#আজি_বিজন_ঘরে (শেষ পর্ব)

১০.

আঁধার থাকুক দিকে দিকে
আকাশ-অন্ধ-করা,
তোমার পরশ থাকুক আমার-
হৃদয়-ভরা।

রিজভীর মাথায় সারাদিন ধরে গানের এই লাইনগুলো ঘুরছে। বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়ার অনেক ফ্যাসাদ। নিজের মনের কথা, অনুভূতি কোনো কিছুই প্রকাশ করা যায় না। কবে থেকে ঠিক করে বসে আছে যে ঘুরতে যাবে কোথাও। কিন্তু কিছুতেই বলার সাহস পাচ্ছে না। আজ বলতেই হবে। অর্পার পাসপোর্ট করতে দিয়েছিল। আজ দিয়ে গেছে। শফিকে নেপাল ট্রিপ প্লান করতে বলে সে অফিস থেকে বেরিয়ে প্রথমে আড়ংয়ে গেল। একটা সাদার ওপরে সাদা কাজের মসলিন শাড়ী আর ম্যাচিং করে সিলভারের জুয়েলারি কিনলো। বাসায় ফিরেই তাড়াতাড়ি করে দোতলায় উঠলো। এক তলা থেকে দোতলায় উঠতেই হাঁপিয়ে গেল সে। এতটুকু উঠতেই তোমার এই অবস্থা আবার বউ নিয়ে পাহাড়ে ওঠবার সখ হয়েছে। তুমি পারো ঢং করতে। নিজেকে নিজেই গালি দিল মনে মনে।

-অর্পা ….. অর্পা…
দরজা নক না করেই সে দুম করে ঘরে ঢুকলো। কাজের সময় যদি এই মেয়েকে পাওয়া যায়। কোথায় গেল যে?
-টগর….
টগর ছুটে এল।
-তোর আপা কোথায়?
-আপা তো হাসপাতালে গেছে ফুপুকে দেখতে।
-আমাকে বলে গেল না কেন?
-প্রায় প্রতিদিনই তো যায়। আর আপনার সাথেই তো আসে।
তাইতো আজ তো সব কিছু ভুলে বসে আছে।
-এই ভুল কি করে হল তার?
টগর চুপ করে দাড়িয়ে থাকলো। সে এই কথার কি উত্তর দেবে।
-আচ্ছা তুই যা।
টগর চলে যেতেই জিনিগুলো বিছানার একপাশে রেখে শুয়ে পড়লো। বাহঃ কি সুন্দর তার ঘর দখল নিয়ে বসে আছে। তাকে ডেকে আনলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত নাকি? গুরুজনেরা এই কারণেই মনে হয় বিয়ের রাতেই বেড়াল মারতে বলে। তিনি তো তা করেন নি উল্টা বিড়ালকে আদর দিয়ে মাথায় তুলেছেন। আজ আসুক। এর একটা হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বে।

আবার উঠে বসল। আচ্ছা এসব কি ভাবছে সে। মাথা কি পুরাই নষ্ট হল নাকি? তাকে এখানে দেখলে কি ভাববে অর্পা। নিচে নেমে এল হুড়মুড় করে। হাসপাতালে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো।

অর্পা বাসায় ঢুকতেই টগর দৌড়ে এল।
-কিরে? কি হয়েছে?
-ভাইজান আপনার খোঁজে বাড়ি মাথায় তুলছে।
সে ফোন চেক করলো। ফোন তো করেনি। আর আজ তো হাসপাতালে আসতে না দেখে সে ভেবেছে কাজে আটকা পড়েছে।
-কোথায় তোর ভাইজান?
-নিজের ঘরে।
-আচ্ছা আমি দেখছি। তুই দুইকাপ কফি বানায়ে ফেল।
-ঘরে এসে বিছানায় রাখা শপিং ব্যগগুলো দেখে সেগুলো খুলে দেখলো। কি সুন্দর শাড়ীটা। চট করে গোসল সেরে শাড়ী আর গয়নাগুলো পরলো। চোখে যত্ন করে কাজল লাগালো। ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক। চুল ভেজা বলে ছেড়েই রাখলো। বেশী বেশী হয় যাচ্ছে না তো? কিন্তু সে তো তার একান্ত আপন মানুষটার জন্যই সাজছে। টুং করে শব্দ হতেই সে ফোনটা হাতে নিল।

“চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে
দিন কেটেছে কোনোমতে,
এখন সময় হল তোমার কাছে
আপনাকে দিই আনি ॥”

ওরে বাবা, এই লোক টেক্সট করতেও জানে দেখি।

লাইব্রেরির দরজা খোলার শব্দ হতেই রিজভী বেরিয়ে এল। সে কি ভুল দেখছে? এত সুন্দর মানুষ হতে পারে? নিজেই নিজের হাতে চিমটি কাটলো।
-যাহঃ বাবা।
-কি হয়েছে?
-আজকেও পারলাম না।
-কি পারলেন না।
-বেড়ালটা মারতে।
অর্পাকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে সে হা হা করে হেসে উঠলো।
-জিনিস পত্র গুছিয়ে নাও। আমরা সামনের সপ্তাহেই ঘুরতে যাব।
-এই সময়? ফুপুও তো হাসপাতালে।
-ফুপুর সব ব্যাবস্থা করা হবে। তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
-আমি তাহলে টগরের কফি এখানেই দিতে বলি?
-আরে না। চল বাইরে থেকে ডিনার করে আসি।
-পার্সটা নিয়ে আসি তবে।
-তোমাকে সুন্দর লাগছে।
অর্পার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে ভালই লাগছে। কত সহজে যে মেয়েরা লজ্জা পায়।

১১.

মনোয়ারা কদিন হল বাসায় এসেছেন। তার বাম পাশটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। রিজভী যত্নের চুড়ান্ত করছে। দিন রাতের জন্য দুজন নার্স। মেরী তো আছেই। রিজভী প্রতিদিন সকালে নার্সের সাথে কথা বলে। সারাদিন কি করতে হবে মেরীকে বুঝিয়ে দিয়ে অফিসে যায়। বউটাও একটু পরপর আসে।

তার জন্য ওরা যে প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে যাবে তা তিনি কল্পনাও করেননি। কত ছোটাছুটি ওদের। কিন্তু তিনি কি এসবের যোগ্য। সত্যিটা জানলে কি কেউ তাকে মাফ করবে?

অর্পা এসে তার পাশে বসলো। খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। তিনি নিজেই তো ভুল করেছিলেন আর সেই ভুলের মাশুল তাকে তো দিতেই হত। তিনি সেটা না বুঝে অবুঝ হয়ে গেলেন। প্রতিশোধের নেশা আর হিংসায় তিনি পাগল হয়ে গিয়ে অনাচারের পর অনাচার করলেন। এখন কি এভাবেই প্রাশচিত্ত করতে হবে। আল্লাহ আমাকে মাফ করো। তিনি কাঁদতে লাগলেন।

-কি হয়েছে ফুপু ? শরীর কি খারাপ লাগছে? কাঁদছেন কেন? দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
তার কথা জড়িয়ে গেছে। কথা বলতেও অনেক কষ্ট হয়। যাও বলেন মেরী ছাড়া কেউ তেমন বুঝতে পারে না। তবুও বলতে চাইলেন। ছটফট করতে লাগলেন। নার্স তাকে চলে যেতে বলল।

অর্পা বেরিয়ে যেতেই তিনি রিজভীর মাকে দেখতে পেলেন। নার্স মেয়েটার পেছনে দাঁড়িয়ে। মুখটা হাসি হাসি। তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেন। নার্স মেয়েটা চলে যাচ্ছে কেন? মেরী কোথায়?

লায়লা এসে তাকে ছুয়ে দিল। বরফ শীতল স্পর্শে তার নিশ্বাস বন্ধ হতে শুরু করলো।
-তোমাকে নিতে এলাম মনোয়ারা। কতদিন ধরে এ বাড়িতেই ঘুরছি বলোতো। তোমাকে ছেড়ে তো যেতে পারছি না।
তিনি বলতে চাইলেন তুমি চলে যাও। শুধু গো গো শব্দ হতে লাগলো।
-আমাদের মেরেও তোমার শান্তি হয়নি? আমার ছেলের জীবনটাও নষ্ট করতে চাইছো? তা তো হতে দিতে পারি না। তাই তোমাকে নিতে এলাম।দেখ রোদেলাও এসেছে।
তিনি দরজার কাছে রোদলাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন।

