#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৫
#এম_এ_নিশী
রূপসী পিছলে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তার এক কোনায় কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়িগুলো সব তার পাশ ঘেষে যাচ্ছে। তবে দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়ায় রূপসীর ভয় হচ্ছে ভিষণ। সে না পারছে ওপারে যেতে না পারছে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে। ইফাদ নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। কালবিলম্ব না করে ছুটে গিয়ে রূপসীকে হেঁচকা টানে ফুটপাতের ওপর নিয়ে আসে। রূপসী একবার ইফাদের দিকে তাকায়। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আছে সে। রাগের বর্ষণ হতে যেন সময় লাগবে না আর। রূপসী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। ইফাদ চাপা স্বরে খেঁকিয়ে ওঠে,
–সমস্যা কি তোমার? হ্যা? এটা তোমার গ্রাম পেয়েছো যে যেখানে সেখানে নেচে বেড়াবে। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসবে। আর একবারও যদি গাড়ি থেকে নামার জেদ করেছো তো সোজা রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবো। গট ইট?
ইফাদ গটগট পায়ে হেটে গিয়ে গাড়ি আনলক করে দরজা খুলে দেয়। রূপসী দ্রুত বেগে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে সে আর ক্ষেপাতে চায় না। ইফাদও উঠে এসে গাড়ি ছোটাতে শুরু করে। মাঝেমাঝে আড়চোখে ইফাদকে দেখার চেষ্টা করছে রূপসী। থমথমে মুখে বসে আছে সে। হয়তো এখনো রেগে আছে। রূপসীর এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে হাসফাঁস লাগছে। অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করছে তার। তবে ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না সে। তাই অযথাই একাত হয়ে বসছে কখনো ওকাতে। কখনো বা পা তুলে বসছে। একটুপর বিরক্তি নিয়ে আবার দুদিকে পা ছড়িয়ে বসে। সবটাই ইফাদ লক্ষ্য করছে কিন্তু কিছু বলছে না। মেয়েটাকে তার ভালোভাবে চেনা হয়ে গেছে। চঞ্চলতার মূর্ত প্রতীক সে।
এইতো দুপুরের দিকে গাড়িটা যখন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তখন আশেপাশে মেকানিকের খোঁজ চালাচ্ছিল সে। মেকানিক পেয়ে যেতেই একটু রিল্যাক্স হয়ে খেয়াল করে দেখে রূপসী নেই। ভয় পেয়ে গিয়েছিল ভিষণ। এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে দেখে একটু দূরেই ঝোঁপের আড়ালে থাকা এক বিশাল গাছ বেয়ে ওপরে উঠছে সে। ইফাদ আহাম্মক হয়ে যায়। এ কি মানুষ নাকি বাঁদর?
–এই মেয়ে তুমি ওভাবে গাছে উঠেছো কেন? নেমে এসো, নেমে এসো বলছি।
–ম্যাজিস্ট্রেট স্যার এইহানে কি সুন্দর একখান পাখির বাসা। পাখি আবার ম্যালাগুলান ডিম পাড়ছে। কি সুন্দওওরর!
–তো কি হয়েছে? সেসব পাখির ডিম তোমার ডিম নয়। নেমে এসো।
ইফাদের কথাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে সে মনের সুখে পাখির বাসাটা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইফাদ চুপচাপ দেখতে থাকে রূপসীর কান্ডকারখানা। একটুপর মেকানিক এসে বলে কাজ হয়ে গিয়েছে। এবার সে রূপসীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে ওঠে,
–এই মেয়ে তুমি নেমে আসবে? নাকি আমি তোমাকে এখানে ফেলেই চলে যাব?
রূপসী ভয় পেয়ে জলদি নেমে পড়ে। তারপর দুহাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে,
–আইচ্ছা চলেন।
হাঁটতে হাঁটতে আবার রূপসী চিৎকার করে ডেকে ওঠে।
–ম্যাজিস্ট্রেট স্যাআআরর!
