#অমানিশা❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪
রাস্তার ধারে একটা কালো কুকুর ভিজছে। ভিজছে বলাটা ভূল, মূলত সে ভিজতে বাধ্য হচ্ছে। ঝুমঝুমে বৃষ্টিতে
মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি কোথাও। আরশাদ রিকশা ভাঁড়া মিটাচ্ছিলো। মুনতাহা তখনো তার বাহুর শার্ট টেনে ধরে রয়েছে। অবশ্য সারারাস্তায় ছাড়েওনি। একভাবে ধরেই রেখেছে তখন থেকে।
বাদামী চামড়ায় মানিব্যাগটা পকেটে ঢোকালো আরশাদ। এদিক ওদিক তাকিয়ে মুনতাহাকে নিয়ে গেটের দিকে এগোতে এগোতে বললো,”আপনিতো আমাকে রক্তাক্ত করে ফেললেন মুনতাহা।”
মুনতাহা কপাল কুচকালো। বললো,
—“মানে?”
আরশাদ একঝলক হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“শার্টটা দেখলে যে কেও বলবে আমাকে বুঝিমাত্র গুলি করা হয়েছে। রক্ত মেখে একাকার।”
আরশাদের দৃষ্টি অণুসরণ করে তাকালো মুনতাহা। আৎকে উঠলো মূহুর্তেই। হকচকিয়ে শার্টের হাতা ছেড়ে দিলো। বিহ্বল চোখে চেয়ে বললো,”সরি, আ…আমি বুঝিনি।”
—“আহা! ঠি ক আছে। আপনি ধরুন। আমি এমনেই বললাম।” হাসলো আরশাদ।
মুনতাহা ধরলোনা। অপরাধীর মতোন চোখ নামিয়ে ঈষৎ লজ্জিত কন্ঠে বললো,” আপনি…গরম পানি দিয়ে ধুলেই আলতার রং উঠে যাবে।”
আরশাদ নরম গলায় বললো,
—“আচ্ছা ঠি কাছে, আসুন সাবধানে। আংকেল বোধহয় ফিরেননি এখনো।”
ভেতরে ঢুকে দরজা ধরে কয়েকসেকেন্ড দাড়িয়ে রইলো মুনতাহা। মাথাটা হাল্কা বের করে ঠোঁট সরু করে
তু তু জাতীয় আওয়াজ করতেই রাস্তার ধার থেকে একপ্রকার দৌড়ে কাছে চলে এলো কালো কুকুরটা। মুনতাহা ঢোকার জন্য একটু সরে দাড়াতেই চটপট ঢুকে পড়লো কাকভেজা গায়ে। কৃতজ্ঞতার সহিত লেজ নাড়াতে লাগলো অনবরত। প্রায় সাথেসাথেই দারোয়ান আংকেল কোথ্থেকে যেনো উদয় হলেন। কুকুরটাকে বের করার জন্য দ্রুতগতিতে পা বাড়াতেই মুনতাহা শক্ত চোখে চেয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
—“ওকে বের করবেন না আংকেল, বৃষ্টি কমলে ও নিজেই চলে যাবে।”
দারোয়ান থেমে গেলো। মুনতাহা বাড়িওয়ালার মেয়ে। উনিশ- বিশ হলে তার চাকরি চলে যাবে ভেবে মৃদুকন্ঠে সম্মতি দিলো সে,”আইচ্ছা, আপামনি।”
আরশাদ নিশব্দে হাসলো। চাঁদের তেজ দেখে খানিকটা প্রশংসাও করলো মনে মনে।
মহাবিপত্তির সমাপ্তি ঘটাতে না ঘটতেই বাঁধলো আরেক বিপত্তি।
গেটে চকচকে তালা ঝুলছে। মুনতাহা বেকুবের মতো চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আরশাদ তার কেবল ফোনধরা ফাঁকা হাতদুটোর দিকে চেয়ে বারকয়েক খুকখুক করে পরিষ্কার গলায় বললো,”আপনার কাছে চাবি নেই?”
