#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_১৩

সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমের সাগরে ভাসমান চোখ দুটি নিয়ে সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে আছে আফীফ।ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই ঘড়িটি ঢং ঢং করে বিকট শব্দে বেজে উঠলো।ঘরির দিকে তাকিয়ে আফীফ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।সারাদিনের ব্যস্ততায় আজ এক মূহুর্তের জন্যেও বিশ্রাম নেওয়া হয় নি তার।

তখন ব্লাক হাউজে সেহেরিশের সামনে আফীফ নিজের রাগটা দমন করলেও পররর্তীতে তা যেন আরো চওড়া দিয়ে উঠছে।একে তো জ্বর তার উপর সেন্স লেস।বারন করা স্বত্তেও একই কাজ বার বার করতে কি করে সাহস পায় এই মেয়ে ভেবে পায়না সে।সেহেরিশকে তার রুমে চন্দনার কাছে রেখে গিয়ে নিজের রুমে চলে যায় আফীফ। পরবর্তীতে বাড়ির বাকি সবাই চন্দনপুর থেকে ফিরে এলে চন্দনা নিজে সেহেরিশের খেয়াল রাখবে বলে বাদবাকি সবাইকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দেয়।এদিকে বাড়ির সবাই যখন ক্লান্ত শরীরে অতি শীঘ্রই ঘুমে কাবু তখন আফীফ চন্দনাকে পাঠিয়ে দিয়ে,নিজে সেহেরিশকে জলপট্টি দিতে থাকে।আফীফের শরীর যখন ক্লান্তিতে মুষড়ে যায় তখন সোফায় হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে থাকে সেহেরিশের দিকে।

– আরে আপনি এখানে কি করছেন?
ভাঙ্গা গলায় সেহেরিশের ফ্যাচফ্যাচে আওয়াজে চমকে যায় আফীফ।
– দু-চোখ তবে খুলেছেন আপনি!কি অবস্থা এখন?
আফীফ দ্রুত এগিয়ে আসে তার দিকে কপালে হাত দিয়ে নিশ্চিন্ত শুরে বলে,

– যাক জ্বর তবে কমেছে।দেখতে হবে না সেবা যত্ন কে করছে!
শেষ কথাটা আফীফ ফিসফিস করে বললেও সেহেরিশের কর্ণকুহরে ঠিকি পৌছে যায়।
– কে সেবা করছে মানে কি?আর এত রাতে আপনার এই রুমে কী?রাতের বারোটা বেজে গেছে।

সেহেরিশের কথায় আফীফ প্রত্যুত্তর করলো না।বরং গলার মাফলার টা ভালোভাবে জড়িয়ে সেহেরিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রাখে,
– দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো।আমি খাওয়ার গরম করে আনছি।
– কেন বাড়ির সবাই কোথায় আপনি যাবেন মানে কি?
– এত রাতে তোমার জন্য নিশ্চই কেউ জেগে থাকবে না।এবার আর একটা কথাও না বাড়িয়ে দ্রুত যাও।
– তো আপনি জেগে আছেন কেন?
– আমার এখনো হিসাব নেওয়া এবং দেওয়া বাকি তাই।

আফীফের কথাগুলো মাথায় ডুকলো না সেহেরিশে।আফীফ যাওয়ার পর ওয়াশরুমে ঢুকতেই মনে পড়ে যায় সে তো ব্লাক হাউজে ছিল।

খাওয়ার শেষে হাতে ওষুধ নিয়ে বিরস মুখ নিয়ে বসে আছে সেহেরিশ।তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে আছে আফীফ দেওয়ান।

– কি হলো ওষুধ মুখে দাও এত নাটক করছো কেন?
আফীফের ঝাঝালো কন্ঠে সেহেরিশ দ্রুত ওষুধ মুখে পুরে নেয়।
– কাল ব্লাক হাউজে কেন গেছিলে?
– দেখতে গেলাম কি আছে তার মাঝে যার জন্য আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
সেহেরিশের রুষ্টতা বুঝতে পেরে আফীফ বাঁকা হাসলো।
– জানার খুব শখ বুঝি মিস সেহেরিশ আনওয়ার?
– ইয়েস।
– তাহলে বলছি।আগে তুমি বলো, তুমি শেষ কবে গ্রামে এসেছিলে?

