#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৩
বসার ঘরে দেওয়ান বাড়ির সকলের আজ হইচই জমে গেছে।আফীফ অবশেষে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বিয়ে বাড়ির দাওয়াতটা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে।তারপর থেকেই মৌ,আমানের মাঝে হইচই বিরাজমান।কিন্তু মুখ গোমড়া করে বসে আছে সেহেরিশ।কি পরবে সে বিয়ে বাড়িতে!হাতে তিনটে জামা।তিনটাই ভারী কাজের গর্জিয়াস ফ্লোর টার্চ গাউন।কিন্তু কোনটা পড়বে?জামা গুলো হাতে নিয়ে দম করে চন্দনার সামনে বসে যায়।এতক্ষন যাবৎ আফীফ চুপচাপ ল্যাপটপে মুখ গুজে সেহেরিশের কান্ড দেখছে।
– আন্টি প্লিজ হেল্প মি আমি কোন জামাটা পড়বো?
– সবগুলো জামা সুন্দর।এবার আমি কি বলি বলতো? আচ্ছা তুমি মিষ্টি রঙের জামাটা পড়ো।
– হাহ এটাই তো আমি ভাবছিলাম।এই জামাটা পড়লে আসলেই আমাকে কিউট লাগে।
সেহেরিশ জামাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।গায়ের সাথে মাপ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতেই কানে আসে আফীফের গমগমে সুরের কথা,
– এখানে বিয়ে খেতে যাওয়া হবে ঝাড়ু দিতে নয়।গ্রামের রাস্তায় কাদামাটি,থাকবেই এইসব ঝাড়ু ওয়ালা জামা না পরাই বেটার।
আফীফ ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে উঠে চলে যায়।এদিকে আফীফের এমন কথায় ঠোঁট টিপে হাসে চন্দনা,আমান। সেহেরিশ রাগ দেখিয়ে জামাটা ছুড়ে মারে মেঝেতে,
– আন্টি আপনি বলুন এই জামাটা খারাপের কি হলো?
– না মানে এটা তো গ্রাম সেহেরিশ।বিয়ে বাড়িতে এই জামাটা পড়ে তুমি আরাম পাবেনা।
– থাক আমি বিয়েতেই যাবো না তোমরা সবাই যাও।
সেহেরিশ জামা গুলো রেখেই নিজের রুমের উদ্দেশ্য চলে গেলো।
রাতের খাওয়ার শেষে আফীফের রুমে প্রবেশ করে সেজুঁতি।তার মুখটা গম্ভীর নিরবতা বিরাজ মান।
– আমায় কেন ডেকেছিস?
– আম্মা তুমি এইভাবে মুখ ভার করে রেখেছো কেন?
– না কিছু না।
– আব্বার সাথে ঝগড়া করেছো?
– না।
– তবে?
– বললাম তো কিছুনা।
আফীফ নিজের মায়ের রেগে থাকাটা বুঝতে পারে কিন্তু কেন রেগে আছে তার মোটেও আন্দাজ করতে পারছে না।
– আমার সাথে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে না আম্মা।এমন ত্যাড়ামো আমার মোটেও ভালোলাগে না।
– তোর ভালোলাগেটা কি?
সেঁজুতির ঝাঝালো কন্ঠে আফীফ চমকে যায়।মায়ের দুবাহু জড়িতে ধরে অনুনয় সুরে বলে
– আম্মা কি হয়েছে তোমার।কেউ কিছু বলেছে?
সেজুঁতি এবার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিলেন।তার চোখের নোনাজল আফীফের
শাল ভিজিয়ে দিচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে রুষ্ট হলো আফীফ।
প্রিয় মানুষ গুলোর চোখের জল মোটেও সহ্য হয় না।তাদের একএকটা চোখের নোনাজল আমাদের বিষ গেলার মতো অবস্থা হয়।
সেখানে আফীফ তার মায়ের চোখের জল সহ্য করবে কি করে?তার তো ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে।
– আম্মা কি হয়েছে বলো আমায়। তোমার চোখে পানি কেন?
– তোর দাদী আজো আমার সাথে রাগারাগি করেছেন।
– কিন্তু কেন?
– তোর বিয়ে নিয়ে।তোর কারনে সে তার সন্তানকে কাছে পাচ্ছে না।এদিকে তোর বয়সটাও কম হয়নি।বিয়ের উপযুক্ত সময় বিয়ে দেওয়াটাই উচিত।
– দাদীজানের কি আর কাজ নেই সুযোগ পেলেই এইসব বিষয় নিয়ে তামাশা শুরু করেন।দেখো আম্মা তুমি কেঁদে কেঁদে আবার বেহুশ হইয়ো না।আমাকে আমার প্লানিং মাফিক কাজ করতে দাও।
আর প্যাকেট গুলো নাও।সেহেরিশকে জামা গুলো দেবে।বেচারিকে রাগিয়ে দিয়েছি তাই বিয়েতে যাবে না বলেছে।
সেজুঁতি প্রত্যুত্তর করলো না পেকেট গুলো হাতে নিয়ে সহসা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বাবরি চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে হালকা সাজসজ্জায় তৈরি হয়ে নিলো সেহেরিশ।তার চোখে মুখে আজ আনন্দের আভাস।কাঁচা হলুদ রঙের জামাটায় তাকে অপূর্ব লাগছে।এক রাশ মুগ্ধতায় গ্রাস করছে তাকে বারংবার।দুপুর শেষে বিকেলের ঠান্ডা শীতল আবহাওয়ায় জানান দিচ্ছে অন্যরকম অনুভূতির।রুম থেকে বের হতেই আফীফকে সামনে দেখে ভড়কে যায় সে।
– কি হলো এখানে কি করছেন?
