#উরন্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৫(শেষ পর্ব)
#কলমে_অপরাজিতা_ইসলাম

প্রজ্ঞাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।বাকি সবাই ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে।রুদ্ধ অস্থির হয়ে গেছে প্রজ্ঞাকে দেখার জন্য।কেউ ওকে শান্ত করতে পারছে না।প্রেমা রীতিমতো কেঁদে ফেলেছে।রোহান ওকে নিয়ে এক কোণায় দাড়িয়ে আছে।বাকি সবার মুখেই চিন্তার ছাপ।

এর মধ্যেই ডক্টর রিম্মি বেরিয়ে আসলো।ডক্টরকে দেখে সবাই ওনার সামনে গিয়ে দাড়ালো।রুদ্ধ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“ডক্টর প্রজ্ঞা এখন কেমন আছে?আমার স্ত্রী আর সন্তান দুজনেই ঠিক আছে তো?”

“মিস্টার রুদ্ধ আপনি প্লিজ একটু শান্ত হন।এই অবস্থায় আপনাকে শক্ত থাকতে হবে।”

ডক্টরের কথা শুনে রোহান বলল,

“কেন ডক্টর?প্রজ্ঞার অবস্থা কি খুব বেশি ক্রিটিকাল?”

ডক্টর কিছুটা হতাশ গলায় বললেন,

“মিসেস প্রজ্ঞার ফিজিক্যাল কন্ডিশন ভালো না।ওনার প্রসবের ব্যাথা উঠার সাথে সাথে ওনার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গিয়েছে।এখন আপনাদের যেকোনো একজনকে বাঁচাতে হবে!”

এই কথাটা শুনেই রুদ্ধ কয়েক পা পিছিয়ে গেল।ওর মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে।অবিশ্বাস্য চোখে ডক্টর রিম্মির দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রেমা এবার শব্দ করেই কেঁদে দিল।রোহান ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলো।প্রজ্ঞা আর রুদ্ধর পরিবারের সবার চোখের কোণেই এখন পানি চিকচিক করছে।রোহান কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“ডক্টর আর কি কোনো অপশন নেই?”

“না।আর একটা কথা,মিসেস প্রজ্ঞাকে আমরা এখন বাঁচাতে গেলেও পরবর্তীতে তিনি আর কখনো মা হতে পারবে না!”

হঠাৎই রুদ্ধ ঠাস করে মাটিতে বসে পরলো।ওর চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রুপাত হচ্ছে।মুখে কোনো কিছু না বলে চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।তখনই একজন নার্স ওটি থেকে বের হয়ে আসলো।

“ডক্টর, প্রজ্ঞা ম্যাম ওনার হাসবেন্ড এর সাথে কথা বলতে চায় এখনই।”

রুদ্ধ এই কথাটা শুনে ছুটে ওটি’র ভেতরে চলে গেল।প্রজ্ঞার হাতে ক্যানোলা লাগানো।মুখে অক্সিজেন মাস্ক।চোখ ফুলে গেছে।মুখটা একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।চোখের কোণা বেয়ে বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।প্রজ্ঞা হাতের ইশারায় রুদ্ধকে কাছে ডাকলো।রুদ্ধ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রজ্ঞার পাশে বসে পরলো।প্রজ্ঞা খুব কষ্টে বলে উঠলো,

“রুদ্ধ আমি জানি আমার হাতে সময় খুব কম।”

এবার রুদ্ধ আর নিজেকে আটকাতে পারলো না।ছেলে হয়েও শব্দ করে কাঁদতে লাগলো।

“তোমার কিচ্ছু হবে না প্রজ্ঞা।তুমি আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারো না।”

প্রজ্ঞা মুচকি হাসলো।একটা ছেলে কতটা ভালোবাসলে এভাবে কাঁদতে পারে?রুদ্ধর ভালোবাসায় প্রজ্ঞা নিজেও আটকে গেছে।ওকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু ওদের সন্তানকে বাঁচাতে হলে ওকে এই স্যাক্রিফাইস টুকু করতেই হবে।

“রুদ্ধ প্লিজ শান্ত হয়ে আমার কথাগুলো শোনো।আমাদের সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখাতেই হবে।কারণ ওও আমাদের ভালোবাসার একমাত্র চিহ্ন।ওর মধ্যেই আমি বেঁচে থাকবো।আমাদের সন্তানকে তুমি নিজ হাতে বড় করবে।আর একটা কথা রাখবে প্লিজ?”

