#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_৩
অচেনা অজানা একজন মানুষের হাতে হাত রেখে চলতে দ্বিধা সংকোচে নুইয়ে যাচ্ছে বার বার সেহেরিশ।তবুও একশত ঘা চাবুকের ভয়ে মুখ ফুটে কিচ্ছু বলার সাহস হচ্ছে না তার।দীর্ঘ একদিন পর সেই গুপ্ত কক্ষ থেকে আফীফের হাতে হাত রেখে বের হয়েছে সে।আফীফ তার তাকিয়াকে হাতে হাত রেখে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে।সেহেরিশো কিছু সময়ে বুঝে গেছে এটা যেন বাড়ি নয় রাজপ্রাসাদ!দোতলায় বেশ কয়েকটি কক্ষ।নিচতলায় বৃহৎ বসার ঘরের ব্যবস্তা।তার কল্পলোকে রাজাদের যেমন বাড়ি থাকতো আজ বাস্তবে সে অনুভব করছে তার ভাবনার অধিকাংশ যেন সত্যি!জমিদারের বাড়ি বলে কথা, সারবত্তা না হয়ে পারে!
– এমন চমকে তুমি কি দেখছো তাকিয়া?
আফীফের প্রশ্নে সৎবিৎ ফিরে আসে তার।গলা খাকিয়ে “কিছু না” বলে আবার হাটতে থাকে সমান তালে!সেহেরিশের বিরোধাভাস বুঝতে পেরে আফীফ তিলার্ধেক হাসে।
– তোমার পরিবারে কে কে আছে তাকিয়া?
– কেন আপনি জানেন না?
– না।তুমি না বললে আমি তোমার বিষয়ে জানবো কী করে?তোমার ফুফি যে তোমায় ছেড়ে শহরে চলে গেছে তুমি কী জানো?
– কি? ফুফি আমায় ছেড়ে কেন গেলে?তবে আমি ফিরবো কী করে!
– তোমায় বন্দি করার অপরাধে এলাকার থানায় আমার নামে অভিযোগ করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি তাই শহরের বড় অফিসারের কাছে নালিশ নিয়ে গেছে।দেখি কী করতে পারে।
সেহেরিশের চিন্তিত মুখ দেখে আফীফ কথা কাটিয়ে নেয়।
– তোমার বাড়িতে কে কে আছে?
আফীফের প্রশ্নে সেহেরিশ আড় চোখে তাকায় তার দিকে।এই মূহুর্তে তার আসল পরিচয় কিছুতেই দেওয়া যাবে না।একদিক দিয়ে আফীফ যে তার পুরো নামটা জানেনা তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরেছে সেহেরিশ।
– আমার কেউ নেই ফুফি আর আমি একাই থাকি।
– অন্ততপুরের কোন এলাকায় থাকো?
– আ..অন্তত পুরে থাকি না আমি। শহরে ফুফির বাড়িতে থাকি।
ঝটপট উওর দিয়ে হাফ ছেড়ে বাচঁলো সেহেরিশ। আফীফের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।এদিকে আফীফ সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে নিলো তার তাকিয়া এতিম!এতে যেন মেয়েটার প্রতি মায়া আরো একশত গুন বেড়ে গেছে তার।
আর কোন কথা না বাড়িয়ে আফীফ সেহেরিশের হাত টেনে তার দাদীজানের রুমে নিয়ে গেলো।আফীফের দাদীজান ফাতেমা, আফীফের সবচেয়ে কাছের এবং বিশ্বস্ত মানুষ।মায়ের পরে কোন নারীকে ভালোবাসলে আফীফ তার দাদীজানকেই ভালোবাসে।
– দাদীজান দেখো কাকে নিয়ে এসেছি!
আফীফের কন্ঠে মাথা তুলে তাকান ফাতেমা। সেহেরিশে দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছু মূহুর্ত নির্মল নয়নে।
– এই বাচ্চা মেয়েটাকে তুই শাস্তি দিচ্ছিস আফীফ!তোর কি রাগ,জেদ,উগ্রতা কোন দিন কমবেনা?
ফাতেমার কথায় কান দিলোনা আফীফ। বরং সেহেরিশের উদ্দেশ্য করে বলে,
– দেখো সেহেরিশ উনি আমার দাদীজান।তুমি দাদী বলেই ডাকবে।
-দাদী মানে গ্র্যান্ডমাদার?
