#অপরাজিতা – ৪
নুপুর হা করে দেখছে রিফাত খুড়িয়ে খুড়িয়ে ভেতরে এসে খালি চেয়ারটায় বসল। পুরো দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখে নুপুর স্তব্ধ হয়ে যায়। রিফাত ছেলেটা খোঁড়া মানে প্রতিবন্ধী। এই ছেলের সাথে তার বিয়ে হবে। সবাই বলবে খোঁড়া বর। তাকে দেখে পরিচিত অপরিচিত সবাই মুখ টিপে হাসবে। কেউ দয়া দেখাতে আসবে।
গায়ে ফোসকা পড়া কথা হবে। আহা উহু করবে।
নুপুরের হাত পা ঘামছে। এটা কি করে সম্ভব। এত বড় সত্যটা লুকিয়ে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তার।
নুপুরের ভয়ানক রাগ হল। তার ইচ্ছে করছে ছেলেটার সামনে থেকে সরে যেতে।
তবুও সব রাগ সামলে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করল।
: আপনার পায়ে কি হয়েছে?
: জ্বি ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল তারপর থেকে হাঁটতে সমস্যা হয়।
: আপনার কষ্ট হয় হাঁটতে?
রিফাত হেসে ফেলল। কষ্টে মোড়ানো হাসি।
: নাহ! অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে বেঁচে আছি এটাই তো অনেক বেশী।
: ওহ।
: সরি আসলে নিজেকে নিয়ে এভাবে বলাটা অনুচিত হচ্ছে।
নুপুর সহজ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সে চিন্তা করল ফর্মাল আলোচনা করা দরকার।
: সরি কেন নিজের কথা বলতেই তো এলেন।
: আপনার কথা বলুন।
: আমার কোন কথা নেই।
তার আগে বলুন আমার ফোনটা রিসিভ করেননি কেন?
: আম্মু নিষেধ করল।
: বিয়েটা আপনি করছেন না?
নুপুর উকিলের মত জেরা করছে।
: জ্বি।
: তাহলে আম্মুর কথা আসছে কেন?
আপনাকে আমি দশবার কল করেছিলাম। আর আপনি কোন রিপ্লাই দেননি। লাস্ট না পেরে মেসেজ করেছি।
সেটাও ইগনোর করলেন।
আমি দেখা করতে চেয়েছি। আপনি না করে দিলেন।
: আজ আসব এটা জানা কথা,, তবুও আলাদা করে দেখা করতে চাইলেন কেন?
: এখন এসব বলে লাভ নেই।
আমার নাম্বার কোথা থেকে পেলেন।
: এত অবাক হওয়ার কি আছে, বায়োডাটা থেকে নিয়েছি।
: আসলে।আপনার সাথে দেখা করাটা আমার মা ভালোভাবে নেয়নি।
নুপুর রেগে গেছে।
: ওকে ফাইন।
খুব রূঢ় শোনালো আওয়াজটা। নুপুর যে বিরক্ত সেটা তার বিহেভে বোঝা যাচ্ছে।
এবং এটাই নরমাল। বরং বিরক্ত না হলে অস্বাভাবিক হত। তাকে পছন্দ করার কিছু নাই। নুপুর বা যেকোন মেয়ে তাকে রিজেক্ট করবে এটাই স্বাভাবিক। ।
: ফোনের বিষয়টা বড় হয়ে গেলো?
: অবশ্যই। আপনি আমাকে হেয় করেছেন। এটা আমি ভুলতে পারছি না।
: তার মানে আপনার এই বিয়েতে মত নেই।
নুপুর আটকে গেছে এই কথায়। কি বলবে সে।
: দেখুন বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তই বড় হয়। সেখানে একটা মেয়ের পছন্দ অপছন্দগুলো সবসময় গৌন থাকে।
এটা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট।
এবং আমরা মেয়েরা এখানে বারবার আটকে যাই।
: আপনার কোথাও পছন্দ ছিল।
নুপুর কঠিন করে না বলে ফেলল। এখন তার এসব নিয়ে ডিশকাস করতে ভালো লাগছে না। যেখানে ফাইনালি সব হতে যাচ্ছে। সেখানে অযথা কথা বাড়িয়ে লাভ কি।
দরজায় টোকা পড়ছে। একটু পর সিলভিয়া দরজা খুলে ঢুকে পড়ে।
:তোমাদের কথা বলা শেষ?
