#অনুরক্তির_অনুভূতি
#আফসানা_মিমি
|৪র্থ পর্ব |
পরিবেশ উত্তপ্ত। অগ্নেয়রুপ ধারণ করে আছে তিনজন রমণী। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। অবস্থান করছে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে। সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক। সোফায় বসে থাকে একজনের হাতে জাম্বু। ভয়ে নুয়ে আছে। অসহায় দৃষ্টিতে আরাতকে দেখছে।
কষ্টে অন্তর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। সাহস তো চরম যুবকটার! এগিয়ে গেলাম সামনে। মুখোমুখি হলাম তিনজনের। প্রতিদিন দানা পানি চাওয়া যুবক মুখ খুলল,
” আহারে বোবা প্রতিবেশী, কথায় ঝগড়া করতে পারবে না বলে অস্ত্র সহ এসেছে।”
কান গরম হয়ে আসলো আমার। হটিস্টিক উঁচু করে জমিনে আঘাত করলাম পরপর দুইবার। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
” আমাকে কী অসুস্থ মনে হয়? আপনার চোখ নেই? রুপে, চুলে, উচ্চতায় সম্পন্ন রমণী বোবা হবে কেন? ভালোয় ভালোয় বলছি আমার জাম্বুকে দিয়ে দিন। নয়তো এখানে লা’শ পড়বে।”
রাগে কাঁপছি। শরীর ঝাঁকুনি দিচ্ছে। জাম্বু ক্যা ক্যা করছে চোখের সামনে। ভয়ে বাচ্চাটা জোরে আওয়াজ করছে না। কান্না চলে আসলো। পাশের যুবক বলে উঠল,
” ভাবেছিলাম বোবা, এতো দেখি জাসি কি রাণী। চল রিফাত এখানে এক মুহূর্তেও না।”
” সব দোষ তোর। বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছিল প্রিয়ম। এবার?”
গর্জে উঠলাম। আমার জাম্বুকে এই মুহূর্তে চাই। চারপাশে নিস্তব্ধ। সাথে আসা রত্না রেজিয়া ভয়ে চলে গেছে। আকিল নামক যুবকের হাতে জাম্বুকে রেখে এগিয়ে আসলো প্রিয়ম। হাতের হটিস্টিক কৌশলে নিয়ে নিলো। প্রিয়ম এখন আমার অতি নিকটে। নিশ্বাস অনুভব করছি।
” এত শক্তি? লা’শ ফালাবে? ফালাও গুন্ডি মেয়ে। কী দিয়ে লা’শ বানাবে। তোমার অস্ত্র তো আমার হাতে।”
নুয়ে গেলাম। স্বরও মিইয়ে গেলো। মুখের কাঠিন্যভাব কোথায় যেন উবে গেলো। আত্মসমর্পণ করছি না।
” হাত তো আছে। সেটা দিয়েই কাজ করব।”
দূরে সরে গেলো প্রিয়ম। নিঃশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হলো। প্রত্যুত্তর করল প্রিয়ম,
” কুকুরকে লেলিয়ে দিবে কামড়ে লা’শ ফেলতে? তাও হবে না। তোমার জন্য আমার সাতটা ইনজেকশন পুশ করতে হয়েছে। হিসেব এখনও ঢের বাকি। তোমার জাম্বুরাকে ছাড়ছি না।”
তেতে উঠলাম তাৎক্ষণিক। নামের অপব্যবহার করছে লোকটি। দয়া মায়া কী নেই অন্তরে?
” ওর নাম জাম্বু। আপনার সাহস তো কম না?”
আঙুল তুলে কথা বলছি। এগিয়ে আসলো প্রিয়ম। আঙুলের সাথে হাত পেঁচিয়ে ধরল পিঠের সাথে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” মেয়েদের নরম থাকা ভালো। উড়চন্ডী হয়ে থাকা খারাপ মেয়েদের কাজ। তোমার কুকুরকে আজ ভালো ট্রেনিং দিলে এমন পরিণতি হতো না।”
ব্যাথা পাচ্ছি। চোখ বেয়ে অবাধ্য অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। মায়া হলো প্রিয়মের। ছেড়ে দিলো হাত। অনুশোচনায় নিবদ্ধ দুই আঁখি। ফ্রিতে এতক্ষণ দুইজন বিনোদন নিচ্ছিল। জাম্বুর ঘেউঘেউ আওয়াজে স্তম্ভিত ফিরে আসলো। জাম্বু আমার কাছে। ছুটে এসেছে আকিলের হাত থেকে। চোখ রাঙিয়ে বকা দিলো প্রিয়ম আকিলকে, ‘কু’ত্তা’র বাচ্চা, তোর জন্য কু’ত্তা’র পায়খানা ঠিক আছে’। যা শুনে কান গরম হয়ে আসে আমার।
চলে আসার উদ্যোগ নিলাম। শক্তিতে পারব না এখন। ডেকে উঠলো প্রিয়ম। দাঁড়িয়ে গেলাম। বুকশেল্ফের আড়ালে লুকিয়ে রাখা ক্যামেরা বের করে আনলো অনিমেষে। ভয় পেলাম। কী করতে চায় প্রিয়ম?
” গুন্ডির আসল পরিচয় আমার হাতে। অনলাইনে বা অফলাইনে ছেড়ে দিলে কেমন হবে?”
বাঁকা হাসি প্রিয়মের মুখে। রাগে গজগজ করে বললাম,
” আপনার ফালতু কথায় ভয় পায় না এই আরাত।”
নরম হলো প্রিয়ম। নেত্রপাত করে কয়েকবার আরাত নাম বুলি আওড়াতে দেখলাম। উঁচু হলো ভ্রু। চমকে উঠলাম। প্রিয়ম বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল,
” তোমার নাম আরাত?”
