অপরাজিতা – ৫

রাত দুইটায় গাড়ি এসে থামল উত্তরায়। দৃষ্টিনন্দন ছয়তলা একটা বাড়ির সামনে। আলীশান বাড়ি।
কিন্ত বিয়ে বাড়ির কোন সাজ নাই। ঝলমলে বাতি ভরপুর আয়োজন বা রঙিন উৎসবের আমেজ। কিছুই না। কেমন নিথর আর থমথমে।
। নুপুর সারাটা পথ কেঁদেছে।
একবারও চোখ তুলে দেখেনি কোথায় যাচ্ছে। কার সাথে যাচ্ছে। মনের ভেতর ঝড়। তুমুল ঝড়। ভেঙেচুরে এক হয়ে যাচ্ছে সব। কেউ জানল না, কেউ দেখল না।

কেবল গাড়ি থামার পর দেখল রাজকীয় বাড়ির গেইট। জানল এটা তার শ্বশুরবাড়ি। সবাই নেমে গেলো। নুপুর নামল তার শাশুড়ির হাত ধরে।

: মা, এটা আজ থেকে তোমার বাড়ি।
তাকিয়ে দেখো।

নুপুর একবার শুধু দেখেছে। তার মাঝে ভালো খারাপ প্রতিক্রিয়া নেই। বোধও নেই। নিজেকে কলের পুতুল মনে হচ্ছে। যে যেটা বলছে সেটাই সে করছে।
বাড়িতে ঢুকে নুপুর তাজ্জব। এতো এলাহী কান্ড।
চমকানো ব্যাপার স্যাপার। দোতলা আর তিনতলা মিলে ডুপ্লেক্স। অসাধারন সুন্দর।
ডুপ্লেক্স এর সিড়ি পুরোটাই ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।
তাও কাঁচাফুল। সুগন্ধি ফুলের মিষ্টি গন্ধ চারপাশে।
কনের বেশে নুপুরকে পরীর মত লাগছিল।
গহনা কম শাড়িও ভালো নয়। তবুও অপরূপ স্নিগ্ধ তার সৌন্দর্য।
নতুন বউকে বরন করা হল ধান দূর্বা দিয়ে। মিষ্টিমুখ করা হয়েছে। এরপর ছবি তোলার হিড়িক চলল। হাসি তামাশার মধ্যে।
বাড়িতে অতিথি অনেক। অতিথি আত্নীয়জন নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত। রিফাত কখন নামল সেটা নুপুরের চোখে পড়ল না।
কেবলমাত্র বাড়ির ভেতরে থাকা লোকজনের হৈ চৈ এর মাঝে শুনল তিনতলায় রিফাত ওর রুমে চলে গেছে।
তার শাশুড়ি অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
তার মধ্য বিশ একুশ বয়সের একটি মেয়ে প্রশ্ন করে বসে।
: নতুন বউয়ের এত মন খারাপ কেন মামী?

তার শাশুড়ি সহ অনেকেই হাসছে।

: বর্ষা তুমি যেদিন বউ হবা সেদিন বুঝবা বউ হলে কত মন খারাপ থাকে।
: নুপুর তুমি মন খারাপ করো না, আমরা খুব পছন্দ করে তোমাকে বউ করে এনেছি।
কি বলো শারমিন?
নুপুর শারমিন নামের কাউকে চিনে না। শুধু দেখল আধপাকা চুলের একজন বিশাল সাইজের মানুষ তার সামনে। দেখে মনে হল খুব কাছের কেউ কিন্ত বেশভুষা খুব মলিন।

