আকাশে অনেক তারা – ৭

——-
মুহিব লেখাদের ফ্ল্যটে এসে ফিরে গেল নিরাশ হয়ে। অন্যদিন তো লেখা দরজা খুলেনি। সেদিনের পর থেকে লেখা নিজে থেকে কোনো যোগাযোগ করেনি মুহিবের সঙ্গে। মুহিব নিজেই সপ্তাহ পরে খোঁজ নিতে আসে। প্রথমদিন লেখা কথা বলেছিল। সেই কথায় অন্যদিনের মত কোনো উষ্ণতা ছিল না। আর না ছিল কোনো হৃদ্যতা। লেখা যথেষ্ট স্বাভাবিক ছিল তবুও যেন বিরাট অস্বাভাবিকতা টের পেয়ছিল মুহিব। বারবার করে বলে যাওয়া সত্ত্বেও যখন মুহিব ফোন দেওয়ার পরে ফোনটা ধরেনি লেখা তখনই মুহিব পূর্ণভাবে টের পায় তার অস্বস্তি সঠিক ছিল। লেখা অস্বাভাবিক ছিল তখন। মুহিব পরদিন আবারও আসে। সেদিন লেখা সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। মুহিব যেন দূরত্ব রেখে চলে এখন থেকে। মুহিব মুহিবের মত থাকুক। লেখা লেখার মত থাকবে। তাঁরা বড় হয়েছে। দু’জনের পৃথক জীবন রয়েছে। সেদিনই নিধির ব্যপারটা নিয়ে ক্ষমা চেয়েছিল মুহিব। তার প্রেক্ষিতে লেখা স্পষ্ট জানিয়েছিল,’দেখ মুহিব, একদম গিল্টি ফিল করবি না। তুই কি করবি না করবি সেটা তো আমাকে জানিয়ে সবসময় করবি না, না? তোর নিজস্বতা রয়েছে। নিজের পছন্দ অপছন্দ রয়েছে। নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব অবশ্যই দিবি। যেকোনো জন দেয়। আমি চাই তুই ভালো থাক। জীবনে অনেক অনেক উপড়ে যা। আকাশে ডানা মেল। মুক্ত পাখির মত। কোনো পিছুটান না রেখে।’
মুহিব ফোনে পাচ্ছে না লেখাকে। কাল আসা হয়নি।
কিছু জরুরি কাজে আঁটকে যাওয়ায় আসতে পারেনি। সেদিনর সেই বিচ্ছিরি ঘটনার পর ব্যক্তিগত কারনে সে পরদিনই লেখার কাছে নিজেকে প্রমানের জন্য ছুটে আসতে পারেনি। এসেছিল সাতদিন বাদে। আজও এসেছে। বাড়িতে কেউ নেই। শরীরটা ছেড়ে দিচ্ছে তাঁর। নিচে থেকে পনেরো তলা এপার্টম্যন্ট ভবনের দিকে তাকাল সে। বারো তলায় লেখাদের ফ্ল্যট। সূর্যের আলোর বিকিরনে স্পষ্ট তাকানোও যাচ্ছে না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল চোখ কুঁচকে। একদিকে লেখাকে নিয়ে টেনশন অন্যদিকে মা’কে নিয়ে। যতই সে মায়ের প্রতি বিরাগ দেখাক। মনে মনে মায়ের প্রতি তার অগাধ টান। জন্ম দিয়েছেন তিনি তাকে। জামার্নি গেছেন থেকেই অসুস্থ মুহিবের মা। প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই অসুস্থ হচ্ছেন। ডাক্তার প্রিয়জনের কাছাকাছি থাকার নির্দেশণা দিয়েছেন। শরীরের থেকে মনের রোগ বেশি জাহানের। তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এজন্য সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শও নিচ্ছেন। জাহানের চিকিৎসক নিজে ফোন নম্বর নিয়ে মুহিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। জাহানের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাবে যদি না কোনো প্রিয়জন তাকে সঙ্গ দেয়। মুহিবের বাবা কখনোই যাবেন না ওনার কাছে। স্ত্রীর প্রতি ভীষণ বিদ্বেষ মনে পুষে রেখেছেন তিনি। বিদ্বেষের আড়ালেই ভালোবাসাটা চাপা পড়ে