#আকাশ_এখন_মেঘলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি
২||
আধাঘন্টার মধ্যে চা নাস্তার পাশাপাশি যে ঘটনাটা ঘটলো তার নাম ‘কাকতালীয়’ হলেও গহনা এর নাম দিলো শাপেবর। আমান পিয়নের মাধ্যমে ওদের দুজনের মাকর্সিট দুটো আনিয়ে নিলেন। তারপর ফোন করলেন একজনকে। পিয়নকে তার কাছে পাঠালেন। সে কাগজ দুটোকে সই সাবুদ করে আমানের হাতে দিলে তিনি নিজেও এককোণে স্বাক্ষর করলেন। তারপর দুলিরটা দুলির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গহনাকে বললেন,” আপনার নাম ঠিকানা কনট্যাক্ট নম্বর সব একটা সাদা কাগজে লিখে জমা দিন। তারপর এটা বুঝে পাবেন। আর বাড়ি যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হবার কিছু নেই। আমার নিজেরও ওয়ার্কিং আওয়ার শেষ। তোমাদের তিনজনকে নামিয়ে দিতে পারবো। ” শেষের কথাটা সাবেরের দিকে তাকিয়ে বললেও কথাটা যে ওদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তা আর কারো বোঝার বাকি রইলো না। সাবের চুপচাপ কথাগুলো শুনলো। দুলি বোকার মতো একবার গহনার দিকে আরেকবার আমানের দিকে তাকালো।
গহনা ততক্ষণে ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে তাতে চটপট নিজের নামবৃত্তান্ত লিখে আমানের দিকে বাড়িয়ে দিলে আমান সেটা মনোযোগের সাথে দেখতে লাগলেন। গহনা নিজেও এবার কৃতজ্ঞ হতে শুরু করেছে। মাত্র একটু আগেই বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা মিলেমিশে মনের ভেতর যে তেতো একটা অনুভূতিটার জমাট বাঁধতে শুরু করেছিলো তার সবটাই উড়ে গেলো আমানের কথার আশ্বাসে। মন পবনের নৌকাটা আচমকাই বিপরীত দিকে বইতে শুরু করেছে। করবে নাইবা কেন। গহনা এতোক্ষন নিশ্চিত ছিল ওর জার্ণি করে আসার পরিশ্রমটা শুধু পণ্ডই নয়, সাথে বাড়ি যাবার অনিশ্চয়তাটাও ওকে আরেকটা কঠিন বিপাকে ফেলতে যাচ্ছে। সেখানে হুট করে পরপর দুটো সমস্যারই চমৎকার সমাধান হয়ে যেতে দেখলে কার না ভালো লাগবে৷ গহনার বুকের ভেতর এখন শিরশিরে একটা অনুভূতি জাগতে শুরু করেছে। ভালোলাগারা যে যেখানে ছিলো সবাই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে কোটর ছেড়ে। তারা আমান স্যারকে উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখতে শুরু করেছে। আর মুচকি মুচকি হাসি দিচ্ছে পরম লাস্যে। নইলে গহনার হঠাৎ করে কেন মনে হবে কেন লোকটা দেখতে যথেষ্ট প্রেজেন্টেবল। তার তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুলের চাপে কাগজটা ধরা, নত মুখে লেখাটা পড়া। সব কিছুই অসম্ভব সুন্দর আর নান্দনিক মনে হবে কেন। মনের অজান্তেই ওড়না জামা টেনেটুনে ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করলো গহনার অবচেতন মন। কৃতজ্ঞতা ? হতে পারে। নিজেকে চোখ রাঙাতে গিয়ে শুনলো মনের দুষ্টু অংশ বলছে , ‘ তোর মার্কসিট আনানোর কোন কারণই ছিল না রে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে লোকটা তোর প্রতি আগ্রহী। নইলে একেবারে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইবে কেন ! মনের ভদ্র এবং সচেতন অংশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে শাসালো গহনাকে। বললো, ” তোমাদের মতো কোমলমতি মেয়েদের নিয়ে এই এক সমস্যা। কেউ একটু ডাক খোঁজ করলো বা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো অমনিই তোমাদের মনে হওয়া শুরু করে সে আমার জন্য দিওয়ানা মাস্তানা। আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছো ! না দেখে থাকলে আজ আরেকবার একটু দেখো। তারপর নিজেকে আমানের জায়গায় বসাও। আর বলো, কোন খুশিতে সে দুলির মতো সুন্দরী সম্ভান্ত পরিবারের পূর্বপরিচিতিকে বাদ দিয়ে তোমার মতো কালোগোলাপকে চয়েস করবে। এটা তো কেবল আলিফ লায়লার এপিসোড গুলোতেই সম্ভব। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে ফিরে পেলো গহনা। যা আরেকটু হলেই হারাতে বসেছিলো। মনের ভেতর কৃতজ্ঞতাবোধের যাবতীয় শুভবোধগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে তরবারী ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘ তোরা আমাকে ছোটলোকের মতো ভাবতে দেখলেই আমার মাথায় ঘা বসিয়ে দিবি । যত্তসব।
