#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ৭
সুরমা

কাজল রেখাও বিলকিস বেগমের পাশে বসলেন। তিনি বললেন,,,,,,,
-রিমি রিয়াদের বউ। তুমিতো বিয়েতে আসো নি। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,

-আমি অনুমান করে নিয়েছি। কাজল রেখা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,,,,,
-বউমা যাও। খাবারের আয়োজন করো। আর এখন হাল্কাপাতলা কিছু নাস্তা দাও। শরবত দাও। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,,

-না। আমার জন্য কিছু করতে হবে না। আমি কিছু খাবো না।
-তা বললে কিভাবে হবে? তুমি কি সব সময় বাসায় আসো? যাও বউমা। তুমি কিছু করো। কতো দিন পর আসলে। বললেই না খাইয়ে ছেড়ে দিবো।

-না না। তোমরা সবাই বসো। আমি কিছু বলার জন্য এসেছি। অনু কোথায়? বাসায় নেই? ওকে দেখছি না যে। প্রিতি হেসে বলে,,,,,

-আপু রুমে। আপনি বসুন আমি আপুকে নিয়ে আসি। প্রিতি কোনো কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা না করেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। অনু ব্যালকনিতে বসে বই পড়ছিল। প্রিতি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়ে অনুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা প্রিতির এমন কাণ্ডে অনু চমকে উঠে। অনু বলে,,,,,,

-কি করছিস এসব? আরেকটু হলেতো ভয়ে মরেই যেতাম। এভাবে কেউ ধরে???
-আপুরে, ভয়ে না মরলেও আমি এখন এমন একটা খুশির সংবাদ দিবো যাতে তুই খুশিতে মরে যাবি। অনু ভ্রু কুঁচকে বলে,,,,,,,,

– কি সব পাগলের মতো বলছিস? সর এখান থেকে। খুশিতে কেউ মরে না। বেশি খুশিতে বেশি বাঁচার স্বপ্ন দেখে। প্রিতি অনুকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলে,,,,,,

-না মরলেও অনেক সময় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। খুশির সংবাদ দিলে আমাকে কি দিবি বল?
-আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছু নাই। এমনি বলতে চাইলে বল।

-না। সব কিছু এমনি বলা যায় না। আগে বল কি দিবও।
-আল্লাহ আগে আমাকে ছাড়। ভেঙ্গে গুড়ো করি দিবি নাকি। প্রিতি অনুর কাধে থুতনি রেখে বলে,,,,

-আমারতো জোরে চেপে ধরতে ইচ্ছে করছে রে আপু। অনু জোর করে প্রিতির হাতের আবদ্ধ থেকে মুক্ত হয়ে বলে,,,,,
-হয়েছে। এতো নাটক রেখে আসল কথা কি বল।
-আপু, আপু, আপু। অনু দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,,,

-তোকে ইচ্ছে করছে থাপ্পড়াই। এতো ঢং করে বলার কি আছে? সরাসরি কথা বলতে পারিস না?
-এটু মজা লইয়া বলতেছি। প্রিতি দাঁত বের করে কিলকিল করে হাসে। অনু বলে,,,,,,

-তুই যাতো। আমার অনেক পড়া। আমাকে আর ডিস্টার্ব করবি না। প্রিতি অনুর হাত থেকে বইটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে বলে,,,

-আগে আমার সাথে চল। পড়াশোনা পরে হবে। প্রিতি অনুর হাত ধরে টেনে তুলে। অনু বিরক্তি নিয়ে বলে,,,,,
-তোকে যে কি করা উচিত। এখন আবার আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস??
-সারপ্রাইজ সিস্টার সারপ্রাইজ। অনু কিছু না বলে প্রিতির সাথেই যায়। কারণ কথা বললেও উপায় নেই। প্রিতি কারো কথা শোনবে না।

অনু ড্রয়িংরুমে গিয়ে বিলকিস বেগমকে দেখে হতবাক হয়ে যায়। সে আবুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। বিলকিস বেগমও অপলকে অনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই কবে দেখেছিলেন সঠিক মনে নেই।

তবে তখন অনু এতো বড় ছিল না। এখন আরো মায়াবী লাগছে। অনুর পরনে ব্লু সালোয়ার কামিজ। সাদামাটায় অনুকে অপরূপ লাগছে। বিলকিস বেগম মনে মনে ছেলের পছন্দ দেখে খুশি না হয়ে পারলেন না।

এমন একটা মেয়েকে ভালো না বেসে কেউ পারবে না। হয়ত অবাকও অনুর এই রূপেই পাগল হয়ে গেছে। অনু বিলকিস বেগমকে দেখে কেমন নার্ভাস ফিল করছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে,,,,,,,

