
“কিসের বাচ্চা মানে! এরমধ্যে ভুলে গেলেন নাকি এখনো সেই তিয়াসাতে আটকে আছেন?” তনুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বানে শিল্প অসহায় বোধ করলো। তনু কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো, “এইজন্য কি ফিরেছি? আপনি কোনদিন আমার হবেন না তাইনা?”
“ছি ছি কি বলছো, এমনকিছু না তনু৷ আচ্ছা সরি। আমরা আমাদের সন্তানকে কারো কাছে দিবো না। খুশি?” মনে হলো তনু বেশ খুশি হয়েছে। মুখে হালকা হাসির পরত।
“বাড়ি চলো, তনু।”

সামনে এগোতে গিয়ে একজন মহিলার দিকে নজর পড়লো শিল্পের। কপালে বড় টিপ, মাথায় সিঁদুরের মোটা প্রলেপ লেপন। দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছেন। আর্দ্র চোখ জোড়ায় রাজ্যের দুঃখ। ইনি কি তৃষ্ণা দাসের কেউ হন? কেনো জানি হঠাৎ করে এমন মনে হলো। শিল্প তনুর দিকে তাকালো তনু ভবিষ্যতের কল্পনায় ব্যস্ত। তাদের সন্তান এলে কি করবে, কিভাবে মানুষ করবে? এসব কথা বলে চলেছে। শিল্প এবার সত্যি নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। এতোটা অসহায় এর আগে লাগেনি। আল্লাহ্ সাহায্য করো।
হঠাৎ দেখলো মহিলাটি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শিল্প তনুকে আরো চেপে ধরলো নিজের সাথে। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।

রিকশায় ওঠার পরে ঘিরে ধরলো সব চিন্তারা। তনু তখনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মগ্ন।
“এই শোনেন, আমাদের সন্তানে নাম কিন্তু রাখা হয়নি। দুটো সুন্দর নাম খুঁজতে হবে বুঝলে। একটা ছেলের নাম আর একটা মেয়ের। শোনেন মেয়ে হলে কিন্তু আমি টুকটুকি বলে ডাকবো আচ্ছা। আর ছেলে হলে… উমম টুকটুক বলে ডাকবো, আচ্ছা। এই বলো আচ্ছা।”
“আচ্ছা।”

_______________________

তনুকে বাড়িতে রেখেই অফিসে চলে আসে শিল্প। বাড়ি ফিরেই তনুর খুব ঘুম পেয়েছে। এতো ঘুম যে হাতমুখ ধোবার সময় পায়নি। এসেই বিছানায় সাথে লেগে গেছে। চোখ বন্ধ রেখেই শিল্পকে বলেছে তার মাথা নেড়ে দিতে। বলার ধরনেও নতুনত্ব।
“মাথা একটু নেড়ে দিন তো। একদম বাইরে যাবেননা। বলে রাখছি খবরদার যদি না দেখি তাহলে ন্যাড়া করে রেখে দিবো।”
“অ্যা।”
“হ্যাঁ, মনে থাকে যেন।” এতো চিন্তা, অবসাদের মাঝেও হাসি ফুটলো শিল্পের মুখে। শেষে তনুকে ঘুম পারিয়ে তারপর অফিসে পৌঁছেছে।

অফিসে কোনো কাজে মন দিতে পারছেনা শিল্প। চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো, কিভাবে সব ঠিক করবে? সামনে যে কি অপেক্ষা করছে?
আমিনুল সাহেব অনেক সময় ধরে শিল্পকে অন্যমনষ্ক দেখছে। বারবার টাইপিং মিস্টেক করছে। কাজের মাঝে খেই হারিয়ে ফেলছে। তাঁর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলেও করছে না, আগের অপমান তাঁকে বাঁধা দিচ্ছে। তবে শিল্পের দিকে নজর রাখছেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

হঠাৎ কাঁচ ভাঙার শব্দে শিল্পের দিকে তাকায় সবাই। শিল্প বিব্রত ভঙ্গিতে হাসে। সবাই আবার কাজে মন দেয়। মাঝে মাঝে চোরা চোখে শিল্পের হাবভাব দেখে, আবার কেউ কেউ এগিয়ে এসে ভদ্রতার সাথে জিজ্ঞেস করে, “এনি প্রবলেম?”
শিল্প সব চিন্তাকে দুরে সরিয়ে হাসিমুখে বলে, “নো প্রবলেম, জাস্ট ড্রপ দা গ্লাস। আই ডোন্ট নো হাও।”

একজন এসে কাঁচ পরিষ্কার করে গেলো। শিল্পর খারাপ লাগলো পরিষ্কারকের জন্য। পরিষ্কারক চলে যেতেই আমিনুল সাহেব শিল্পের কাছাকাছি চেয়ার নিয়ে বসলো। বললো,
“কি হয়েছে বলেন তো ভাই?”

আমিনুল সাহেব এমনভাবে বললেন যেন শিল্পের উপর তাঁর অনেক অধিকার। শিল্প তাঁর অধিকারবোধে রাগ করল না, না বিরক্ত হলো। কোন এক মন্ত্রবলে যন্ত্রের মতো বলে গেলো তনুর সমস্যা গুলো। পুলিশি ঝামেলার কথা অবশ্য কিছু বলেনি। সেসব স্কিপ করে সব বললো।
আমিনুল সাহেব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বয়সে শিল্পের থেকে ভালোই বড় তিনি। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা কম না। তিনি সব শুনে নিজে থেকে একজন ডাক্তারের ব্যপারে সাজেস্ট করলেন। অতিসত্বর ডাক্তার দেখানোর জন্য নিজে থেকেই এপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিলেন কাল সন্ধেবেলার। শিল্প খুব কৃতজ্ঞ বোধ করলো। পৃথিবীতে কেউ অকেজো নয়, কে কবে কখন কাজে লেগে যায় কে জানে। তাই কাউকে অবহেলা করা উচিৎ না।

____________

বাড়ি চমক অপেক্ষা করছিল শিল্পের জন্য। কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দাঁড়ায় তনু। তনু! হঠাৎ তনুকে দেখে চমকে ওঠে শিল্প। তনু এই বাড়িতে! তনুর পরনে তখন লাল শাড়ি, পরিপাটি সাজ তার অসুস্থতাকে ছাপিয়ে সৌন্দর্য তুলে ধরেছে। লাল লাল ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। অনেকদিন, অনেকদিন পর শিল্পকে আবার মোহিত করে তুলছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিশ্চল শিল্প তখন ধরণীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। মনে ক্লান্তি, জরা, দুঃখ সব অনেকদুর…বহুদূর। বহুদিন পর সেই প্রথমদিনের মতো অনুভূতি। আহা যদি সবটা আবার সেই আগের মতো হয়ে যেতো!

চলবে…
মেহবুবা তানজীম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here