গেছে। ভার্সিটি জীবনে চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। বছর ঘুরতেই ঘর আলোকিত করে মুহিবেরও জন্ম হয়েছিল। মুহিবের জন্মের এক বছরে জাহান বিসিএস দিয়ে সর্বোচ্চ সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন। সে বছর মুহিবের বাবার ভাগ্য সহায় হয়নি। তিনি প্রিলির পরেই ছিটকে যান। জাহানের চাকরি পাওয়ার পর থেকেই হুঁট করেই সব বদলে যেতে থাকল। কাজে ডুবে যেতে থাকল জাহান। কাজই ধ্যন, কাজই জ্ঞান হয়ে যায় তাঁর। মুহিবের প্রতিও তেমন গুরুত্ব দেননি সে সময়ে। স্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্বে হেলা করেন। এর পরের বারের বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে চতুর্থ হয়ে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করেন মুহিবের বাবা। স্ত্রীকে দেখিয়ে দেন তিনিও পারেন। এরপর থেকেই দু’জনের মাঝে কেমন অদৃশ্য অঘোষিত একটা লড়াই শুরু হয়ে যায়।
জীবনে কে কতবেশি, কার থেকে বেশি সাকসেস পাবে। সেই লড়াইয়ে এখনো অবধি দু’জনে অপরাজিত সৈনিক। শেষদিন অবধি হার না মানার পন নিয়েছেন যেন। মুহিবের মায়ের মন গলতে শুরু করেছে। তিনি একাকীত্ব বোধ করছেন প্রচণ্ডভাবে। স্বামীকে, ছেলেকে মিস করছেন। বিষন্নতায় ভুগছেন। নিজের পূর্ববর্তী ধ্যান-ধারনা নিয়ে ভীষণ অনুতপ্ততায় পুড়ছেন। মুহিবের বাবা জামার্নি গিয়ে কিছুদিন থেকে আসবেন। মুহিবের মা যেমন সব ছেড়েছুড়ে দেশে আসবেন না তেমনই তাঁর বাবাও নিজের ক্যরিয়ার বিসর্জন দিয়ে স্ত্রীর কাছে একেবারে চলে কখনোই যাবেন না। কিছুদিন থেকে আসবেন সেটাই অনেক বেশি। মুহিবের চতুর্থ বর্ষ শেষ। সবদিক বিবেচনায় মুহিবকে সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। মুহিবের মা-ও ভীষণ খুশি। তিনি নিজে বার্লিনের হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের একজন স্বনামধণ্য অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেছেন। মুহিবের রেজাল্টে তিনি সন্তুষ্ট। মুহিব আবেদন কার্যক্রম সেরে ফেলেছে সেখানে ইতোমধ্যে। যেকোনো দিন তার যাওয়ার ভিসা কনফার্ম হতে পারে। শুধুমাত্র বাবার কথায় মায়ের জন্য যে সেখানে যাবে সেটা ধারনা করাও সমীচীন নয়। মুহিব ভেতরে ভেতরে নিজে-ও উৎসুক হয়ে রয়েছে। মায়ের সান্নিধ্য সে নিজেও চায়।
ছোটবেলা থেকেই চেয়ে এসেছে। তাঁর অপূর্ণতা হয়ত চব্বিশে এসে পূর্ণ হবে। সমস্যা হচ্ছে লেখাকে নিয়ে।
সেদিনের পর থেকে মেয়েটার কোনো খোঁজই নেই।
লেখার বাবার সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সে। তিনিও কেমন কাঠখোট্টা গলায় বলে দিয়েছেন,
’তুমি তোমার মত থাক, লেখাকে লেখার মত ছেড়ে দাও। সেটাই ঠিক হবে। আর ইচ্ছে হলে লেখা নিজ থেকেই যোগাযোগ করবে। তুমি ডিস্টার্ব করো না তাকে।’
নিজের চুলগুলো ছিড়তে ইচ্ছে করছে মুহিবের। এপার্টম্যন্ট এড়িয়া থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠে পড়ল সে। কোনদিকে যাবে জানে না।

