#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৮

আমার হাতেই শেষমেশ তর মায়ের দম গেছে বুঝলিরে আরু। তারপর তর মায়ের ঘরে যাইয়া আলমারির সব লু’ট’পা’ট কইরা আমার ভাইরে ফোন দিয়া আইনা ওর কাছে সব পাঠাইয়া দেই। আর মানুষজন ডাকতে যাই ডা’কা’তির খবর দিতে। মানুষজন ডাইকা আইনা দেহি তুই বাড়িতে আইয়া পরছস। মায়ে বাপেরে ধইরা কা’ন্দা কাটি করতাছস। তারপর তো সব জানস। তর মায়ের লা’শ পুলিশে নিয়া গেলো ত’দ’ন্ত করবার। আর তর বাপে হাসপাতালে যাইয়া প্যারা*লা*ইসিস হইয়া কতাবার্তা বন্ধ হইয়া পইরা রইলো। এই হইলো গিয়া দুই মাসের আগ পর্যন্ত কাহিনী।’

‘তার পনেরো দিন পর আরাফাত তরে দেইখা পছন্দ করলো। ভাবছিলাম তরে বিয়া দিয়া ঝামেলা মুক্ত হইমু। কিন্তু ঝা*টা মারা কপাল আমার। বিয়ার রাইতে গেলি ভাই*গা। তয়, তুই ভা’ই’গা না গেলে আমার ঘাটে ঘাটে জল ঘোলা করা মাইয়াডা পার হইতো না। আর তর বাপ…’

‘পরের টুকু না-হয় নাকের আর চোখের পানি এক করতে করতে হা’জ’তের গরম হাওয়ায় বসে শোনাবেন।’

স্যার এর আওয়াজ এলো আমার কানে। সাথে আরও কয়েকজনের কন্ঠ শুনতে পেলাম। কিন্তু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে শক্তি বা শরী’রে’র জোর কোনটাই সায় দিচ্ছে না। আমি দাড়িয়ে রইলাম একইভাবে। আমার মায়ের মৃ’ত্যু চাচির হাতে হলেও আসল খু’নি আমার বাবা। সেদিনের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো আমার চোখে,

সেদিন কলেজ থেকে ফিরে যখন গেট পেড়িয়ে কিছুটা ভিতরে এলাম তখন মা বাবা দুজনকে র’ক্তা’ক্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আমি ছুটে এসেছিলাম মা-বাবার কাছে। বাবা অ’জ্ঞা’ন হয়ে ছিলো। কিন্তু মা আমার গলার আওয়াজ পেয়ে গো’ঙি’য়ে ওঠে। বারবার শুধু বাবাকে ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কিন্তু শুধু গোঙানোর আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম মা হয়তো বাবাকে বাঁচানোর কথা বলতে চাইছে। মা সারাজীবন এর মতো চুপ করে যাওয়ার আগে আমার হাতটা ধরেছিলো। বাবার দিকে এগিয়ে নিয়েছিলো খানিকটা। তারপর আর কোন সারা দেয় নি মা। কিছু বলেও নি। আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলো। আর কখনো ধরবে না আমার হাত। কখনোই না।

হটাৎ মনে হলো আমি অতল অ’ন্ধ’কার গহ’ব্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছি নিজের ওপর। চোখ যেন আপন মানুষ গুলোর মতো ধোঁ’কা দিয়ে জোর করে বুঁজে আসতে চাইছে। তখনই বোধহয় কেউ ধরে ফেললো আমায়। শুন্যে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলো কোথাও। আমি কিছু একটা শুনতে পাচ্ছি। ঢিপঢিপ ধ্বনি ভেসে আসছে আমার কানে। অনুভূতিরা যেন ফিশফিশ করে জানান দিচ্ছে, কেউ খুব যত্নে আগলে নিয়েছে তার বুকের ভেতর। আমাকে লুকিয়ে রাখবে বুকের পাজরে। কেউ কখনো আঘাত করতে পারবে না সেখানে। কেউ কখনো কষ্ট দিতে পারবে না। কানে এলে কারো ঝাপসা আওয়াজ,

‘ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছি। আমি ওকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ওদের ব্যাবস্থা করো।’