আফীফের এমন প্রশ্নে বিমূঢ় হয়ে যায় সেহেরিশ।তার থতমত মুখ লুকোনো অবস্থা বুঝতে পেরে কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।নিজেকে লুকাতে আবারো মিথ্যা কথার আশ্রয় নেয় সেহেরিশ,

– আব..আমি যখন ছোট ছিলাম দাদা-দাদী,ফুফা মারা যাওয়ার পর ইতালি চলে যাই এর পরে আমি আর বাংলাদেশে আসি নি।তবে গ্রামে আসবো কি করে।
– ওহ!যাই হোক তবে শুনো।জিনের কথা শুনেছো নিশ্চই?
– হ্যা শুনেছি বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য সঞ্চার করে এমন ক্রোমোজোম।

আফীফের সিরিয়াস মুডের কথায় সেহেরিশের এমন উত্তর কিছুতেই আশা করেনি সে।দু-হাত মুষ্টি করে কপালে ঠেকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– আমি সেই জিনের কথা বলিনি মিস। আমি আমাদের ইসলাম ধর্মের যে অদৃশ্য দেহধারী জিন আছে তার কথাই বলছি।
– হ্যা শুনেছি আমি মামনি এবং ফুফির কাছ থেকে।
– ওই ব্লাক হাউজে জিন আছে।
– কি?
– জি।
সেহেরিশ আতংক নিয়ে আফীফের দিকে তাকিয়ে আছে।বিছানায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসলেও হঠাৎ গা ছমছমে করায় দ্রুত এক লাফে বিছানা থেকে নেমে আফীফের পাশে সোফায় বসে পরে।
– কি হলো এখানে কি?
– আমার হঠাৎ কেমন জেন লাগছে।
– এই টুকু শুনেই কুপ কাত মিস সেহেরিশ।আর এই সাহস নিয়ে আমার ব্লাক হাউজে যাও বাহ। প্রসংশার তারিফ করতে হয় দেখছি।

– মজা করবেন না প্লিজ সত্যিটা বলুন।
– ওই বাড়িটাতে একটা জিনের সন্ধান পাওয়া গেছে।কিন্তু জিনটা বড্ড দুষ্টু।আর সেই জিনটা মেয়ে জিন আমাদের বাড়ির ছেলেদের প্রতি তার বরাবরি আকৃষ্ট তাই সেই বাড়িতে কোন মেয়ে মানুষ দেখলেই জিনটা ক্ষেপে যায়।তাই সেই বাড়িতে সব মহিলা প্রবেশ নিষিদ্ধ।কিন্তু তুমি কাল রাতে সেখানে কেন গেলে?যদি জিনটা কিছু করে ফেলতো?

আফীফের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আফীফের পাশে আরেকটু খিচে বসে যায়।
– আপনি কি সত্যি বলছেন?
– তোমার সাথে মিথ্যা বলার সময় আমার নেই।যা হয়েছে তা শেষ। ভবিষ্যতে আর এমন দুঃসাহস ভুলেও করবেনা।আমি গেলাম দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাও।

আফীফ উঠে যেতে নিলেই সেহেরিশ তার হাত টেনে ধরে নেয়।
– প্লিজ যাবেন না আমার ভিষণ ভয় করছে আমি একা থাকতে পারবো না।যদি ওই দুষ্টু জিনটা চলে আসে তখন?
– আমি জানি না সব দোষ তোমার কে বলেছিল সেখানে যেতে?
– আর যাবো না সত্যি বলছি আমায় ছেড়ে যাবেন না প্লিজ।
– প্রমিস করো আর যাবে না?
– প্রমিস,প্রমিস,প্রমিস কোন দিন না।

সেহেরিশের ভীতু মুখখানা দেখে আফীফের বেশ মজাই লাগলো।প্রায় এক ঘন্টা ব্লাক হাউজে জিন সম্পর্কে আফীফের মুখ থেকে মিথ্যা ধারণা শুনতে শুনতে সেহেরিশ যে কখন ঘুমিয়ে গেছে তার হুশ নেই।

সেহেরিশকে রেখে আফীফ তার রুমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাত ১ টা ১২ মিনিট দেখে আফীফ দ্রুত তার রুমে যায়।সারাদিনের দখলে আজ বড্ড ক্লান্ত সে।

—-
শেষ রাতের পর একসঙ্গে পাঁচটি কুকুরের চিৎকারে কেঁপে উঠে দেওয়ান মঞ্জিল।বাড়ির ঘুমন্ত মানব গুলো আবারো জেগে যায় সচকিতে।আহনাফ দেওয়ান,আফীফ,মুনিফ,মাসুম বাড়ির পুরুষ গুলো দ্রুত সদর দরজা খুলে বাইরে আসতেই সবাই হতবিহ্বল হয়ে যায়।পুরো বাড়িটি নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে আছে।একে একে সেহেরিশ,কেইন, তুন্দ্র,খুরশীদ সবাই নিচে নেমে আসে।

আফীফ আর মুনিফ দ্রুত টর্চ নিয়ে বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে,
– এই বাড়িতে রাতের জন্য ছয় জন দৌবারিক সবগুলো কোথায়?
আফীফের প্রশ্নে মুনিফ সহসা জবাব দেয়,
– দুইজন ছুটিতে আছে ভাই।বাকি চারজন তো পাহারায় ছিল তারা কোথায়?
– দ্রুত বাড়ির সার্কিট চেক কর।লাইটের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি।

