#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৭

সাহস করে খুব সাবধানতা অবলম্বন করে বেড়িয়ে এলাম রুম থেকে। চাচি এখন সিড়ির দিকে আছে। তাই আমায় দেখে নেওয়ার চান্স খুব কম। কোনভাবে আমার রুমে চলে যেতে পারলেই হবে। ব্যাগে আমার ফোনটা আছে। সেটাই এখন শেষ সম্বল। আমি ধীর পায়ে এগুতে লাগলাম আমার রুমের দিকে। আচমকা চাচির কথায় আমি থমকে দাড়ালাম। আমার অন্তর আত্মা যেন বেড়িয়ে গেলো। শেষ রক্ষা কি তবে আর হলো না। আমার হাত পা ভিষন ভাবে কাপছে। আমি ভয়ে ভয়ে তাকাই পিছনে ফিরে। কিন্তু পিছনে কাউকেই দেখতে পেলাম না। আমার দম যেনো ফিরে পেলাম। সামান্য একটু এগিয়ে সিঁড়ির দিকে উকি দিলে চোখে পড়ে চাচি দুজন লোকের সাথে কথা বলছে। লোক দুজন একে অপরকে আব্বাস আর রহমতুল্লাহ বলে সম্বোধন করছে। আমি আরও এক দফা চমকে উঠলাম। এই দুই নামই তো শুনেছিলাম যারা সিএনজি নিয়ে গেছিলো আমার কলেজের সামনে। চাচি তো এখন আমার খোজ করাবে। যদি বাড়ির ভিতর খোঁজ করে আমিতো ধরা পড়ে যাবো। ওরা এক সেকেন্ড ও সময় নেবে না আমাকে খু*ন করতে। পরিস্থিতি এখন হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। এগিয়ে গেলাম আমার রুমের দিকে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম। ফোনটা হাতে নিতে নিতেই কেঁপে উঠলো। আচমকা ফোন এ কল আসাতে ফোনটা কেঁপে উঠেছে। আমার অন্তর আত্মা কয়েক মুহূর্তের জন্য শুকিয়ে গেছে। হার্ট মনে হচ্ছিল থেমে গেছে। স্যারের নাম্বার থেকে কল আসছে। এখন স্যারের কথাগুলো মনে করে ভিষন লজ্জা লাগছে। স্যার তো ঠিকি বলেছিলো। স্যারের কথা শুনলে নিশ্চয়ই আজ বিপদে পরতে হতো না। আমি রিসিভ না করে কেটে দিলাম স্যারের ফোন। ইচ্ছে করলো না কিছু বলতে।

থানার নাম্বার ফোনে সেইভ করা ছিলো। ভাবলাম থানায় কল দিয়ে জানাই। সেটাই ভালো হবে। থানার নাম্বার ডায়েল করার আগেই একটা মেসেজ আসলো ফোনে। মেসেজ টি পড়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলাম। স্যার পাঠিয়েছে। তাতে লেখা আছে,

‘আমি আসছি বিশ মিনিটের মধ্যে। যদি বাড়ি গিয়ে থাকেন তাহলে সেইফ থাকার চেষ্টা করবেন। বাড়ি এখনো না পৌছিয়ে থাকলে বাড়িতে ঢুকবেন না প্লিজ।’

এই মানুষের উপর সম্মান আরও ধাপ বেড়ে গেলো। আমার হাজারো না বলা কথাগুলো বুঝে নেওয়াই বোধহয় এনার একমাত্র কাজ। আমি মেসেজ করে দিলাম, ‘আমি বাড়ির ভেতরে আছি। ভেতরে পাঁচ জন জানোয়ারের অবস্থান আছে। প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।’

মাথায় অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষমেশ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। ফোনটা রেখে আলমারি খুললাম। একদম উপরের দিকটা হাতড়িয়ে কিছু একটা হাতে বাজলো। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতে নিয়ে কোমড়ের দিকে সালোয়ারের ভাজে লুকিয়ে বেরিয়ে পরলাম নির্ঘাত মৃত্যু সম্ভাবনাময় এক রাস্তায়। হয়তো বা*চার অবলম্বন নিয়ে বেঁ*চে ফিরবো নয়তো নিজে হাতে বিলিয়ে আসবো আমার জিব*ন