রিফাত এক গাল হেসে মাথা নাড়ল।
সিলভিয়া এক প্রকার এড়িয়ে নুপুরকে নিয়ে রুম থেকে চলে যায়।
: তুমি বসো।
ওরা চলে যেতেই রিফাত উঠে পড়ল। পরিস্থিতি ভালো নয়। ঝড়ের পূর্বাভাস। রিফাত অসহায় বোধ করছে।
শপিং থেকে সবাই ফিরেছে এগারটায়। সমস্ত কেনাকাটা শেষ। সবার মুখে প্রশান্তির ছাপ। যেন বিশাল কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে। আলোচনার বিষয় শপিং এর খুটিনাটি।
কলকল করে মাতিয়ে তুলেছে ড্রইরুম। আট দশটার মত শপিং ব্যাগ সোফাতে রাখা। বিশাল সাইজের ব্যাগ।
ছেলের মা সালমা বেগমকে ডেকে সবগুলো জিনিস বুঝিয়ে দিলেন। খুলেও দেখালো।
শাড়ি, জুতা, ব্যাগ কসমেটিকস আর সামান্য জুয়েলারি। শাড়ি সালমার পছন্দ হয়নি। সস্তা মানের। রঙও ভালো না । লাল হলে সুন্দর হত।
সালমা হতাশ হলেন।
ব্লাউজের রঙ সোনালী। ওড়না নাই। জুতার ডিজাইনও নরমাল।
কেবল গোল্ডেন চুমকির কাজ। মিনা করা কাজ নাই।
কেবল নাকফুল কেনা হয়েছে ডায়মন্ডের।
ছোট্ট বক্সটা সালমার হাতে তুলে দিয়ে সুন্দর করে হাসল।
: আপা এটুকুতে আমরা মেয়েকে আজ বরন করলাম। আপনারা খুশী থাকেন। এরপর বড় করে প্রোগ্রাম করে মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো।
: আপা স্বর্ন ছাড়া বিয়ে হবে?
অন্তত একটা চেইন আর কানের দুল আনলে ভালো হত না?
: আসলে এই মুহুর্তে আমাদের হাতে টাকা নাই। সোনার দাম আজকের ভরি সত্তর হাজার টাকা।
কেমনে কিনব।
সালমা থমকে গেছে। কেবলমাত্র নাকফুল দিয়ে বিয়ে।
তারা এত এত টাকার মালিক। তার নমুনা তো দেখা যাচ্ছে না।
ছেলের মা নরম হল ।
: আপা, মন খারাপ করলেন? আমরা মেয়েকে গহনা দিয়েই তুলে নিয়ে যাবো।
ছেলের বাবা সোফা থেকে উঠে এলেন।
: বেয়াইন আপনার মেয়েকে আমরা খুশী করেই নিয়ে যাবো। আমার একমাত্র ছেলের বউ সে।
ঢাকায় আমাদের নিজেদের ছয়তলা বাড়ি আছে।
এগুলো ছাড়া আরো দুটি ফ্লাট আছে। একটা বনানী আরেকটা ধানমন্ডিতে।
এসব কার বলুন । সব আমার ছেলের।
সালমা মনে মনে খুশী হল। কিন্ত ভাবসাবে প্রকাশ করল নয়।
: ভাই আপনার মেয়েও তো আছে।
মেয়ে মেয়ে জামাইের হক আছে তো এসবে।
: হুম। মেয়ে মেয়ের জামাইকে পূর্বাচলের প্লট লিখে দিয়েছি। আমি সব কাজ ঝামেলামুক্ত করে রাখি।
ছেলের বাবা শব্দ করে হাসছে।
সালমা কিছুটা লজ্জা পেলো।
কেন যে প্রপার্টি নিয়ে কথা বলতে গেলো। সে জিনিসগুলো নিয়ে উঠে আসতেই সিলভিয়া ড্রইরুমে ঢুকে।
হাতে তিনটা বড় বড় ব্যাগ।
ছেলের মাকে ব্যাগগুলো বুঝিয়ে সালমাকে নিচু গলায় কি একটা বলল।
: ভাবী জরুরী কথা আছে আসো।
ছেলের মা হতচকিত হয়ে গেলো।
সিলভিয়া সালমাকে নিয়ে চলে আসতে আসতে পেছন থেকে শুনল ছেলের বাবা বলছে।
: কোন ঝামেলা?
