১৬ বছর বয়সী দুরন্ত কিশোরী লাফিয়ে লাফিয়ে হেঁটে চলেছে আঁকাবাঁকা মাটির রাস্তাটি ধরে। লাফানোর তালে তালে দুলছে তার দীর্ঘ কেশের বিনুনি। টানা টানা চোখ, উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং তবে রোদে পোড়া ভাব রয়েছে তাতেও যেন তার উজ্জ্বলতায় এতোটুকুও ভাটা পড়েনি। স্নিগ্ধ মায়াবী মুখশ্রী। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া সেই দুরন্ত কিশোরী আজ মহা খুশিতে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে যেন। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলো। এখন ছুটে বেড়াবে পুরো গ্রাম নিজের সখীদের নিয়ে বিনা বাধায়। হুট করে তার চঞ্চলতা থেমে যায় পেছন থেকে আসা কন্ঠস্বর শুনে।

–কিরে রূপসী? ওমন কোমড় দুলায় দুলায় কই যাস?

রূপসী পিছন ফিরে তাকায়। আজমলকে দেখে একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ২২ বছর বয়সী এই আজমল মাধ্যমিক পাশ। এরপর আর পড়াশোনা করেনি। বাবার সাথে ক্ষেতের কাজ করে। সে যখন কেবল নবম শ্রেণিতে ওঠে তখন থেকেই আজমল তার পেছনে পড়ে আছে। তাকে নাকি খুব ভালোবাসে। কিন্তু রূপসী তার এই প্রেমের প্রস্তাব বরাবরই নাকচ করে দেয়। তবুও আজমল তার পিছু ছাড়ে না। তবে মাঝে মাঝে রূপসীর মনে হয় আজমল হয়তো তাকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে। তবুও সে ভয় পায়। আজমল এগিয়ে আসে। রূপসীর দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

–আর কত দৌড় করাইয়া তুই আমারে বুঝবি রে রূপু? তোর কি একটু মায়া লাগেনা?

–এ..এসব প্রেম-টেম আমারে দিয়া হইবো না আজমল ভাই।

–তোরে কে কইলো আমি তোর লগে প্রেম করবার চাই?

–আপনিই তো সারাক্ষণ কইতে থাকেন আপনি আমারে ভালোবাসেন।

–আমি তোরে ভালোবাসি কইছি? তোরে কি একবারও প্রেম করতে কইছি?

রূপসী অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবে সত্যি তো আজমল এমনটা কখনো বলেনি। শুধু তার ভালোবাসার কথায় বলে গেছে। রূপসী কোনো জবাব দেয়না। উল্টো ফিরে দ্রুত হাটতে থাকে। আজমলও পিছু পিছু আসতে থাকে।

–রূপু তুই শুধু একবার হ্যা ক আমি তোরে বিয়া কইরা বউ বানাইয়া লই যামু তারপর মন ভইরা প্রেম করমু।

রূপসী থেমে যায়।
–আপনি আমারে বিয়া করবেন আজমল ভাই?

–তো কি এমনি এমনিই তোর পিছে ঘুরতাছি?

আজমল ছেলেটাকে রূপসীর খারাপ লাগেনা। তবে প্রেম নামক বিষয়ে জড়ানোতে ছিলো তার একরাশ ভয় আর দ্বিধা।
আজমল এবার রূপসীর পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।

–ওই রূপু শোন না। পূব দিককার ওই মায়ানদীখান আছে না ওইহানে ঘুরতে যাবি?

–কি কন আজমল ভাই! আপনের লগে ঘুরতে যামু আর আব্বাই আমার ঠ্যাং ভাঙবো।

–কেউ জানবো না। সক্কাল সক্কাল মালতীর বাড়িত যাবি কইয়া বাইর হবি সন্ধ্যার আগে আগেই তোরে বাড়িত দিয়া আসমু। আমি মালতীরে যাইতে কমু। তোর মারে কইয়্যা লইয়া আনবো তোরে।