-আসসালামু আলাইকুম মামী। কেমন আছেন? অবাকদের বাসায় অনুর বেশি যাওয়া হয়নি। এমনকি মামীর সাথেও তেমন কথা হয়নি কখনও। কিন্তু হঠাৎ বিলকিস বেগমকে দেখে অনুর কেমন অস্থির লাগছে। বিলকিস বেগম বলে,,,,,

-ওয়ালাইকুম সালাম। আমি আল্লাহর রহমতে আছি। তুমি কেমন আছো?
-জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ।

-দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো বসো এখানে। অনু গিয়ে বসে বিলকিস বেগমের পাশে। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,,
-কতো বড় হয়ে গেছে। যখন লাস্ট দেখেছিলাম তখন ছোট ছিল। আর মাশআল্লাহ, বেশ রূপবতীও হয়েছে। অনু মুচকি হেসে মাথা নিচু করে।

রিমি কিছু ফল, মিষ্টি, শরবত নিয়ে আসে। বিলকিস বেগম খাবার দেখে বলেন,,,,,,,
-আমি মিষ্টি জাতীয় খাবার খাইনা। ডায়াবেটিস। আসলে আমার এখানে আসার একটা কারণ আছে। আমি কথাগুলো বলেই চলে যাবো। আমার জন্য কিছু করতে হবে না।

বিলকিস বেগমের কথা শোনে কাজল রেখা, রিমি, প্রিতি অনু সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকায়। বিলকিস বেগম একটু থেমে বলেন,,,,,,

-কয়দিন আগে আমি অবাকের বিয়ের কথা বলাতে অবাক আমাকে বললো সে অনুকে পছন্দ করে। মানে অনুকে বিয়ে করতে চায়। বিলকিস বেগম থামলেন। বিয়ের কথা শোনে অনু লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলে,,,,,,
-আমি রুমে যাই। তোমরা কথা বলো। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,,

-না। তুমি বসো। কথা গুলো যেহেতু তোমাকে নিয়ে তোমার শোনা উচিত। আর আমি তোমার সাথে কথা বলবো বলেই এসেছি। অনু চোখ তুলে তাকায়। তার কেমন জানি লাগছে। কাজল রেখা বললেন,,,,,

-অনু আর অবাক দুজন দুজনকে অনেকদিন ধরে পছন্দ করে। এটা সবাই জানেও। আমি চেয়েছিলাম ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে। তুমি এখন না আসলেও আমি কয়েকদিনের মধ্যে যেতাম। তুমি এসে ভালোই করেছো। বিলকিস বেগম নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,,,,,,

-অনু আর অবাকের বিয়েটা সম্ভব না। বিলকিস বেগম এই কথাটা বজ্রের মতো গিয়ে লাগলো সবার কলিজায়। অনু প্রায় কেঁপে উঠে। হঠাৎ করেই বুকটা ধরাম করে উঠে। অনু চোখ বড় বড় করে তাকায়। কাজল রেখে স্বাভাবিক ভাবে বললেন,,,,,

-সম্ভব না কেন? অবাক কি এখন অনুকে বিয়ে করতে চায়না?
-অবাক চাইলেই যে বিয়েটা হবে এমনটা না। রেখা, আমি এখন কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শোন। অনু মা তুমিও শোন। রেখা তোমার ভাইর বন্ধু হায়দার ভাইয়ের কথা তো তুমি সব জানো। উনি তোমার ভাইকে কতটা সাহায্য করেছিলেন ? বিলকিস বেগমের কথায় কাজল রেখা বললেন,,,,,,

-হ্যাঁ জানি। কিন্তু অনু আর অবাকের বিয়ের মধ্যে উনি আসছেন কেন? আর বিয়েটা হবেই না বা কেন??
-কারণ, তোমার ভাই হায়দার ভাইকে কথা দিয়েছিল উনার মেয়েকে ছেলের বউ বানাবেন। মারা যাওয়ার আগেও বলে গেছেন। এই দায়িত্বটা আমায় দিয়ে গেছেন। আমি এখনও বেঁচে আছি। আর আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় উনার কথার খেলাপ করতে পারিনা। বিলকিস বেগম জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন,,,,,,

-আমি জানি অনু খুব ভালো মেয়ে। ওর মতো দ্বিতীয় একজন হয়না। রূপে গুণে বুদ্ধিমতী। এমন একটা মেয়েকে ঘরে তুলতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমারও থাকতো না। কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই। অনুর মাথা ঘুরছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

