#আজি_বিজন_ঘরে (৩-৪)
৩.
বাসায় আজ কেউ নেই। মা আর তার বাবা (সৎ) গিয়েছেন বিয়ের দাওয়াতে। আসতে দেরি হবে। তাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সামনে পরীক্ষা বলে সে যায়নি। কিন্তু এখন কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি চেপে বসছে। মনে হচ্ছে কোন একটা বিপদ হবে। বই নিয়ে অনেক্ষন ধরেই বসে আছে কিন্তু পড়া হচ্ছে না। ভাইয়েরা (সৎ) যে যার কাজে। সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষন পরেই রাজন এল। অর্পা দরজা খুলে দিল।
-তুমি এসেছো। আমার একা একা ভয় লাগছিল।
-ভয় কিসের। এক কাপ চা কর তো।
চা বসিয়ে দিয়ে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চা দিতে রাজনের ঘরে গিয়ে দেখলো সে কেমন উদভ্রান্ত্রের মত পায়চারি করছে। সে চা টা টেবিলে রাখতেই মনের ভেতরে কেউ বলল, “পালিয়ে যা এক্ষুনি।”
কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে হয়ে গেছে। রাজন তাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল। তার ওপর যখন ঝাপিয়ে পড়লো তখন সে ভয়ে চিৎকার দিতেও ভুলে গেল। কিছুক্ষন পরে তাকে ছেড়ে দিয়ে রাজন বিছানায় উঠে বসল। কোন রকমে সে ও ঘর থেকে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করল। সেখানেই বসল। কি থেকে কি হয়ে গেল? যাকে নিজের বড় ভাইয়ের মত ভেবেছে সে এমন করবে?
কতক্ষন হয়্ছে অর্পা জানে না। দরজায় কলিং বেল বাজছে। দরজা খুলে দিয়ে রাজন বেরিয়ে গেল। রাশেদা কাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে মেয়ের ঘরে এলেন। দরজা বন্ধ দেখে ধাক্কা দিলেন। বাড়ির মধ্যে দরজা লাগানোর দরকার কি? দরজা খুলেই সে কাঁদতে লাগলো। অনেক্ষনপর যখন সে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা বলতে পারলো তখন রাশেদা তার মুখ চেপে ধরলো।
-যা হবার হয়ে গেছে। এইসব কথা কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে বুঝেছিস?
মায়ের হাতটা সে সরিয়ে দিল ঝটকা দিয়ে।
-কি বলছ এসব মা?
রাশেদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কি করা উচিত তার? মেয়ের পাশে দাঁড়াবেন নাকি নিজের নিশ্চিত ভবিষ্যত রক্ষা করবেন। হঠাৎ করেই উঠে বসলেন। তারপর ঝড়ের বেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মায়ের আচরণে অর্পার গা গুলাতে শুরু করলো। বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে পানির নিচে বসে পড়ল। অনেক্ষন পর দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনে সে বেরিয়ে এল। রাশেদা তার হাতে ঔষধ আর পানি ধরিয়ে দিলেন।
-এইটা কি?
-এত জানার তোর দরকার নেই। চুপ করে খেয়ে নে। কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
-ছিহঃ মা। তুমি এত নীচ।
-হ্যা আমি নীচ। এখন থেকে আমি যা বলবো তাই শুনবি।
মায়ের এমন আচরন দেখে সে চুপ করে গেল। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেলল হলে চলে যাবে। এমনিতেও অনেকদিন ধরে ভাবছিল হলে ওঠার কথা কিন্তু মা ওই বাড়িতে আছে বলেই এখানে থাকতো। এখন আর কোন ভাবেই এখানে থাকা সম্ভব না।
তার সৎ বাবা লোকটা অবশ্য খারাপ না। তার চলে যাবার কথা শুনে খুব অবাক হলেন। তবুও মা যখন বলল হলে থাকলেই ভাল। পড়ালেখার সুবিধা হবে তখন আর কিছু বললেন না।
পরের মাসেই হলে এসে উঠলো। যে কদিন ও বাড়িতে ছিল ঘর থেকে বাহির হয়নি খুব একটা। মা নিজেও সব সময় তার সাথে ছিল। আসবার সময় অবশ্য মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছিল খুব। কিন্তু ওই বাড়িতে তোর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। হলে এসে নিজের বিছানায় শুয়েই মনে হল বুকের ভেতরে জমে থাকা বিষাক্ত কষ্টগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। তার জীবনটা এত কষ্টের কেন? চোখ বন্ধ করতেই নিজের বাবার মুখটা দেখতে পেল। নেশায় আশক্ত একটা লোক। প্রতিদিন তার মাকে টাকার জন্য মারছে। আজ এটা কাল ওটা বাসা থেকে নিয়ে বিক্রি করছে। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে মা মামাদের কাছে এল। তালাক হবার বছর খানেক পরে মামারা আবার মায়ের বিয়ে দিল। প্রথম কয়েক মাস সে মামার বাসাতেই ছিল। তারপর একদিন মা তাকে নিয়ে এলেন রায়েরবাজারের এই বাসায়। কাছাকাছি বয়সের দুইটা ভাই পেয়ে সে তো খুশিই হয়েছিল। তাহলে এতদিন পরে কেন সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল।
-কি রে? এসেই শুয়ে পড়েছিস যে?