ইফাদ চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে রূপসী একটা ফড়িংকে ধরার জন্য ছুটছে। ইফাদ চরম বিরক্ত হয়। শক্ত করে রূপসীর হাতটা ধরে বলে,
–ব্যস! অনেক হয়েছে। একদম জ্বালাবে না আর।
বলেই টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। রূপসী মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলেও ইফাদ তা খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। তবে একটু পর পরই বিরক্ত হয়ে সে এটা ওটা ঠোকাঠুকি করতে শুরু করে দেয়। কখনো সামনে ঝুঁকে ওঝাদের মতো পাগলাটে আচরণ করতে থাকে। কখনো বা পিছনে হেলান দিয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকার ভান ধরে থাকে। ইফাদ মেয়েটার ছটফটানি বুঝতে পেরে জানালার গ্লাস নামিয়ে দেয়। রূপসী জানালার ওপর মুখ রেখে বাইরে তাকাতেই প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেলো। এরপর বেশ অনেকটা সময় ধরেই শান্ত ছিলো সে। এসব ভাবতে ভাবতেই হুট করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে তার। রূপসী সেটা দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে যায়। মানুষটা তো রেগে ছিলো তাহলে হাসছে কেন? জ্বীনে ধরলো না তো। এসব ভরসন্ধ্যায় আবার প্রচুর জ্বীনের আনাগোনা থাকে। রূপসী ভয়ে আরেকটু দূরে সরে বসে। ইফাদ তাকিয়ে বলে,
–কি হয়েছে?
–আপনে কেডা?
–হোয়াট? দেখতে পাচ্ছো না আমি কে?
–আপনে কি ম্যাজিস্ট্রেট স্যার?
–না তোমার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের আব্বা। কেন কোনো সমস্যা?
–আপনি না রাগে আছিলেন তাইলে হাসতাছেন ক্যান? আপনারে জ্বীনে ধরেনাই তো?
–কিইহহ! জ্বীন? হাও ফানি। আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে যে আমাকে জ্বীনে ধরেছে?
রূপসী সরে এসে আঙুল দিয়ে ইফাদের হাত ছুঁয়ে দেখলো। ইফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–কি করছো?
–আপনে সত্যিই ম্যাজিস্ট্রেট স্যার কিনা দেখতাছি।
–দেখা হয়ে গেছে? তো কি বুঝছো?
–হ বুঝছি। আপনারে জ্বীনে ধরেনাই। ধইরলে তো আপনে আমারে এখনই মাইরা ফালাইতেন। উফফ! আল্লাহ বাঁচাইছে।
ইফাদ এদিক ওদিক নজর বুলিয়ে এক সাইডে এসে গাড়ি দাঁড় করায়। রূপসীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–তোমার ক্ষিদে পেয়েছে? কিছু খাবে?
–হ! ম্যালাআআআ ক্ষিদা লাগছে।
–চলো তাহলে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।
ইফাদ নেমে এসে দরজা খুলে দেয়। রূপসী নেমে চারপাশে তাকাতেই তার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়। এতো বড় বড় বাড়ি, এতো এতো আলো। সবটাই কি সুন্দর লাগছে দেখতে। মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখতে থাকে সে। ইফাদ এগিয়ে এসে বলে,
–দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো।
–এত্তো বড় বড় সুন্দর সুন্দর বাড়িগুলান কাগো বাড়ি?
–এগুলো বাড়ি নয়। কিছু অফিস, কিছু ফ্ল্যাট বাড়ি, কিছু শপিং মল।
রূপসীর মাথায় শব্দগুলো ঠিকঠাক প্রবেশ করলো না। সে চারপাশ মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে ইফাদের পিছু পিছু রেস্টুরেন্টে ঢোকে। বিশাল বড় রেস্টুরেন্ট বিভিন্ন রং এর আলো দিয়ে সাজানো। নানারকম কারুকার্যে শোভিত চারপাশ। কৃত্রিম ফুল, লতাপাতা দিয়ে সাজানো দেয়াল, টেবিল সবকিছু দেখে রূপসীর চোখ দুটোর সাথে সাথে মুখখানাও বিশাল ‘হা’ রূপ ধারণ করেছে। সে ছুটে ইফাদের পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে,
–ম্যাজিস্ট্রেট স্যার, এই এত্তো বড় বাড়িখান কার?