দরজা লক করে মিটিং বসেছে।
বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে শফিক। তার হাতে সিগারেট। আদিল একটু চুপচাপ।
সালমা। ঝাড়ি খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
সিলভিয়া সারা ঘরের এ মাথা ও মাথা হাঁটছে।
: ভাবী তুমি বিয়ে ভেঙে দাও।
বাটপার কোথাকার। একটা খোড়া ছেলের কাছে আমরা নুপুরের বিয়ে দিবোনা।
সিলভিয়া রাগ করেছে প্রচন্ড।
: আমাদের মেয়ে কি এতই সস্তা? নাকি পানিতে পড়ে গেছে?
সালমা সিলভিয়ার আচরনে খুব বিস্মিত। আশ্চর্য খুচিয়ে কথা না বলতে পারলে তার পেটের ভাত হজম হত না যার সেই মানুষটা তার পক্ষে কথা বলছে।
শফিক আয়েশ করে সিগারেট টানছে।
তার মুখে হাসি। তৃপ্তির হাসি।
আদিল বলেই ফেলল।
: ভাইয়া এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমাকে আগেই সব বলেছিলাম। তুমি তো কানে তুললে না।
সিলভিয়া চেচিয়ে উঠে।
: তার মানে তোমরা সব জানতে?
সালমার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। মেয়েটার জীবন শুরু হল ধোকা খেয়ে। কি করে সামলে নেবে ও।
আদিল মুখ খুলল।
: জানতাম বলতে বিয়ের সবকিছু আমিই তো করলাম। ছেলের পায়ে সমস্যা আছে এটা জানার পর আমি ভাইকে না করতে বলে দিই কিন্ত ভাই বলল ওদের আসতে বল।
সালমা সিলভিয়া অবাক হয়ে শফিককে দেখছে। এই লোক বাবা হয়ে তার মেয়ের জীবনটা নিয়ে খেলবে?
শফিক মুখ খুলল অনেক পর।
: আমি মত দিয়েছি। একশবার দিবো। হাজারবার দিবো।
কারন ওদের টাকা আছে। এই দুনিয়াতে টাকা আছে যার সুখ তার। ছেলে খোড়া হোক কোন অসুবিধা নাই।
বোবা হলেও আমি দিতাম। কারন টাকা আছে ওদের ব্যস।
আমার মেয়ে রাজসুখে থাকবে। টাকার বিছানায় ঘুমাবে। এমন জীবন আমি কল্পনাও করি নাই। সেইটা আজ আমার হাতে।
সিলভিয়া তাজ্জব হয়ে যাচ্ছে।
: ভাইয়া এমন কথা বলতে পারলেন? ছেলেটা খোড়া।
মানুষ কি বলবে জানেন আপনার মেয়েকে?
বলবে লেংড়ার বউ।
আপনার ভালো লাগবে শুনতে?
