অমিশা_ভিলা
#পর্ব_৪_ও_৫
লেখা_ইয়াছিন
২০১১ খ্রি.
সকাল থেকেই আকাশ কালো হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব তবে নামছে না। মাঝে মাঝে গুড়ুগুড়ু আওয়াজ হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রবল বেগে হাওয়া। ধুলো উড়ছে, পাতা উড়ছে, উড়ছে ফেলনা কাগজ। মনে হচ্ছে এই বুঝি ঝপ করে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু না। নামছে না। আমি বসে বসে সেই দৃশ্যই দেখছিলাম। মা এসে বললেন, “এই আরজু, আবার এমপি-ফাইভ হাতে নিয়েছিস! সারাদিন গান শুনে আর গেম খেলে কী মজা পাস বল তো?” বলেই তিনি আমার হাতের এমপি-ফাইভ ডিভাইসটা একরকম টেনে নিয়ে গেলেন। আদতে আমি গানও শুনছিলাম না আর গেমও খেলছিলাম না। আমি কেবল আকাশের কালো কালো মেঘ দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম, আকাশটা আজ এত রেগে আছে কেন? তাকে কি কেউ বকেছে?
মা আমার একগোছা চুল মুষ্টিবদ্ধ করে বললেন, “আমার সামনে ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে বসে আছিস! বাঁদর! বেয়াদব!”
“উঃ!” বলে দাঁড়িয়ে বললাম, “তোমার ছেলে তোমার মতোই হবে।” বলে চোখ টিপে দিলাম দৌড়। মা এক ঝাপটায় আমার হাত ধরে ফেললেন। কড়া গলায় বললেন, “এখন ছাদে যাবি না। আকাশের অবস্থা দেখেছিস? কখন না ঝড় এসে তোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।”
আমি মুখ ভার করে বললাম, “তুমি সব সময় আমাকে নিয়ে উপহাস করো। আমি কি ইচ্ছে করে পাতলু আছি নাকি! আমি তো ঠিকই খাই। তোমার থেকেও বেশি খাই। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। এখানে আমার দোষটা কোথায়?”
মা আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন, “কচু খাস তুই। এর চেয়ে দু’বছরের বাচ্ছারা আরো বেশি খায়।”
মা আর আমার খুনসুটি প্রায় জমে উঠেছিল। তখন নিচতলার বারান্দায় আমরা দাঁড়িয়ে। জায়গাটা বেশ ফাঁকা। বারান্দা পেরিয়ে সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা গেট পর্যন্ত চলে গেছে। রাস্তার দু’পাশে গাদাগাদি ফুল গাছ। বড়ো গাছগুলো মা লাগিয়েছিলেন। আর ছোটো চারাগাছগুলো ক’দিন আগে আমি লাগিয়েছি। সেগুলোর কয়েকটা গাছ মরে গেছে। কয়েকটা জীবিত আছে। তবে কতক্ষণ জীবিত আছে তার ঠিক নেই। আর একটি গাছ আছে। সেটা কী ফুলের গাছ তা তো জানি না। তবে সেই গাছে দু’টো ফুল ফুটেছে। দেখতে বেশ লাগে।
গেট পেরিয়ে কে যেন এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মা দেখলেন প্রথম। হেসে বললেন, “আরে! মোতালেব সাহেব! কী খবর?”
এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। মুখে বিনীত হাসি। তার পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে এল এক মেয়ে। বয়স পনেরো কি ষোলো হবে। ফ্রক পরেছে বলে একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে। মেয়েটার মুখ ভার। বগলে ছাতা ভাঁজ করে রাখা। আমি এর আগে কোনোদিন তাদেরকে দেখিনি। তবে দু’দিন পর মা বলেছিলেন ওই ছোট্ট মেয়েটা আমার খালাতো বোন। আর ওই ভদ্রলোক আমার খালু। খালা মারা গেছেন প্রায় আট বছর আগে। আমাদের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার পর আমাদের শেষ সম্বল মানে এই বাড়িটা মা এই পুঁচকে মেয়েটার নামে লিখে দিয়ে যাচ্ছেন। তবে মা’র কাবিনের জায়গাটুকু কাউকে দিচ্ছেন না। ওটা যেভাবে আছে সেভাবেই পড়ে থাকবে। আমি কৌতূহলবোধ করেছিলাম। আমার খালাতো বোন অথচ এর আগে কখনো তার কথা শুনিনি! মা আলতো হেসে জবাব দিলেন, আপন খালা নয় রে! দূরসম্পর্কের খালা। মেয়েটার মা মরার পর সে খুব অসহায় হয়ে পড়েছে। খুব গরিব। ওঁর বাবা এসেছিল আমার কাছে যেন ক্যানাডা চলে যাবার আগে তার মেয়ের পড়াশোনার খরচ বাবদ কিছু টাকা সাহায্য করি। আমি আমাদের বাড়িটাই লিখে দিয়েছি। এতে ওঁরাও থাকতে পারবে আর বাকিটুকু ভাড়া দিয়ে যা পাবে তা দিয়ে আরামসে মেয়েটার পড়াশোনা চলে যাবে। এবার বল, ঠিক করিনি আমি? কী রে খোকা? বল? আমি হেসে বলেছিলাম, তুমি সব সময় ঠিকটাই করো মা।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আপনাদেরকে দেখতে এলাম। কালকেই তো ক্যানাডায় চলে যাবেন। আর কখনো দেখা হবে কি না…”
মা মৃদু হেসে বললেন, “এসে ভালোই করেছেন। আমরা একা একা বোর হচ্ছিলাম। এই বৃষ্টি বাদলের দিনে চায়ের সাথে আড্ডা বেশ জমবে।”
আড্ডা হলো অনেক্ষণ। ভদ্রলোক আর মা কথা বলছিলেন। আমি বসে বসে শুনছিলাম। আর ওই ফ্রক পরা মেয়েটা মুখ কালো করে ছাতা বগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শেষে আমিই ওর কাছে গেলাম। মেয়েটাকে বাগে পেয়েছি। একটু ভয় দেখানো যাক! যেই ভাবা সেই কাজ। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম, “এই, কী নাম তোমার?”
সে কথা বলে না। সাড়া দেয় না। শুনতে পায়নি এমন ভান করে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাপারটা অপমানজনক। শেষে আমি তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই চেঁচিয়ে বলল, “অমিশা।”
সহসা বুকটা ধড়াক করে উঠল। বাবাগো বাবা! কী জোরে চিৎকার দিয়েছে! আমি তো ভেবেছিলাম এই মেয়ে কথাই বলতে পারে না! এবার আমি বললাম, “আমাদের বাসার ছাদে যাবে? ওখানে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখাব।”
কৌতূহলে মেয়েটার ভ্রু কুঁচকে গেল। আমি মুখ টিপে হাসলাম। এইতো কাজ হচ্ছে! এবার ভুলিয়ে ভালিয়ে ছাদে নিয়ে গিয়ে এমন ভয় দেখাব যে…
“কী হলো, যাবে?”
মেয়েটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমি আরো একটু কৌতূহল জাগাতে বললাম, “সত্যি যাবে? ভয় পাবে না তো আবার?”
মেয়েটা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়াল। আনন্দে আমার ভেতর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠল। ক্যানাডায় যাব বলে স্কুল ছেড়েছি বহুদিন। এতদিন সমবয়েসী কাউকে পাইনি। খেলাধুলা, হৈচৈ সব বন্ধ। মা বলেছেন বাকি দুষ্টুমি ক্যানাডায় গিয়ে হবে। কিন্তু তাই কি হয়? দুষ্টুমি না করলে পেটের ভাত হজম হবে আমার?
যাহোক, মেয়েটাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে উঠতে পেছন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম আর মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিলাম এই বলে যে, “এই, সত্যি ছাদে যাচ্ছে তো! ভয় পাবে না তুমি? দ্যাখো, ভয় পেলে কিন্তু আমাকে কিছু বলতে পারবে না।”
মেয়েটার মুখ তখনও গম্ভীর। সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে এক মনে সিঁড়ি ভাঙছে। একটুও ভয় নেই, সঙ্কোচ নেই, হাসি, আহ্লাদ এমনকি বিস্ময় পর্যন্ত নেই। আমি ভেবেছিলাম বিস্ময়ে তার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। এবার বুঝতে পারলাম, বিস্ময়ে নয় বরঞ্চ প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে। এ-কেমন মেয়েরে বাবা! একে নিয়ে কী যে করি!
ভয় দেখানোর সিদ্ধান্ত এখানেই পাল্টে ফেললাম। তবে ছাদে যাওয়ার প্ল্যান অটুট রইল। ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। মেয়েটাকে বরং চমকে দেওয়া যাক!