রূপসীর খুব ইচ্ছে ওই মায়ানদীর পানিতে একটু ভেসে বেড়াবে। তবে বাবার ভয়ে যেতে পারে না। বাবার কথা মেয়ে মানুষদের একা একা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে হয়না। রূপসীর তো কোনো বড় ভাই নেই যে তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। মাঝে মাঝে এসব ভেবে একটা বড় ভাইয়ের জন্য খুব আফসোস হয় রূপসীর। আজমলের এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে মন সায় দেয় না তার। কিশোরী আবেগি মন বাস্তবতার কাঠিন্যতা সম্পর্কে খুব একটা অবগত থাকেনা। রূপসী দোনোমোনো করতে করতে রাজিই হয়ে যায়।

বাড়িতে ফিরে চিৎকার করে মাকে ডেকে খাবার দিতে বলে কলপাড়ে চলে যায় সে হাতমুখ ধুতে। হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখে তার ছোটো বোন মৌটুসী ছবি আঁকায় ব্যস্ত। তার বোনটার আঁকার হাত বেশ ভালো। তবে এই গ্রামাঞ্চলে এসব আঁকাআঁকির খুব একটা কদর নেই বললেই চলে। এখানকার মানুষেরা মেয়ে জন্ম দেওয়া মাত্রই হাতে খুন্তি ধরিয়ে দেওয়াকেই জরুরি মনে করে। একটু বুঝদার হলেই ভালো করে রান্না-বান্না ঘরকন্যার কাজ শিখিয়ে দাও। কৈশোরে পা দিতেই বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি গছিয়ে দাও। এই আদ্যিকালের নীতি হয়তো সব গ্রামেই বিরাজমান। আধুনিকতার ছোঁয়া বাকি সকল বিষয়ে লাগলেও বিয়ের এই নীতিকে ছুঁতে অক্ষমই বটে।

–কিরে টুসটুসি! এত আঁকাআঁকি কইরা কার খাওন জুটাইবি তুই?

–খাওনের লাইগা এসব করন লাগে বুঝি। এগলান তো শখের কাম।

–গরীব মাইনষের আবার শখ।

–ক্যান বুবু! গরীব কইলি আবার মানুষও কইলি। মাইনষের শখ না থাইকলে সে মানুষ হইবো ক্যামনে?

–ইসস! হয়ছে থাক। জ্ঞানী ম্যাডাম আইছে আমার।

–হি হি হি।

দু বোনের কথার মাঝে রূপসীর মা মরিয়ম বিবি এসে হাজির হন ঘরে। হাতে খাবারের থালা।

–এতো হি হি চলে ক্যান? লেহাপড়া কই শুনি? এ ধর রে রূপু তোর খাওন ধর। ম্যালা কাম পইড়া আছে। তোর আব্বাই আজ জলদি ফিরবো।

–ও আম্মা হুনো না। কাইল না মালতীর বাড়িত যামু। সন্ধ্যার আগে আগেই আইসা পড়মু। ও আম্মা যাই, যাই।

রূপসী দু’হাতে মাকে জড়িয়ে আদুরে স্বরে আবদার করে যাচ্ছে। মরিয়ম বিবির দুটি মাত্র মেয়ে। দুটোই তার চোখের মণি। মেয়ে দুটো আবদার করলে কখনোই ফেলতে পারেন না। কিন্তু তার স্বামী রফিকউদ্দীনের জন্য সবসময় মেয়েদের আবদার পূরণ করা সম্ভব হয় না। যদিও রফিকউদ্দীনও তার মেয়েদের যথেষ্ট ভালোবাসে। তবুও পিতৃশাসনের মানসিকতা মাঝে মাঝে তাকে কঠোর হতে বাধ্য করে।

–আইচ্ছা তোর আব্বা আইলে আমি কমুনে। ওহন ছাড় আমারে। ম্যালা কাম। ছাড় ছাড়।

রূপসী ছেড়ে দেয় মাকে। মরিয়ম বিবি ব্যস্ত পায়ে দ্রুত চলে যান। রূপসী জানে তার মা ঠিক তার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবে। তার বেশ খুশি লাগছে। মৌটুসী লাফিয়ে উঠে বলে,

