#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ২১
সুরমা

অবাক আর মেঘ রিসোর্টে পৌঁছায় সন্ধে ৬টায়। রিসোর্টের সামনে এসে মেঘ বিস্মিত হয়। এতো সুন্দর কোনো ঘর হয় মেঘের জানা নেই। মেঘ আবেগ আপ্লুত হয়ে অবাকের হাত আঁকড়ে ধরে। অবাক কিছুটা রেগে চোখ গরম করে বলে,,,,,
-এভাবে ধরে রেখেছো কেন? হাত ছাড়ো। মেঘের মুখ কালো করে বলে,,,,,

-একটু হাতটাই তো ধরেছি।
-একটুকুও ধরবে না। মেঘ মুখ ঘুগরা করে দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক নরমাল হয়ে বলে,,,,,
-ভেতরে চলো
-আমরা এই বাড়িতে থাকবো?
-এটা বাড়ি না। রিসোর্ট
-আমরা এমন একটা বাড়ি বানাবো। আপনি, আম্মা আর আমি থাকবো। অবাক কিছু না বলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। মেঘও অবাকের পেছন পেছন যায় আর বকবক করতে থাকে। মেঘের বকবকানি শোনে অবাকের মাথা ধরে যায়। অবাক থমকে দাঁড়ায়। মেঘ জিজ্ঞেস করে,,,,,

-দাঁড়ালেন কেন? অবাক দাঁত চেপে ধীর কণ্ঠে বলে,,,,
-তুমি কি চুপ করে থাকতে পারো না? মেঘ হাসি হাসি মুখ করে বলে,,,,,
-আসলে আমি চুপ করে থাকলে আমার পেটের ভেতরে কথাগুলো তুফান শুরু করে দেয়। তাই কথা গুলো বলে মনটাকে শান্ত করি। নাহলে কলিজা ফেটে কোনদিন মরে যেতাম।

-আর একটাও কথা বলবে না। যদি নিঃশ্বাসের শব্দটাও আমি শোনি তাহলে তোমার খবর আছে । অবাকের রাগী মুড দেখে মেঘ চুপ করে থাকে।
রিসোর্টের রুম আগে থেকেই বুক করা ছিল। অবাক শুধু এসে ফরম পূরণ করে। তারপর রুমের চাবি নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। রুমে ঢুকে বিছানার উপর ব্যাগ রেখেই অবাক ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে। মেঘ ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখতে থাকে। রাজ প্রাসাদের মতো দেখতে রিসোর্টটা। রুমের ফার্নিচার সব সেইম ডিজাইনেরর। রুমের বেডকভার, দরজা জানালার পর্দা সব সাদা।

ড্রেসিংটেবিল, বিছানার পাশে ছোট ছোট টেবিল সাজানো তরতাজা ফুল গাছের টব দিয়ে। রুমে একপাশে ব্যালকনি। মেঘ ব্যালকনিতে গিয়ে আরো বিস্মিত হয়ে যায়। ব্যালকনিটা অনেক বড়। চারপাশে ফুলের টব। ব্যালকনিটার মেঝেতে সবুজ কার্পেট। ট্রিটেবিল, ডিভান। টেবিলেট মাঝখানে ফুলের টব। আর ব্যালকনি থেকে যতদূর চোখ যায় সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। মেঘ হা করে গ্রিল ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতো সুন্দর জায়গা। আগে কখনও এই জায়গাটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। অবাক ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে মেঘ রুমে নেই। ব্যালকনিতে উঁকি দিয়ে দেখে দাঁড়িয়ে মেঘ আছে। অবাক এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,,,,