রুদ্ধ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

“বলো।”

প্রজ্ঞা কিছুটা হেসে জোর গলায় বললো,

“তুমি কিন্তু আর কখনো বিয়ে করবে না।তুমি শুধুই আমার।অন্য কেউ যেন আমার জায়গায় আসতে না পারে।আমি চাইনা আমাদের সন্তান সৎ মায়ের কাছে বড় হোক।”

এর প্রেক্ষিতে রুদ্ধ কিছু বলার আগেই প্রেমা কান্নারত অবস্থায় ভেতরে এসে বললো,

“তুমি চিন্তা করো না আপু।তোমার সন্তান ওর মিমির কাছে বড় হবে।ওকে আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়ে আগলে রাখবো।আমি তো ওর মা হতে পারবো না।কিন্তু ওকে কখনো মায়ের অভাবটা বুঝতে দিবো না।”

প্রেমার কথায় প্রজ্ঞা নিশ্চিন্ত গলায় বললো,

“তুই থাকলে আমি নিশ্চিন্ত।কারণ আমি জানি আমার বোন কখনো আমার সন্তানকে মায়ের অভাব বুঝতে দিবে না।”

ধীরে ধীরে সবাই প্রজ্ঞার কাছে এসে কান্নাকাটি করলো।প্রজ্ঞা সবাইকে শেষ বারের মতো দেখে নিলো।তারপর সবাইকে চলে যেতে বললো।সবাই চলে যেতেই প্রজ্ঞা ওর মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে শেষ বারের মতো রুদ্ধর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।রুদ্ধ আলতো হাতে প্রজ্ঞাকে জড়িয়ে ধরলো।প্রজ্ঞার পিঠ ভিজে যাচ্ছে পানিতে।ওও বুঝতে পারলো রুদ্ধ এখনো কাঁদছে।প্রজ্ঞা নিজের হাত রুদ্ধর পিঠে রেখে বললো,

“ভালোবাসি তোমায় অনেক বেশি!”

“আমিও তোমায় বড্ড ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া যে আমি জীবন্ত লাশ হয়ে যাবো।”

এর মধ্যেই প্রজ্ঞা আবার ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলো।ডক্টর আর নার্সরা এসে রুদ্ধকে বাইরে বের করে দিয়ে অপারেশন শুরু করলো।সবাই আল্লাহ আল্লাহ করছে।যদি কোনো মিরাকল এর মতো প্রজ্ঞা আর সন্তান দুজনেই ভালোভাবে ফিরে আসে।

দীর্ঘক্ষণ পর ওটি থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেল সবাই।রুদ্ধ দৌড়ে ওটি’র সামনে গিয়ে দাড়ালো।তখনই একজন নার্স সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে রুদ্ধর হাতে তুলে দিলো।রুদ্ধ নিজের মেয়েকে কাছে পেয়ে পরম আদরে চুমু দিলো কপালে।তারপর ভেতরে তাকিয়ে দেখলো ডক্টর বেরিয়ে আসছে।আর একজন নার্স প্রজ্ঞার মুখের উপরে কাপড় টেনে দিলো।

এটা দেখে কেউ নিজেকে সামলাতে পারলো না।পুরো হসপিটালে কান্নার রোল পড়ে গেল।সবাই নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আজ প্রত্যেকের চোখেই পানি চিকচিক করছে।রোহান রুদ্ধর হাত থেকে বাচ্চাকে নিতেই রুদ্ধ এলোমেলো পায়ে প্রজ্ঞার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো।সাথে সাথেই বাচ্চা কেঁদে উঠলো।প্রেমা খুব সাবধানে বাচ্চাকে নিজের কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলো।প্রজ্ঞার মা জ্ঞান হারিয়েছে।সবাই পাথর হয়ে গেছে।রুদ্ধর পাগলামো দেখে উপস্থিত ডক্টর,নার্স,ওয়ার্ড বয় সহ প্রায় সকলের চোখেই পানি।কেউ কিছু বলার মত অবস্থায় নেই।আশেপাশের আকাশ,বাতাস ও যেন ভারি হয়ে গেছে কান্নার আওয়াজে।