মেরী দৌড়ে অর্পার কাছে এল।
-আপা ফুপুআম্মা যেন কেমন করছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।

নার্স ততক্ষনে হাসপাতালে এম্বুলেন্সের জন্য কল করেছে। সে রিজভীকে কল করলো। হাসপাতালে নেবার পথেই মনোয়ারা মারা গেলেন। গ্রামের বাড়িতে রিজভীদের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা মা আর রোদেলার কবরের পাশেই তাকে দাফন করা হল। অর্পাকে নিয়ে রিজভী বেশ কয়েকদিন গ্রামের বাসাতেই থাকল।

গ্রাম থেক ফিরে এসে অর্পার এই বাসায় থাকতে কেন জানি আর ভাল লাগে না। এতবড় বাড়িটি যেন খাঁ খাঁ করে। শুধু একটা মানুষ চলে যাওয়াতেই তার এমন লাগছে। না জানি রিজভীর কত কষ্ট হয়। সে তো ছোট থেকেই এ বাড়িতে। ইউনিভার্সিটিও বন্ধ। কিছু করার নেই তেমন। মেরী এসে দরজায় নক করলো?

-আপা একটু নিচে আসবেন?
-কেন বলতো?
-ফুপুআম্মার ঘর পরিস্কার করতেছি। আলমারিতে কি আছে দেখে দিতেন যদি। গরীব মানুষদের দিয়ে দিতাম।
-চাবি তো আমার কাছে নেই?
-ভাইজানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে রাখছি।

আলমারি খুলে অর্পা অবাক হয়ে যায়। কত রকম জিনিস। সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছেন। ছোট বেলার খেলনাগুলোও জমিয়ে রেখেছেন। কত রকম শাড়ী। লকার খুলে বেশ কিছু গয়না আর একটা ডায়েরী পেল। সেগুলো নিয়ে সে উপরে এল। গয়নাগুলো কি করবে তা রিজভীর কাছে শুনতে হবে। গয়নাগুলো রেখে সে ডায়েরীটা নিয়ে বসলো। অনেক পুরোনো ডায়েরী। এলোমেলো লিখা। পড়তে গিয়ে সে ভয়ে শিহরিত হল। মানুষ এমনটাও করতে পারে? তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সবাই তো আপনজন ছিল। বাথরুমে গিয়ে সে হাতমুখ ধুয়ে মাথায় পানি ঢাললো অনেক্ষন। ঘরে এসে বিছানায় বসলো। ডায়েরীটা হাতে নিল। এটা কিছুতেই কারো হাতে পড়া চলবে না। ছাদে চলে এল। টুকরো টুকরো করে ছিড়ে সেটাকে জ্বালিয়ে দিল।

রাত্রে খাবার টেবিলে বসে অর্পা কিছু খেতে পারছিল না। খাবার নাড়াচাড়া করছে অনেক্ষন থেকে।
-কি হয়েছে বলোতো? মুখ এমন শুকনো কেন?
-শরীরটা ভাল লাগছে না।
রিজভী তার কপালে হাত রাখলো। গা বেশ গরম।
-জ্বর এসেছে তুমি আমাকে বলবে না?
-তেমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে।
রিজভী খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়ল।
-আসো।
অর্পা তার পেছনে পেছনে এল।
-শুয়ে থাকো। আমি মেরীকে হাল্কা খাবার কিছু দিতে বলছি। সেটা খেয়ে ঔষধ খাও।
রিজভী যাবার জন্য ঘুরতেই সে রিজভীর হাতটা ধরে ফেলল।
-কিছু বলবে?
-আপনি কোথাও যাবেন না প্লিজ।
-যাইনি তো। বাসাতেই তো আছি।
-না এখানেই থাকবেন। আমি একা থাকতে পারবো না।
-কি হয়েছে হঠীৎ তোমার? ভয় পেয়েছো?
-কিছু হয়নি। আপনি টগরকে আপনার জিনিসপত্র এখানে দিতে বলেন।
-আচ্ছা ঠিক আছে বলছি। তুমি শুয়ে থাকো। আমি এক্ষুনি আসছি। টগর একা পারবে না। আর আমার জরুরী জিনিসপত্রও আছে। আর মেরীকেও তো খাবারের কথা বলতে হবে।