”মামা, যাবেন কোথায়?”

মুহিব বিরক্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল,

”যেখানে খুশি নিয়ে যান।”

রিকশাওয়ালা অবাক চাহনিতে মুহিবের দিকে চেয়ে আছেন। লোকটার আচরনে মুহিব মুখে বিরক্তিপূর্ণ শব্দ করে বলে উঠল,

”সদরঘাট!”

”না, মামা ঐদিকে যামু না এহন। অনেক দূর। নাইমা যান!”

মুহিব ভ্রু কুঁচকাল,

”তাহলে, রিকশায় উঠার আগে বলিস নাই কেন? মুখে তালা দিয়া রাখছিলি।”

মুহিবের রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে মুখটা চুপসে লোকটা মিনমিনে স্বরে বলল,

”আপনিই তো আগে উঠে গেছেন। কিছু বলার সুযোগ দিছিলেন!”

”ধুর! কোথাও শান্তি নাই।”

একলাফে রিকশা থেকে নেমে পশ্চিমে হাঁটা দিল সে।
সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। দু’একটা টান দিলে নিশ্চয়ই মাথাটা ঠান্ডা হবে! রাস্তার পাশে দোকানে গিয়ে সিগারেট নিয়ে সেটায় আগুন ধরিয়ে সুখটান দিল কয়েকটা। টাকার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে ব্যঙ্কল বনে গেল। অন্য পকেটেও খুঁজল। টাকা নেই কোথাও। একটা কানাকড়িও নেই। দোকানদার ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ নজরে চাইল মুহিবের দিকে। বেশভূষায় তো জোচ্চর লাগছে না। সিগারেট পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। টাকার চিন্তা রদ করে বেঞ্চে বসে সিগারেটে মনোযোগ দিল সে। অভ্যসবশত, সিগারেট শেষ করে লেখার নাম্বারেই কল দিল। মেয়েলি স্বরে ’দ্য নাম্বার ইজ বিজি’ শব্দগুলো ভেসে আসছে। মুহিবের মুখের রঙ পরিবর্তন হয়। সে নিজের হাতে থাকা দশ হাজার টাকা দামের ঘড়িটা খুলে দোকানদারের সামনে রেখে হাঁটা শুরু করে নিঃশব্দে। লোকটা টাকা না পেয়ে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে,

”অ্যই, অ্যাই কই যান? টাকা দিয়া যান?”

মুহিব পেছনে ঘুরে ঘড়িটার দিকে নির্দেশ দিয়ে বলে,

”দিলাম তো!”

”কি দিলেন?”

”ঘড়ি। এটার দাম দশ হাজার টাকা।”

লোকটা খেঁকিয়ে ওঠে,

”ঘড়ি দিছস? এই ঘড়ি? বল, কোন জায়গা থাইকা চুড়ি করে আনছস? আমারে ফাঁসানোর ধান্দা, না?
দাঁড়া এক্ষুনি পুলিশ ডাকমুনি।”

আশেপাশে দু-একজন এগিয়ে আসে। মুহিবকে ধরে আঁটকায়। এই লোকগুলোর যেন আর কোনো কাজই নেই। একমাত্র কাজ অন্যদের কাজে দখলদারিত্ব করা
। উপায়ন্তর শেষমেশ, মুহিব বাপের নাম্বারে কল দিল।
দ্বিতীয়বারে রিসিভ হল।

”স্ট্রেঞ্জ, তুমি নিজে কল করেছ আমাকে? তুমি আমার ছেলে মুহিবই তো?”

”স্টপ দিজ রাবিস টক বাবা! আমার কিছু টাকা প্রয়োজন। বিকাশে সেন্ড করে দাও। এক্ষুনি।”

”কার্ড কোথায় তোমার? ক্যশ নেই সঙ্গে?”

”থাকলে কি তোমাকে কল দেই আমি!”

আশেপাশে লোকজনের ফুসুরফাসুর মুহিবের বাবার কান অবধি পৌঁছায়। তিনি ভ্রু কুঁচকান। জিজ্ঞেস করেন,

”তুমি কোথায় এখন?”

”মহম্মদপুর!”

”লেখার বাসায় গিয়েছ? তাঁকে তো পাবার কথা না এখন।”

মুহিব চোখের পলক ফেলে। দ্রুত জিজ্ঞেস করে বসে,

”কেন?”

