আমি পদ্মজা – ৩৬
____________________
পদ্মজা ঘরের চৌকাঠে পা দিল মাত্র। আমির রিদওয়ানকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলল, ‘তোকে না করেছিলাম। বার বার না করেছি। তবুও শুনলি না।’
রিদওয়ান শক্ত দুই হাতে আমিরকে ধাক্কা মেরে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। আমির আলমারির সাথে ধাক্কা খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে উঠে। রিদওয়ানের দিকে তেড়ে আসে। নূরজাহান দৌড়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ান। চিৎকার করে বললেন, ‘কী অইছে তোদের? তোরা এমন করতাছস কেন?’
‘দাদু, সরে যাও। মাদা** বাচ্চারে আমি মেরে ফেলবো।’
‘তুই কী ভালা মানুষের বাচ্চা?’ তেজ নিয়ে বলল রিদওয়ান।
আমির নূরজাহানকে ডিঙিয়ে রিদওয়ানকে আঘাত করতে প্রস্তুত হলো। তখন মজিদ হাওলাদারের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে,’যে যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’
আমির মজিদ হাওলাদারকে এক নজর দেখে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। পরেই জ্বলে উঠে বলল, ‘আব্বা,আপনি জানেন না ও কী করছে? পদ্মজা গোসল করছিল,ও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল।’ আমিরের কণ্ঠ থেকে যেন অগ্নি ঝরছে।
ফরিনা,আমিনা,রানি সহ হাওলাদার বাড়িতে কাজ করা দুজন মহিলা ছিঃ ছিঃ করে উঠল। রিদওয়ান সাবধানে প্রশ্ন করল,’তোর কাছে কী প্রমাণ আছে?’
‘প্রমাণ লাগবে? আমি জানি এটা তুই ছিলি। বিয়ের রাতেও তুই পদ্মজার কাছে গিয়েছিলি।’
‘অপবাদ দিবি না।’
‘তুই ভালো করেই জানিস আমি অপবাদ দিচ্ছি না।’
‘তুমি কী করে শত ভাগ নিশ্চিত হতে পারছো ছেলেটা রিদওয়ানই ছিল?পদ্মজা দেখেছে? নাকি তুমি? ‘ বললেন মজিদ।
‘আব্বা, কেউ দেখেনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই চরিত্রহীনটা রিদু। কারণ, আমার আগে থেকে ও পদ্মজাকে পছন্দ করতো।’
পদ্মজা বিস্ময়ে তাকাল। কী হচ্ছে,কী সব শুনছে? ফরিনার দুই ঠোঁট হা হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। আমিনা বললেন, ‘আপা,আমি আগেই কইছিলাম এই ছেড়ি বিনাশিনী। এই ছেড়ির রূপ আগুনের লাকান। এই ছেড়ির জন্যে এখন বাড়ির ছেড়াদের ভেজাল হইতাছে।’
আমির আমিনার কথা শুনেও না শোনার ভান করল। মজিদকে বলল, ‘আব্বা,আপনি এর বিচার করবেন? না আমি ওরে মেরে ফেলব? আর আম্মা, এরপরও বলবা এই বাড়িতে রেখে যেতে পদ্মজাকে। আমাকে তো ফিরতেই হবে ঢাকা। পদ্মজাকে রেখে আমি কিছুতেই যাব না। মনে রেখো। আব্বা তুমিও কথাটা মনে রেখো, আমি তোমার ব্যবসায় আর নেই। যদি পদ্মজা আমার সাথে ঢাকায় না যায়।’
‘তুমি যেখাবে যাবা তোমার বউতো সেখানেই যাবে। বউ রেখে যাবা কেন? আর রিদওয়ান তুমি আমার সাথে আসো। তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।’
মজিদ হাওলাদার বেরিয়ে যান। আমির পদ্মজার হাতে ধরে পদ্মজাকে বলল, ‘আর কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।’
খুশিতে পদ্মজার চোখের তারায় অশ্রু জ্বলজ্বল করে উঠে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে বোঝায়, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করি।’
___________
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্ত। এমন সময় হাওলাদার বাড়ির রাতের রান্না করা হয়। মগা এক ব্যাগ মাছ দিয়ে গেছে। লতিফা মাছ কাটছে। লতিফা এই বাড়ির কাজের মেয়ে। সবাই ছোট করে লুতু ডাকে। ফরিনা ভাত বসিয়েছেন। আর অনবরত বলে চলেছেন, ‘আমি এই বাড়ির বড় বান্দি। দাসী আমি। বাবুর বাপ দাসী পুষে রাখছে। দাসী পালে। সারাদিন কাম করি। অন্যরা হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে। মরণ হয় না আমার। মরণই আমার একমাত্র শান্তি।’
পদ্মজা গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর রান্নাঘরের আশেপাশে ঘুরছে। ফরিনার সব কথাই তার কানে আসছে। তার গায়ে লাগছে না। বরং হাসি পাচ্ছে। সে বহুবার রান্নাঘরে গিয়েছে কাজ করার জন্য। ফরিনা তাড়িয়ে দিয়েছেন। কাজ করতে হবে না বলেছেন। আর এখন বলছেন,কেউ সাহায্য করে না। পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্না ঘরে ঢুকল। বলল, ‘আম্মা, আমি সাহায্য করি?’