সেহেরিশের কথা ভ্রু কুচকে যায় ফাতেমার।চোখের চশমাটা নাকের ডগায় এনে সেহেরিশের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
– গ্যারেনমাদার মানে?কি কও তুমি পিচ্চি মাইয়া?
ফাতেমার কথায় আফীফ নিঃশব্দে হাসে।
– দাদীজান এতশত বুঝতে হবে না। আর আমার সাথে যেমন সদা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো, তাকিয়ার সাথেও একই ভাবে বলবে।তোমার আঞ্চলিক ভাষা তোমার কাছেই রাখো।
আফীফের কথা শেষ করতেই রুমে প্রবেশ করে ফাতেমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী পারভিন।পারভিন বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতে থাকেন ফাতেমাকে সাহায্য করার জন্য।
পারভিনের দিকে তাকিয়ে আফীফ সেহেরিশকে শুধালো,
– ওনাকে আন্টি বলে ডাকবে।এসো বাদবাকি সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি।
বাড়ির প্রত্যাকটা সদস্যর সঙ্গে সেহেরিশ পরিচিত হয়ে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো এই বাড়িতে আহনাফ দেওয়ানের পরে রাজত্ব চলে আফীফ দেওয়ানের।
কেটে গেলো আরো দুটিদিন তবে এই বাড়ি ছেড়ে পালানোর কোন রাস্তা পেলো না সেহেরিশ।যতক্ষণ আফীফ বাড়িতে থাকে ঠিক ততক্ষণ সেই রুম থেকে বের হওয়ার সুযোগ থাকে তার না হলে বাকিটা সময় ওই রুমেই বন্ধী থাকে। তবে এই বাড়ির সবার মাঝে সবচেয়ে বেশি ভাব জমেছে পারভিনের সাথে।আর পারভিন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে করেই হোক এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেবে তার। তাই সব চেষ্টা ধাতস্ত রেখে পারভিনের উদ্দেশ্য দিন গুনছে সে।
রাত একটা ছুঁই ছুঁই বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। কিন্তু ঘুম নেই সেহেরিশের চোখে।গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে সারা রুম জুড়ে পাইচারি করছে।তার জীবন থেকে তিনটে দিন পার হয়ে গেলো এই বন্ধী দশায়।পালানোর ফাঁদ খুঁজতে গিয়েও পেলোনা কোন উপায়।এদিকে পারভিনের কোন খবর নেই।বিরস মুখ নিয়ে আলমারির পেছনে থাকা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে আস্তেধীরে খুলতে গেলে আশ্চর্যের শেষ সীমানায় পৌছে যায় সে!একি দরজাটা খোলা।
সেহেরিশ গুটি গুটি পায়ে ধীরে ধীরে আফীফের রুমে প্রবেশ করে।বিছানার দিকে তাকাতেই ড্রিম লাইটের আলোয় আফীফের কাঁথা জড়ানো মুখটা সাদৃশ্যমান। সেদিকে তাকিয়ে সেহেরিশ নিজেকে ধাতস্ত করে।পীল পীল পায়ে রুমের দরজা খুলে আফীফের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো বাড়িটা ফাঁকা দেখে সস্তির শ্বাস ছাড়ে সে।
সবটা ভালোয় ভালোয় মিটলেও বাড়ির সদর দরজার ছিটকিনি খুলতে যত বাধা বিপত্তি লেগে যায়।ছোট্ট সেহেরিশের হাতে কিছুতেই ছিটকিনি নাগালে আসছেনা। তিন চারবার লাফানোর পরেও কোন মতেই ছিটকিনি তার হাতের নাগাল পর্যন্ত এলো না।বিরক্ত হয়ে মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে শ্বাস নিতে থাকে জোরে জোরে যে করেই হোক আজ তাকে পালাতে হবে।
– দরজা খুলতে পারছো না আমি খুলে দেবো তাকিয়া?
পেছন থেকে পুরুষের কন্ঠে তড়াক করে তাকায় সে।আফীফকে দেখে নির্বাক ভঙ্গিতে ঢোক গিলে।
– কি হলো ছিটকিনি খুলে দেবো?
আফীফের কথায় সেহেরিশ কোন প্রত্যুত্তর করলো না।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে চুপচাপ দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।
– এবার যাও কোথায় যাবে তুমি?