সিড়ির দিকে এগোতেই দেখলাম চাচি ওই দুজন লোককে সাথে নিয়ে এখনো ওখানেই দাড়িয়ে আছে। আমায় এখনো তাদের চোখে পড়ে নি। আমি এগিয়ে গেলাম তাদের চোখে পড়তে। সোজা তাদের সামনে গিয়ে থেমে দাড়ালাম। চাচি আমায় দেখে ভুত দেখার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে। বাড়ির ভেতরে আমায় মোটেও আশা করেনি। আমার হাতে সময় খুব কম তাই বেশি সময় না নিয়ে চাচি কে বললাম,

‘আমার তোমার সাথে কথা আছে। এখানে দাড়িয়ে কথা বললে আমাদের কথা গেটের বাইরে থেকে যে কেউ শুনে ফেলতে পারে। তাতে তোমারই বিপদ। ভেতরে যাবে নাকি এখানেই আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে? যদি ভয় না পাও তাহলে আরকি। নয়তো থাক। আমাকে মারবে তো, মেরে ফেলো।’

চাচি অনেকটা ভড়কে গেছে আমার সহজ গলার শক্ত কথা শুনে। আমি যে ইতিমধ্যে অনেক কিছুই জেনে গেছি তা চাচি বুঝে গেছে। তাই কথা না বাড়িয়ে সম্মতি জানায়। নয়তো ভীতু প্রমানিত হতে হবে যে! তা কি আর চাচি মানবে, কখনোই না। আব্বাস এবং রহমতুল্লাহ নামক লোক দুটি গর্জে ওঠে বলে, ‘এই মা*ল*ডা যহন নিজে নিজে সামনে আইছে তয় একখান কো*প বহাইয়া দিলেই তো হয়। আবার কতা কওনের কি আছে।’

চাচি অসম্মতি জানিয়ে বলে,

‘দেহি না কি কয়। বাড়িতে ও একা। আমরা আছি পাঁচজন। উনিও কিছু সময়ের মধ্যে আইয়া পড়বো। উনি আইলে মানুষ আমরা ছয় জন। ছয়জনের সামনে ও একলা মা*গি কি করবো। ও মনে করতাছে আমি ভ*য় পামু। ইট্টু ও না। আমিও দেহি ও কইবো ডা কি।’

লোক দুটি সাথে আসতে চাইলে চাচি তাদের পাহারা দিতে বলে গেটের সামনে। গেট নক করলে যেনো চাচিকে ডেকে দেওয়া হয় এমন কথা বলে এগিয়ে যায় চাচি ঘরের দিকে। আমিও চাচির পিছন পিছন এগিয়ে যাই। ঘরে গিয়ে চাচির মুখোমুখি দাড়াই। চাচির চেহারা দেখে বুঝতে পারছি চাচি কতোটা ভয় পেয়ে আছে। কিন্তু তা মোটেও প্রকাশ করবে না। নিজেকে সাহসি ও বুদ্ধিমতি প্রমাণ করতে চাচি সব করতে পারে। এমনটা ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি। চাচির মতো এমন একজন মানুষ কিভাবে মায়ের খুনি হতে পারে তা আমাকে প্রচন্ডভাবে ভাবিয়ে তোলে। আর চাচির ‘উনি’ টাই বা কে? আর এসব করে চাচি আর ওই লোকগুলোর লাভ টাই বা কি?

চাচিকে তীর্যক ব্যাঙ্গ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখলাম। আমার এই দৃষ্টিতে চাচি অস্বস্তির স্বীকার হচ্ছে। কিন্তু কোন কথা বলছে না। পাশের দেয়াল ঘরিতে তাকিয়ে দেখলাম আমার হাতে আর পনেরো মিনিট সময় আছে।

অজস্র আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে চাচিকে আমি বললাম,

“মাকে তোমরা মেরেছো জানি। আমাকে মারতে কলেজে ওই দুজন লোককে সিএনজি দিয়ে পাঠিয়েছিলে এটাও জানি। তোমাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতে পেলে বাবাকেও যে মেরে ফেলবে সেটাও আমার জানা। কিন্তু যেটা জানি না সেটা এখন জানতে চাই। তাও তোমার নিজের মুখে। আজ থেকে দুইমাস আগে ঠিক কি হয়েছিলো সেদিন। মাকে কেনো মেরেছিলে? আমায় কেন মারতে চাও? আমায় আর বাবাকে মারবেই যখন তাহলে এতোদিন কেন মারো নি? বাবার ঘরেই বা কি খুজছো তোমরা? এসবের উত্তর আমার চাই। এই প্রশ্নগুলো আমি ওই লোকগুলোকেও করতে পারতাম। কিন্তু তারা ভয় পাবে। আর ভয় পেয়ে আমায় যত তারাতারি সম্ভব মেরে ফেলতে চাইবে। কিন্তু আমি জানি তুমি আমায় কোনদিনই ভয় পাবে না। ‘তুমি’ আর ‘ভয়’ এই দুটি শব্দ একসাথে যায়ই না। তাই না চাচি?”