– তোমায় দেখতে এসেছি ফুলপরী।
– দেখা হয়েছে এবার যান।
– উহুহ।আমি গেলে থাকবে কে?বাই দা ওয়ে তোমার লং গাউন থেকেও এই থ্রি-পিস টা বেশ মানানসই।
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না।সোজা করিডোর পেরিয়ে নিচে নেমে গেলো।
বিয়ে বাড়িতে আজ গায়ে হলুদের হই হুল্লোড়ে চমকে আছে কেইন,তুন্দ্র,সেহেরি।ভরা মজলিশে সবাই তাদের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।সবার ভাব গম্ভীর এমন যেন চিরিয়াখানার তিনটে প্রাণী বিয়ে বাড়িতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাই সবাই অবাক হয়ে শুধু দেখছে।কেইন তুন্দ্রের হাত টেনে ক্রুদ্ধ স্বরে বলে,
– হোয়াটিস দিস ব্রো?আমার ভালো লাগছে না।এখানে মানুষ গুলো এত অদ্ভুত কেন?এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?
– আহ কেইন এটা গ্রাম।প্রত্যাকটা অঞ্চলের মানুষের ব্যবহার একই হবে এটা আশা করা মোটেও ঠিক না।
সেহেরিশ, তুন্দ্র, এবং কেইন এক সাইডে এসে চিপকে দাঁড়িয়ে আছে।নানান বাচ্চারা রঙ ছোড়াছুড়ি করছে।কিছু ছেলে সেহেরিশের দিকে আছে আড় দৃষ্টিতে।কেউ সরাসরি তাকানোর
সাহস ভুলেও করছে না।কেননা ইতিমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে মেয়েটি দেওয়ান বাড়ির অতিথি।
হঠাৎ দুইজন মহিলার কানাঘুষা সেহেরিশের কানে এলো।
– মাইডার চুলডি এত ছোড কিল্লাইগা।এরুম হইলে কেরুম লাগে?
– হ ঠিক কইছো। হুনছি বিদেশে থাহে।বিদেশী মাইয়া গুলার চুল এমনেও ছুড হয়।
সেহেরিশ হতভম্ব হয়ে মেঝেতে দৃষ্টি নিমজ্জিত করে সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া লাগছে তার কাছে।অদ্ভুত সবার আচরণ।সন্ধ্যার পর সবদিকে লাইটিং ব্যবস্থা।সাউন্ড বক্সের জোরে জোরে গানের তালে পরিবেশটা জমজমাট।তুন্দ্র সুযোগ পেলেই সবার ছবি তুলতে ব্যস্ত কিন্তু কেইন আর সেহেরিশ মন মরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়।আমান, মৌ, সামী সবাই এদিক থেকে সেদিক ছোটাছুটি করছে।সেহেরিশ ভেবেছিল বিয়ে বাড়িটায় হইচই আনন্দ করবে কিন্তু তার ভাবনার মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে সব অনুভূতি সাদামাটা হয়ে গেছে।আফীফ দূর থেকে সেহেরিশকে ভালোভাবে পরখ করছে। সেহেরিশের মনমরা অবস্থা দেখে তার ভ্রু কুচকে যায়। যে মেয়েটি বিয়ে বাড়িতে আসতে এতটা এক্সাইটেড ছিল হঠাৎ তার কি হলো?
আফীফ ইশারায় আমানকে কাছে ডাকে।আমান ভাইয়ের ইশারা বুঝতে পেরে ছুটে চলে আসে,
– এই তোর ভাবীর সঙ্গে দেখা করবো নিরিবিলি জায়গা খুজে দে।
– এখানে নিরিবিলি জায়গা কোথায় পাবো আমি? সব দিকেই মানুষজন।
– আরে ব্যবস্থা কর।তুই না তোর ভাবীর একমাত্র দেওর।
– ব্লাকমেইল করছো?