ছাদে টবে কয়েকটা ফুলগাছ ছিল। ফুলটার নাম আপাতত মনে পড়ছে না। তবে দেখতে বেশ সুন্দর। আমি করলাম কী, গাছ থেকে একটা ফুল নিয়ে মেয়টার সামনে বসে পড়লাম। ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “ভালোবাসি!”
কিন্তু একি! গম্ভীর মেয়েটা গম্ভীর রয়ে গেল। ধীরে ধীরে আকাশের মেঘ কেটে গেল ঠিকই কিন্তু মেয়েটার গোমড়া মুখ গোমড়াই রয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার চুলে এক টান মেরে বললাম, “শয়তান মেয়ে! এত এমন কেন রে তুই? তোর ভিতরে কি ইমুশন টিমুশন নেই নাকি, অ্যাঁ?”
মেয়েটা খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “আপনি আমাকে তুই করে বলছেন কেন?”
“উরিম্মা! তুই করে বলব না তো কী করে বলব? আপনি করে? তুই আমার ক’বছরের ছোটো হবি জানিস?”
“কী যে দেখাবেন বললেন?”
“দেখাব তোর মাথা, মুন্ডু। দেখবি? বল? দেখবি?”
এরপর ডাক পড়ল। মা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে মেয়েটাকেও। এরপর ওরা চলে গেল। আমি আর মা আবারও একা হয়ে গেলাম। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “তারপর বল, কাল তো ক্যানাডা চলে যাচ্ছি। কেমন লাগছে তোর?”
আমি নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলাম৷ দৃষ্টি তখনও সেই আঁকাবাঁকা পথে। যে পথ ধরে মেয়েটা অর্থাৎ অমিশা আর তার বাবা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছেন।
ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসতেই মেয়েটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ভূতেরা কি তবে জাদু জানে! মেয়েটা কেবল আমার মাথার উপর হাত রেখেছিল। আর এতেই আমি গত দশ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা আবারো চোখের সামনে দেখতে পেলাম। সারা রাত ঘুমাইনি। ঘুমে চোখ লেগে আসছে। ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে পড়তে হবে। এরপর আবার অপেক্ষা। সেই ছোট্ট অমিশা যাকে দশ বছর আগে দেখেছিলাম সে আবার আসবে। আসতেই হবে তাকে। না এলে যে জটিল রহস্য রয়ে গেছে তার সমাধান কখনোই পাওয়া হবে না।
#পর্ব_৫
মানুষ স্বভাবতই কৌতূহলী।
এদের কৌতূহলের শুরু আছে শেষ নেই। কৌতূহলে কেউ কেউ নীল হয়, কেউ হয় লাল। কেউ আবার সবুজ। এদের বদলে যাওয়া রং আবার খালি চোখে দেখা যায় না। কল্পনার রঙিন চশমা নাকের ডগায় রেখে দিলে তবেই দেখা যায়। যাহোক, যা বলতে চাচ্ছিলাম, সব মানুষের মতো আমিও কৌতূহলী। এবং এতটাই কৌতূহলী যে একবার কোনো রহস্যে আটকে গেলে সেটার সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই। এবার বলবেন, এরকমটা তো সবার ক্ষেত্রেই৷ কিন্তু না। সবার সমান না। আমার বেলায় একটু বেশিই। চলুন উদাহারণ দেওয়া যাক!
আমার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। সঠিক মনে নেই। যতদূর মনে পড়ে, তখন বয়স পাঁচ বছর পেরিয়ে ছয় ছুঁইছুঁই। আমি আর মা আমাদের এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। তারা আবদার করে বসল বিয়ে শেষে চলে আসলে হবে না। ওঁদের বাসায় ক’টা দিন থাকতে হয়। আমার মা অমায়িক মানুষ। তিনি বিনয়ের সাথে তাদের আবদার রাখলেন। আমরা বিয়ের পর ক’টা দিন বিয়ে বাড়িতে থাকব। সে নাহয় হলো। এবার মূল ঘটনায় আসা যাক!