–বুবু! আমারেও নিয়া চলো।

–চুপপ! তোর না সামনে পরীক্ষা। এইটে পড়স। যদি ফেল মারস তো আব্বাই তোর বিয়া দিয়া দিবো। যা পড়তে বস।

মৌটুসী মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। তার বোনটা সবসময় একটাই ভয় দেখায়। “ফেল করলে বিয়ে দিয়ে দিবে।” সে ভেবে পায় না বিয়ে দিয়ে দেওয়া কি শাস্তি নাকি? বিয়ে তো ভালো জিনিস। এটা আবার শাস্তি হয় কিভাবে? তার ছোট্ট মাথায় সে এতো চাপ নিতে পারে না। তাই আবার সে আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। ডুবু ডুবু ভাব নিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে গোধূলির আভা। কেউ কেউ গরু ছাগল নিয়ে ফিরছে। কেউ বা হাঁস মুরগী খোঁয়াড়ে ঢোকাতে ব্যস্ত। কেউ কেউ মাঠের কাজ শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহখানা টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির পথে। কিছু মানুষ আয়েশি ভঙ্গিতে হেলেদুলে চলছে বাজার সদরে। আজ হাট বার কি না। উঠোনের এককোণে বিশাল দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষজনদের পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে রূপসী। মৌটুসী মুরগীগুলোকে খোঁয়াড়ে ঢোকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার মা মরিয়ম বিবি গিয়েছেন মাঠে বাঁধা ছাগল দুটোকে আনতে। সে মূলত অপেক্ষা করছে তার বাবার। বাবা বাড়িতে ফিরলে মা তার মালতীদের বাড়ি যাবার অনুমতিটা নিয়ে দিবেন। সেই চিন্তায় ছটফট করে যাচ্ছে সে। দুপুরে ঠিকমতো খেতেও পারেনি। পেটের ভিতর শুধু গুড়গুড় অনুভূতি হচ্ছে। মায়ানদীতে ভেসে বেড়ানোর প্রবল আগ্রহ তাকে যেন একদন্ড স্থির হতে দিচ্ছে না। রফিকউদ্দীনকে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসতে দেখে রূপসী ছুট লাগায় ঘরে। চুপচাপ বসে বসে কাঁথা সেলাই করার ভান ধরে থাকে। পরীক্ষা শেষ তাই পড়াশোনাও নেই। ব্যস্ত মানুষের ভাব দেখানোর জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর খুঁজে পেলো না সে। উঠোনে এসেই হাঁক ছাড়ে রফিকউদ্দীন,

–ও রূপসীর আম্মা! কই গেলা? মাছগুলান নিয়া যাও। আইজ নদীর টাটকা মাছ লইয়া আনছি। ম্যালাদিন এগুলান মাছ খাওন হয়না। আইজ মন ভইরা খামু।

মরিয়ম বিবি ছাগল দুটোকে টেনে টেনে বাড়ি ঢুকছিলেন। রফিকের আওয়াজ শুনে ছাগল গুলো পাশের খুপড়ি ঘরটাতে ঢোকাতে ঢোকাতে জবাব দেন,

–মাছ আনোনের আর সময় পাইলা না। এহনি আন্ধার নামবো। কুপিবাতি দিয়া মাছ কুটন কি কম জ্বালা?

–কি করমু কউ। মাছগুলান দেইখা লোভ সামলান গেলো না। হে হে! তা আমার আম্মা দুইখান কই? নজর পড়ে না ক্যান? রূপসী আম্মা, মৌটুসী আম্মা কইরেএএএ?