– কি করছো এখানে? মেঘ অবাকের দিকে না থাকিয়েই বলে,,,,
– রুমটা দেখছি। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কি সুন্দর জায়গা। রুমটাও খুব খুব সুন্দর। অবাক ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,,,,,
-দেখা শেষ হলে ফ্রেশ হও। বাহিরে যাবো। মেঘ পিছন ঘুরে দেখে অবাক টাওয়াল দিয়ে মাথার চুল মুছছে। মেঘ মুগ্ধকর একটা হাসি দেয়। অবাককে গোসলের পর এতো স্নিগ্ধ দেখায় কেন? তার উপর থেকে তখন চোখ সরানো কঠিন হয়। মেঘের ইচ্ছে করছে অবাককে এখন একবার জড়িয়ে ধরতে। মেঘের আকাঙ্ক্ষা দিন দিন বাড়তেই লাগলো। স্বপ্ন বেড়ে চলেছে। কতোগুলো ইচ্ছা বুকের ভেতরে চেপে বসতে চাইছে। এজীবনে কি স্বপ্নগুলো পূরণ হবে? নাকি এই মানুষটার থেকে দূরে চলে যেতে হবে? ভাবতেই মেঘের মনে কালো মেঘে ঢেকে যায়। কষ্টে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। অবাক পেছনে ফিরে দেখে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। অবাক জিজ্ঞেস করে,,,,,,,

-দাঁড়িয়ে আছো কেন? মেঘ চমকে উঠে বলে,,,,
-এক্ষণি ঘুরতে বের হয়ে যাবো?
-কেন যেতে চাওনা?
-চাই চাই
-গুড। আমরা এখানে বেশি থাকবো না। সো সব একটু দেখে নাও। অবাক রুমে চলে আসে। মেঘ অবাকের পেছন পেছন আসে।
-একটু করে দেখবো কেন? বেশি বেশি দেখতে পারবো না? অবাক মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘ বলে,,,,,,

-না মানে বলছিলাম দেখবোই যখন একটু বেশি করে দেখলে কি সমস্যা?
-একটু করে মানে সময় বেশি ব্যয় করা যাবে না সেটা বুঝাতে চাইছি। আজ রাত দেখবে কাল দুপুর পর্যন্ত দেখবে। বিকেলের ট্রলারে সেন্টমার্টিন চলে যাবো। ওখানে জাস্ট দুদিন স্টেয় করবো। আমার এতো সময় নাই। অফিসে প্রচুর কাজ পড়ে আছে।
-আপনি এমন কিপ্টা কেন বলুন তো? মেঘের কথা শোনে অবাক চোখ বড় বড় করে বলে,,,,
-আমি কিপ্টা? হাউ ফানি। আমাকে এপর্যন্ত কেউ কিপ্টা বলেনি।

-কেউ তো আর আপনাকে আমার মতো পরখ করে দেখেনি। ঢাকা তিন প্লেইট ফুচকার কথা শোনেই আপনার চোখ আকাশে উঠে গেছিল। আমি দেখিছি। তিন প্লেইট ফুচকার দাম শুনেই যার এই অবস্থা। সেতো ঘুরতে এসে কিপ্টাগিরি করবেই।
-শোন, আমার চোখ টাকার জন্য আকাশে উঠেনি। ঠিক আছে? উঠেছিল তোমার কথা শোনে। তোমার পেট কতো বড় সেটা ভেবে আকাশে উঠে গেছিল।
-আপনি এবার আমাকে খাওয়া নিয়ে কুটা দিচ্ছেন? ভ্যা ভ্যা, মেঘের কান্না দেখে অবাক বেকুব হয়ে যায়। টাওয়ালটা বিছানায় রেখে মেঘের কাছে এগিয়ে আসে।

-শোন, আমি এটা বলিনি। আমি আসলে বলতে চাইছিলাম,,, মেঘ অবাককে থামিয়ে দিয়ে দুহাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,,,,,
-আপনি এটাই বলেছেন। আমি বুঝতে পেরেছি। আপনি আমাকে পেটুক বলেছেন। ভ্যা,,,
-আরে না। আসলে আগে কাউকে এক সাথে ৩প্লেইট ফুচকা খেতে শুনি নি। তাই আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলাম।

