#আড়াল_কথা
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২১

আড়াল চোখ খুলে কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থাকে। আচমকা চিৎকার শুরু করে দেয় র’ক্ত বলে। আড়ালের চি’ৎ’কারে দুজনই এঁটো হাতে ওঠে পড়ে খাবার রেখে। কারোরই আর খাওয়া হলো না। হবে কি করে, মেয়েটা যে দুজনেরই প্রাণ। আলো বেগম কাছে গিয়ে জাপটে বুকে টেনে নেন আড়ালকে। আড়াল অনবরত মুখের সামনে হাত রেখে র’ক্ত বলে চিৎকার করছে আর এপাশ ওপাশ দেখছে। শুদ্ধ ও আসিফ সাহেব তাড়াহুড়ো করে হাত ধুয়ে আসে প্লেটের মধ্যেই। আসিফ সাহেব কি বলে মেয়েটাকে স্বান্তনা দেবেন বুঝতে পারছেন না। অসহায় চোখে শুধু দেখে যাচ্ছেন আর হাসফাস করছেন। শুদ্ধ আড়ালের সামনে বসে আড়ালকে শান্ত করার জন্য স্নেহমাখা কন্ঠে বলতে থাকে,

‘এরকম করো না আড়াল। একটু স্বাভাবিক হও। এখানে কোন র’ক্ত নেই। তোমার মুখ একেবারে পরিষ্কার। তুমি একটু ছুঁয়ে দেখো।’

আড়াল থামছে না। ওর মনে হচ্ছে শুধু তখনকার ঘটনা। ভাবছে এখনো র’ক্ত মেখে বসে আছে সে। দুর দুরান্ত পর্যন্ত শুধু খু’নি’দের বসবাস। যখন তখন যে কেউ খু’ন হয়ে যাবে। আর খু’নি হবে তার নিজের আপন কেউ। সবটাই যেনো তার চোখের সামনেই হবে। সে শুধু দেখতে পাবে প্রতিরোধ করতে পারবে না। কেউ বিশ্বা’সযো’গ্য নয়। সবাই খু’নি।

আড়ালের অবস্থার অবনতি দেখে শুদ্ধ ইনজেকশন রেডি করতে যায়। ঘুম পাড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আলো বেগম অস্থির হয়ে আড়ালের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন শক্ত করে বুকে চেপে ধরে। আসিফ সাহেব এতোক্ষণ ধরে দেখে যাচ্ছিলো আর উতলা হয়ে ভাবছিলো কি করলে মেয়েটা শান্তি পাবে। শুদ্ধকে ইনজেকশন রেডি করতে দেখে বাধা দিয়ে বলে,

‘এখন আবারও ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পারালে মেয়েটা দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি একটু চেষ্টা করছি।’

আসিফ সাহেব আড়ালকে শান্ত করতে মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন ওর মায়ের কথা,

‘আপনার মায়ের সব থেকে বড় ইচ্ছে কি ছিলো তা জানেন আপনি? আপনার মায়ের জীবনের সমস্ত সুখের গল্প আপনাকে শোনানোর ইচ্ছে ছিলো তার সবথেকে বড় ইচ্ছে। আপনার মায়ের গল্প শুনবেন আড়াল? সুবর্ণা নামের এক রাজকন্যার গল্প।’

আড়াল এর শ্রবণেন্দ্রিয় পর্যন্ত মায়ের নাম পৌঁছাতেই ধপ করে নিভে গেলো যেনো। তার স্যার তার মায়ের নামটা উচ্চারণ করেছে এটুকুই তার বোধগম্য হয়েছে। বাকি কথাগুলো তার কর্ণপাত হয়নি। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ফেলে তাকায় আসিফ সাহেব এর দিকে।