”এমনিই।”

”এমনিই না। তুমি কিছু জানো নিশ্চয়ই? বল, কি হয়েছে?”

”আমি টাকা সেন্ড করছি। ক্যশ আউট করে নিও।”

”বাবা!”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মুহিব পুণোরায় কল দেয়। রিসিভ হয়না। আশেপাশের লোকজন আর দোকানদারও ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছে মুহিব সাধারন কেউ নয়। ঘড়িটা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট হলেন। মুহিবের মাথায় অন্যচিন্তা। কি হয়েছে লেখার? গুরুতর কিছু? সে পথ ঘুরে ফের লেখাদের বাসার দিকে ঘুরে এল। আজ যতক্ষণ না লেখা ফ্ল্যটে ফিরবে ততক্ষণ সে এখানে বসে থাকবে। ফিরুক লেখা। সে আচ্ছামত বকবে। তাঁকে কষ্ট দিয়ে মজা পায় মেয়েটা! সামান্য কারনে এত দূরত্ব কেন তৈরি করবে? কে সাহস দিয়েছে তাঁকে? অভদ্র, নিষ্ঠুর মেয়ে একটা!

________________________________

জুবায়ের কক্ষে প্রবেশ করে দেখল লেখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। তাঁর
চাহনি একটু অস্থির। লেখার চুলের পরিধি খুব বেশি নয়। কাঁধ ছাড়িয়ে একটুখানি। নিচের দিকে রঙ করা। তবে, চুলের পরিমাণ ভালোই। আশেপাশে চোখ দু’টো বুলিয়ে জায়নামাজের স্থাণে কোনো নড়চড় না দেখে চোখের রঙ পরিবর্তন হয়। চোয়াল কঠিন হয়। সে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসে। লেখা জুবায়েরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাঁর দিকে ফিরে বিস্তর হাসে। বলে,

”আপনি এসেছেন? খাবার কোথায়?”

জুবায়ের নড়চড়হীন নজরে লেখাকে দেখে। তাঁর কথার জবাব দেয়না। নিজে জিজ্ঞেস করে,

”নামাজ পড়েছেন আপনি?”

লেখা কাঁধ নাড়ায়,

”মাত্রই ফ্রেশ হয়ে বেরলাম। আচ্ছা, আপনার এখানে হেয়ার ড্রায়ার নেই? ভেজা চুলে আমার সর্দি লেগে যায়।”

দাঁতে দাঁত ঘর্ষণ করে জুবায়ের। লেখার কর্ণকূহর অবধি সে শব্দ পৌঁছায় না।

”আমি আপনাকে বলে গিয়েছিলাম এসে যেন দেখি আপনি নামাজ পড়েছেন। আরো একটা কথা আমি আপনাকে জানিয়েছি, প্রধানীয়া ভিলায় নামাজ না পড়ে কেউ খাবার পায়না। আপনিও ব্যতিক্রম নন।”

কথা শেষ করেই ঘড়ির দিকে তাকায় জুবায়ের। তার চোখের পাতা নড়ে হতাশ ভাবে। নামাজের সময় শেষ।
সে চোখ বন্ধ করে আবার খুলে। শুনতে পায়,

”আমি নামাজের নিয়ম জানি না।”

তীক্ষ্ণ চোখে লেখার দিকে তাকায় সে। এমনও মানুষ আছে যে নামাজের নিয়মকানুন জানে না। আর সেই মানুষটাই তাঁর সহধর্মিণী। এমন মানুষগুলোই কেন তাঁর জীবনে আসে! বিদ্রুপাত্মক হাসি দখল করে তাঁর ঠোঁটের কোণ।

”আমি নামাজ পড়তে পারি না সে কারনেই পড়িনি। প্লিজ খাবার আনুন দয়া করে। আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি।”

জুবায়ের পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায় লেখার মুখে। বলে,

”তখন না বললেন, নামাজ পড়েছেন? মিথ্যা বলা মহাপাপ জুলেখা!”