দুপুর নাগাদ। তখন কনভেনশন সেন্টারে মানুষ গিজগিজ করছে। আমি আর মা চেয়ারে বসে আছি৷ তখনও খাবার দেওয়া হয়নি। মা বললেন, “খোকা, তুই একটু বোস। আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি। এই যাব এই আসব। দু’মিনিট লাগবে। তুই এখানে বসে থাকিস। কোথাও যাস না যেন। গেলে আর কখনো আমাকে পাবি না।”
বলে মা চলে গেলেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। আর তখন কোত্থেকে যেন একদল মেয়ে আমাকে ঘিরে ফেলল। একজন বলল, “ওলেলে, ছেলেটা কী কিউট। একদম হাবলা মার্কা।” বলেই হেসে ফেলল। অন্য একটা মেয়ে বলল, “কী বাবু? বিয়ে খেতে এসেছো? বিয়ের পর বাসর রাতে কী হয় তুমি জানো?”
অন্য একটা মেয়ে ধমক দিয়ে বলল, “কীসব বলছিস তোরা! এই বাচ্চা ছেলেটাকে এসব শেখাচ্ছিস! লজ্জাশরম কিছু আছে নাকি তোদের?”
মেয়েটা হেসে কুটিকুটি করে বলল, “তাতে কী! দেখছিস না বেচারার চোখদু’টো কেমন বড়ো বড়ো হয়ে গেছে? ভয় পেয়েছে মনে হয়।” বলে মুখ টিপে হাসল। আরো কী কী যেন বলেছিল সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। তবে প্রথম কথাগুলো আমার এখনো মনে আছে। আমি সত্যি সত্যি ভাবতে বসে গিয়েছিলাম। আসলেই তো! বিয়ের পর কী হয়? আবারও বলে রাখি, আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। সেদিন রাতে যখন বাসরঘর সাজানো হচ্ছিল আমি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সুযোগ বুঝে আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম৷ খানিক বাদে, যখন বাসরঘর সাজিয়ে সবাই বেরিয়ে গেছে তখন হৈচৈ শুরু হলো। গোলমালটা আমাকে নিয়েই। পুরো বাড়ি খুঁজে আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কেউ জানে না, আমি বাসরঘরে টেবিলের নিচে চেয়ারের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছি।
আমাকে না পেয়ে মা কেঁদেই ফেলবেন তা আমি জানতাম। এজন্য আমার খারাপ লাগছিল। তবে রাতে কী হবে এ-নিয়ে আমার ভেতরে যে কৌতূহল জমেছিল তার সমাধান না হওয়া অবধি আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। যার ফলে চুপ করে টেবিলের নিচেই বসে রইলাম। তখন ঘরটায় দু’টো মানুষ। আমি আর সদ্য বিবাহিত নতুন বউ। মেয়েটা লম্বা ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে ছিল। কিছুক্ষণ পরপর ঘোমটা সরিয়ে চোখের জল মুছছিল। আমার একটু মায়া হলো। আহারে মেয়েটা!
রাত দশটা নাগাদ। না আরো বেশি হবে। বোধহয় এগারোটা। তখন ধড়াক করে দরজা খুলে গেল। বর দ্রুত এসে দরজা বন্ধ করে গায়ের শেরওয়ানি খুলতে খুলতে বিরক্ত গলায় বলল, “কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বলো তো! কই বিয়ে বাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হবে। আনন্দ ফূর্তি হবে। তা না উল্টো কান্নাকাটি গন্ডগোল আর শোক চলছে। ডিসগাস্টিং। যত্তসব ফালতু ঝামেলা।”
নতুন বউ ঘোমটার আড়াল থেকেই বলল, “কী হয়েছে?”
“আর বোলো না। এক আত্মীয়ের ছেলেকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোও না! যত্তসব ত্যাঁদড়। গিয়ে দ্যাখো কোথায় গিয়ে বসে আছে। আর এদিকে ছেলের মা কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ।”
“এজন্য এত শোরগোল শোনা যাচ্ছে?”
“নয়তো কী! ছেলেটাকে যদি একবার হাতের কাছে পাই তবে মাথার উপর তুলে এমন আছাড় মারব না। যে আর জীবনে তার মা’কে না বলে কোথাও যাবে না। যত্তসব ফালতু ঝামেলা। এখন বাসরের কথা ভুলে গিয়ে ছেলেটাতে খুঁজতে বেরোতে হবে। মরার কপাল!” বলে নিজের কপালে চাপড় মারল লোকটা।
নতুন বউ আলতো হেসে বলল, “খুঁজতে হবে না। ওই তো টেবিলের নিচে বসে আছে। নিয়ে যান।”
সেদিন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, “আর কখনো আমাকে না জানিয়ে কোথাও যাস না খোকা। তুই ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার।” মায়ের বলা কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে। দেখুন ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। আমাকে দূরে যেতে মানা করে মা নিজেই আমাকে রেখে হারিয়ে গেছেন। বাস্তবতা কী কঠিন! কী নির্মম!