বাবার ডাক শুনে রূপসী ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মৌটুসী কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে গিয়েছিলো। বাবার হাঁকডাক শুনে সে ও ছুটে আসে। রফিক সাহেব মাছগুলো রূপসীর হাতে দিয়ে বলে,

–যারে আম্মাজানেরা তোগো আম্মারে মাছগুলান কুইটা কাইটা দে। জলদি রান্ধা হইলে পেটপুইরা খামু।

রূপসী মাছগুলো নিয়ে চুলার পাড়ে চলে যায়। মৌটুসী নাক সিঁটকায়৷ তার এসব মাছ একদম ভালো লাগে না। কাঁটা বেছে খাওয়া তার কাছে রীতিমতো যুদ্ধ। এসব যুদ্ধ করে খাওয়ার চেয়ে তার কাছে শুকনো ভাত গেলা ঢের ভালো মনে হয়। রূপসীরও এসব মাছ খুব একটা পছন্দ নয়। তার পছন্দ গরুর মাংস। গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাতের সাথে ঝাল ঝাল গরুর মাংসের ভুনা তার কাছে অমৃত মনে হয়।

রাতে কুপিবাতির আলোতে সবাই মিলে রফিকের আনা সেই নদীর মাছ দিয়ে ভাত খেতে বসেছে। রফিক সবাইকে নিয়ে একসাথেই খেতে পছন্দ করেন। মরিয়মও খেতে বসেছেন। রফিকের কথা হলো, বাড়ির পুরুষরা আগে খাবে, মেয়েরা তাদের বেড়ে খাওয়াবে পুরুষদের খাওয়া শেষ হলে মেয়েরা খাবে” এসব তার কাছে ভুয়া নীতি বলে মনে হয়। একসাথে সবাই মিলে না খেলে তার কাছে তৃপ্তি লাগে না। খেতে খেতে রূপসী কয়েকবার তার মা কে ঈশারা করেছে বাবাকে কথাটা বলতে। মেয়ের ঈশারা বুঝতে পেরে মরিয়ম বিবি কথাটা বলেই দিলেন,

–রূপসী কাইল মালতীগো বাড়িত যাওনের বায়না লাগাইছে। তুমি কি কও?

–আব্বা সন্ধ্যার আগেই আইসা পড়মু।

রফিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে রূপসীর দিকে তাকান। তারপর হেসে হেসেই বলেন,

–যাওনের মন চাইছে যাইবা। তবে দেরি কইরো না আম্মাজান। তুমি মাইয়্যা মানুষ। ঘরের বাইরে বেশি ঘুরাফিরা ভালা না। গেরামের মানুষ ভালা কই না।

রূপসী খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তবে বাবার সামনে সেটা প্রকাশ করলো না।

রাতে ঘুমানোর সময় রফিক মরিয়মকে ডেকে বলেন,

–রূপসীর আম্মা আমার ম্যালা ইচ্ছা রূপসীরে অন্নেক পড়ামু। বড় ম্যাজিসটেরেট বানামু। কিন্তু গেরামের মানুষজন তো এতো বড় মাইয়্যা বাড়িত রাখবার দিবো না। এহনি যে কত্ত সম্বন্ধ লইয়া আনতাছে। ভাবতাছি মাইয়্যারে লইয়া শহরে চইলা যামু। বড় কলেজে পড়ামু।

–কি কও! তোমারবাপ-দাদার ভিটা ছাইড়া শহরে চইলা যাইবা। আমাগো ক্ষেতের জমিগুলান কি হইবো।

–জানি না গো রূপসীর মা। দেহি কি করন যায়।

হুট করে রূপসী এসে মিনমিন স্বরে ডেকে ওঠে,

–আব্বা!

মেয়ের ডাক শুনে রফিকউদ্দীন ফিরে তাকান। কুপিবাতিটা তখনো মিটমিট করে জ্বলছে। সেই আবছা আলোতে রূপসীর মায়াবী মুখখানা আরো মায়াবী লাগছে। রফিক মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। তাকে এমন কন্যাসন্তানরূপী জান্নাত দেওয়ার জন্য। মেয়েকে আদুরে স্বরে ডেকে বলেন,

–আম্মাজান! আসো দেহি আমার এইহানে বসো।

রূপসী গুটুগুটি পায়ে হেটে এসে রফিকউদ্দীনের পাশে বসে। আচমকা সে রফিকের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তার বড্ড মন খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে সে যেন তার বাবা মা কে আর দেখতে পাবে না। হয়তো সে হারিয়ে যাচ্ছে। দূরে! বহুদূরেএএএ! রফিক পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। মেয়েটা তার ভিষণ চঞ্চল কিন্তু বড্ড অবুঝ। মেয়েকে নিয় তার অনেক স্বপ্ন। আবার ভয়ও বিশাল।