এসব কি বলছেন উনি? তার মনে হচ্ছে কালবৈশাখী ঝড় হয়ে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। অনু সোফা শক্ত করে ধরে। বিলকিস বেগম অনুর দিকে তাকিয়ে বলেন,,,,,

-আমি জানী, আমি সারাজীবন তোমার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকতো তাহলে আমি তোমাকে আমার ঘরে তুলতাম।

আমার ছেলেটাকে অপরাধী মনে করো না। ও এই বিয়ে সম্পর্কে কিছু জানতো না। সে মন থেকেই তোমাকে ভালোবেসেছিল। হায়দার ভাইর মেয়েটা বড্ড অবুঝ। সে অবাককে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।

অবাককে স্বামী হিসাবে মানে। এই মেয়েটার মনটা যদি আমি ভেঙ্গে দেই তাহলে আমি জান্নাতে গিয়েও শান্তি পাবো না। বিলকিস বেগমের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অনুও কাঁদছে। বিলকিস বেগম অনুর দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেন,,,,,,

-হায়দার ভাই মেয়েটাকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন। মেয়েটা ছোট বেলায় তার মাকে হারিয়েছে। আমাকে মা বলে ডাকে। এই মা মরা মেয়েটাকে এতো বড় আঘাতটা দিলে সইতে পারবে না। মেয়েটা কষ্টে কষ্টে এতোটুকু বড় হয়েছে।

এখন থাকে নতুন করে আরেকটা আঘাত দিলে আল্লাহ হয়তো আমাকে কোনদিন ক্ষমা করবেন না।
তুমি হয়তো আমাকে স্বার্থপর মনে করছো। হয়তো ভাবছো আমি আমার কথাই ভাবছি শুধু।

কিন্তু আমিতো নিজের জন্য কিছুই চাইছি না। আমার এই সিদ্ধান্তে আমার ছেলেও কম কষ্ট পাবে না। আমি আমার ছেলের সুখটাও দেখছি না। তুমি প্লীজ, আমার ছেলের থেকে দূরে সরে যাও। আমি তোমার কাছে হাত জোর করে বলছি, আমাকে এটুকু দয়া করো।

তুমিও কষ্ট পাবে। কিন্তু কয়দিন পর এই দাগটা কাটিয়ে উঠার মতো ক্ষমতা তোমার আছে। অবাকে না পেলেও তুমি কোথায় থেমে যাবে না। তোমারতো কোনো দিক দিয়ে কিছু কমতি নাই। বিলকিস বেগম অনুর হাত দুটো নিজের কপালের সাথে লাগিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

অনুও কাঁদছে। তার বুকে ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদতে। কিন্তু সেটাও পারছে না। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এ কোন পরীক্ষার সামনে আল্লাহ দাঁড় করিয়েছে তাকে। এ কোন কষ্টের আগমন ঘটছে জীবনে। কাজল রেখা, রিমি প্রিতি সবাই বাকরোদ্ধ হয়ে যায়।

বিলকিস বেগম নিজের চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই বেকুবের মতো বসে আছে। একমাত্র অনুর চোখ দিয়েই বৃষ্টি পড়ছে। বিলকিস বেগম কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থেমে গেলেন। তিনি আবার ফিরে এলেন। তিনি নিস্তেজ হয়ে বললেন,,,,,

-সামনে শুক্রবার অবাকের বিয়ে। অনু তুমি যদি নিজ থেকে ওর থেকে দূরে সরে যাও অন্তত আমি নিশ্চিন্ত হবো। ওও হয়তো তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইবে।

ওর বিয়ের পরও যদি তোমাদের সম্পর্ক অটুট থাকে তাহলে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। অনু, আমি বিশ্বাস করি তুমি আমার কথা ফেলবে না। বিলকিস বেগম জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বললেন,,,,,,

– ভেবেছিলাম একমাত্র ছেলের বিয়েটা দুমদাম করে দিবো। সারা এলাকার মানুষদের দাওয়াত করবো। আত্মীয়স্বজনদের একত্র করবো। কিন্তু এখন হয়তো সেরকম কিছুই হবে না।

তেমন কাউকে বলিও নি। আমার শরীরের অবস্থা তেমন ভালো না। কোনদিন মরে যাই ঠিক নেই। তোমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আমাকে নিজগুণে ক্ষমা করো। অনু তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও।

জানি না আজকের ঘটনার পর আমাকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা। তবুও যদি পারো ক্ষমা করে দিও। আর আমার কাজের জন্য আমার ছেলেটাকে কেউ অভিশাপ দিও না। অবাক এসবের জন্য কোনো ভাবেই দায়ী না।