আড়ালকে শান্ত হতে দেখে তিনজনের হৃদয়ে যেন যুদ্ধের সমাপ্তি হলো। শুদ্ধ ইনজেকশন টা রেখে দিতে ঘুড়ে দাড়ালে চোখে পড়ে বাড়ির প্রায় সবাই দরজার সামনে বিষন্ন হয়ে দাড়িয়ে আছে। শুদ্ধ সবাইকে ইশারা করে চলে যেতে বলে। ইনজেকশন সরঞ্জাম জায়গা মতো রেখে দিয়ে এগিয়ে যায়। ফিসফিস করে বলে সকালে এসে দেখা করতে। এখন আড়ালের অবস্থা ঠিক নেই। সবাই শুদ্ধের কথামতো চলে যায় যে যার রুমে। শুদ্ধ দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে এক পাশে বসে পড়ে। এদিকে আসিফ সাহেব আড়ালকে তার মা সুবর্ণার কথা বলতে শুরু করে,

‘আপনার মা চেয়েছিলো নিজে মুখে আপনাকে শোনাবেন তার সুখের গল্প। এবাড়িতে আসার পর সবাইকে নিয়ে আপনাকে একটা সুস্থ জীবন দেওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো তার। জানেন, আপনার মা আর আমি ছিলাম জমজ ভাই-বোন। আমাদের সব ভাই-বোনদের মধ্যে আমার আর সুবর্ণার বন্ডিং ছিলো সব থেকে ভালো। আমরা দুজন আব্বা আম্মার প্রথম সন্তান ছিলাম। আমরা জমজ হলেও ওর থেকে আমি দশ মিনিটের বড় ছিলাম। কিন্তু ও সেটা কখনোই মানতে চাইতো না। বলতো আমি নাকি ইচ্ছে করে আগে আগে চলে এসেছি ওকে একা ফেলে। নয়তো ওই আগে আসতো আর বড় বোন হয়ে যেতো। আমার গাল দুটো টেনে আমাকে ছোট ভাই বলে ডাকতো। আমি ওকে বড্ড ভালোবাসতাম। ওর এই আফসোস আমার মোটেও মনে ধরতো না। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সবসময় আমি আর সুবর্ণা একে অপরকে নাম ধরে ও ‘তুই’ করে সম্বোধন করতাম। আমাদের দুজনকে আব্বা সিক্স এ ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন যেদিন, সেদিন থেকে আমি ওকে ‘আপনি’ করে বলা শুরু করি। আমাদের জন্মদিন ছিলো সেদিন। ও যে কি খুশি হয়েছিলো না। ওর খুশি দেখে আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। আজ ও ভুলিনি সেইদিন এর কথা। সেদিন এর পর থেকে ওকে কখনো তুই বা তুমি করে সম্বোধন করি নি। এমনকি আপনি সম্বোধন করা ভুলি নি বড় হয়েও। অন্যান্য ভাইবোনেরা আমাকে অনুসরণ করে ওকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করলে ও সুন্দর করে বুঝিয়ে মানা করে দিতো। ওটা নাকি শুধু আমার কন্ঠেই মানাতো। আপনাকে দেখলে আমার মনে হয় আমার সুবর্ণা দাড়িয়ে আছে আমার সামনে। তাই আপনাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করি। যতবার আমি আপনাকে আপনি সম্বোধন করি ততবার আমার বুকটা শীতল হয়ে যায়। আপনাকে বাঁচতে হবে আড়াল। বাঁচার মতো বাঁচতে হবে। আপনার মায়ের ইচ্ছের কথা ভেবে হলেও আপনাকে সুন্দর করে বাঁচতে হবে। আপনি ভেঙে পড়বেন না। আজ আপনি যা যা জানতে চাইবেন সব প্রশ্নের উত্তর দেবো আপনাকে। আপনি বলুন কি কি জানতে চান। আজকের পর আপনি আর কখনো এসব মনে করবেন না। আজকেই সব প্রশ্ন আর উত্তর এর পর্ব শেষ করে দিন। ওরা আপনার আপনজন ছিলো না কোনদিনই। ওদের দেওয়া ধোঁকা মনে রাখবেন না। কথা বলুন আড়াল। বলুন কি কি জানতে চান?’