________________________________

আজ আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে।পূর্ণিমা রাত।রুদ্ধ ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।আজও ওর চোখে পানি টলমল করছে।

পেড়িয়ে গেছে চারটি বছর।প্রজ্ঞা আর রুদ্ধর একমাত্র মেয়ে ‘প্রমিতা হাসান প্রমি’র আজ চার বছর সম্পূর্ণ হয়েছে।প্রেমা ওর কথা রেখেছে।নিজের বোনের সন্তানকে মাতৃত্বের স্নেহ দিয়ে বড় করছে আজও।প্রমির মুখের দিকে তাকিয়ে রোহান আর প্রেমা আর কোনো বাচ্চা নেয়নি।প্রমি আর একটু বড় হলে তবেই ওরা ওদের সন্তানকে নিয়ে ভাববে।রুদ্ধ একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।সব সময় নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখে।আর প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে প্রজ্ঞার কবরের সামনে গিয়ে বসে থাকে।এভাবেই কেটে গেছে এতগুলো দিন।সময় নিজের মত করেই চলছে।শুধু থমকে গেছে প্রজ্ঞা আর রুদ্ধর পরিবারের সকলের জীবন।রুদ্ধর কথা সত্যি হয়েছে।আজ সত্যিই রুদ্ধ জীবন্ত লাশের মতো জীবন কাটাচ্ছে।নিজের সন্তানকে নিয়েই কাটছে ওর জীবন।

প্রেমা প্রমিকে নিয়ে ছাদে এসে দেখল রুদ্ধ এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।ওও আর কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচে নেমে গেল।রুদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়েই বলল,

“আমাদের ভালোবাসাটা #উরন্ত_ভালোবাসা ছিল প্রজ্ঞা।ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি।দীর্ঘ চব্বিশ টা বছর আমরা একসাথে কাটিয়েছি।কখনো নিজেদের অনুভূতির কথা একে-অপরকে বলিনি।আমাদের #উরন্ত_ভালোবাসার মতো আজ তুমিও উরন্ত পাখি হয়ে গেছো।তুমি তো ঐ দূরের আকাশে তারা হয়ে জ্বলজ্বল করছো।সবাইকে জানান দিচ্ছো তাঁরা হয়ে আজও আমাদের সাথে আছো তুমি।কিন্তু আমি যে ভালো নেই।আমি যে তোমাকে ছাড়া জীবন্ত লাশ হয়ে গেছি।আমি আমার কথা রেখেছি।আমার জীবনে আর কাউকে আসতে দেইনি।কারণ আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে যে শুধুই তোমার বসবাস।আমাদের #উরন্ত_ভালোবাসা’র একমাত্র চিহ্ন আমাদের রাজকন্যার আজ চার বছর হয়ে গেল।প্রেমা আর ভাইয়া আমাদের মেয়েকে নিজের সন্তানের মত বড় করছে।শুধুমাত্র আমাদের মেয়ের কথা চিন্তা করে ওরা আজ পর্যন্ত নিজেদের সন্তান নেয়নি।তোমার সব ইচ্ছা আজও পূরণ করে যাচ্ছি আমরা।কিন্তু আমাদের একটা মাত্র ইচ্ছা তোমার বেঁচে থাকাটাই পূরণ হলো না।আজ প্রথমবারের মত আমি চিৎকার করে বলছি,ভালোবাসি তোমায়।অনেক বেশি ভালোবাসি তোমায় প্রজ্ঞা।আমাদের #উরন্ত_ভালোবাসা সব সময় অমর হয়ে থাকবে আমাদের রাজকন্যার মধ্যে।ভালো আছি আমি তোমার স্মৃতিগুলো নিয়ে।তুমিও ভালো থেকো আমাদের #উড়ন্ত_ভালোবাসা’র সাক্ষী হয়ে!”

___________________সমাপ্ত__________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here