: হ বউ তো ম্যালা সোন্দর গো ফারজানা।

নুপুরের শাশুড়ির নাম তাহলে ফারজানা। মহিলা চোখে মুখে খুব চতুর। মানুষকে ভোলাতে পারে। অনেকটা তার চাচী সিলভিয়ার মত। কিন্ত তার চাচী মোটেও ধুরন্ধর নয় যেটা আগে তার মা তাকে বলত। ছোট বেলা থেকে মা সবসময় বলত চাচীর পয়সা অনেক তাই চাচী মানুষকে মানুষ মনে করে না। বেশী চতুর। অন্যের ক্ষতি চায়।
কিন্ত বিয়েতে সে দেখল একমাত্র চাচীই বাঁধা দিয়েছে। নুপুর শুনেছে চাচী মাকে বলছে ” তোমরা এখানে নুপুরকে বিয়ে দিও না “।
নুপুরের ক্ষতি চাইলে চাচী নিশ্চয় বিয়েতে বাধা দিত না।
কিন্ত বাবা মা কেউই তো এমন বলল না। নুপুরও চায়নি বিয়েটা হোক। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে মন ভেঙে এই বিয়েতে রাজী হয়েছে।

নুপুর সব রকম চেষ্টা করেছে। মাকে কতবার বললো, মা আমার পছন্দ হয়নি ছেলেকে।
কিন্ত ওরা টাকার কাছে, লোভের কাছে তাকে বলি দিয়েছে।

: তোমার পছন্দ হইছে?

: হ পছন্দ হইছে। ওরে রিফাতের গরে লইয়া যাও।
যার জিনিস তারে দিয়া আসো।

শাশুড়ি হেসে ফেলে।

: আমি পছন্দ করেছি বুঝছো, এখন তোমার কাজ হলো নুপুরের জন্য খাবার নিয়ে আসা।
সব গরম আছে তো?

: হ বেবাকই গরম গরম।
: ঠিক আছে। মেয়েটা কতক্ষণ যে না খেয়ে আছে।

শারমিন মুচকি মুচকি হাসে।
আর নুপুরের কানে কানে কি যেন বলে
এটা শুনে নুপুর হেসে ফেলল।

: বাহ, নুপুর তোমায় হাসলে তো দারুন লাগে।

: হ আম্মা ম্যালা সোন্দর লাগে। এহন বাইজানের সাথে ঠিক থাকলেই অয়।

শাশুড়ি ক্ষেপে যায়।

: মুখে যা আসে তাই বলতে ভালো লাগে?

শারমিন মুখ কাচুমাচু করে আছে। এমন বকা সে মনে হয় রোজই খায়।

: শারমিন তুমি উপরে গিয়ে রিফাতকে বলো আমার সাথে যেন দেখা করে।

একদল মেয়ে ছুটে এসেছে। কম বয়সী। খিলখিল করে হাসছে। এরা অনেক ছবি তুলল নুপুরের সাথে।
এদের কেউ নুপুরের শাশুড়িকে মামী কেউ চাচী বলে সম্বোধন করছে।
তার শাশুড়ি কিছুক্ষন বসল এদের মাঝে। সে খুব সতর্ক চোখে খেয়াল করছে। নুপুর মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী। এত ছোট বয়সে তবুও মনে হয় তার সাথে সে পেরে উঠবে না।
খুব সাবধানে এর সাথে তাল মেলাতে হবে।

শাশুড়ি একটু চিন্তিত হয়ে লক্ষ্য করল যে নুপুর মেয়েদের সাথে সহজ হতে পারছে না। একটা দূরত্ব রেখে টুকটাক কথা বলছে।
তার চিন্তা অবশ্য অন্য জায়গায়। এটা মনে হতেই সে চঞ্চল হয়ে উঠে।
মেয়েদের দলকে তাড়া দেয়।