মিতার কথা শুনে উঠো বসলো অর্পা। মিতা আর শান্তা সামনের বেডে বসে পড়ে।
-শান্তি লাগতেছে তাই।
-কি হয়েছে বলতো? তোর আচার আচরণ সুবিধার মনে হচ্ছে না। চেহারাও কেমন অন্যরকম। কদিন ক্লাসেও এলি না।
-একটু সময় দে। বলবো এক সময়।
-রেডি হয়ে নে। চল তাহলে আজ বাইরে খাওয়া দাওয়া করি।
-আজ থাক।
-থাকবে কেন ? ওঠ।
তিনজনে মিলে হলের সামনে এসে রিক্সা ঠিক করে। যদিও তিন জন রিক্সায় বসতে মানা তবুও কে শোনে কার কথা। যাবে তো সামনেই।
ক্লাস শেষে অর্পা বেরিয়ে আসতেই রাজন সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজনকে দেখে সে ভয় পেয়ে একপাশে সরে গেল।
-তোর সাথে কথা আছে।
-আমার আপনার সাথে কোন কথা নাই। আপনি এখান থেকে চলে যান। তা না হলে আমি আমার বন্ধুদের ডাকবো।
-তুই এভাবে বাসা থেকে চলে এলি কেন?
-তাতে মনে হয় আপনার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। তাই না?
-আমার ভুল হয়ে গেছে।
-ভুল। এটাকে আপনি ভুল বলেন? আপনি না সম্পর্কে বড় ভাই হন।
-সত্যি ভুল হয়েছে রে। কি থেকে যে কি হয়ে গেছে। সেদিন বন্ধুরা মিলে উল্টা পাল্টা খেয়েছিলাম। আমার সত্যি নিজের উপর কোন কন্ট্রোল ছিল না। আমাকে মাফ করে দে।
-আমি এসব শুনতে চাই না। আপনাকে আর কখনও যেন আশেপাশেও না দেখি।
অর্পা ক্লাসরুমের দিকে ফিরে যায়। মিতা বা শান্তার সাথেই ফিরতে হবে।
৪.
বেশ আরাম করেই ঘুমিয়েছে অর্পা। কিছুক্ষন অবশ্য জেগে বসেছিল লোকটার জন্য। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই বুঝতে পেরেছিল উনি রাতে আসেননি এঘরে। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে বের হয়েই দেখতে পেল বুয়া ঘর পরিস্কার করছে। নীচে নেমে দেখলো কোথাও কেউ নেই। সে ফুপুর ঘরের দিকে গেল। মনোয়ারা বারান্দায় বসে আছেন তসবি হাতে। সে গিয়ে পাশে বসলো।
-বৌমা উঠছো?
-জ্বি ফুপু।
– রিজভী বাবা তো অফিস চলে গেছে সকালে।
-আমি আসলে বুঝতেই পারিনি এত বেলা হয়ে গেছে।
-তুমি নাস্তা করে নাও। নতুন জায়গায় সব কিছুর সাথে মানায় নিতে তো সময় লাগবেই। মেরী…
-জ্বি আম্মা।
-বৌমাকে নাস্তা দাও।
নাস্তা করে সে নিজের ঘরে এল। লোকটা তো বেশ অদ্ভুত। রাতেও এলনা। আবার সকালে দেখা না করেই চলে গেল। মিতাকে ফোন করলো।
-কিরে এত সকালে তুই?
-সকাল কই দশটা বাজে।
-তা জামাই কই? রোমান্স করা বাদ দিয়ে আমাকে কেন ফোন দিলি।
-খালি উল্টা পাল্টা কথা।
-এখনই তো উল্টা পাল্টা কথার সময় বন্ধু।
-জরুরী কথা বলবো, আর উনি আছেন ফাজলামি নিয়ে।
-কেন কি হয়েছে?
-লোকটাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।
-সময় তো একটু লাগবে। আর এক্ষেত্রে তো বেশী লাগবে। হঠাৎ করে কেন যে এমন সিদ্ধান্ত নিলি। কত বেশী বয়সের ডিফারেন্স। কত করে নিষেধ করলাম আমরা দুজনে। কারো কথাই শুনলি না। কোথায় উনি।
-ঘুম থেকে উঠে দেখি অফিসে চলে গেছেন।
-তুই ওনাকে একটা ফোন কর।
-ওনার নাম্বার তো নেই?
-কি বলিস। ওনার পিএর নাম্বার আছে না?
-আছে।
-ওই ব্যাটার কাছ থেকে নে।
-আচ্ছা।
-সময় দে। আর লোকটাকে বোঝার চেষ্টা কর।
-আচ্ছা পরে কথা বলবো তাহলে।
-ভাল থাকিস।
শফির নাম্বার ফোনে সেভ করাই ছিল। রিং হবার সাথে সাথেই কল রিসিভ করল শফি।
-আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাডাম।
-ওয়ালাইকুমআসসালাম। একটা দরকার ছিল।
-জ্বি ম্যাডাম বলেন।
-আপনার স্যারের ফোন নাম্বারটা যদি দিতেন।
-আচ্ছা ম্যাডাম আমি এখুনি পাঠাচ্ছি। স্যারকে কি কিছু বলতে হবে? ফোন কি দেবো?
-নাহ ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ফোন নাম্বারটা ম্যাসেজ করেছে শফি। নাম্বারটা ফোনে সেভ করলো। কিন্তু ফোন করে কি বলবে? ফোন করতে কেমন একটা সংকোচ বোধ হচ্ছে। পরে ফোন করলেই হবে। কদিন দেখা যাক। এখানে তো তার কোন ভয় নেই। রাজন প্রতিদিন এমন বিরক্ত করতে শুরু করেছিল যে যখন অনলাইন পেজটায় পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনটা দেখেছিল তখন ভেবেছিল যদি এমন কাউকে বিয়ে করে এটলিস্ট সে বেঁচে যাবে। হয়তো তার ভয়াবহ অতীত নিয়ে লোকটা মাথা ঘামাবে না। আর সেই কারণেই সে সাথে সাথে যোগাযোগ করেছিল।
চলবে….
এমি