গহনাকে শান্ত আর নিরব দেখে দুলি নিজেই এবার মুখ খুললো। হেসে বললো, ” এতোক্ষণ তো খুব রেগে ছিলি আমার ওপর। এখন থ্যাঙ্কস দে আমাকে। ট্রিট ও তো পাওনা হয়ে গেছে আমার। নইলে পুরো কলেজ যেখানে মার্কসিটের খবর জানেনা সেখানে তুই রীতিমত ওটা হাতে পেয়ে যাচ্ছিস। আবার বিনা খরচে বাড়ি পৌঁছানো।”
গহনা কী বলবে ভেবে না পেয়ে নিরব রইলো। তবে সাবের বিরক্ত হলো বোনের কথায়। বোকার মতো আমানের সামনে নিজের চরিত্রটাকে মেলে ধরছে কোন আক্কেলে। থাপ্পড় মারা দরকার বেকুবটাকে। সাবের খাঁকাড়ি দিলে দুলি তার দিকে তাকালো আর চোখ রাঙানী খেয়ে দমে গেলো।
গহনার মন বললো এখানে কোন ঘটনা আছে নিশ্চয়ই। একটু আগেও মার্কসিট আনার মধ্যবর্তী সময়টুুকুতে সাবের আর আমান স্যারকে স্মৃতিচারণ করতে শুনেছে। তখনই বোঝা হয়ে গেছে অনেককিছু। বাকিটা এখন বুঝতে পারলো। সাবের ভাইয়ের বাড়তি সতর্কতা বলে দিচ্ছে , আমান স্যার সাবের ভাইদের আত্মীয় হতে যাচ্ছে ৷ এবং ইনি সম্ভবত একসময় সাবের ভাইদের প্রতিবেশী ছিলেন এবং আজ দুলিকে পাত্র দেখাতেই এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। যা দুলি নিজেও হয়তা জানতো। নইলে বন্ধুস্থানীয় একজনের সামনে এতো ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিসের। এই রুমে ঢোকার আগে দুলির সচেতনতা গহনার চোখে পড়েছে। কাজেই সে যতোই বলুক অন্য কাজে এসেছে তা সত্যি নয়। আমান তার সম্ভাব্য পাত্র। কিন্তু গহনাকে টানলো কেন সে। একটু ভাবতেই উত্তরটা পেয়ে গেলো সে। মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেলো এবার। চোখে পানি চলে আসতে চাইলো। দুলি নিশ্চিত ছিলো গহনা তার প্রতিদ্বন্দী হবার যোগ্যতা রাখেনা। কোন পাত্রের চোখে সমস্যা না থাকলে সে দুলিকে বাদ দিয়ে গহনাকে নিজের জন্য ভাববে না। দুলি এই চান্সটাই নিয়েছে। আরেকটা চাপা নিঃশ্বাস পড়লো গহনার।
সাবের হঠাৎ পুরোনো কথার খেই ধরলো, ” বাড়ি কবে আসছো আমান ? আম্মা কিন্তৃ বারবার তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছে। আমার তো মনে হয় আজকের দিনটাই চমৎকার। কী বলো ?
আমান তখনও গহনার কাগজটা দেখছিলো। তা থেকে চোখ সরিয়ে বললো, ” না সাবের আজ না। আজ আম্মার সাথে গিয়ে কথা বলি। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করে ফোনে জানাবো ইনশাআল্লাহ। তবে এটা পুরোটা আম্মার উপরই থাকছে। আম্মা যেদিন বলবে সেদিনই চলে আসবো।”
” খুব ভালো। আন্টিকে তাহলে সাথে করে নিয়েই আসো। মা তো আন্টির কথা প্রায়ই বলেন। ওনার কথা থেকেই আজ তোমার এখানে আসা। দুলি তো প্রথমে এখানে আসতে রাজিই ছিলো না। পরে তোমার ছবি দেখালাম। তোমার সব কথা বললাম তারপর ম্যাডামের মন নরম হলো। আমার বোনটা আবার খুবই নাক উঁচা স্বভাবের মানুষ। হা হা হা…!” সাবের হেসে উঠলো। আমান নিজেও মুচকি হাসলো। গহনা তখনও নিজের মার্কসিট নিয়ে ব্যস্ত। দেখা শেষ করে মার্কসিটটা ব্যাগে রেখে উঠে দাঁড়ালো সে, ” স্যার আমি আসি ? ”
” সে কি একা ? এলেন তো বন্ধুর সাথে। বন্ধুর সাথেই যান।” আমানকে সিরিয়াস দেখাচ্ছে৷ গহনা দুলির দিকে তাকালো। দুলি অস্বস্তিভরে বললো, ” সমস্যা নেই, ও চলে যাক। আমাদের তো দেরিও হতে পারে তাই না। বেচারীকে আটকে রেখে লাভ কী। আমার তো মনে হয় সি ক্যান টেক কেয়ার অফ হারসেল্ফ। ”
গহনা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমান ধীরে সুস্থে কলমটা বন্ধ করে বুক পকেটে রাখতে রাখতে বললো, ” যত যাই হোক। ওকে এ পর্যন্ত আপনিই টেনে এনেছেন। ওকে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও আপনার। মেয়েটা এতদূর একা কীভাবে যাবে এটা ভাবা উচিত । গহনা আপনি বসুন। বেশি ভদ্রতা দেখাতে যাবেন না। আমরা সবাই একসাথে যাচ্ছি। একটু আগেই বলেছি কথাটা। তারপরেও যাই যাই করাটা…ব্যাড ম্যানার্স। সিট ডাউন।” আদেশের সুর আমানের কণ্ঠে। গহনা এবার আস্তে করে বসে পড়লো। (চলবে)