– আ..আমি
– হ্যা তুমি কোথায় যাবে?
আফীফের শান্ত কন্ঠে সেহেরিশের ভয় যেন আরো দিগুন বেড়ে গেলো।তবুও বাজখাঁই গলায় রাগ দেয়ে বলে,
– আমি চলে যাবো।আমি এই গ্রামে থাকতে চাইনা। আর আপনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্য আমি ক্ষমা করে দিলাম।জানেন আপনি আমার কাকাতুয়াকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি?আমার কাকাতুয়া আমার দাদাজানের শেষ স্মৃতি।আর একটা নিষ্পাপ পাখিকে আপনি মেরে দিলেন তবুও ক্ষমা করলাম আপনায়। এবার ছেড়ে দিন আমায়।
– কিন্তু আমি তো তোমায় ক্ষমা করিনি তাকিয়া!তবে?
– দেখুন আমি চলে যাবো। আমার ফুফি আমার জন্য অপেক্ষা করছে।এতটা বেহায়া কেন আপনি?কতবার বললে আমায় জেতে দেবেন?
শেষ কথাটা বেশি রাগ দেখিয়ে বললো সেহেরিশ।কিন্তু তার কোন প্রত্যুত্তর করলোনা আফীফ।সে ধীরে সুস্থে এগিয়ে এসে বাড়ির সদর দরজা খুলে দেয়। সেহেরিশকে ইশারা করে বলে,
– তোমার কাছে একটা সুযোগ আছে তুমি চলে যাও।বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে তুমি যদি যদি এক পা’য়ো ফিরে আসো তবে সারাজীবনের জন্য এই বাড়িতে বন্ধী থাকতে হবে তোমায়!রাজি?
আরাফের বিধিবদ্ধা নিয়ম লুফে নেয় মেয়েটি।একবার যখন সুযোগ এসেছে তখন যে কোরেই হোক এই বাড়ির গেট থেকে আগে তাকে বের হতে হবে বাকিটা পরে দেখা যাবে।
– বেশ আমি রাজি।
– তবে দেরি কিসের এখনি বেরিয়ে যাও!
সেহেরিশ ঠোঁট বাকিয়ে বেরিয়ে যায় দ্রুত বড় বড় পা ফেলে।
তার পেছন পেছন আফীফ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।বাড়ির বিশাল উঠানটা মাড়িয়ে যখন গেটের সামনে দাড়ায় তখনি আফীফের পালিত সাতটি কুকুর সেহেরিশের দিকে তেড়ে আসে।তাদের ঘেউঘেউ শব্দে পুরো এলাকার মানুষ সহ সবাই জেগে উঠে।একসঙ্গে এতগুলো কুকুর তেড়ে আসতে দেখে সেহেরিশ আহাম্মোক বনে যায়।ডানে বামে না তাকিয়ে বিকট শব্দে চিৎকার দিয়ে পেছনে ছুটতে থাকে।হাতের নাগালে আফীফকে পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
সেহেরিশের অবস্থায় আফীফ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালোনা চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে রইলো একই অঙ্গভঙ্গীতে।চারজন দৌবারিক ছুটে এলে আফীফ তাদের ইশারা করে চলে যাওয়ার জন্য।কিন্তু কুকুর গুলো এখনো সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করছে।কনকনে ডিসেম্বর মাসের শীতেও ঘেমে একাকার সেহেরিশ।আফীফের গায়ে থাকা গেঞ্জিটি আঁকড়ে ধরে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।ইতিমধ্যে বাড়ির সকলেই সদর দরজার সামনে উপস্থিত। সেহেরিশের অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সেদিকে আফীফ পাত্তা না দিয়ে সেহেরিশের কানে ফিসফিস করে বলে,
– সে দূরে যেতে চেয়েও কাছে চলে আসে।আমি ঘৃণা করতে চেয়েও ভালোবেসে ফেলি।তবে এত চনমনিয়ে লাভ নেই সে আমার অন্তরিন প্রণয় হয়েই থাক!আমার বিরান বক্ষে সে সুখের রসদ হয়েই থাক।আমার কল্পলোকের সম্রাজী হোক!
আফীফের কথা গুলো সেহেরিশের কর্ণধারে পৌছলো কী না কে জানে?তবে এখনো গুটয়ে আছে আফীফের বক্ষপিঞ্জিরায় একরাশ ভয় নি।
#চলবে…..