‘এই ছেড়ি তুমি এতো বেয়াদব কেরে? কতবার কইছি তোমার সাহায্য করতে হইব না।’
‘না…মানে আপনি বলছিলেন, কেউ সাহায্য করে না।’
‘তোমারে তো বলি নাই। তোমার গায়ে লাগে কেন?’
‘মেঝে ঝাড়ু দিয়ে দেই?’
‘তোমারে কইছি আমি? তুমি যাও এন থাইকা। যাও কইতাছি।’
পদ্মজা বেরিয়ে আসে। বাসায় লাবণ্য নেই,আমির নেই। কার কাছে যাবে? রানি আছে! রানির কথা মনে হতেই পদ্মজা রানির ঘরের দিকে এগোল। যাওয়ার পথে সন্ধ্যার আযান ভেসে আসে কানে। তাই আর সেদিকে এগুলো না। নিজের ঘরের দিকে হেঁটে গেলো। নামায পড়তে হবে।
নামায পড়ে, সূরা ইয়াসিন একবার পড়ল। এরপর জানালা লাগাতে গিয়ে রানিকে দেখতে পেল। সেদিনের মতো জঙ্গলের ভেতর ঢুকছে। আর কিছু মুহূর্ত পার হলে চারিদিক রাতের গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন সময় কী করতে যাচ্ছে ওখানে? এতো সাহসই কী করে হয়? পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়। আজ সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লাবণ্য সবে মাত্র সদর ঘরে ঢুকেছে। পদ্মজাকে তাড়াহুড়ো করে কোথাও যেতে দেখে বলল, ‘কী রে, কই যাস?’
পদ্মজা চমকে উঠল। এরপর বলল, ‘এইতো…এইখানেই। কই ছিলি? আচ্ছা, পরে কথা বলব আসি এখন।’
লাবণ্য ঠোঁট উল্টে পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এরপর মনে মনে ভেবে নিল, দুই তলা থেকে হয়তো দেখেছে দাভাই আসছে। তাই এগিয়ে আনতে যাচ্ছে। সে নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা কখনো বাড়ির পিছনের দিকে যায়নি। এই প্রথম যাচ্ছে। বাড়ির ডান পাশে বিশাল পুকুর। কালো জল। অথচ,বাড়ির সামনের পুকুরের জল স্বচ্ছ।
দুই মিনিট লাগে শাক-সবজির ক্ষেত পার হতে। বাড়ির পিছনে এরকম শাক-সবজির বাগান আছে সে জানতো না। এরপর পৌঁছালো জঙ্গলের সামনে। সেখান থেকে অন্দরমহলের দিকে তাকাল। ওইতো তাদের ঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জানালাও দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকে খেয়াল করল, সেই জানালার গ্রিল ধরে কেউ তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ঠাওর করার চেষ্টা করল এটা কার ঘর। মনে হতে বেশি সময় লাগল না। এটা রূম্পা ভাবির ঘর। তবে কী তিনিই তাকিয়ে আছেন? পদ্মজা আবার তাকাল। রূম্পা জানালার পর্দা সরিয়ে হাত নাড়ায়। পদ্মজা মৃদু হেসে হাত নাড়াল। দূর থেকে রুম্পার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে,সে কিছু বলতে চায় পদ্মজাকে। তার ভেতর লুকানো আছে কোনো এক রহস্যময় গল্প।
‘ভাবি এইনে কী করেন রাইতের বেলা?’
ভূমিকম্পে ভূমি যেভাবে কেঁপে উঠে,পদ্মজা ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠল। তাকিয়ে দেখল, মদনকে। সে জঙ্গলের ভেতর থেকেই এসেছে। পদ্মজা আমতাআমতা করে বলল, ‘হা…হাঁটতে এসেছিলাম।’
‘এই রাইতের বেলা?’
‘বিকেল থেকেই। এখন ফিরে যাচ্ছিলাম।’
‘চলেন এক সাথে যাই। জায়গাডা ভালা না ভাবি। আপনি হইছেন সুন্দরী মানুষ। জ্বিন,ভূতের আছর পড়ব।’
‘আপনি যান। আমি আসছি।’
‘আর কী করবেন এইহানে?’
পদ্মজা জঙ্গলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়! সব জঙ্গল অযত্নে বেড়ে উঠলেও এই জঙ্গল যেন যত্নে বেড়ে উঠা। সে অন্ধকারে খোঁজার চেষ্টা করল রানিকে। পেল না। এদিকে মদনের সাথে না গেলে সে বাড়িতে যদি বলে দেয়। তাহলে অনেকের প্রশ্নের সম্মূখীন হতে হবে। আর একটার পর একটা মিথ্যে বলতে হবে। পদ্মজা মনে মনে পরিকল্পনা করে, মদনের সাথে বাড়ি অবধি গিয়ে আবার চলে আসবে।
চলবে…
®ইলমা বেহরোজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here