: এ্যাই তোমরা কি শুরু করলা, মেয়েটা খুব ক্লান্ত। ওকে রুমে নিয়ে যাও।

ফুল দিয়ে সাজানো পুরো রুম। খুব সুন্দর লাগছে।
নুপুর বসে আছে তার রুমে। আশপাশে রিফাত নেই। কি আশ্চর্য লোকটা এমন করে কোথায় গায়েব হয়ে গেলো।
বাড়িতে আসার পর একবারও তাকে দেখেনি। মেয়েরা লজ্জা পায়। জড়তায় আড়ষ্ট থাকে। কিন্ত একজন পুরুষ মানুষ লজ্জা পেতে পারে এটা অসম্ভব। নুপুর দু চোখে রিফাতকে খুজল। কমবয়সী মেয়েগুলো চলে গেছে। নুপুর একদম একা এখন।
শাড়ি মেকাপে খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার। ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। শারমিন নামের মহিলাটি নুপুরের খাবার নিয়ে ঢুকল।
দুই প্লেট খাবার টেবিলে ঢেকে রেখে সে চলে যায়। কোন কথা বলল না।

প্রায় আধঘণ্টা পর রিফাত এল। নুপুর আওয়াজ শুনে নড়েচড়ে বসে।
এসেই সে কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
ঠিক দশ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে বের হয়।
তারপর ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে। খাবার খেলো না। পানিও না। নুপুরকেও কিছু বলল না।
নুপুর সবটা দেখে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিছানা থেকে নামে।
ঘড়িতে সময় রাত তিনটা।
নুপুর ফ্রেশ হয়ে বাসা থেকে আনা সুতির একটা থ্রিপিস পড়ে খাবার খেতে বসে যায়। যা থাকে কপালে আগে খেতে হবে। ক্ষিধেয় পেট পুরাই খালি। নুপুর চটজলদি প্লেট ফাঁকা করল।
খেতে খেতে রিফাতকে দেখে তার অবাক লাগছে। কি অদ্ভুত মানুষ সে।
এমন ভাব করছে যেন নুপুরকে সে চিনেই না। আজব।
তার বাড়ি। তারই তো উচিত নুপুরকে জিজ্ঞেস করা যে সে খেয়েছে কিনা। নুপুর দুম করে জিজ্ঞাস করে বসে।

: আপনি খাবেন না?

: খেয়েছি।

: ওহ।

রিফাত ল্যাপটপে একমনে কাজ করছে।
কোনদিকে খেয়াল নাই। নুপুর খাওয়া দাওয়া করে সব গুছিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসল।
শেষ রাত্রির শহর। কি নিপাট আঁধার। জোনাক জ্বলা আলোর মাঝে মন খারাপের কথারা ডেকে ডেকে যায়।
নুপুর আঁচ পায় নিঃসঙ্গ বেদনার ঝড় বুকের ভেতর।
বিয়ে নামক শব্দটা কি করুন ভাবে একটা মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয় কয়েক ঘন্টার ভেতর।
পরিচয় সন্মান অস্তিত্ব সব বদলে যায়।
এই বাড়ি তার বাড়ি। এটা সে ভাবতে পারছে না। কি করে ভাববে। এমন একটা অদ্ভুত লোক তার জীবনসঙ্গী। তার কাছের মানুষ হবে যে কিনা নুপুরকে ডেকে দুটো ভালমন্দ কথা বলেনি। জানতে চায়নি তার কেমন লাগছে। নুপুর কি করে এর সাথে সারা জীবন থাকবে। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু। নুপুর ব্যালকনি থেকে রুমে।আসে।
ফুলভর্তি বিছানাটা তার অসহ্য লাগছে।