_________

সকাল হতে না হতেই মালতী এসে হাজির রূপসীদের বাড়িতে। সে আজমলকে খুব মেনে চলে। রূপসীর প্রতি আজমলের পাগলামিগুলো তার ভিষণ ভালো লাগে। সে মনে করে আজমলের প্রস্তাবে রূপসীর সাড়া দেওয়া উচিত। তার পিছনে কেউ এভাবে দুদিন ঘুরলেই সে পটে যেতো বছরের পর বছর ঘুরানো তো সম্ভবই না।
রূপসী মালতির হাত ধরে বেরিয়ে যায়। আসার সময় রূপসী তার মা মরিয়ম বিবিকে কেন জানি কারণ ছাড়ায় বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে জড়িয়ে ধরে ছিলো। মরিয়ম বিবি বুঝতে পারছেন না রূপসীর এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ। তবে তা নিয়ে খুব একটা মাথাও ঘামালেন না।
রূপসীকে আজমলের হাতে তুলে দিয়ে মালতী চলে যায়। এবার রূপসীর ভয় হতে থাকে। এভাবে একা একটা ছেলের সাথে ঘুরতে এসে কোনো ভুল করেনিতো সে? আজমল একটা নৌকা জোগাড় করেছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। আজমল নিজেই নাকি নৌকা চালিয়ে নদী দেখাবে রূপসীকে। নৌকায় চড়ে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে ভয়ের কথা বেমালুম ভুলে বসেছে রূপসী। হুট করে হুঁশ ফিরতেই সে বলে উঠে,

–আজমল ভাই, নৌকা ঘাটে লাগান। আমি বাড়িত যামু।

–নৌকা তো ম্যালাদুর আইসা পড়ছে। যাইতে যাইতে মাঝরাত হইয়া যাইবো। সামনেই একখান ঘাট। ওইখান দিয়া ভ্যান গাড়ি লইয়া গেরামে ফিরলে তাড়াতাড়ি ফিরন যাইবো।

রূপসীর ভয় গাড় হতে থাকে। বাড়ি ফিরার চিন্তায় এই নদীভ্রমণের আনন্দ চাপা পড়ে যায়। নৌকা ঘাটে লাগাতে লাগাতে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। ভয় আর দুশ্চিন্তায় রূপসীর চিন্তা ভাবনা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। সে বলে এসেছিলো সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরবে। এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চললো। সে এখনও গ্রামেই ফিরতে পারেনি। বাড়ি কখন ফিরবে? রূপসী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আজমল শান্তনা দিয়ে বলে,

–কান্দিস না রূপু। আর অল্পক্ষণ সময়। গেরামে আইসা পরমু।

আজমল রূপসীকে একটি মালবাহী ট্রাকে উঠিয়ে দেয়। কিন্তু সে ওঠে না।

–আজমল ভাই! আপনি যাইবেন না।

–হ যামু তো। আমি সামনে বইতাছি।

আজমল সামনের দিকে গেলেও গাড়িতে বসল কি না বোঝা গেলো না। রাত এখন কতটা গভীর আন্দাজ করতে পারছে না রূপসী। বাড়িতে মা হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। বাবা হারিকেন নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন হয়তো রূপসীকে খুঁজতে। মৌটুসীও হয়তো বুবু ঘরে না ফেরার দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে রয়েছে।
গাড়ি ছুটতে শুরু করে। রূপসী আর শান্ত থাকতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। মায়ের কাছে ফেরার তীব্র ইচ্ছে জাগছে। যেভাবেই হোক তাকে মায়ের কাছে ফিরতে হবে। ফিরতেই হবে। খেয়াল করে দেখে তার পেছনে, আশেপাশে আরো বেশ কয়েকজন মেয়ে। এরা এখানে কিভাবে এলো? সব অল্প বয়সী মেয়ে। সকলেই কাঁদছে।