-আপনি আমাকে রাক্ষসীও বলছেন? এ্যা এ্যা। অবাক এবার সপ্তম আকাশ থেকে পড়ে।
-আমি কখন রাক্ষসী বললাম??
-আপনি সরাসরি বলেন নি। কিন্তু ইনডিরেক্টলি বলেছেন। আপনি মাত্রই বললেন আমার মতো খেতে কাউকে দেখেন নি। আমার মতো একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে আপনি রাক্ষসী বলতে পারলেন? অবাক কপালে হাত দেয়। হায় আল্লাহ। কি মহা মুশকিলে পড়লাম আমি। অবাকের মেঘের সামনে এসে বলে,,,,,,
-আমাকে ক্ষমা করো। তোমার সাথে কথা বলাই ভুল। আমি আর কখনও তোমায় কিছু বলবো না। এই কান ধরছি। অবাক সত্যি সত্যি কান ধরে। মেঘের কান্না থামে। অবাক বলে,,,,
-যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। নাহলে আমি তোমায় এখন রেখে চলে যাবো। মেঘ কান্না থামিয়ে বলে,,,,
-আমাকে রেখে যাবেন না। আমি এক্ষণি ফ্রেশ হয়ে আসছি। মেঘ বিদ্যুৎ এর গতিতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। অবাক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,,,,,

-আল্লাহ আমার মতো এমন বিপদে যেন আর কেউ না পরে। পাঁচ মিনিটে মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে অবাক রেডি হয়ে বসে আছে। অবাক টিশার্ট আর থিকটার পরেছে। এই ছেলেকে সব সাজেই অসাধারণ লাগে। মেঘের ইচ্ছে করে সব সময় অবাকের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কখনও তো ইচ্ছে হয় অবাককে একটু খেয়ে ফেলতে। মেঘ অবাকের পায়ের দিকে তাকাতেই শরীর কেঁপে উঠে। পৃথিবীতে যত মায়া আছে তার অর্ধেক অবাকের পায়ে বাকি অর্ধেক তার বুকে। মেঘ অন্যদিকে ফিরে কাঁপা কণ্ঠে বলে,,,,

-আমি রেডি। অবাক তাকিয়ে দেখে মেঘ অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। মেঘের মাথার চুল ভেজা। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। আর চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। পেছন থেকে মেঘকে অসাধারণ লাগছে । অবাক আনমনে উঠে আসে মেঘের দিকে। পরক্ষণেই অবাক নিজের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। মেঘের থেকে অনেকটা দূরে চলে এসে অন্যদিকে ফিরে বলে,,,,,

-চলো। অবাক মেঘকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে আসে। মেঘ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাতের সমুদ্র এতো সুন্দর মেঘ কল্পনাও করতে পারছে না। সমুদ্রের চারপাশে মানুষ আর মানুষ। আর চাঁদের আলোয় সমুদ্রের সুন্দর্য বর্ণনাতীত। মেঘের চোখ সুন্দর্যের মায়ায় ডুবে যায়।

অনু সবার সাথে খেতে বসেছে। রিয়াদ কয়েকবার আড়চোখে অনুকে দেখে। অনু স্বাভাবিক আছে। কাল পাত্র পক্ষ আসবে। অনুর আজকের রিয়েকশন দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুই জানে না। রিয়াদ শান্ত কণ্ঠে অনুকে জিজ্ঞেস করে,,,,,

-অনু, । অনু মাথা তুলে রিয়াদের দিকে তাকায়। রিয়াদ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। অনু মা বোন ভাবি সবার দিকে এক পলক থাকিয়ে বলে,,,,,
-জ্বি ভাইয়া,
-কাল তোকে দেখতে আসবে নিশ্চয় জানিস? অনু মাথা নিচু করে ছোট উত্তর দেয়।
-হুম

-তোর কোনো আপত্তি আছে আমাদের এই সিদ্ধান্তে? অনু চুপ থেকে এদিক ওদিক মাথা ঝাকায়। রিয়াদ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,,,,,,,
-আমরা তোর খারাপ চাইনা। আমরা চাই তুই হেপি থাক। তোর সুখের জন্যই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। অনু কিছু বলে না। মনে মনে চিন্তা করে,,,,,,
-তোমরা যে সুখের জন্য এতকিছু করছো সেই সুখকি আমার কপালে আছে ভাইয়া? এতসুখ কি আমার কপালে সইবে? আমার কপাল তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন আর এই কপালে কিছু নেই।