মুনতাহা ঘাড় বাকিয়ে তাকালো। দৃষ্টি বিনিময় হলো। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো,”আমি তো চাবি নেইনা সাথে। আব্বুর কাছেই থাকে সবসময়।… মনে ছিলোনা।” কন্ঠের ভার ছেড়ে দিলো সে।
নিচের ঠোঁটের লিপস্টিক উঠে গেছে। লালের ফাঁকে ফাঁকে গোলাপি রং বেরিয়ে এসেছে। বামকোণের দিকে ছড়িয়ে গেছে কিছুটা।
আরশাদ বিচলিত ভঙ্গিতে চোখ নামালো। এমন হ্যাংলো স্বভাব তার নয়। কখনোই নয়। আজীবন নিজেকে সংযমী উপাধিই দিয়ে এসেছে।
বারকয়েক ঢোক গিলে বললো সে,”আপনি এই ফ্ল্যাটে বসুন কিছুক্ষণ। আংকেল আসলে চলে যেয়েন।” কন্ঠ এলোমেলো শোনালো নিজের কাছেই। পকেট হাতরে চাবি বের করলো আরশাদ। মুনতাহা কি যেনো ভেবে চুপচাপ এগিয়ে এলো। আরশাদ সন্ধানী গলায় বললো,
—“আপত্তি করলেন না যে? বিশ্বাস করেছেন তাহলে আমাকে?”
—“আব্বুতো বললো বিশ্বাস করতে।”মুনতাহার সহজসরল উওর।
আরশাদ একটু চুপ থেকে বললো,
—“আব্বু না বললে করতেন না?”
মুনতাহা একঝাঁক দোটানা নিয়ে উওর দিলো,”কি জানি।”
সাবিনা বেগমকে হাভাতের মতো চেয়ে থাকতে থেকে খানিকটা ইততস্তবোধ করলো মুনতাহা। আরশাদের পাশ ঘেঁষে গেলো দাড়ালো। আরশাদ জুতোর ফিতা খুলছিলো। মুনতাহা চাপা কন্ঠে বললো,”আপনি বলুন আমি কে। উনি কি না কি ভাবছেন…”
আরশাদের মাও বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে। মুনতাহাকে একনজর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সে বলল,
—“তুই এমনে ভিজেছিস কেনো বাবা? ও কে ?”
আরশাদ সহজ গলায় উওর দিলো,
—“মাহতাব আংকেলের মেয়ে, মুনতাহা। আংকেল ঝড়ে আটকা পড়েছেন তাই ভার্সিটি থেকে নিয়ে আসতে বললেন। ঝড়বৃষ্টির মধ্য, রাত হয়ে গেছে। চিন্তা করছিলেন খুব। তাই নিয়ে আসলাম। উনার কাছে ফ্ল্যাটের চাবি নেই। আংকেল আসা পর্যন্ত এখানেই থাকুক।”
আরশাদের মা হাসলেন এবার। একটা বিনীত আদুরে ভাব চলে এলো কন্ঠে,
—“ওহ, বসো বসো। বসো মা। দাড়িয়ে আছো কেনো?”
মুনতাহা তীব্র সংকোচ নিয়ে আরশাদের দিকে তাকালো। যেনো তাকে ছাড়া এক পা বাড়াতেও লজ্জা, ভীতি, দ্বিধা।
আরশাদ আশ্বস্ত করে বললো,
—“বসুন মুনতাহা, আমার আম্মা আর ইনি আমার দাদু। ভয় পেয়েননা।”
_____________
মাহতাব সাহেব ফিরলেন সাড়ে দশটার দিকে। উদ্ভ্রান্তের মতো অবস্থা তার। কি একটা জ্যাম রাস্তায়। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝরাস্তায় মনে পড়েছে মেয়ের কাছে চাবি নেই। আরশাদকে ফোনও দিতে পারেননি।
সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে পরপর কয়েকবার ব্যস্ত হাতে কলিংবেল চাপলেন তিনি। দরজা খুললো আরশাদই।
সাবিনা বেগম বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন নিজের ঘরে। সবুজ রংয়ের হাল্কা বাতি জ্বালানো। মুনতাহা ঘুমাচ্ছে তার পাশেই। পা দুটো ভাঁজ করা। গালের নিচে হাত দেয়া। কাঁচের চুড়িগুলো হাতে নেই। কেউ একজন যত্ন করে খুলে রেখেছে। ঠোঁটের রং মুছিয়ে দিয়েছে। চুলগুলো আলগা হাতে বেঁধে দিয়েছে। ঘুমের ঘোরে যাতে পড়ে না যায় সেজন্য পাশে একটা কোলবালিশও রেখে দিয়েছে।
মাহতাব সাহেব দরজার কাছে দাড়িয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। মলিন কন্ঠে বললেন,
—“ঘুমিয়ে পড়েছেতো।”
আরশাদ উওর দিলো,
—“একটু আগেই ঘুমিয়েছে আংকেল। আপনার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারবার ঝিমিয়ে পড়ছিলো। আম্মা জোর করে ভাত খাইয়ে দিলো একটু। তারপর দাদুর সাথেই বসে ছিলো। ঘন্টাখানেক আগে দেখি ঘুমাচ্ছে। তাই আর ডাকিনি।”
~চলবে~