আমি কখনও ভাবিনি এমন একটা কাজ আমাকে এই শেষ বয়সে এসে করতে হবে। শুধুমাত্র স্বামীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করবো বলে আমাকে এই রাস্তাটা বেঁচে নিতে হয়েছে।

বিলকিস বেগম আর দাঁড়ালেন না। তিনি অপরাধীরর মতো বের হয়ে আসলেন। এক মুহূর্তে বাসাটা কেমন থমথমে হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত আগেও সব ঠিকঠাক ছিল। কে জানতো হঠাৎ করে এমন এক দুর্যোগ এসে হানা দিবে।

সবাই নীরব। শুধু অনুর কাছ থেকে কেমন গুণ গুণ শব্দ ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ পরপর তার ভেতর থেকে চাপা কষ্ট বাতাসের গতিতে হবে হচ্ছে। কিছুক্ষণ কাঁদার পর অনুও পাথরের মতো বসে থাকে।

প্রিতি খেয়াল করলো অনু কেমন ঢুলে পড়ে যাচ্ছে। প্রিতি তাড়াতাড়ি অনুকে ধরে ফেলে। প্রিতি চিৎকার করে বলে,,,,,

-আপু, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে? প্রিতির চিৎকারে কাজল রেখা রিমিও ছুটে এসে ধরে অনুকে। অনুর শরীর সাপের শরীরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। কাজল রেখা উত্তেজিত হয়ে বললেন,,,

– কি হয়েছে মা? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল। কাজল অনুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মুখে গলায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। রিমি বললো,,,,,,,
– অনু তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। শরীর শীতল হয়ে গেছে। বিলকিস বেগম বললেন,,,,,,

– ওর শরীরে তেল গরম করে দাও। অনুতো অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার এমন অবুঝ একটা মেয়েকে নিয়ে মা ছেলে মিলে খেলা শুরু করে দিয়েছে।

আমার মেয়েটার কিছু হলে আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলবো না। আমি ওকে কতবার বললাম, কোনো ছেলেকেই এতোটা বিশ্বাস করতে হয়না। আমার কথায় পাত্তা দেয় নি। এখন বুঝলো তো।

অবাক ঠিক বিয়ে করে সংসার করবে। কিন্তু আমি আমার মেয়েটার বিয়ে দিতে পারবো না। পাড়াপড়শি সবাই জানে। কোনো ছেলেই আর আমার মেয়েকে বিয়ে করবে না। আমার মেয়ের সুন্দর জীবনটা অকালে শেষ হয়ে গেলো। কাজল রেখা কাঁদতে লাগলেন।

রিমি রান্না ঘরে দৌঁড়াল তেল গরম করে আনতে। প্রিতি বিরক্তি নিয়ে বললো,,,,,

-আম্মু প্লীজ চুপ করো। এখন কি এসব কথা বলার সময়? কাজল রেখা চুপ করলেন। কিন্তু মনে মনে কষ্ট পেতে লাগলেন। এতো বড় একটা আঘাত অনু সইতে পারবে তো?

এতো আদরের মেয়েকে এতটুকু বয়সে চুল পরিমাণ আঘাতও দেন নি। অবাকের সাথে সম্পর্কে যাওয়ার সময় তিনি একবার না করেছিলেন। কিন্তু মেয়ে শোনে নি। তিনি দ্বিতীয় বার আর অবাককে নিয়ে কিছু বলেন নি অনু কষ্ট পাবে বলে।

আজ সেই কষ্টই পেলো। কিন্তু এই কষ্টের দাগ যে বহুগুণ বেশি। আল্লাহ জানে এই কষ্টের দাগ কেটে উঠতে পারবে কিনা। নতুন করে নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারবেন কিনা।

অনু বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে চোখের লোনা জ্বলে। তার জ্ঞান ফিরার পর কারো সাথে কথা বলনি। সোজা নিজের রুমে চলে আসে। পেছন থেকে সবাই ডেকেছিল।

কারো কথায় সে পাত্তা দেয়নি। অবাক কি সত্যি তাকে ছেড়ে দেবে? ভাবতেই অনুর বুক ধরফর করে কাঁপতে শুরু করে। চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে। আল্লাহ কেন এতো বড় শাস্তি দিল তাকে।

কি অপরাধ করেছে সে?? অবাককে ভালোবেসে যদি অপরাধ করা হয় তাহলে কেন বুকের ভিতরে তার জন্য ভালোবাসা জন্ম দিলো আল্লাহ? তার জন্য কেন ঘৃণা জন্মদিলো না প্রভু। কেন? কেন?