তারপর শুধু পায়ের আওয়াজ পেলাম।ধীরে ধীরে অনুভব এর প্রখরতা কমে এলো। আমি হারিয়ে গেলাম কোন এক অজানায়। মনে হলো মা হাত বাড়িয়ে অন্ধকার হতে ডাকছে আমায়।

_______________

কেমন যেন হই হট্টগোলের আওয়াজ আসছে কানে। ধীরে ধীরে আওয়াজের প্রখরতা বাড়ছে। অনেক মানুষের গলার সুখী স্বর ভাসছে যেন আমার আশেপাশে। কেউ বোধহয় আমার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তবে কি আমি মায়ের কাছে এসে গেছি। মা তো এইভাবেই আমার মাথায় বিলি কেটে দিতো।

চোখ দুটো কি ভারি লাগছে। যেন কতশত বোঝা বয়ে বেরাচ্ছে চোখের পাতা গুলো। চোখের পাতার সাথে যুদ্ধ করে তাকালাম। চোখ খুলতেই সর্বপ্রথম নজরে পরলো কারো হাত। কানে আসছে বহু কন্ঠের আনন্দ ধ্বনি। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নজরে এলো অনেকগুলো হাস্যাজ্বল মুখশ্রী। সবই অচেনা। এতো গুলো চেহারা গুনতে গেলেও বোধহয় ক্যালকুলেটর এর সাহায্য নিতে হবে। আমার শিয়রের পাশে বসা চল্লিশোর্ধ অতি সুন্দরী ভদ্রমহিলাটি আবেগমিশ্রিত গলায় হটাৎ বলে ওঠলো,

‘এখন কেমন লাগছে মা?’

আমি চকিতে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকালাম তার চোখে। কি মায়ামাখা ডাক। মা! শব্দটিতে কি যেনো ছিলো। মাথাটা খানিক ভার লাগলেও আমি উঠে বসলাম। কতগুলো চোখের দৃষ্টি এখন আমার দিকে তা খোঁজ করার ইচ্ছা জাগলো আমার মনে। আমি চেয়ে দেখলাম সবাইকে। কি আশ্চর্য! সবার দৃষ্টি কেমন আপন আপন। সবার চোখে রয়েছে এক রাশ মায়া। প্রথম চোখ খুলে এতোগুলো অচেনা মুখ দেখে একটু অস্বস্তি হলেও এখন মনে হচ্ছে এ জায়গাটা আমার জন্য মোটেও অস্বস্তির কারন হবে না। মন এমন কেন বলছে?

সেই মহিলাটি আবারও আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে মা?’

আমি তার দিকে ফিরে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে না করলাম। আশেপাশের সবাই এখনো একইভাবে দাড়িয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। তবে তাদের দৃষ্টিতে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু আমার তো আছে। অনেক প্রশ্ন আছে আমার। আমি এখানে কেনো? আমি তো..

হটাৎ মাথা চারা দিয়ে উঠলো দুপুরের ঘটনা। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। হাসফাস করে আশেপাশে তাকালাম। এতো ভীরের মাঝে চেনা কোন মুখ তো নেই। কাকে জিজ্ঞেস করবো? আমি চিৎকার করে বলে ওঠলাম,

‘চাচি কোথায়? আপনারা কারা? চাচির থেকে তো আরও অনেক কিছু জানার বাকি আছে। আরও কি যেনো একটা বলছিলো চাচি। আর আমার রেকর্ডারই বা কোথায়? ওটাতো আমি জামার ভেতরে সলোয়ার এর ভাজে রেখেছিলাম। ওটাতে চাচির সব কথা রেকর্ড করেছিলাম। তাছাড়া বাবা নামক ওই জ’ল্লা’দ টাকে তো আমি নিজ হাতে শাস্তি দিবো। ওই জ’ল্লা’দ টাই বা কোথায়?
আমাকে নিয়ে চলুন আপনারা। প্লিজ আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন। ওরা আমার মাকে মেরে ফেলেছে। আমার মায়ের বুকের ভেতর কু’পি’য়ে’ছে ওরা। ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে আমার মায়ের বুকটা। আমার মা অনেক কষ্ট পেয়েছে। অনেক কষ্ট। আমার মা! মা! মা গো! আমি পারছি না মা! আর পারছি না। তোমার কষ্ট আমি কি করে কমাবো মা। কি করে কমাবো। বলো না মা। বলো। তোমার বুকটা বুঝি জ্বলে যাচ্ছে?’