রাত ১০টা বাজে। অবাক মেঘকে জোর করে নদীর পাড় থেকে নিয়ে আসে খাওয়ার জন্য। রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখে একটা সিটও ফাকা নেই। সবগুলো সিটে লোকজন। মেঘ ঠোঁট ভেঙ্গে বলে,,,
-বলেছিলাম না এখন খাবো না? পরে আসলে আরও কিছুক্ষণ সমুদ্র দেখতে পেতাম। আমার কথা শুনলে ভালো হতো।

-হুম এটা তুমি ঠিক বলেছো। মেঘ লাফিয়ে উঠে,,,,,
-ইয়েস ইয়েস। মাঝে মাঝে আমি দার্শনিক কথাবার্তা বলি কিযে ভাল্লাগে। অফ! অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকায় মেঘের দিকে। তারপর মাথা ঝাকিয়ে বলে,,,
-হুম। তুমি একজন দার্শনিক। বাংলাদেশে মেবি তোমার মতো একটাও দার্শনিক নেই। মেঘের খুব ভালো লাগছে। এই প্রথম অবাক তার প্রশংসা করেছে। অবাক রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখে একটা টেবিলে একজন কাপল বসেছে। বাকি চেয়ার গুলো ফাকা। এখন খেতে না পারলে অনেক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আর অবাকের ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে না অপেক্ষা করতে। শরীর খারাপ লাগছে। কেমন এক নিঃসঙ্গতা ভেতরটা শেষ করে দিচ্ছে। অবাক এগিয়ে গিয়ে বলে,,,,

-এক্সকিউজ মি, অবাকের কথা শোনে দুজন অবাকের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,,
-জ্বি আমাদের কিছু বলছেন?
-জ্বি। আমরা দুজন এই টেবিলে ডিনার করলে আপনাদের কি কোনো প্রবলেম হবে? দুজন দুজনের মুখ দেখে বলে,,,,
-না না। আমাদের প্রবলেম নেই। আপনারা বসতে পারেন। অবাক মেঘ দুজনেই বসে। অবাক মৃদু হেসে বলে,,,,,
-থ্যাংকইউ সো মাচ। এক্সুয়ালি, একটা টেবিলও ফাকা নেই। আর আমাদের এখন ডিনারটা করা খুব দরকার। তাই আপনাদের একটু ডিস্টার্ব করলাম।
-না। আমরা ডিস্টার্ব ফিল করিনি। অবাক খাবার অর্ডার করে।

অবাক মেঘ খাবার খেয়ে রুমে চলে আসে। অবাক মেঘকে একমতো টেনে নিয়ে আসে। মেঘ আসতেই চাইছিল না। সারারাত সমুদ্র দেখে কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে মেঘ। কিন্তু অবাকের ভালো লাগছে না। তাই মেঘকে জোর করে নিয়ে আসে। যার কারণে মেঘের মন প্রচণ্ড পরিমাণ খারাপ হয়। রুমে এসে মেঘ চুপটি করে বসে থাকে। অবাক ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ অবাকের মনটা কেমন জানি করছে। ভালো লাগছে না কিছু। এই জায়গায় মেঘকে নয়, অনুকে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেছিল একদিন। সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। অবাকের বুকটা হাহাকার করে উঠলো। শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা হঠাৎ করেই বুকের ভেতরে চেপে বসলো।

রাতের আধার ভালোভাবে কাটে নি। ভোরের আলো ফুটতে আরো কিছুক্ষণ সময় প্রয়োজন। এমন সময় মেঘ অবাককে ডেকে তুলে। রাতে অবাক কখন ঘুমালো মনে নেই। অনুর কথা ভাবতে ভাবতেই তার চোখটা লেগে যায়। অবাক টেনে চোখ খোলে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,,,,,,