সারা বিছানায় ছড়ানো ফুলগুলো সে দুহাতে সরিয়ে বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল।
নতুন জায়গা। কেমন গুমোট লাগে। দম বন্ধ করা অবস্থা। ঘুম আসছে না। কিছুক্ষন পর চমকে জেগে দেখে পুরো রুম ফাঁকা। কেউ নেই। লাইট নেভানো। সে অস্থির হয়ে নেমে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে দেখে ওটাও লাগানো।
মানে কি। তাহলে লোকটা কোথায় গেছে। হঠাৎ শুনতে পেলো কেউ হাসছে। কিন্ত কে।
হাসির শব্দের কারন খুঁজতে নুপুর পা টিপে টিপে ব্যালকনিতে উঁকি দেয়। দেখে রিফাত মোবাইলে গেমস খেলছে। আয়েশ করে শুয়ে শুয়ে। ফ্লোরে ম্যাট পাতা। ওখানেই শুয়ে আছে। রাত সাড়ে তিনটায় সে গেইম খেলছে।
খেলার মাঝে কখনও হাসছে। কখনো চুপ।
নুপুর এক ঝটকায় পিছিয়ে আসে।তার বুক ধড়ফড়িয়ে উঠে। এসব কি। এই লোকের সমস্যা তো বোঝা যাচ্ছে না।
ভয়ে নুপুরের মুখ শুকিয়ে গেছে। কি হল এটা। টাকা পয়সা দেখে বাবা মা অন্ধের মত কার হাতে তুলে দিলো।
ভুল মস্ত বড় ভুল।
তবুও সাহস করে রিফাতকে ডাকল।

: শুনছেন?

: এই যে আপনাকে বলছি, শুনুন।

রিফাত মোবাইল রেখে উঠে আসে।
: আপনাকে এত করে ডাকছি। শুনেন না?

: জ্বি।

নুপুর রেগে যায়। লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিতে মন চাইছে। আগ বাড়িয়ে কোন কথা বলে না। কেমন বেহায়া লাগছে নুপুরের।
নিজ থেকে কথা বলতে।

: একটা মশারী লাগবে আমার। এখানে কোন মশারী নাই। আমি ঘুমাতে পারছি না।

: এসিতে মশা থাকে না। আপনি ঘুমান।

: না, আপনি মশারী আনিয়ে দিন। আমি এভাবে ঘুমাতে পারি না।

নুপুর কথাগুলো বলে রুমে চলে আসে।
বিছানায় বসে ঢুলতে ঢুলতে আরো বিশ মিনিট পার হয়। হঠাৎ জেগে দেখে রিফাত বিছানার এক কোনে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার পায়ের কাছে একটা মশারী ফেলে রাখা।
নুপুর আবার উঠল মশারী টানাতে থাকে দুনিয়ার বিরক্তি নিয়ে।
তারপর বালিশটা জড়িয়ে নিতে নিতে মন খারাপ হল খুব। ঘুটঘুটে রাতটা সকাল হতে বাকী নেই। ভোরের আলো ফুটবে অল্প সময় পর। নুপুরের জীবনে আনন্দময় একটা দিনের সমাপ্তি এভাবে হবে এটা খুব কষ্টের।
নুপুর বুঝে গেছে জীবনের বাঁকগুলো সহজ নয়। যেমন সহজ নয় সুখকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাওয়া।
আমরা দৃশ্যত অনেক কিছু দেখি কিন্ত তার সবটা সত্য নয়। মানুষের ভাবনা আর ঘটমান ছবির সাদৃশ্য যেমন সম্ভব না তেমনি জোর করে সব নিজের করে নেয়াও সম্ভব না।
জীবন খেলে। সত্যিই খেলে। সবার সাথে। কেউ জেতে। কেউ হারে। কেউ মুখ লুকিয়ে নিজকে শেষ করে দেয়।
এটাই ভাগ্য। যা বিধাতা নির্ধারন করে রাখেন। এর থেকে মুক্তি কারোর নেই।

তবে সত্য আর মিথ্যের জালে জীবন কখনও আটকে যায়। তখন সেখান থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন।হয়ে পড়ে।

হঠাৎ বিকট এক শব্দে নুপুর জেগে দেখে রিফাত ভয়ঙ্কর রকম শব্দে চিৎকার করছে। ঠিক একটা পশুর মত। তার চোখগুলো ঠিকরে বের হচ্ছে। হাত পা ছুড়ছে।
যেন জলজ্যান্ত একটা জানোয়ার।
উঃ মাগো! এটুকু বলেই নুপুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

…….. তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here