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি। সেই মহিলাটি আমায় জরিয়ে ধরে বুকে টেনে নিলো। আমি তাকে আঁকড়ে ধরে কাদঁতে কাঁদতে হটাৎ নির্জীব হয়ে এলাম। জ্ঞান হারালাম তৎক্ষনাৎ।

আড়ালের কান্নার আহাজারিতে মাহতাব ভিলার প্রতিটা কোনা যেনো কেঁপে উঠছে। ভারী হয়ে উঠছে বাতাসের গভীরতা। রুমের অবস্থানরত সবগুলো মানুষের চোখের জল বাধ ভেঙে উপচে পড়ছে। আড়াল মুর্ছা যেতেই ওয়াসিফ ভিলার বড় ছেলে আসিফ সাহেবকে ডেকে পাঠায় তার স্ত্রী আলো বেগম। তার বুকেই এখন ঠায় নিয়েছে আড়াল। আড়ালকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ঘর খালি করতে বলেন আলো বেগম। সবাই অশ্রু চোখে এক এক করে রুম ছাড়লে রুমে প্রবেশ করে শুদ্ধ মাহতাব। শুদ্ধ রুমে প্রবেশ করে তার মাকে বলে,

‘আমি বাইরে থেকে ওর সব কথা শুনেছি আম্মু। তোমার ‘সে’ এখন বাড়ি নেই। ডাক্তার আংকেল কে এগিয়ে দিতে গেছে। মেয়েটা প্রচন্ড ট্রমার মধ্যে আছে এখন। ওকে এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সবকিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে হবে। ওর আবার জ্ঞান ফিরলে এসব মনে করার যেনো কোন সুযোগ না পায় সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। তুমি এখন যাও। ওর জন্য একটু সুপ করে নিয়ে এসো। আমি ওর জ্ঞা’ন ফিরানোর ব্যাবস্থা করছি।’

আলো বেগম রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। শুদ্ধ পা বাড়ায় বিছানায় মলিন চেহারা আর রু’গ্ন শ’রীর নিয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির কাছে। আড়ালের পাশে বসে বাম সাইড থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দেয় আড়ালের মুখের ওপর। আড়াল পিটপিট করে তাকায়। এবার চোখ মেলে সবার আগে নজরে আসে একটি পুরুষালী চেহারা। কেমন চেনা চেনা মনে হলো মুখটি। হটাৎ আড়ালের মনে হলো এটা তো সেই পানির বোতলধারী দানব চেহারার ছেলেটা। কলেজের ছাদেই তো আজ সকালে দেখা হলো। পানি খাইয়িয়ে চুপচাপ চলে গেছিলো ছেলেটি।

শুদ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে আড়ালের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে। আড়ালকে ভাবুক চেহারায় দেখে শুদ্ধ আর সময় না নিয়ে বলে ওঠে,

‘তুমি রোজ কি কি খাও বলো তো?

একটি অচেনা ছেলের কাছ থেকে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে আড়াল একটু লজ্জা পায়। সাথে হয় অস্বস্তি। আড়ালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলে ওঠে,

‘এখন থেকে রোজ ডায়েট করে চলবে। তাতে তোমারও উপকার আর অন্যদেরও।’

আড়াল থতমত খেয়ে যায়। এ কেমন পরিস্থিতি! কেমন যেন পেট মোচড়াতে লাগলো আড়ালের। হয়তো খিদেতে অথবা অস্বস্তিতে। ঠিক ঠাওর করে ওঠতে পারলো না আড়াল। আড়াল চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাওকে দেখতে না পেয়ে একটু চমকায়। আবারও প্রশ্নের খেলা চলে মস্তিষ্ক জুড়ে। কিন্তু তার স্থায়িত্ব খুব বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। সামনে থাকা দানবীয় চেহারার পুরুষটি আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,

‘আচ্ছা আমি কি তোমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি? নাকি বিয়ের? এতো চিন্তা ভাবনার রেল ছুটাচ্ছো কেনো?

আমার কান দিয়ে যেনো ধোয়া বেরোতে লাগলো। হটাৎ করে মনে হলো পেটের মোচড় টা তিন গুন বাড়লো বোধহয়। কান গরম হয়ে উঠেছে। আমি কোথায়? এই দানবের পাল্লায় কি করে পড়লাম?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here