অর্পা তার হাত ছেড়ে দিল।

পরিশিষ্টঃ

ছোট্ট ছিমছাম আকাশনীল একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। চারিদিকে বেশ কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া আর কদম গাছ। বাড়ির ছাদ থেকে চাইলেই ফুল পেড়ে নেয়া যায়। মেইন গেট খোলার শব্দে অর্পা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনের পোর্চে এসে দাঁড়ালো। অরণ্য গাড়ির দরজা খুলে দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
-তুমি এয়ারপোর্টে এলে না কেন?
-আমি আসলে তোর পছন্দের খাবার রান্না করবে কে?
-বাবা থাকলে এই সব অজুহাত দিতে পারতে না মা।
-ভেতরে চল আগে। তারপর যত পারিস রাগ করিস।
-আগে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর মজা দেখাচ্ছি তোমাকে।

অরণ্য তার ঘরে যেতেই সে নিজের ঘরে আসলো। রিজভী তাদের ছেড়ে গেছে প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে। ছেলে তখন মাস্টার্স করছে কানাডায়। বাবার অসুস্থতার খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল। তারপর এই এলো।

পাহাড়সম স্মৃতি নিয়ে সে শুধু থেকে গেল এখানে। এই বাড়িতে এসেই পুরোনো বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিল রিজভী। তারপর অরণ্য হলো। তখন তো আর অফিসেও যেত না। সারাদিন ছেলেকে নিয়ে থাকতো। ছেলেও বাবা অন্তপ্রাণ। ছেলেকে আন্ডারগ্রাডুয়েট করতে কানাডা পাঠিয়ে দিল। তখন প্রতিবছর অরণ্য সামারে দেশে এসেছে। তারা দুজন মিলে এয়ারপোর্টে যেত তাকে নিয়ে আসতে। আজ কি করে সে একা যাবে?

-মা।
অরণ্য মাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ছেলের সামনে একটুও কাঁদবে না প্রতিজ্ঞা করলেও চোখের পানি যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
-মা কাঁদবে না তো।
-আচ্ছা কাঁদবো না যা।
-এবার তোমাকে নিয়ে যাব।
-তাই হয় নাকি? এখানের কাজ কে দেখবে?
-শফি কাকু আছে তো।
-নারে বাবা। তোক বিয়ে দিয়ে দেই। বউ নিয়ে যা।
-কি যে বল মা? এখুনি কিসের বিয়ে।
-কেন রে? বাবার মত বুড়ো হয়ে বিয়ে করতে চাস?
অরণ্য হা হা করে হাসে। ঠিক যেন রিজভী হাসছে। অর্পা তাকিয়ে থাকে। অবিকল সেই মুখ। সে অরণ্যের চুলে বিলি কাটতে থাকে।
-আমার কিন্ত একজনকে খুব পছন্দ ।
-তুমিও বিয়ে করতে চাও ? তাহলে তো ভালই। আমার চিন্তা কিছুটা কমে।
-তোর জন্য পছন্দরে পাগল?
-কে বলতো?
-তোর শফি কাকুর মেয়ে শাহিরা।
সে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে।
-তুমি সব জানতে?
-বোকা ছেলে। আমি জানবো না। টেবিলে খাবার দিতে বলি। শাহিরাও
চলে আসবে এক্ষুনি। ওদের আসতে বলেছি।
-তুমি হচ্ছ বেস্ট মা।
-হয়েছে আর তেল দিতে হবে না। নীচে যা তো। ঐ বোধহয় ওরা এসে গেছ।
-তুমি যাবেনা?
-আসছি।

সে আলমারি খুলে তার বিয়ের গয়নাগুলো বাহির করলো। বাক্সোটা খুলে ছুয়ে থাকলো কিছুক্ষন। মানুষটা না থেকেও সবখানে আছে। বেডসাইড টেবিলে রিজভী আর তার ছবিটার দিকে তাকালো। তোমাকে ভুলে থাকা তো অসম্ভব।

যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল না ই দেখা দেয় নয়নকোণে
তবু মনে রেখো…..

চোখ মুছে সে বেরিয়ে এল সে। ওদের কথা শোনা যাচ্ছে। শাহিরা বড় ভাল মেয়ে। তার ছেলে সুখে থাকবে।

সমাপ্ত।
এমি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here