চাচির মুখটা খুশিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। খানিক লজ্জাও পেলো বোধহয়। আমার ভেতর থেকে ঘৃনার সমুদ্র উতলে উঠলেও মুখে কুলুপ এঁটে রইলাম। চাচি বেশ শৌখিন ভঙ্গিতে বিছানায় বসলো। পাশের চেয়ারটি পা দিয়ে ঠেলে এগিয়ে দিলো আমায় বসতে। আমি নিশ্চুপ হয়ে বসলাম। চাচি আপন মনে বলতে শুরু করলো,

‘কইতে তো কস, কিন্তু কোনহান থেইকা শুরু করি কতো। মধ্যেহান থেইকা কইলে তো বুঝবিনা। আইচ্ছা এক্কেরে শুরুর থেইকা হুন। তর বাপের আর আমগোর অবস্থা আছিলো এক রহমের। দিন আইনা দিন খাওন। তারপর তর বাপ কোনহান থেইক্কা তোর মায়েরে ধইরা নিয়া আইলো বউ বানাইয়া। তর বাপে কইলো তর মায় নাকি অনাথ। কিছুদিন পর তর মায়ের গয়না বেইচা তর বাপে গেলো বিদেশ। বিদেশ যাওনের পর তর বাপের তো এক্কেবারে কপাল খুইলা গেলো। আসতে আসতে টেহা পয়সা জমাইতে লাগলো, ভাল মন্দ খাওনের তো কমতি নাই। তর মায় একা থাকতো তাই একখানা কাম এর বেডিও রাইখা দিলো। রাজরানীর মতোন থাকতো তর মায়। তারপর তুই হইলি। তাতে তর বাপ মায়ের দেহনদারি আরও বাইরা গেলো। পুরা গ্রামের মাইনষেরে মিষ্টি খাওয়াইলো তর মায় তর জন্মের খুশিতে। তুই এট্টু বড় হইলে তর বাপে এই দালান তুলতে শুরু করলো। ছয়খানা রুম এই এক তলা দালান ঘরে। বুঝস কিছু? কোন থেইকা কোনহানে পৌছাইয়া গেছে তর বাপে। আগে ঘুইরা ফিরা কেনরহমে দিন যাইতো যার হে কিনা থাকবো এত্তো বড় দালান ঘরে। তো একদিন তর মায় হটাৎ কইরা এট্টু অসুখে বিছনায় পড়ে। পরের দিনই তর বাপে আইয়া হাজির হয়। তহন তর দশ বারো বছর বয়স মনে হয়। আমার সন্দেহ হইলো তর বাপের ওপর। বিদেশ থাকলে একদিনের মধ্যে কেউ আইতে পারে তুই ক দেহি আমারে। আমি আমার এক চাচাতো ভাইরে দিয়া খুঁজ নিয়া জানবার পারি যে তর বাপে বিদেশ থাহে না। সবাইরে মিথ্যা কতা কইছে। তর মায়েরেও মিথ্যা কতা কইছিলো। তর মায়েও জানতো না তর বাপে বিদেশ না। তর মায় সুস্থ হইয়া গেলে তর বাপেও চইলা যায় আবার। তর মায়রে কইছিলো আগেই টিকিট কাইটা রাখছিলো তাই আইছে। আর এহন বসের শরীর ভালা না তাই যাওন লাগবো। ছুটি বাতিল হইয়া গেছে। তর মায় এত বলদের বলদ, তর বাপের সব কতা বিশ্বাস কইরা নিছে। তর বাপে যহন যায় তহন আমার ভাইয়ে তর বাপের পিছন পিছন গেছিলো খুজ নিতে। যাইয়া দেহে তর বাপে নাকি অবৈধ কোন একখান কামে জড়িত আছে। ভালা কাম করে না। তারপর আমার ভাইয়ের কাছ থেইকা খবর সব পাইয়া আমি তর বাপেরে ফোন দিয়া থেরেট দিয়া কইছি আমার লগে আলাদা দেহা কইরা কতা কইতে। তারপর তর বাপে দেহা করে আমার লগে। আমি কইলাম মাসে মাসে আমারে টেহা পয়সা দেওনের কতা আর তগোর দালান ঘরে আমাগোর পুলাপান সহ থাকার লাইগা দুইডা ঘর দিতে। তর বাপে রাজি হইয়া যায়। আর আমিও কাওরে কিছু কই নাই তর বাপের কুকির্তির কতা। এমনেই কয়েক বছর কাইটা যায়।