আড়াল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর চোখের অশ্রু মুছে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে,

‘ওদের সম্পর্কে আমি আর কিছুই জানতে চাই না। যেটুকু জেনেছি সেটুকু সহ্য করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। আরও না জানি কত কি আমার জানার আড়ালে রয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সামলে নেবো নিজেকে। শুধু একটাই অনুরোধ। আমার মায়ের খুনিরা যেনো তাদের যোগ্য শাস্তিটা পায়। শুধু সেটুকুই আমি নিজের চোখে দেখতে চাই। অনুভব করতে চাই ওদের যন্ত্রণা আর অনুশোচনায় ধুঁকে ধুঁকে নেওয়া নিশ্বাস।’

শুদ্ধ ও আসিফ সাহেব নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না আড়ালের কথায়। মুখে যাই বলুক ভেতর থেকে সামলে নেওয়া যে অতো সহজ নয়। তবু মুখে যে বলেছে এই এখন ঢেড়। বাকিটা সময়ের সাথে পাল্টে যাবে। শুদ্ধ এগিয়ে এসে আড়ালকে আশ্বাস দিয়ে বলে,

‘সবগুলো জা’নো’য়া’রের শাস্তি তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে আড়াল। খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারবে ওদের নিদারুণ কষ্টের নিষ্ঠুরতা। শুধু একটু অপেক্ষা করো আর ভরসা রাখো আমাদের ওপর।’

আলো বেগম নিজের ভেজা চোখ মুছে নিয়ে আড়ালের কপালে পরম যত্নে চুমু খান। রুম ছেড়ে বেড়িয়ে যান তড়িৎ গতিতে। এক মিনিটের মধ্যে ফিরে আসেন হাতে এক গ্লাস উষ্ণ গরম দুধ নিয়ে। আড়ালের হাতে দিয়ে বলেন,

‘মারে ওরা দুজন এখনো কিচ্ছুটি খায়নি। রাত প্রায় অর্ধেক হতে চললো। তুই দুধটা খেয়ে নে। আমি ওদের খাবার দিচ্ছি।’

আড়াল দুধের গ্লাসটি হাতে নিলে আলো বেগম নিচে রাখা প্লেট দুটো নিয়ে ছুট লাগান রান্নাঘরে। যতটুকু মাছ, মাংস তরকারি ছিলো সবটাই এনেছিলো খাওয়াতে। এখন আর কিছুই নেই শুধু ভাত ছাড়া। শুধু অল্প একটু ডাল রয়ে গেছে। দুটো ডিম ভেজে ঝটপট ভাত নিয়ে আসেন দুজনের জন্য। এখনকার মতো এতেই হয়ে যাবে। বাপ ছেলের খাওয়া নিয়ে কোন ঝুট ঝামেলা নেই। যা দেওয়া হবে তা দিয়েই তৃপ্তি করে খেয়ে নেবে। শুধু বেশি তেল ঝাল না হলেই হলো। এদিকে আসিফ সাহেব বলে কয়ে আড়ালকে দিয়ে দুধের গ্লাসটি খালি করান।