একবার ভাবুন তো, সেই কৌতূহলী আমি আজ ক’টা দিন যাবৎ অমিশা ভিলা’র রহস্যে আটকে আছি। যদিও কিছু রহস্য উদঘাটন হয়েছে। তেমনিভাবে আবার নতুন নতুন রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। নতুন নতুন প্রশ্ন সামনে এসেছে। যার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।
বিকেলের পর এখনও সন্ধ্যে হয়নি। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবি ডুবি করছে। রেবা বেগম মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। তার পরনের গোলাপি নতুন শাড়িটায় এখনও ভাঁজ পরেনি। বাঁ হাতটা বোধহয় তিনি ইচ্ছে করেই সামনে ঝুঁকিয়ে রেখেছেন। যাতে করে নতুন ব্রেসলেটটা আমার নজরে পড়ে। বাঙালী মেয়েরা অনেকটা এরকমই। কিছু একটা কিনবে অথচ লোক দেখাবে না তা কোনোভাবেই মানতে পারে না তারা।
টেবিলের উপরে রাখা চায়ের কাঁপ থেকে সাদা ধোঁয়া উড়ে উড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। রেবা বেগম একটু চিন্তিত। তিনি বিচলিত গলায় বললেন, “আমরা এখনও বিয়ে করিনি।”
“তবুও একসঙ্গে থাকছেন? ইসলামে এরকম সম্পর্ক হারাম।” আমি বললাম।
রেবা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিয়ের কথা কি বলিনি ওঁকে? বহুবার বলেছি। তার দিক থেকে এ-ব্যাপারে কোনো রকম উদ্যোগ নেই।” খানিক চুপ থেকে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “মানুষটাকে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। সে কখন কী ভাবে আর কখন কী করে তা বোধহয় সে নিজেও জানে না।”
“ক’দিনের সম্পর্ক আপনাদের?”
“অনেক বছর হয়ে গেছে। এখন আর হিসেব করি না। হিসেব করতে ভয় হয়। বয়স বাড়ছে। আমার প্রথম স্বামী মারা যাবার পর কখনো ভাবতেও পারিনি আর কোনো পুরুষ আমার জীবনে আসবে। কিন্তু কী করে যে কী হয়ে গেল…” বলতে বলতে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
“আপনার হাজবেন্ড। না মানে আপনার হবু হাজবেন্ড বা আপনার প্রেমিক। যার কথা আমরা বলছিলাম। তার নাম কি মোতালেব?”
রেবা বেগম আমার দিকে তাকালেন। চিন্তিত গলায় বললেন, “হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?”
জবাব না দিয়ে ফের প্রশ্ন করলাম, “আপনি বলেছিলেন অমিশার বাবা দূরে কোথাও চলে গেছেন। তা হলে উনি কে?”
মুহূর্তেই রেবা বেগমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি ইতস্তত করে বললেন, “আ-আমার কিছু কাজ আছে। একটু আসছি। আপনি চা’টা খেয়ে যাবেন কিন্তু। আর হ্যাঁ, দু’টো বিস্কিটও নেবেন।” বলে তিনি দায়সারাভাবে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আমি চায়ের কাপে দু’বার চুমুক দিয়ে পকেট থেকে একটি সাদা কাগজ বের করলাম। সাথে একটি কলম। কাগজে লিখলাম, মিস রেবা বেগম, জানি আপনি আমার থেকে অনেক কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও ভালো ঠেকছে না। সত্য লুকিয়ে রাখা আপনার জন্য শোভনীয় হবে না। তা ছাড়া আপনি হয়তো জানেন, সত্য কখনো চাপা থাকে না। তাই অনুরোধ রইল, লুকিয়ে না রেখে সব সত্য আমাকে বলবেন। আমি আপনাদের ভালো চাই। তাই আবার আসব। আর হ্যাঁ, আপনার হাতের চায়ের স্বাদ সত্যিই খুব অসাধারণ। ইতি, অমিশা ভিলার ভাড়াটিয়া।
চিঠিটা টেবিলে রেখে বেরিয়ে এলাম। আকাশ পরিষ্কার। তবে অন্ধকার নেমে যাচ্ছে। বাঁ পাশের মুদি দোকানে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাত হতে বেশি দেরি নেই।
চলবে