অমিশা_ভিলা
#পর্ব _১০
লেখা_ইয়াছিন
রাত বারোটার পর অমিশা ভিলার পরিবেশ পালটে যায়।
একটা চাপা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাড়িতে। শব্দটা অনেকটা গোঙ্গানির মতো। মনে হয় কে যেন খুব করে কান্না আটকে রাখতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। যার ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিষাদের ঢেউ বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। তবে আর্তনাদের শব্দ এতটাই ক্ষীণ যে, কেউ ভালো করে কান পেতে না শুনলে ব্যাপারটা বুঝতেই পারবে না। সেই ক্ষীণ আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠে বাড়িটা।
ঘড়িতে যখন ঠিক বারোটা বাজে তখন আরো কিছু অস্বাভাবিক কান্ড ঘটে। আরো অনেক অস্বাভাবিক কান্ড দেখা যায়। তবে যা দেখা যায় না তা হলো চাঁদ। এই বিষয়টা গত ক’দিনে আমি লক্ষ্য করেছি। রাত বারোটার পর অমিশা ভিলা থেকে আকাশের দিকে তাকালে সেই চিরচেনা আকাশের দেখা মিলে না। সন্ধ্যের পর যদিও আকাশ, তারা, চাঁদ এসব দেখা যায়। কিন্তু রাত বারোটার পর কখনোই নয়। তখন উল্টো চোখে পড়ে গাঢ় অন্ধকার টুকরো টুকরো ইটের মতো কী যেন মাথার উপর ভেসে আছে। মনে হয় সেই ইটের টুকরোগুলো চারতলায় উঠলেই ধরা যাবে। কিন্তু আজ অবধি আমি চারতলায় উঠতে সাহস করিনি।
আজও একই দৃশ্য। একই শব্দ। একই রকম পা টেনে টেনে এগিয়ে আসা। একইরকম অন্ধকার। সবকিছু ধীরে ধীরে সয়ে গিয়েছে আমার। এখন আর অতটা ভয় লাগে না। কিন্তু যখন দিজা পেছন থেকে ডাকল তখন কেন জানি না আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। এক পশলা শীতল হাওয়া বোধহয় কানে কানে বলে গেল, “এই হলো অমিশা ভিলা’র গোলকধাঁধা। এর থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।”
হ্যাঁ, সত্যিই কঠিন। যতটা সহজে সবকিছু ভুলে গিয়ে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাব ভেবেছিলাম বিষয়টা তত সহজ নয়। যত সময় যাচ্ছে সবকিছু আরো বেশি পেঁচিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আরো ফেঁসে যাচ্ছি আমি। এগিয়ে যাচ্ছি মরণফাঁদের দিকে। বিপদ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা। হ্যাঁ, সত্যিই নতুন বিপদের আশঙ্কায় গা হিম হয়ে যাচ্ছে আমার। যেভাবে দিনদিন সবকিছু এলোমেলো হচ্ছে শেষে যদি অমিশা রেপ অ্যান্ড মার্ডার কেসে আমাকেই ফাঁসিয়ে দেয়া হয়! আজ নিজের বউয়ের চোখে আমি খুনি, ধর্ষক। বাকি সবার চোখে হতে কতক্ষণ!
তখনও জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আবারো দিজার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি…”
দ্রুত ছুটে গেলাম৷ অন্ধকারে পকেট হাতড়ে লাইটার বের করে মোমবাতিতে আগুন দিলাম। এক হাতে মোমবাতি নিয়ে অপর হাতে পানির গেলাস এগিয়ে দিতেই দিজা এক নিমিষে পানিটুকু শেষ করে গেলাসটা ফিরিয়ে দিলো। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অসামির মতো মাথা নিচু করে ফেললাম। দিজা করুণ গলায় বলল, “এমন একটা মানুষকে ভালোবেসেছি আমি! একটা খুনি, একটা ধর্ষককে ভালোবেসে বিয়ে করেছি আমি!”
সঙ্গে সঙ্গে ধু-ধু বাতাস এসে মোমবাতির আলো নিভিয়ে দিয়ে গেল। একটা অদৃশ্য আওয়াজ ভেসে এল চারদিক থেকে। একটা জ্বালাময়ী মেয়েলী কণ্ঠস্বর। সেই কণ্ঠ হুঙ্কার দিয়ে বলল, “বিনা দোষে কাউকে দোষারোপ করা অন্যায়। ঘোর অন্যায়।”
দিজা আঁতেক উঠে বলল, “কে কথা বলছে? আর কে আছে এ-ঘরে?” অন্ধকারে আমার হাত টেনে ধরে বলল, “কাকে লুকিয়ে রেখেছো তুমি? কে কথা বলল এখন? বলো! কোন মেয়েকে নিয়ে আছো তুমি এখানে?”
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল দিজা। আমি কাঁপা হাতে মোমবাতি জ্বালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু যতবার চেষ্টা করলাম ততবারই এক ঝাপটা হাওয়া এসে আগুনটুকু নিভিয়ে দিয়ে গেল। হঠাৎ খেয়াল করলাম দিজার চোখদু’টো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, “কে তুমি? এই কে তুমি বলো? এখানে কী করছো?”
সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি একটা ভীষণ কালো ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। তাকে চিনতে এক মুহূর্ত সময় লাগল না আমার। কারণ সেই অন্ধকার ছায়াটাই অমিশা। আমি দ্রুত ফিরে তাকিয়ে দিজার চোখ চেপে ধরলাম৷ ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম, “তাকাবে না দিজা। চোখ বন্ধ করো। চোখ বন্ধ করো বলছি।”
দিজা এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে আবার সেই অন্ধকার ছায়ার দিকে তাকাল। যেই না সেই ছায়াটার কাছে যাবার জন্য পা বাড়াল ঠিক তখন চারপাশ আলোকিত করে বিদ্যুৎ চলে এল। আর সেই ছায়াটা অদৃশ্য হয়ে গেল। দিজা দিশেহারার মতো খুঁজতে থাকল ছায়াটাকে। বলতে লাগল, “কোথায় গেল? কোথায় গেল মেয়েটা? এখানেই তো ছিল! এখন কোথায় গেল?”
আমি দিজার হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম। বললাম, “তুমি তাকে পাবে না। সে নেই দিজা। তাকে তুমি কখনোই পাবে না।”
আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। আবার সেই অন্ধকার। সেই সাথে অমিশার ছায়াটা আবারো ভেসে উঠল। চারপাশটা এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। এদিকে অমিশার ছায়া এতটাই কালো যে, ঘন অন্ধকারে দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়। আবার দিজার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। আবার সে ছায়াটা ধরতে যাচ্ছিল। ঠিক তখন বিদ্যুৎ চলে এল। ঝলমলে আলোয় চারপাশের সবকিছু স্পষ্ট দেখা গেলেও ছায়াটাকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে গেল না।
এবার দিজা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। সে ভীত, সন্ত্রস্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হতভম্বের মতো বলল, “কী হচ্ছে এসব?”
এতক্ষণে আমি সুযোগ পেলাম। দিজার কাছে গিয়ে তার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বললাম, “যার ছায়া তুমি দেখেছো সে আর কেউ না, স্বয়ং এ-বাড়ির মালিক মৃত অমিশা।”
সব ঘটনা শুনে অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে দিজা। আমি সারা রাত দিজার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল বুলিয়ে দিয়েছি আর অমিশার গল্প বলেছি। বলেছি ছোটোবেলায় অমিশার সাথে দেখা হওয়ার গল্প। ছাদে নিয়ে গিয়ে তাকে চমকে দেওয়ার জন্য প্রপোজ করার গল্প। বলেছি আজ থেকে দশ বছর আগে এ-বাড়িটা অমিশার নামে লিখে দেওয়ার গল্প। বলেছি সেই ঝড়ের রাতের গল্প। যে-রাতের কালো থাবা বাঁচতে দেয়নি অমিশাকে। যে রাতে ঘরে আটকে রেখে অমিশাকে ধর্ষণ করতে সাহায্য করে তারই সৎ বাবা মোতালেব উল্লাহ।
সেইসব গল্প শুনতে শুনতে আমার কোলে মাথা রেখে চোখের জলে গাল ভাসিয়েছে দিজা। কখনো কখনো এক-আধবার চোখ মুছে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছে। ঘোলাটে চোখে আমাকে দেখে নিয়ে আবারও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছে। শেষরাতে চোখের কোলে জল নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আমি তখনও তার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছি। দু’চোখে ঘুম নেই। মনে শুধু একটাই ভাবনা, শেষমেশ দিজাকে নিয়ে ফিরে যেতে পারব তো?
ভোরের নতুন আলো ছড়িয়ে পড়ার আগে আগে অতি সাবধানে দিজার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে বালিশের উপর রেখে বাথরুমে গেলাম। ঘুমে ভালো করে তাকাতে পারছি না। আয়নার দিকে চোখ পড়তেই একজোড়া লাল চোখ দেখতে পেলাম। অযত্ন অবহেলায় বড়ো হওয়া ক’দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি চোখে পড়ল। থাক, বেঁচে থাকলে শেভ করা যাবে। এখন শুধু দাঁত ব্রাশ করে মুখে কয়েক ঝাপটা পানি মেরে বেরিয়ে এলাম। দিজার গা স্পর্শ করে ডাকলাম, “দিজা, এ্যাই দিজা! শুনো, সকাল হয়ে গেছে। এখনি বেরোতে হবে তো!”
দিজা ঢুলঢুলে চোখে মুখ তুলে তাকাল। তার চোখদু’টোও লাল। ধরা গলায় বলল, “কোথায় যাবে?”
“জানি না। আপাতত পালাতে হবে। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে।” কথাটা বলে শেষ করতে পারিনি দিজা এক লাফে উঠে বসে বলল, “তাই বলে পালিয়ে যাবে? আর অমিশা? তার খুনের কী হবে?”
“ওসব জানি না। যে মরে গেছে তার কথা ভেবে নিজের জীবন বিপন্ন করার কোনো মানেই হয় না। চলো চলো।” বলে দিজার হাত ধরে টান দিলাম আমি। দিজা এক হেঁচকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “এতটা সেলফিশ কী করে হতে পারো তুমি? একবার অমিশার সাথে হয়েছে। এরপর আমার সাথে এরকম হবে না তার কী গ্যারান্টি?”
“আমি কিচ্ছু জানি না দিজা। আমি শুধু বেঁচে থাকতে চাই। তোমায় নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। চলো এখান থেকে পালাই।”
দিজা শক্ত করে আমার হাত ধরে বলল, “কিন্তু তুমি এমন ছিলে না আরজু। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল তোমার মনে আছে?”
“হ্যাঁ, মনে আছে।” আনমনে বললাম। এরপর চোখের সামনে ভাসতে লাগল সেই দৃশ্য। সেদিন প্রথমবার অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী এক মেয়েকে দেখেছিলাম। মেয়েটির নাম, মেয়েটির নাম দিজা…
চলবে