– কি হয়েছে? ডাকছো কেন?
– ঘুরতে যাবো। অবাক মোবাইলটা হাতে নিয়ে টাইম দেখে বলে,,,,,
– এখনও ৪ টা বাজে না। এক্ষণি ডেকে তুললে কেন? ৭টায় বের হবো।
– না না। ৭টা বাজতে অনেক দেরি। আমি এক্ষণি যাবো। অবাক আবার ঘুরে শুয়ে পড়ে। মেঘ অবাকের হাত ধরে টেনে তুলে। অবাক উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে বলে,,,,,

– তোমার কি সমস্যা? ডিস্টার্ব করছো কেন? মেঘ মুখটা অসহায় করে বলে,,,,
– ঘুরবো না?
– না। তুমি যাও। একা একা সব ঘুরে ফেলো। একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিচ্ছ না।
– আমি একা যাবো কেন? আপনি যাবেন না?
– না যাবো না। অবাক আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। মেঘের মন খারাপ হয়। সে কিছুক্ষণ মুখ ভোতা করে বসে থাকে। তারপর একা একা রুম থেকে বের হয়। কাল কোনদিক দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে গেছিল মনে নেই। রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায় কিন্তু এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। মেঘ রিসোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকজন দল বেঁধে ঘুরাঘুরি করছে। মৃদু আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাতাসও বইছে।

মেঘের হঠাৎ চোখ যায় একটা কাপলের উপর। মনে হচ্ছে আগেও তাদের দেখেছে। মেঘ একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে তারা সেই দুজন যাদের সাথে রাতে ডিনার করেছিল। মনের মন খুশিতে ভরে উঠে। অচেনা শহরে এই দুটো মুখ মনে হয় চেনা। সে দৌঁড়ে তাদের কাছে যায়। মেঘ হাসি হাসি মুখ করে বলে,,,,,
– আপু আমাকে চিনতে পারছো? মেঘের কথা শোনে তারা দুজন চোখাচোখি করে। মেয়েটা বলে,,,,,,

– রাতে আমাদের সাথে ডিনারে বসেছিল, রাইট?
– জ্বি আপু। তোমরা কোথায় যাচ্ছ??
– সমুদ্রের পাড়ে। সূর্যোদয় দেখবো। সমুদ্রের পাড়ে সূর্যোদয় খুব সুন্দর হয়।
– আমিও সূর্যোদয় দেখতে চাই। আমাকে তোমাদের সাথে নিবে? মেঘের কথা শোনে আবার দুজন একে অপরেরদিকে তাকায়। তারা দুজনেই বুঝতে পারছে মেয়েটা নিতান্ত সরল প্রকৃতির। প্রথম কথায় তুমি সম্বোধন করছে। মেয়েটা হালকা হেসে বলে,

– হ্যাঁ চলো। তবে তুমি একা কেন? তোমার সাথে যে একজন ছিল উনি কোথায়? মেঘ মাথা নিচু করে বলে,,,,
– উনি ঘুমাচ্ছেন। আসলে আমিতো কিছু চিনি না তাই বুঝতে পারছি না কোনদিকে যাবো।
– আচ্ছা আসো সমস্যা নাই। মেঘের মন খুশিতে ভরে উঠে। তিনজন একসাথে সমুদ্রের দিকে যেতে থাকে। মেঘ নিজ থেকেই বলে,,,

– আমার নাম মেঘ। মেয়েটা মৃদু হেসে বলে,,,,
– বেশ মিষ্টি নাম তোমার। ঠিক তোমার মতোই নামটা মিষ্টি । আমার নাম প্রমি। আর উনি হচ্ছেন আমার হাজবেন্ড সাকিল। সাকিল হেসে জিজ্ঞেস করে,,,,,
– তোমার সাথে যে লোকটা ছিল উনি কে?
– আমার হাজবেন্ড। প্রমি বলে,,,,
– ওয়াও! তুমিতো খুব লাকি এমন একজন হাজবেন্ড পেয়েছো। খুব হেন্ডসাম তোমার হাজবেন্ড। ক্রাশ খাওয়ার মতো। কথাটা বলেই প্রমি সাকিলের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ মারে। মেঘ মাথা নিচু করে হাসে। সাকিল একবার মেঘকে দেখে প্রমির দিকে ঝুকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,,,,,,

