#উজানে_ফেরে_নদী (৩,৪)
৩.
সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। বেশ কদিনের ছুটি। বাবা মা কদিন ধরে বলছে বাড়ি যাবার জন্য। নদী নিজেই যেতে চায়। কতদিন বাড়ি যায়নি। এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি যাবে বলে ঠিক করে ফেলে।
রাফাতের কোনো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত। কয়েকবার ফোন করেও পেল না। ফোনে রিং হচ্ছে তবে কেউ ধরলো না।
-ধুর.. নিজের বাড়ি যাবে তাও আরেকজনকে জানাতে হবে। কোনো মানে হয় এর।
মাকে ফোন করে।
-হ্যালো মা।
-কেমন আছিস রে মা? কবে আসবি? আরিফ, হৃদি সবাই আসছে।
-ভালো আছি মা। সবাই চলে গেল? আমাকে একবার বলল না?
-তোর তো আসবার ঠিক নেই। আর ওদের তো ছুটি কম।
-আচ্ছা ঠিক আছে। বাবাকে বলো একটা টিকেট বুক করে আমাকে জানাতে।
-বাসে আসবি নাকি ট্রেনে?
-বাসে মা। কালকে সকালের বাসে টিকেট বুক করতে বোলো। আমি যেয়ে টিকেট কেটে নিব।
-ঠিক আছে। তুই তাহলে ফোন রাখ। তোর বাবা বাজারের দিকেই গেছে। আমি ফোন করে জানাই।
ফোন রেখে কাপড়টা পালটে সে নীচে নামলো। নিউমার্কেট থেকে একটু ঘুরে আসবে। বাড়িতে ছোট চাচাতো ভাই বোনগুলা আছে। সবার জন্য টুকটাক কিছু কিনতে হবে। নিউমার্কেটে ঘুরতে তার বেশ ভালই লাগে, যদিও আজ একা। টুকটাক জিনিস কিনতে কিনতে দুই হাত ব্যগ দিয়ে ভর্তি হয়ে গেল।
-কি কিনেছিস এত?
পেছনে ফিরে দেখলো উজান দাড়িয়ে। হাতে সবুজ রঙের পপসিকেল।
-খাবি একটা? দাঁড়া আমি আমি কিনে আনছি। নড়বি না এখান থেকে।
এই লোকটা কি তাকে ফলো করে নাকি? যেখানেই যায় সেখানেই হাজির। সে হেটে এক নাম্বার গেটের দিকে যাওয়া শুরু করল।
-কি রে নড়তে মানা করলাম তবুও হাঁটা দিলি কি মনে করে? ব্যাগগুলো আমাকে দে আর পপসিকেলটা নে।
নদী দাঁড়ালো। জোরে একটা শ্বাস টেনে নিল।
-আপনি কি আমাকে ফলো করেন?
-তুই কি এমন রসগোল্লা যে তোকে ফলো করতে হবে? এটা কি খাবি না?
-আমি কি বলেছিলাম যে আমি খেতে চাই? আপনাদের কারো কাছেই অন্যের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই না। সবাই নিজেদের মত করে সব কিছু ভেবে নেন।
-ওহ সরি। কিছু মনে করিস না।
একটা পিচ্চির হাতে পপসিকেলটা ধরিয়ে দিয়ে উজান ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
জীবনটা অতিষ্ট হয়ে গেছে। একজনকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে ধূমকেতুর মত উদয় হন। আর আরেক জন শুকতারা হয়েছেন সকাল সন্ধ্যা সবসময় আছেন। বাহ্ সেই রকম চিন্তা ভাবনা করে ফেলল তো। নিজেই হেসে উঠলো।
নিজের রুমে এসে জিনিসগুলো রেখে দিল। সন্ধ্যার পরে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে হবে। মার কাছে শুনে নিতে হবে কয়টার বাসের টিকেট বুক করেছে বাবা? আপাতত গোসল করে আসা যাক। গরমে পুরো সেদ্ধ হয়ে গেছে। ললিটা খেলেই পারতো। সবুজ পপসিকেলটা তার বেশ পছন্দের। নাহ্ তার মাথা পুরোপুরি গেছে। ফোনটা বাজলো তখনি। রাফাতের ফোন। যাক শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল।
-হ্যালো
-আমি তোর হলের গেটের সামনে। তাড়াতাড়ি আয়।
নদী তাড়াহুড়া করে নেমে এল। গেটের বাইরেই বাইক নিয়ে দাড়িয়ে রাফাত। তাতে দেখেই এক্সট্রা হেলমেটটা বাড়িয়ে দিল।
-পেছনে উঠে বস।
-এই সময় কোথায় যাব?
-এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না।
-কাল বাড়ি যাব। অনেক কাজ পড়ে আছে।
-আর একটা কথা বলবি তো এখানেই পুতে ফেলবো। যা বলছি তাই কর।
নদী কোনো কথা না বলে চুপচাপ উঠে বসলো।
৪.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। আরিফ গোসল করতে যেতেই উজান পুকুর ঘাটে চলে এল। রনিকে আসতে বলেছিল কিন্তু তার বিশেষ মানুষের সাথে কথা বলতে হবে।
বাঁধানো ঘাটে বসে আকাশের দিকে তাকালো। গ্রামের আকাশ বলেই অসংখ্য চোখে পড়ছে। এখানের জীবনটাও খারাপ না। তবে শহুরে জীবন থেকে বেরিয়ে আসাটাই মুশকিল। আরিফের যে নদী নামের একটা বোন আছে তা তো সে জানতোই না। আরিফ আর রনির সাথে তার পরিচয় জবে জয়েন করবার পর। তিনজনের এসএসসি আর এইচএসসি একই সালে হবার কারণে খুব সহজে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এখন তো তারা তিনজন তিন দেহ এক প্রাণের মত।
তার মাথা পুরো এলেমেলো হয়ে আছে। ঠিকমত কাজ করছে না মনে হয়। সারাদিন এ বাড়িতে অসংখ্যবার নদী নাম ধরে সবাইকে ডাকতে শুনেছে কিন্তু একবারও কাউকে দেখতে পায়নি। নাকি পেয়েছে কিন্তু এ নদী হয়তো সে নদী নয়। একটা মানুষ মাত্র দুই বছরের মধ্যে কি করে এমন উধাও হয়ে যেতে পারে যে পরিচিত কেউ তার কেনো খোঁজ দিতে পারলো না। কোথায় চলে গেলি তুই? আমি তো তোকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে চাইনি। কোথায় খুঁজবো তোকে?
-কি রে একা একা এখানে বসে আছিস কেন? রনি কই?
-এমনিতেই। রনি কথা বলছে। তুই জেগে আছিস কেন? ঘুমিয়ে পড়। কাল তো বিশাল ধকল যাবে।
-আরে নাহ। আমার কিছুই হবে না। বাবা চাচারা সব ম্যানেজ করে ফেলবে।
-তাও ঠিক। তোদের পরিবারের সবাইকে একসাথে দেখতে খুব ভাল লাগছে। এখন তো এমন দেখাই যায় না। সবার মাঝে শুধু রেসারেসি, ঝগড়া, অলিখিত সব কম্পিটিশন।
-ঠিকই বলেছিস। তবে আমাদের পরিবার এখনও শুধু দাদীমার জন্য এক আছে। দাদীমা চলে গেলে কি হবে তা অবশ্য জানি না।
-বিয়ে তো নিজেদের মধ্যেই করছিস।
-হমম। তা ঠিক। চার ভাইয়ের মধ্যে বাবা সবচেয়ে বড়। আমি তো একাই সেটা তো জানিস। মেজ চাচার দুই মেয়ে নদী আর হৃদি। বিয়েটা কিন্তু আমার নদীর সাথেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ হয়তো তা চাননি। পরে সেটা বদলে হৃদির সাথে ঠিক করা হল।
-কি হয়েছিল? এমনটা হলো কেন?
-তা তো জানি না বন্ধু। নদী তো আমাদের কাউকে কিছু বলে না। তবে দাদীমাকে বলেছিল নিশ্চই। দাদীমা পরে সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে।
-আর তুই? তুই কি নদীকে পছন্দ করতি না?
আরিফ কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। কি বলবে সে? বিয়ের আগের দিন সে কি বলবে যে হৃদি না সে নদীকে ভালবাসে। এটা কি বলা যায়? আর সাথে নদীর জীবনে ঘটা দুর্ঘটনার কথাও তো বলা যায় না যেটা শুধু মাত্র সে, নদী আর মিতা জানে।
-নাহ্ দোস্ত। ছোট বেলা থেকে ভাই বোনের মত বড় হয়েছি। ওই সব চিন্তা মাথাতেই আসেনি। এক ছুটিতে সবাই বাড়ি এলাম। দাদীমা তখনই সবাইকে এই কথা বললেন। শুনে সবাই রাজি। পরে দাদীমা নিজেই মত পাল্টালেন।
-তোর বউয়ের সাথে তো পরিচয় হল। কই তার বোনকে তো দেখলাম না।
-ওর কথা আর বলিস না। সাইকোলেজিকাল সমস্যা। কারো সামনে সহজে আসে না। নিজের ঘরেই থাকে। এমনি সময় হয়তো দেখতে পেতি এখন যেহেতু অনেক লোক তার টিকিও দেখবি না। বহু কাউন্সলিং করানো হল। কিছুদিন ঠিক থাকে তারপর আবার আগের মত।
-কিরে ব্যাটা হবু বউ এর সাথে কথা না বলে বন্ধুর সাথে কি করিস।
রনির কথায় দুজনে চমকে উঠে। তারপর তিনজনে মিলে হাসতে শুরু করে।
-এট কি আসলেই তুই নাকি তের ভূত? তোর পায়ের শব্দও তো পেলাম না।
-তোদের চমকে দিব বলেই পা টিপে এলাম।
-ব্যাটা বুড়া হয়ে যাচ্ছিস তবুও ছেলেমানুষি গেল না তোর।
-ওঠ দুজনে। অনেক হইছে।
-কত সুন্দর গল্প করছিলাম। তুই এসে সব নষ্ট করলি।
-তাহলে কর গল্প। আমি যাই।
-চল ওঠ, আরিফ। আসলেই অনেক রাত হয়েছে। বেশী জাগলে তোর চেহারার গ্লো নষ্ট হবে। বর দেখতে এসে সবাই ভূত দেখবে।
তিনজন চলে এল সেখান থেকে। কেউ খেয়াল করলো না একটু দূরেই নারিকেল গাছের আড়ালে কেউ দাড়িয়ে আছে।
চলবে….
এমি
*কপি করা নিষেধ ।