লেখা দৃষ্টি অবনত করে। জুবায়েরের স্বরে স্পষ্ট অবজ্ঞা। তাঁর ঠোঁট কাপছে। সে কোনোরকমে কম্পমান স্বরে বলে,

”আমি মিথ্যে বলিনি। সেই ছোটবেলায় নামাজ পড়েছিলাম। কিছু নিয়মকানুন মনে নেই আমার।”

জুবায়ের অবাক হয়। সেই ছোটবেলায় শেষ নামাজ পড়েছিল। এরপরে এত বড় হয়েছে অথচ কোনোদিন নামাজ পড়েনি। সে নিজের বিস্ময় ধরে না রেখে বলে বসল,

”সত্যিই আপনি সেই ছোটবেলার পরে কোনদিন আর নামাজ পড়েননি?”

লেখা মাথা নাড়ায় দু’দিকে,

”না!”

’আল্লাহ, তুমি ক্ষমা করবে তো তোমার এই বান্দাকে!’

জুবায়েরের মুখে ভয়ার্ত ভাব। লেখা বিস্ময় নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। সে কিছু বিরবির করছে সম্ভবত। তাই লেখা জিজ্ঞেস করে,

”কি হয়েছে? কি বিরবির করছেন আপনি?”

জুবায়ের হতভম্ব অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পায় লেখার কথায়। সে কয়েক মূহুর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। এমন মেয়েটাকে বাবা তার জন্য সত্যিই পছন্দ করেছে? বিশ্বাস করতে কেন কষ্ট হচ্ছে তাঁর। মুখ খুলে ধীরেসুস্থে,

”আপনি ধর্ম মানেন না?”

”জানি না!”

”জানেন না?”

”উহু, ছোটবেলায় বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর তো কেউ কোনোদিন ধর্ম নিয়ে কিছুই বলেনি। মা থাকাকালীন নামাজ পড়েছিলাম। এরপরে তো আমি নিজের মত করে বড় হয়েছি। বাবা খুববেশি সময় দেননি কখনোই আমাকে।”

লেখার কথায় বিষন্নতা লুকানো। জুবায়েরের কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। কি অকপটে সবকিছু বলে যাচ্ছে সে।
বাবার কথাই তাহলে ঠিক। মেয়েটা সত্যিই কাদামাটি। সে যেভাবে গড়ে নেবে সেভাবেই রূপ পাবে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুখে হাসি ফোঁটায় জুবায়ের। লেখার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

”আপনাকে আমি খাবার দিতে পারি তবে একটা শর্তে!”

লেখার মুখভঙ্গি কুঁচকে যায়। এ কোথায় এসে পড়েছে সে? বেশি ভাবে না। পেটে গুড়গুড় আওয়াজ হচ্ছে। আপাতত খাওয়া দরকার।

”কি শর্ত?”

”আপনি মাগরিবের নামাজ পড়বেন!”

লেখা ঠোঁট উল্টায়। লোকটা কি তাঁকে ব্যঙ্গ করছে। সে তো বললই সে নামাজ পড়তে জানে না। তারপরেও? অসন্তোষপূর্ণ গলায় বলে উঠল,

”আপনি মজা নিচ্ছেন? আমি তো বলেছিই আমি নামাজ পড়তে পারি না। কি করে পড়ব মাগরিবের নামাজ? ম্যাজিক করে নিয়মকানুন শিখে যাব নাকি অল্প কতক্ষণে!”

জুবায়েরের মুখে বিস্তীর্ণ হাসিটা জড়ানো এখনো। সে লেখার মুখোমুখি হয়ে জবাব দেয়,

”না, ম্যজিক করে নয়।”

”তাহলে?”

”আপনি আমার সঙ্গে নামাজ পড়বেন? আমি শিখিয়ে দেব আপনাকে।”

”আপনি?” লেখার চাহনিতে বিস্ময়।

জুবায়ের হাসে,

”হুঁ, আমি।”

লেখা বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। কোথায় এসে পড়েছে সে? কোন কারাগারে বন্দি হয়েছে?

”শুনুন লেখা, শুধু মাগরিবের নামাজই নয়। কাযা জোহর, আসরও পড়বেন সঙ্গে!”

”আপনি?”

”জুলেখা কি আপনি আপনি শুরু করেছেন? আমার নাম ধরে ডাকুন নয়ত অন্যকিছু বলুন।”

লেখা চোখ দু’টো সংকুচিত করল। লোকটা তাঁর কথাই তাঁকে ফেরত দিচ্ছে। তফাতটা শুধু চেঁচিয়ে বলেছিল সে আর জুবায়ের মুখে হাসি নিয়ে। নিঃশ্বাস ফেলল সে। লোকটা সাংঘাতিক!