– তুমি কি আবারো ক্রাশ খেয়েছো নাকি?? প্রমি কাধ ঝালিয়ে বলে,
– ক্রাশ খাওয়ার মতো হলেতো খেতেই হবে।
– আল্লাহ! তোমার ক্রাশের সংখ্যা এখন জানি কতো হলো?
– হিসাব করো
– ৭৬ জন। যাক, এখনও সেঞ্চুরি হয়নি।
– হয়ে যাবে টেনশন নিও না। সাকিল লাফিয়ে উঠে বলে,,,
– আমার খুব আনন্দ লাগছে জানো? প্রমি চোখ ছোট ছোট করে বলে,,,
– এতো আনন্দের কি কারণ?
– তুমি এতো ক্রাশ খাওয়ার পরও আমার কাছেই থাকো। আমাকেই এত্তো ভালোবাসো এটা ভেবেই আনন্দ লাগছে। প্রমি হো হো করে হেসে উঠে।

সূর্যের আলো সমুদ্রের উপর লাল হয়ে আছে। সমুদ্রের পানি চিকচিক করছে। মেঘ আনন্দে লাফিয়ে উঠছে। এতো ভালো লাগছে বলার মতো নয়। সমুদ্রের বাতাস কি শীতল। মন প্রাণ সব জুটিয়ে যাচ্ছে। সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এখন অবাক পাশে থাকলে আরো ভালো লাগতো। ভালোবাসার মানুষটাকে সাথে নিয়ে সুখময় মুহূর্ত উপভোগ করা ভাগ্যের ব্যাপার। যারা এটা পারে তারা সত্যিই ভাগ্যবতী। মেঘ প্রমি আর সাকিলের দিকে তাকিয়ে দেখে সাকিল প্রমিকে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে। দুজন ভালোবাসার দুষ্টুমিতে মেতে আছে। এটা দেখে মেঘের মুখ কালো হয়ে যায়। বুকে কষ্ট লাগছে।

সকাল থেকেই অনুর বাসায় চলছে উৎসব উৎসব একটা ভাব। অনু সোফায় বসে বিস্মিত হয়ে সবার কাণ্ড কারখানা দেখছে। মনে হচ্ছে আজই তার বিয়ে। কাজল রেখা অনুর কাছে এসে বসে।
-কিরে তুই এতক্ষণ ধরে বসে কি দেখছিস? অনু মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,,,,
-আজ কি আমার বিয়ে?
– এটা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
-সবার রিয়েকশন দেখে তো এটাই মনে হচ্ছে আজ এবাড়িতে একটা বিয়ে।
-বিয়ে না হলেও তো একটা আয়োজনের ব্যাপার আছে। এরা নতুন আসছে। আর ভাগ্যে থাকলে নতুন আত্মীয়ও হবে । তাই খাওয়াদাওয়ার জন্য সামান্য একটু আয়োজন চলছে। তুই কি আজ পার্লার যাবি? অনু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি কি কখনও সাজার জন্য পার্লার গেছি?
-তা যাস নি। তবে এবার যদি যাস তাই জিজ্ঞেস করছি। অনু কিছু না বলে চুপ করে থাকে। কাজল রেখা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলেন,
-আজ তাহলে একটু সাজগোজ করিস। সাজলে তোকে খুব সুন্দর লাগে।
-আচ্ছা সাজবো। তবে আমি যেভাবে সাজি সেভাবে। এতো মেকাপ করতে পারবো না। মেকাপ করলে বিরক্ত লাগে আমার।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তোর মতো করে সাজলেই হবে। এমনিতেও আমার মেয়ে খুব সুন্দর। সাজ ছাড়াও তাকে অপরূপ লাগে।