অনুর কান্নার শব্দ ভেসে যাচ্ছে ব্যালকনির খোলা জানালা দিয়ে অনেক দূর। প্রিতি দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। সেও কাঁদছে। তার কষ্টও কম হচ্ছে না। কে জানতো প্রাণপ্রিয় আপুটাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে হবে একদিন।

সব সময় যার মুখে সুখের হাসি লেগে থাকতো আজ সেই মানুষটা কষ্টে কাতরাচ্ছে। প্রিতি গিয়ে বসে অনুর পাশে। তার হাত কাঁপছে। এই মুহূর্তে কি বলা যায় তাকে জানা নেই প্রিতির। আপু তুই কাঁদিস না। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রিতি কি অনুকে এটা বলে শান্তনা দিবে?

এটা বললেই আপুটার কান্না থেমে যাবে? এই কথাটা বলেতো অবুঝ বাচ্চাদের কান্না থামানো যায়। অনুতো অবুঝ নয়। সে খুব ভালো করেই জানে এটা ঠিক হওয়ার নয়। প্রিতি কাঁপা হাত রাখে অনুর পিঠে।

অনু ভেজা চোখে মাথা তুলে তাকায় প্রিতির দিকে। প্রিতির গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অনু শোয়া থেকে উঠে প্রিতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। প্রিতিও অনুকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ দিয়েও পানির বন্যা বইছে। প্রিতি কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,,,,

-আপু তুই কাঁদ। খুব কাঁদ। এতো পরিমাণ কাঁদ যাতে চোখের পানি হয়ে মনের কষ্ট সব বেরিয়ে আসে। চোখের পানিটাও মূল্যবান। এটাকে তুই বিফলে যেতে দিস না ।

কান্না থামার পর যেন মনে হয় এতক্ষণ কাঁদার পর তোর মনটা হালকা লাগছে। বুকের ভারটা কমেছে। অনুর কান্নার গতি বেড়ে যায়। প্রিতিও এবার শব্দ তুলে কাঁদতে শুরু করে। দুবোনের কান্নার আওয়াজ চলে যায় কাজল রেখার রুম পর্যন্ত।

বিলকিস বেগম নিঃশ্বাসের উপর নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট। কেন এতো কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছেন না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। কোনো শক্তি পাচ্ছেন না। চেয়ার থেকে উঠে যে বিছানায় শুবেন সেই শক্তিটুকু শরীরে নাই।

বিন্তিকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারছেন না। ভেতর থেকে আওয়াজটুকুও বের হচ্ছে না। মনে মনে বলছেন, বিন্তি তুই কোথায়? কিন্তু বাহিরে কোনো আওয়াজ করতে পারছেন না। সেই মুহূর্তে বিন্তি এসে দেখে বিলকিস বেগম ঘেমে একাকার। সে বিচলিত হয়ে বলে,,,,,

– আম্মা কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? বিলকিস বেগম বিন্তিকে দেখে সাহস পেলেন। তিনি মাথাটা হালকা নেড়ে হ্যাঁ বললেন। বিন্তি দেরি না করে দৌঁড়ে গেলো রান্না ঘরে।

ফ্রিজ খুলে আচারের বয়াম এনে বিলকিস বেগমের মুখে দিলো। একটা লেবু কয়েকটা টুকরা করে তার রস টাও খাওয়ালো সে। বিলকিস বেগমের ঘাম ঘাম ভাবটা কমে গেলো। বিন্তি আবার জিজ্ঞেস করলো,,,,,,
– আম্মা, এখন ভালো লাগছে? বিলকিস বেগমের মুখ থেকে অস্পষ্ট আওয়াজ আসলো। তার কি অর্থ বিন্তি বুঝলো না। বিন্তি বললো,,,,,,

– মাথায় পানি দিবো আম্মা? বিন্তি বুঝতে পারছে বিলকিস বেগমের প্রেশার বেড়ে গেছে। যখনি প্রেশার হাই হয়ে যায় তখনেই শরীর এমন হয়। সে বিলকিস বেগমের হাত ধরে তোলার চেষ্টা করে।

কিন্তু একার পক্ষে কষ্টকর হয়। তবুও সে কোনো রকম বিলকিস বেগমকে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। বিন্তি হাঁপিয়ে উঠে। ওয়াশরুম থেকে তাড়াতাড়ি এক বালতি পানি এনে বিলকিস বেগমের মাথায় ঢালতে শুরু করে।

অনেক্ষণ পানি দেওয়ার পর তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে বললেন, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আল্লাহ হয়তো চাইছে আমি আরো কয়েকটা দিন বেঁচে থাকি। তাই বিন্তিকে তখন রুমে পাঠালো।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here