”জুলেখা বললেন না আপনি কি শর্তে রাজি?”

”শর্ত?”

”নামাজ পড়ার!”

লেখার ভ্রু বটা দেখে জুবায়ের হেসে বলল,

”অবশ্য এমনিতেই আপনি নামাজ পড়বেন। নিজে থেকেই পড়বেন। একবার রবকে চিনে গেলে, জেনে গেলে কোনোভাবেই নামাজ বাদ দিতে পারবেন না।”

”আমি মরে গেলে রবকে চিনব জানব কি করে?”

হকচকিয়ে গেল জুবায়ের আকস্মিক লেখার কথায়।
পরক্ষণে, যখন তার কথার সারমর্ম বুঝল তখন সে মুখে হাসি ফুঁটিয়ে লেখার চোখে তাকাল।

”কেন মরবেন আপনি? খিদায়? দু’বেলা না খেয়ে? আচ্ছা, একবার চিন্তা করুন তো যারা দিনের পর দিন খেতে পায়না, আধপেটা খেয়ে জীবন ধারন করে তাঁরা কি মরে গেছে? নাকি একদিন না খেতে পেলেই পটল তুলে?”

”কি বলতে চাইছেন?”

”একবেলা না খেতে পেয়ে এত অধৈর্য না হয়ে বরং আল্লাহর শুকরিয়া করুন। খেতে তো পান। আপনার খাবারের নিশ্চয়তা তো ছিল এবং রয়েছে এখনো পর্যন্ত।”

”আর নিশ্চয়তা! নিশ্চয়তা ছিল না দেখেই তো আপনাকে বিয়েটা করেছি। এখন দেখি এখানেও যেই লাউ সেই কদু। সেই অনিশ্চয়তা!”

”কোনো অনিশ্চয়তা নেই। আপনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজেকে ডেডিকেট করুন। ইন শা আল্লাহ কোনো জিনিসের অভাব হবে না।”

লেখা দাঁত কিড়মিড় করে জুবায়েরের দিকে তাকাল এবার। কর্কশ গলায় ব্যঙ্গ করে বলল,

”আগে বেঁচে নেই তারপর নাহয় ডেডিকেশণের কথা আসবে।”

জুবায়ের নিঃশ্বাস ফেলে। একটু নিরাশ ভাবে লেখার দিকে চেয়ে বলে,

”আপনি বড্ড অধৈর্য্য জুলেখা। মহানবি (সাঃ) বলেছেন,’ধৈর্য্য হল আলোকবর্তিকা। (সহিহ মুসলিম)’
আপনাকে সবর করা শিখতে হবে জুলেখা!”

লেখা কিছু না বোঝার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জুবায়ের মাথা দু’দিকে একটু ঝাঁকিয়ে বলে,

”অপেক্ষা করুন আমি খাবার নিয়ে আসছি। আর খবরদার কাউকে ভুলেও বলবেন না আপনি নামাজ পড়েননি।”

কি হল লেখা বুঝল না। জুবায়ের বেরিয়ে গেল রুম থেকে। লেখা কয়েক কদম এগিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ল। সিলিংয়ে চাহনি নিবন্ধ করে সে ভাবল জীবনটা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে থেমেছে।
ভবিষ্যত কি হবে? কারো জানা নেই। আচ্ছা, মুহিব যদি শুনে লেখার বিয়ে হয়ে গেছে। সে কি প্রতিক্রিয়া দেবে? যে বাড়িতে নামাজ না পড়লে খাবার পাওয়া যায় না সে বাড়িতে বিয়ে হয়েছে শুনলে খুব হাসবে কি? হাসতে হাসতে নিশ্চয়ই মাটিতে গড়াগড়ি খাবে। বদ দিবাটা এটাসেটা বলে উসকে দেবে পরিস্থিতি নিশ্চিত!
__________________________________

®সামিয়া বিনতে আলম

’এই গল্পটা কি দীর্ঘ চান নাকি চান কয়েক পর্বেই শেষ করে দেই? আপনাদের মতামত জানান দয়া করে। জাযাকাল্লাহ খাইরান!’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here