অবাক ঘুম থেকে উঠে দেখে মেঘ রুমে নাই। ব্যালকনিতে উঁকি দিয়ে দেখে সেখানেও নেই। অবাক মনে মনে বলে,,,
-আশ্চর্য! মেয়েটা গেলো কোথায়? সত্যি সত্যি বাহিরে চলে গেলো নাতো? ওতো এখানে কিছুই চিনে না। অবাক তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকে। যদি একা একা বের হয়ে থাকে তাহলে কোনো গণ্ডগোল করবে। এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই। এই মেয়ে লাফাতে লাফাতে কি করবে নিজেও বুঝবে না। অবাক ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে যেই বের হতে যাবে তখনেই দেখে মেঘ রুমে প্রবেশ করছে। অবাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,

-একা একা কোথায় গিয়েছিলে? মেঘ লম্বা হয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে বলে,,,,
-সমুদ্র দেখতে।
-সমুদ্র দেখতে মানে? একা একা তোমাকে কে বলেছে পণ্ডিতগিরি করতে? এখানকার কিছু চিনো তুমি? লোকজন জানো কেমন? এখানে সবাই ঘুরতেই আসে না। বাজে মতলবেও আসে। তোমার মতো বাচ্চা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে তুমি বুঝতেও পারবে না। মেঘ বালিশ আঁকড়ে ধরে ধরা গলায় বলে,

-আমাকে তুলে নিয়ে গেলেতো আপনারেই ভালো। আমার থেকে মুক্তি পাবেন। তারপর রিলেক্সে আপনি আবার অনু আপুকে বিয়ে করে ফেলবেন। মেঘের কথা শোনে অবাক চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিসফিস করে বলে,
-তুমি নিজেও তো আমাকে ছেড়ে দিতে পারো। এতো কাঠকুটো পুড়ানোর তো প্রয়োজন হয়না। যদিও অবাক কথাটা আনমনে ফিসফিস করে বলে। তবুও মেঘের কান ভেদ করে বুকের ভিতরে গিয়ে লাগে। মেঘ উঠে বসে। অবাকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমি চাইলেই চলে যেতে পারি না। আমি একটা মেয়ে। আর মেয়েদের সব কিছুর মূল হলো সংসার। আর একটা মেয়ে আঘাতে পুড়ে, যন্ত্রণায় প্রতিদিন মরে। তবুও চায় সংসারটা ঠিকিয়ে রাখতে। এতো যন্ত্রণা সহ্য করেও পড়ে থাকে। ছেলেদের মতো হুটহাট করে বলতে পারেনা আমার ডিভোর্স চাই। আমি চলে গেলে আপনার মতো ছেলেদের একদিনও লাগবে না নতুন করে জীবন শুরু করতে। কিন্তু আমাদের মতো মেয়েদের কি অবস্থা হয় জানেন?

আপনি আগে একটা বিয়ে করেছেন শুনেও একটা মেয়ে ঠিকেই আপনাকে বিয়ে করে ফেলবে। কিন্তু আমার বিয়ে হয়েছে শুনে কেউ বিয়ে করবে না। হয়তো কোনো একদিন আমার বিয়ে হবে। তবে সেটা কোনো হৃদয়বানের সাথে না। যাকে কোনো মেয়ে বিয়ে করছে না সে আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি করবে না। আর আমার পরিবার? তাদের কথা চিন্তা করুণ। তাদের অবস্থা কেমন হবে?

আমার মতো একটা মেয়ের জন্য একটা পরিবার কতোটা যন্ত্রণা সহ্য করবে। আশেপাশের লোকজনও আমাকে নিয়ে কত সমালোচনা শুরু করবে। কেউ কিন্তু একবারো আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করবে না। বিয়েটা ভাঙ্গাতে আমার কি দোষ ছিল সেটা কেউ বিবেচনা করে দেখবে না। এটা হলো আমাদের সমাজ। আর সব দিক বিবেচনা করলে বুঝতে পারবেন মেয়েরা সবসময় দয়ালু হয়। হৃদয়বান হয়। নাহলে বিবাহিত জেনেও একটা মেয়ে একটা ছেলেকে বিয়ে করতো না। অবাক হা করে মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ মেঘকে অন্যরকম লাগছে। কথার মাঝে একটা ম্যাচিউর ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। মেঘ আবার বলে,

-ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। একটা মেয়ের বিয়ে হয়েছে। কয়েকবছর সংসার করে দু একটা বাচ্চাও হয়েছে। হঠাৎ একদিন তার হাজবেন্ড মারা গেছে। তখন দেখবেন এই মেয়েকে কোনো অবিবাহিত ছেলে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করবে না। কোনো ছেলে চাইবে না এই বাচ্চাগুলোর বাবা হতে। মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে। যদিও হয় শতকরা একজন। আর একটা ছেলের ক্ষেত্রে ধরুণ। তার বউ মারা গেছে। তার দু একটা বাচ্চা আছে।

সে কিন্তু ঠিক একটা অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করে ফেলবে। আর সেক্ষেত্রে শতকরা ৬০ টা মেয়ে অন্যের বাচ্চার সোল মাদার হয়ে উঠে। বাকি ৪০ জন হয়তো অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা মনে করতে পারে না। কিন্তু ছেলেটাকে ঠিক আপন করে নেয়। আমার যদি আজ অন্য একটা ছেলের সাথে রিলেশন থাকতো আপনি সেটা জানার পর হয়তো আমাকে ছেড়ে দিতেন। আমাকে খারাপ নজরে দেখতেন। কিন্তু আমি তেমন কিছু করিনি। আপনি অন্য একজনকে ভালোবাসেন জেনেও আমি আপনার সাথে আছি।

আপনাকে ভালোবেসে আপন করে নিতে চাইছি। কিন্তু বিনিময়ে পাচ্ছি অবহেলা। আমাকে আপন করে নেওয়াতো অনেকদূর। আমার সাথে একটিবার ভালো করে কথাও বলতে চান না। মেঘের চোখ জলে ভরে উঠে। সে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। অবাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। মেঘের কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। মেঘতো কোনো অপরাধ করেনি। কোনো অন্যায় করেনি। তবুও এই মেয়েটার প্রতি তার কেন এতো অবহেলা? কেন এতো ঘৃণা? অবাকের চোখের কোণায় পানি জমে। অবাক ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। তার খুব অনুর কথা মনে পড়ছে। অনুর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত চোখের সামনে ভাসছে। কতদিন চলে গেলো। তবুও অনু মনের থেকে সরে যায়নি। সরে যায়নি প্রতিটি সুন্দর ভাবনা থেকে। শুধু স্রোতের প্রতিকূলে ভাসছে তিনটি জীবন।

দুপুর ১২টা বাজে। অনু সেজে বসে আছে। পাত্র পক্ষ আসার কথা ১১টায়। এক ঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। তবুও তাদের কোনো খুঁজখবর নেই। রিয়াদ কন্টিনিউ কল করে যাচ্ছে। ফোনও কেউ রিসিভ করছে না। প্রিতি,কাজল রেখা আর রিমি হাত গুটিয়ে বসে আছে সোফায়। রিয়াদ পায়চারি করছে। কখনও দরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কখনও রুমে এসে স্থির হয়ে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার টেনশন বেড়েই চলেছে। এতো লেইট হওয়ার তো কথা নয়। কাজল রেখা বললেন,

-ওরা এতো লেইট করছে কেন? নাকি রাস্তায় জ্যামে আটকে গেলো কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
-রাস্তায় আজ এতো জ্যাম থাকার কথা নয়। শুক্রবার সকালে এতো জ্যাম থাকে না। থাকলে বিকালের দিকে থাকে।
-তাহলে আসতে এতো লেইট কেন করছে?
-সেটাতো আমিও বুঝতে পারছি না। আমাকে সকাল নয়টায় কল করে বললো ওরা বের হচ্ছে। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা। কিন্তু আসে নি। আবার ফোনটাও তুলছে না। আচ্ছা আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি। যদি না আসে তাহলে আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখবো। রিয়াদ গিয়ে সোফায় বসে। প্রিতি বলে,
-আমি যাই। আপু একা একা বসে আছে। আপুর সাথে কিছুক্ষণ গল্প করি। প্রিতি উঠে উপরে চলে যায়।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here