কিন্তু দুইমাস আগে তর মায় কেমনে জানি সব জাইনা যায়। আর থানায় যাওয়ার হুমকি দিয়া তর বাপেরে ওই কাম ছাইড়া দিতে কয়। কিন্তু তর বাপে হেই কাম ছাড়বোনা তো ছাড়বোই না। দুইদিন খুব মুখ চালাইলো তর বাপ মায় তর অগোচরে। তুই তো সারাদিন কলেজ আর প্রাইভেট নিয়া বাইরেই বেশি থাকতি তাই জানবার পারস নাই। যেদিন বিকালে তর মায় খু*ন হইলো ওইদিন সকালে তর মায় তরে কইছিলো কলেজে না যাইতে কিন্তু তর নাকি কলেজে জরুরি পড়া আছিলো তাই গেলি গা কলেজে। আসলে ওইদিন তর মায়ে তরে নিয়া এই বাড়ি ছাইরা চইলা যাইতে চাইছিলো। আর তর বাপের নামে থানায় মামলা করবার চাইছিলো। কিন্ত তুই গেলি কলেজে। তর মায় গোছগাছ কইরা আমার ঘরে ব্যাগ রাইখা দিছিলো যাতে তুই আইলে তরে নিয়া চইলা যাইতে পারে। কিন্তু আমি তর বাপেরে কইয়া দেই তর মায়ের পলাইয়া যাওনের কতা। তর মায় তো আর জানতো না আমি তর বাপের লগেই মিলা আছি। তর মায় কি কি জানি প্রমান ও জুড়াইয়া রাখছিলো তর বাপের বিরুদ্ধে। হেই প্রমানের কতা তর বাপের কানে দিলে তর বাপে তর মায়েরে অনেক মা*ইর দেয়। তাও তর মায়ে প্রমান গুলা তর বাপের হাতে তুইলা দেয় না। তখন তর বাপে আমারে কয় তর মায়েরে ধরতে যাতে তর মায়েরে তর বাপে মা*রতে পারে। আমি হাত দুইডা ধরছিলাম তর মায়ের। আর তর বাপে তর মায়ের বুকে বটি দিয়া কো*প মা*রে। হেই কোপ মারার সময় তর মায়ে তর বাপের বুকে একখান লাত্থি মারছিলো। তর বাপের মা*রা কো*পটা ভালোভাবে লাগছিলো না তর মায়ের গায়ে। তর বাপে মাটিতে পইরা যায়। এক লাথিতেই তর বাপে কুপোকাত হইয়া গেলে তর মায় উইঠা পিঠের মধ্যেও দুইডা লাত্থি মারে তর বাপেরে। পাশ থেইকা একখান ইট উঠাইয়া হেইডা দিয়াও মাথায় একটা বাড়ি মারে পিঠেও আরো বাড়ি দেয়। আমি সুযোগ বুইঝা তর বাপের আনা বটি দিয়া তর মায়ের পিঠে আর বুকে বহাইয়া দেই কয়ডা কো*প। আমার হাতেই শেষমেশ তর মায়ের দম গেছে বুঝলিরে আরু। তারপর তর মায়ের ঘরে যাইয়া আলমারির সব লুটপাট কইরা আমার ভাইরে ফোন দিয়া আইনা ওর কাছে সব পাঠাইয়া দেই। আর মানুষজন ডাকতে যাই ডাকাতির খবর দিতে। মানুষজন ডাইকা আইনা দেহি তুই বাড়িতে আইয়া পরছস। মায়ে বাপেরে ধইরা কান্দা কাটি করতাছস। তারপর তো সব জানস। তর মায়ের লা*শ পুলিশে নিয়া গেলো তদন্ত করবার। আর তর বাপে হাসপাতালে যাইয়া প্যারালাইসিস হইয়া কতাবার্তা বন্ধ হইয়া পইরা রইলো। এই হইলো গিয়া দুই মাসের আগ পর্যন্ত কাহিনী।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here