– আরে না রে ভাই দ্রুত ব্যবস্থা কর।
– ওকে ঘরের পেছনটায় চলে আসো।
– গুড বয়।
আমান এক ছুটে সেহেরিশের সামনে দাঁড়ায়।ফসফস করে শ্বাস ছেড়ে একগাল হাসি দিয়ে বলে,
– আপু তোমার কি হয়েছে এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
– আমার ভালো লাগছে না আমান।বাড়ি যেতে চাই।
– এই ভাবে চিপায় চিপকে থাকলে ভালো লাগবে কি করে?এসো আমার সাথে এসো।
আমান সেহেরিশের হাত টেনে বাড়ির পেছনে নিয়ে যায়।
– সেহেরিশ আপু দাঁড়াও তুন্দ্র ভাইয়াকে নিয়ে আসি এখানে নিরিবিলি লাইটিং ব্যবস্থা ছবি ভালো আসবে।
– ওকে যাও।
আমান দ্রুত চলে যায়।সেহেরিশ একা চারিপাশটা পরখ করছে।নিয়ন বাতির হালকা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারিদিক।অন্ধকারের মাঝে লম্বা লম্বা তাল গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো সেহেরিশ।মনের মাঝে কেমন কু ডাকছে।পেছনে ঘুরতে দম করে ধাক্কা লাগে কারো সাথে।
– আরে’হ
– এই মেয়ে এখানে একা কি করছো তুমি?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে চমকে তাকায় সেহেরিশ।আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।মিহি বাতাসে সারা শরীর চনমনিয়ে উঠছে তার।
– মুখে কি তালা এঁটে দিয়েছো নাকি?আমি কিছু প্রশ্ন করছি।
– আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই দাঁড়িয়ে আছি।
– বাহ ভালো উওর।বিয়ে বাড়িতে আসার জন্য এত দৌড় ঝাপ দিলে অথচ এখানে এসে থেমে গেলে কেন?
– কিছু না।
সেহেরিশের ত্যাড়া জবাবে রুষ্ট হয় আফীফ।দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে আলতো করে সেহেরিশকে কাছে টেনে আনে।
– কাজি রেডি চলো বিয়ে করে ফেলি।
– আপনার ইচ্ছে হলে করে ফেলুন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
– তুমি রাজি থাকলে এখনি কবুল।
সেহেরিশ মুখ ভেংচালো কিন্তু কোন জবাব দিলো না।আফীফ ডান হাতটা উপরে তুলে এক থাবা রঙ সেহেরিশের গালে লেপ্টে দিলো। অন্ধকার মিশ্রিত হালকা আলোতে টকটকে লাল রঙ সেহেরিশের মাঝে অন্য রকম সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
– বাহ!
– গালে রঙ লেপ্টে দিলেন কেন?আমার এত সুন্দর স্কিনটা এবার নষ্ট হয়ে যাবে।
– উহুহ কিচ্ছু হবে না ফুলপরী।খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করছি।
– কখনো না। আপনি জেগে জেগে সপ্ন দেখুন।
সেহেরিশ গাল মুছতে মুছতে দ্রুত চলে যায়।আফীফ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়তেই তার কানে আসে খচখচে কাগজের মাঝে কারো হাটার শব্দ।আফীফ চমকে যায়।এতক্ষণ সেহেরিশের কাছ থেকে নিজেকে দূরে দূরে রেখেছে একমাত্র কেউ যেন সন্দেহ না করে আফীফ আর সেহেরিশের গভীর সম্পর্কের কথা।আশেপাশে হাসিখুশি ভালো মুখোশধারী অনেকেই আছে।যারা আড়ালে দিন শেষে আফীফের ক্ষতি করতে উঠে পড়ে লেগে আছে।
______
কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠছে দেওয়ান বাড়ি।অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ভারী মাথাটা নিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো আফীফ।দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে সেহেরিশের ছবি গুলোর দিকে।তার চোখের কোনে পানি।এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় দেয়ালের সামনে।সেহেরিশের ছবিগুলোতে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
– গত দুইদিন থেকে তুমি নিখোঁজ ফুলপরী।কোথায় আছো?তোমার অভাবে এই বাড়ির মানুষ গুলো যন্ত্র মানব হয়ে গেছে।দেখো তোমার ভাষ্যমতে নিষ্ঠুর স্বার্থপর আফীফ দেওয়ানের চোখে আজ জল।এই চোখের জল আজ থেকে আট বছর আগে ঝরেছে একমাত্র তোমার কারনে আর আজ আবার!আমি আর পারছি না।আমার সকল চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে।
আফীফের চোখের পানি টপটপ করে ঝরে পড়ছে। সেহেরিশের ছবিগুলোয়ে হাত বুলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সেন্টার টেবিলের সামনে লালচে কাগজটা হাতে তুলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।সেদিন পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই আফীফ কাগজটা পায় যেখানে লেখা ছিল,
” প্রিয় মানুষটা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট বড্ড ভয়াবহ!”
আফীফ তখনি থমকে যায়।তার মস্তিষ্কে বার বার জানান দেয় সেহেরিশের কিছু হলো না তো।তার ভাবনাকে সত্যি করে দিয়ে আজ দুইদিন সেহেরিশ নিখোঁজ। দরজায় কারো করাঘাতে চোখ মুছে দরজা খুলতে এগিয়ে যায় আফীফ।দরজা খুলতেই অস্থির মুনিফকে দেখে থমকে যায়।অস্থির মুনিফ হড়বড়িয়ে বলতে থাকে,
– ভাই তাড়াতাড়ি আয়।সেহেরিশের আব্বা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে।ভীষণ রক্ত ঝরছে। কি করবো এখন আমার মাথায় আসছে না।
#চলবে…..