–এটা বাড়ি নয় বেকুব। এটা একটা রেস্টুরেন্ট।
–হেইডা আবার কী?
–মানে এটা একটা হোটেল যেখানে বসে মানুষ খাওয়া দাওয়া করে।
–ওওও আইচ্ছা, চায়ের দোকান। আমাগো গেরামে আছিলো লিটু কাকার দোকান। লিটু কাকা চায়ের লগে সিংগারা, পুরিও বানাইতো। আব্বার লগে যহন হাটে যাইতাম কাকার দোকানে বইসা গরম গরম পুরি আর চা। আহা কি স্বাদ! আইচ্ছা এইহানে কি পুরি-চা পাওন যায়?
–এটা গ্রামের হাট-বাজারের চায়ের দোকান নয়। চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।
–কই এইহানে তো কাওরে চা বানাইতে দেখন যায় না। বসবার লাইগা তো বেঞ্চিও দেয়নাই। লিটু কাকার দোকানে তো তিনডা বেঞ্চি আছিলো।
ইফাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–এখানে এতোগুলো টেবিল-চেয়ার কি তোমার চোখে পড়ছে না। সবাই যে বসে বসে খাচ্ছে তা কি দেখতে পাচ্ছো না? আর এসব রেস্টুরেন্টে রান্নাটা ভিতরে হাইজিনিক ভাবে রান্না করা হয়। বাইরে নয় যে তুমি দেখতে পাবে।
ইফাদ একটি চেয়ার টেনে ইশারায় রূপসীকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। রূপসী আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে। ফোমের নরম চেয়ারে বসতেই রূপসী বেশ মজা পেল। সে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। ইফাদ বলে,
–কি হলো আবার দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?
রূপসী জবাব না দিয়ে আবার ঠাস করে বসে পড়ে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে আবার দাঁড়ায় আবার বসে। তার খুব আনন্দ হচ্ছে। ইফাদ আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখে বেশ কয়েকজন আড়চোখে তাদের দেখছে আর মুখ টিপে হাসছে। ইফাদ কড়া চোখে রূপসীর দিকে তাকায়। রূপসী সেদিকে তাকাতেই তার মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে চুপচাপ বসে পড়ে। টেবিলে একটি টিস্যু বক্স, টুথপিক রাখা একটি কৌটো, ছোট একটি ফ্লাওয়ার ভাস রয়েছে। রূপসী সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে। তারপর আবার চারপাশে চোখ বুলায়। মাথার ওপরে থাকা বড় বড় ঝাড়বাতিগুলো দেখে তার খুব ছুঁতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অনেক উঁচুতে হওয়ায় সে ইচ্ছে দমিয়েই রাখতে হয় তাকে। একজন ওয়েটার এসে ইফাদকে বলে,
–হ্যালো স্যার! আপনার অর্ডারটা প্লিজ!
ফট করে রূপসী বলে উঠে,
–আপনাগো এইহানে চা-পুরি নাই?
রূপসীর কথা শুনে ইফাদ আঙুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলে, “ব্যস! হয়ে গেলো। সব জায়গায় আমাকে বিপাকে না ফেললে এই মেয়ের শান্তি হবে না মনে হচ্ছে।”
ওয়েটার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
–স্যরি ম্যাম।
ইফাদ দ্রুত বলে ওঠে,
–ওর কথা বাদ দিন।
মেন্যু কার্ডটা দেখতে দেখতে বলে,
— দুটো ভেজিটেবল পিৎজা, ফিস কাটলেট দুটো আর দুটো কফি এন্ড নট কোল্ড ড্রিংকস, প্লিজ।
–ওকে স্যার।
রূপসী তখনো রেস্টুরেন্ট দেখতেই ব্যস্ত। ইফাদ পকেট থেকে ফোন বের করে। সারাদিন মায়ের কতো কতো কল যে এসেছে আজ হিসেব নেই। মাকে সামলাতে তার বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে।
কিছুক্ষনের মধ্যেই ইফাদের অর্ডারকৃত খাবার এসে যায়। রূপসী কপাল কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে বলে,
–এগুলান আবার কি?