_____________

গরম পানির বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাদমান হোসেন। অপেক্ষা করছে একটু দুরে রংচটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ইশারার। সেকেন্ড কয়েক পরেই আঙুলের ইশারা পেতেই বালতিতে রাখা সমস্ত গরম পানি ছুঁড়ে মারেন হাত পা বাঁধা অবস্থায় সামনে বসা লোকটার মুখে। লোকটা চিৎকার করে উঠে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি পেছন থেকে একটা চেয়ার টেনে বের করে এনে ঠাস করে সামনে রাখে। তারপর তাতে আরাম করে বসে হাঁটুর ওপর আরেক পা তুলে গা এলিয়ে দিয়ে বসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সামনের লোকটিকে। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিটের মাথায় ঝট করে সামনে ঝুঁকে লোকটির একহাত টেনে এনে চেয়ারের হাতলে রেখে নিজের হাতে থাকা সরু ধারালো ছুরিটি গুজে দেয় লোকটির হাতের তালু বরাবর। গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে লোকটি। যেন নিঃশ্বাস ত্যাগ করার ভয়াবহ চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু নিঃশ্বাসটা তাকে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে।

–এবার কি তুই মুখটা খুলবি? নাকি আরো কিছু মেডিসিন ব্যবহার করতে হবে?

–ব..বল..ছি, বলছি… প্লিজ ছুরিটা বের করে নিন স্যার। আমি সহ্য করতে পারছি না।

মানুষটি পুনরায় আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। যেন সামনের লোকটির কষ্ট তার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না। ছুরিটা বের করে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে তার মধ্যে দেখা গেলো না। সে সেইভাবে বসে থেকে বাঁকা চোখে ছটফট করতে থাকা লোকটির দিকে তাকায়।

–এই ছুরি ততক্ষণ বের হবে না যতক্ষণ না তুই সবটা বলবি।

–বলছি স্য..স্যা..র, স্যার, আজ রাতেই ওরা এক গাড়ি… মেয়ে নিয়ে আসছে। শহরের রাস্তার ওপর দিয়েই… যাবে। বসও ওই গাড়িতেই থাক.. আহ.. থাকবেন।

মানুষটি উঠে দাঁড়ায়। সাদমান হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে,

–বাবুসোনা মুখ যখন খুলেছে বাকিটাও নিশ্চয়ই বলবে। গাড়িটি ঠিক কোন সময়ে কোন জায়গা থেকে ছাড়বে এবং কোন কোন রাস্তা দিয়ে যাবে তার সমস্ত ডিটেইলস ম্যাপসহ জেনে নিন। আমার আইডিয়া ভুল না হলে আমার বাড়ির রোড দিয়েই তাদের যেতে হবে। সেখান থেকেই ওদের ধরা সুবিধা হবে। তাই আমি এখন বাড়িতেই ফিরছি। সময়মতো সব ইনফরমেশন ম্যাসেজ করে দিবেন। টিম নিয়ে রেডি থাকবেন। আমি বলা মাত্রই বেরিয়ে পড়তে হবে।

–ওকে স্যার। আমি সবকিছু সেট করে আপনাকে জানাচ্ছি।

মানুষটি দু কদম এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসেন। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ারে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে হাত থেকে ধারালো ছুরিটি টেনে বের করে ফেলেন। লোকটি আবার চিৎকার করে উঠে। মানুষটি বাঁকা হেসে বলে,

–আগেই মুখ খুললে এই কষ্টটা পেতে হতো না।

বলেই গটগট করে হেঁটে চলে যায়। তার হেঁটে যাওয়ার ধরনই যেন তার দৃঢ়ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরছে।

মানুষটি চলে যেতেই ধপ করে খালি চেয়ারটায় বসে পড়ে সাদমান। লোকটি ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। সাদমান তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

–সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খন্দকার ইফাদ আহমেদ এর হাতে পড়া কেস গোড়া থেকে সলভড হয় চৌদ্দ গুষ্টি সহ। তাতে তোর বসের মতো রাঘব বোয়াল স্যারের কাছে তো চুনোপুঁটি।

চলবে…..

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#সূচনা_পর্ব
#এম_এ_নিশী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here