দুজনের খাওয়া শেষ হলে আলো বেগম আড়ালের সাথে ঘুমোতে চলে যান আড়ালের রুমে। আড়ালের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন যতক্ষণ না তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু আড়ালের চোখে তো ঘুমেরা বাসা বাধছে না। ঠিক যেমন আপন মানুষগুলো সবাই একের পর এক রং পাল্টিয়ে ধোকা দিয়ে চলেছে ঘুমেরাও তেমন ধোকা দিয়ে সঙ্গ ছেড়ে দিলো বুঝি। চোখে ঘুমের বদলে জায়গা করে নিয়েছে মা বাবার একসঙ্গে র’ক্তা’ক্ত চেহারা, মায়ের শেষবার হাত ধরে বাবাকে ইশারা করে কিছু বলার চেষ্টা, চাচির প্রতিটা অন্যায়ের নিষ্ঠুর স্বীকারোক্তি, বাবার করা প্রতিটি অন্যায়ের অজানা রহস্য উন্মোচন, চাচার আচমকা বদলে গিয়ে হিংস্র রুপ ধারণ করে শুদ্ধের গলায় ছুড়ি ধরা আর তখনই শুদ্ধর ছুরিকাঘাতে চাচার কান ঝুলে পড়া। তারপর চারিদিকে শুধু র’ক্ত আর র’ক্ত। আড়াল চোখ মুখ খিঁচে আলো বেগমকে জাপটে ধরে বুকের ভেতর মুখ লুকায়। চোখের সামনে মায়ের হাসিমুখটা দেখার চেষ্টা করে। যাতে বুকের ঝড়টা শান্ত হয়।

সোহাগ এসেছে কিছুক্ষণ হলো। শুদ্ধ, সোহাগ ও আসিফ সাহেব গেস্ট রুমে বসেছেন। সামনে রয়েছে সুবর্ণার ঘরের দেয়াল ভেঙে বের করা দুই ব্যাগ ভর্তি কাগজপত্র ও কিছু দলিল। সেদিন ওই লোকগুলো পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে যার খোঁজ করছিলো তা হলো আড়ালের বাবার পাপের ধনদৌলত। তারা ভেবেছিলো হয়তো অনেক টাকা পয়সা লুকিয়ে রেখেছে সালাউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু সে যে কাঁচা কাজ করার মানুষ নয়। এতোবড় মাদক সিন্ডিকেটের মধ্যমনি হয়ে কাজ করেছে যেই মানুষটা সে কি আর কোটি কোটি টাকা তার বাড়িতে এমনি এমনি ফেলে রাখবে। ওরা কেউ ধারণাও করতে পারেনি সালাউদ্দিন এভাবে তার পাপের ধন সহিসালামতে দেয়াল বন্দী করে রাখবে।

সেদিন আড়ালকে শুদ্ধ ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ি নিয়ে রওনা হওয়ার পর আড়ালের চাচি আমিনা আর ওই চারজন অজ্ঞাত লোককে আসিফ সাহেব ও তার লোকজন মিলে ধরে নিয়ে আসার সময় আব্বাস নামের লোকটি আড়ালের মায়ের রুমে দৌড়ে ঢুকে পড়েছিলো। সেই লোকটাকে ধরার জন্য আসিফ সাহেব ধস্তাধস্তি করার সময় এক পাশের দেয়ালে ধাক্কা লেগে চির ধরে ধরে যায়। আসিফ সাহেব হাত দেওয়ার পর বুঝেছিলেন ভিতরে ফাঁকা। আর দেয়ালের ওই জায়গাটার রঙও পুরো ঘরের দেয়ালের রঙের তুলনায় একটু বেশি চকচকে আর নতুন মনে হচ্ছিল। আসিফ সাহেব তখনই শুদ্ধকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলো বিষয়টি। শুদ্ধ আড়ালকে বাড়িতে রেখে আবারও ফেরত এসেছিলো সেখানে। আসার পর সেই দেয়াল ভেঙে কোন টাকা পয়সা নয় পাওয়া গেছে সতর্কতার সহিত প্যাকেট করে রাখা অনেকগুলো কাগজপত্র ও কিছু দলিল। সেইগুলোই এখন গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে সবার।

শুদ্ধ তার বাবা আর সোহাগকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে উকিল কাগজগুলো দেখে কি বলেছেন? আসিফ সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন,

‘এই কাগজগুলো আড়ালের জন্য মৃত্যু ফাঁদ।’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here