–হয়তো এর আগে তুমি কখনোই এসব খাওনি। তবে আজ খেয়ে দেখো। এগুলো শহরের খাবার। আশা করি তোমার খারাপ লাগবে না।
ইফাদ রূপসীর প্লেটে খাবারগুলো সাজিয়ে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে দেয়। সে জানে রূপসী চামচ দিয়ে শহুরে কায়দায় খেতে পারবে না। তাই নিজেও হাত দিয়ে খেতে থাকে আর রূপসীকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে খেতে হবে। রূপসী তা অনুসরণ করে সেভাবেই খেতে থাকে। এই শহুরে খাবারগুলো রূপসীর কাছে অসাধারণ লাগে। তাই সে বেশ মজা করে খাচ্ছে। আশেপাশের সবাই বাঁকা নজরে দেখছে যা ইফাদকে অস্বস্তিতে ফেললেও এই মুহুর্তে রূপসীর কথা ভেবে সে সেটা হজম করে নিচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই বিল পে করে ইফাদ বেরিয়ে আসে রূপসীকে নিয়ে। রেস্টুরেন্টের কাছেই একটা মেলা হচ্ছে। সম্ভবত বিজ্ঞান মেলা। রূপসী সেদিকে তাকিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ তার চোখ যায় হাওয়ায় মিঠাই এর দিকে। সে লাফিয়ে উঠে বলে,
–টুকটুকি ফুল!
ইফাদ আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
–মানে কি?
–ওই যে ওইগুলান।
রূপসীর আঙুলের ইশারা অনুসরণ করে তাকিয়ে ইফাদ বলে,
–ওহহ! ওগুলো তো হাওয়ায় মিঠাই।
–হ জানি। আমি ওগুলারে টুকটুকি ফুল কই। নতুন বউ যেমন লজ্জা পাইলে টুকটুক হইয়া থাকে তখন বউএর গালগুলান আমার কাছে ওই হাওয়ায় মিঠাই এর রংএর মতোন লাগে আর ওগুলান দেখতেও ফুলের মতোন তাই আমি টুকটুকি ফুলই কই।
–হাওয়ায় মিঠাই তোমার পছন্দ?
–ম্যালাআআআআআ!
–আচ্ছা, এখানেই দাঁড়াও চুপচাপ আমি আসছি।
ইফাদ এগিয়ে যায় হাওয়ায় মিঠাই বিক্রেতার কাছে। আকাশে আতশবাজি ফুটছে। মেলাতেই ফোটানো হচ্ছে। তা দেখে রূপসী বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আতশবাজি ফোটানোর উৎস খুঁজতে এদিক ওদিক তাকাতেই ইফাদ ফিরে আসে। রূপসীর হাতে হাওয়ায় মিঠাই দিতেই সে ভিষণ খুশি হয়ে যায়। ইফাদ বলে,
–তুমি দাঁড়াও। আমি গাড়িটা এখানেই নিয়ে আসছি।
–আইচ্ছা।
ইফাদ গাড়ি নিয়ে এসে নেমে রূপসীকে ডাকতে গিয়ে দেখে জায়গাটা ফাঁকা। এদিক ওদিক ভালোভাবে তাকিয়ে ভাবে, “নাহ! এখানেই তো দাঁড়িয়ে ছিলো।” একটু থেমে ক্লান্ত সুরে বলে উঠে,
–আবাআআর গায়েএএবব!
চলবে….