মুনিফ মাসুমকে নিয়ে পুরো বাড়ির লাইট গুলো আবারো মেরামত করে।আফীফ তরান্বিত তার কুকুর গুলোর বিশাল আকৃতির খাচার সামনে দাড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করে। ঠিক তখনো তার সন্দেহে তেমন কিছু লাগেনি।কিন্তু বাড়ির গেইটের সামনে গেলেই সে বিমূঢ় হয়ে যায়।বাড়ির সম্পূর্ণ গেইট খোলা।এবং মাটিতে লুটিয়ে আছে নয়টি কুকুরের মৃত দেহ।
– মুনিফ!

আফীফের চিৎকারে মুনিফ সহ বাড়ির সবাই ছুটে যায়।কুকুর গুলোর মৃত অবস্থা দেখে সবার মাঝেই চাপা আতংক বিরাজ করছে।সেহেরিশ মারুফার হাতটা ধরে আছে আতংক গ্রস্ত হয়ে।

—-
ফজরের আযান শেষে আলো ফুটতে শুরু করেছে।দেওয়ান মঞ্জিলের বাইরে আজ গ্রামের মানুষের ভিড়।আফীফ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে হাত গুটিয়ে তার সামনে ভীতগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চার দৌবারিক।

– কোথায় ছিলি তোরা?
-……..
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
-……..
– উওর দে।আমায় আর রাগা’স না আমি যদি একবার রেগে যাই কি হবে ভালো করেই জানিস তোরা।
– আ..আমরা নদীর পাড়ে ছিলাম ভাইজান।
– নদীর পাড়ে,কিন্তু কেন?
– আসলে…
– যা বলেছি উওর দে।যত কথা প্যাচাবি ততই বিপদে পড়বি।

দৌবারিক গুলো কিছু বলার আগেই মুনিফ আফীফের কানের সামনে বলে,
– ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছি এরা নদীর পাড়ে ছিল।সন্ধ্যার পর সারারাত সেখানে পিঠা উৎসব হয়।আর তারা সেখানেই ছিল।

মুনিফের কথায় অবজ্ঞার হাসি হাসলো আফীফ।
– তোদের সাহসের তারিফ কর‍তে হয় আমার বাড়িটাকে বিপদের আশঙ্কায় রেখে তোরা নদীর পাড়ে যাস।মুনিফ এদের নিয়ে যা এদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা কর আর মৃত কুকুর গুলোকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা কর
– ঠিক আছে ভাই।

আফীফ পুরো বাড়িতে আবারো চোখ বুলিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে।প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই একটি কাগজ তার হাতের মুঠোয় চলে আসে যেটা কিছুক্ষণ আগেই আফীফ বাগানের কোনায় পেয়েছে পুটলি বাধা অবস্থায়।পুটলি থেকে কাগজটা বের করে আফীফ দ্রুত পড়া শেষ করে।লাইন গুলো আফীফের জন্য ছিল বুলেটের মতো সুচালো। কাগজে লেখা লাইন গুলো ছিল,

– শত্রু পক্ষের পতন ঘটানোর সহজ মাধ্যেম তার ভালোবাসার মানুষ অথাৎ তার দূর্বল মানুষকে আঘাত করা!
আমরা অপেক্ষায়……

আততায়ীর হামলায় আফীফ ভয় না পেলেও বর্তমানে যে তাকে সেহেরিশের উছিলায় হুমকি দেওয়া হয়েছে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যার দরুনে ভীত হীন আফীফ আজ ভীতিবিহ্বল।তবে সন্দেহ মাথা থেকে এখনো কাটেনি সেহেরিশের ব্যাপারটা বাড়ির সবাই যানলেও বাইরের কেউ কিছু জানে না।তবে শত্রুপক্ষ কী ঘরেই আছে?

কেইন,তুন্দ্র, সেহেরিশ একসাথে দাঁড়িয়ে আছে বসার ঘরে।তাদের মাঝে তুন্দ্র বলে উঠে,
– আজ যেহেতু ভোরে ভোরে উঠেছি তবে চলে আজ আবারো গ্রামটা ঘুরে আসি।

তুন্দ্রের কথা শেষ হতেই বজ্রকন্ঠে আফীফের গলায় উপস্থিত বাড়ির সবাই চমকে যায়।

– আমার অনুমতি বিহীন এই বাড়ির বাইরে আজ থেকে যে পা রাখবে ভবিষ্যতে হাটার জন্য তার আর পা রাখবো না আমি।মাইন্ড ইট!কথাটা সবার জন্য প্রযোজ্য।

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here