:বলুক। আমার মেয়েকে পানিতে ভাসিয়ে দিবো। সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবো। এতে কার কি।
আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ফাইনাল।
এখানেই বিয়ে হবে এবং আজ রাতেই।
নুপুর জানালার গ্রিল ধরে।চুপচাপ বাইরের আকাশ দেখছে।কি শান্ত প্রকৃতি। নগর জীবনের রাত্রির নিরবতায় হাহাকার থাকে।
মন ভাঙার শব্দগুলো আছড়ে পড়ে বুকের পাড় ভেঙে।
কেউ তা দেখে না। শুনেও না।
নুপুর তার মোবাইল বন্ধ রেখেছে।
সর্বশেষ রিহানের মেসেজ আসার পর সেটা সীন করে
আর খুলেনি।
রিহান লিখেছে।
” নুপুর তুমি আমায় ফেলে চলেই যাচ্ছো।
আমায় বিশ্বাস করলে না, একবার শুধু বলো তুমি আমায় ভালোবাসো না, ব্যস তাহলেই আমি চলে
যাবো ”
রাত্রির বুক চিরে আর্তির ছায়ারা ঘুরে বেড়ায়। তারপর কেঁদে কেঁদে শান্ত হয় নুপুর কাঁদেনি। নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করেছে।
: নুপুর?
: বাবা।
: আয় মা বোস।
শফিক মেয়েকে কাছে এনে বসালো। নুপুর কোন কথা বলছে না।
: এই বিয়েতে আমার মত আছে। এখন তুই বল আমি কি ভুল করছি, দেখিস ওরা তোকে অনেক সুখে রাখবে।
আমি তোদের কোনদিন আমি ভালো রাখতে পারিনি। সাধ আহ্লাদ পূরন করতে পারিনি। কিন্ত এবার তুই রাজসুখে থাকবি দেখিস।
যদি মনে কর তোর বাপ তোকে ভাসিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রে ধরে নে এটাই তোর সুখ।
নুপুর কঠিন পাথর হয়ে গেলো।
বারটায় কাজি এলো। সাড়ে বারটায় বিয়ে পড়ানো শেষ। হুড়োহুড়িতে সব ভেঙে পড়েছে।
নিয়ম মেনে মালা বদল আংটি পড়ানো হল।
কিন্ত শাহ নজরে নুপুর একবারও তাকিয়ে দেখল না। সিলভিয়া ভয়ানক মন খারাপ করে তার রুমে চলে আসে।
সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। সব গুছাচ্ছে আদিল সালমা। এমন সময় ছেলের মা ছুটতে ছুটতে এসে সালমার হাত চেপে ধরে।
: আপা বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে আমরা নিয়ম মেনে নুপুরকে নিয়ে যেতে চাই।
সালমা হতভম্ব হয়ে যায়। এভাবে মেয়েকে নিয়ে গেলে আর তো কিছুই হবে না।
: আপা, একেবারে গহনা ছাড়া মেয়েকে নিয়ে যাবেন? হলুদ দিলাম না মেহেদীও নেই হাতে। এটা কেমনে হয় বলুন।
ছেলের মা কতক্ষণ উশখুশ করল।
তারপর আমতা আমতা করল বলল।
: আপা কিছু যদি মনে না করেন তবে একটা কথা বলি?
আপনারা মেয়ের জন্য কিছু তো গহনা বানিয়ে রেখেছেন। সেগুলো দিয়ে দেন। মেয়ে খালি যাবে কেন ভরাই যাক।
ছেলের মায়ের চোখে সরলতার কোন ছাপ নেই। সালমার মনে হল সে বোধহয় ভুলই করে ফেলেছে।
বিঃদ্র- প্রিয় পাঠক অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য দুঃখিত।
আপনাদের সকলের ভালবাসায় গল্পটি এগিয়ে যাচ্ছে এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
ভালো থাকবেন সবাই,,পাশে থাকবেন। আর নিরাপদে থাকবেন।
…….. তামান্না হাসান