উওর দিলাম না। রাগে ফুঁসছি। আবার বলে উঠল,
” সে যাই নাম হোক। মজার বিষয় হচ্ছে তোমার সাথে তোমার নামও যোগ হলো আমার অপছন্দের খাতায়।”
দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। জাম্বুর গলায় রাখা ফিতা শক্ত করে ধরলাম। পুনরায় প্রিয়মের স্বর কানে আসলো,
” ভিডিও ডিলিট করে দিবো। তবে শর্ত আছে।”
” আপনার শর্ত আপনার কাছেই রাখুন।”
” আমি যা বলি তাই করি।”
ভরকে গেলাম। মা জানতে পারলে কষ্ট পাবে। মিনমিন করে বললাম,
” কি শর্ত?”
জয়ী হাসির রেখা ফুটে উঠে প্রিয়মের মুখে। অবলা নারী মানে আমার চারপাশে ঘুরে বলল,
” তিনবেলা রান্না করতে হবে। খুশি করতে হবে আমাকে।”
চোখ বড়ো হয়ে আসলো। খুশি করা মানে কী। বলে উঠলাম,
” জঘন্য চিন্তাভাবনা।”
হেসে উঠলো তিনজন। লজ্জা পেলাম ভীষণ। প্রিয়মের মুখের হাসি সরছেই না,
” খুশি করা মানে ভালো খাবার খাইয়ে খুশি করতে হবে। নতুন জায়গা, বুয়া পাচ্ছি না। ততদিনে আমাদের খুশি করো।”
মূ্র্ছা গেলাম। মনে মনে আওড়ালাম,” তোদের ইচ্ছামত খাওয়াব। আজ থেকে খাওয়ার নাম ভুলে যাবি।”
রাগে গজগজ করতে করতে চলে আসলাম।
————
মধ্যাহ্নের শেষ সময়। জাম্বু বাসায়। দু’দিন আগের করা ঘটনা পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি হাসপাতালের সামনে যেখানে সেই বিকৃতিমস্তিষ্ক যুবককে রেখে গিয়েছিলাম। জীবন নামক হাসপাতালে কী আদৌও সুস্থ জীবন পাওয়া সম্ভব? মনকে প্রশ্ন করলাম।
একজন মেয়ের সাথে দেখা। পরিধানে থ্রি পিস, চোখে কাজল,ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ। অসাধারণ দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ঠাওর করলাম ডাক্তার হবে। সকলকে সেবা প্রদান করে। হাসিমুখে দাঁড়ালাম। সম্মানার্থে অভিবাদন করলাম। মেয়েটার মুখ গাম্ভীর্য। উওর নিলো। ভদ্রতা রক্ষার্থে আগ বাড়িয়ে কথা বললাম,
” আমি আরাত। সামনেই থাকি। এখানে এসেছি রোগীর সাথে দেখা করতে।”
ডাক্তারের মুখশ্রীতে বিরক্তির ছাপ। পরিপাটি পোশাকে আরো পরিপাটি করে প্রত্যুওর করল,
” আমাকে বলছো কেন? তুমি জানো না আমি স্পেশাল পারসন? আমার সাথে কথা বলার সাহস হয় কীভাবে? আমি একজন শিক্ষিত মেয়ে, তোমার সাথে কথা বলার সময় নেই।”
বোকা বনে গেলাম। অধৈর্য হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির পানে। সময় নিয়ে একজন নার্স এগিয়ে আসলো। বুক পকেটে নাম লিখা নয়নতারা। ডাক্তার ভাবা মেয়েটির কাছে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
” পাগলামি করার জায়গা পাও না? জীবনে কত পাগল দেখলাম। শান্ত বিশিষ্ট পাগল দেখিনি।”
নার্সের কথায় অবাক হলাম। ডাক্তার ভেবে পাগলকে এতক্ষণ কত কিছু বললাম। অবশ্য এত পরিপাটি মেয়েকে দেখে যে কেউ ডাক্তার বলবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মেয়ের গায়ে হাসপাতালের পোশাক নেই কেন? সেদিনের বিকৃতিমস্তিস্ক যুবকের গায়ে হাসপাতালের পোশাক ছিলো। বেশি ভাবনা ভালো লক্ষণ নয়। এগিয়ে গেলাম রিসেপশনের দিকে। অনেক কষ্টে রাজি করালাম। যুবকটির পরিচয় জানতে চাইলাম।
রিয়ান মাহমুদ। কোটিপতি বদরুল মাহমুদের সন্তান। দুই বছর যাবত এখানে। ভালোবাসার মানুষের সাথে বিচ্ছেদের কারণে মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। অনেকবার পলায়নের চেষ্টা করেছে। শুনে কষ্ট লাগলো। একজন নার্সের সাথে রিয়ানের কাছে গেলাম।
অন্ধকার ঘর, নিস্তব্ধ পরিবেশ। দরজা, জানালা সব আটকানো। দেয়াল ঘেঁষে ছোট ছোট ছিদ্র রয়েছে বাতাস আদান প্রদানের জন্য। নার্স চলে গেছে একা রেখে। দেয়ালে হাতিয়ে আলোর সুইচ খোঁজ করলাম। পেয়েও গেলাম। আলো জ্বালাতে রিয়ান চিৎকার করে উঠে,
” আলো জ্বালাতে বলেছি? কে এসেছে এখানে? আলো সহ্য হচ্ছে না। চলে যাও। আমাকে একা থাকতে দাও। আমার প্রিয়া আসেনি এখনও তাই না?”
উত্তেজিত হচ্ছে রিয়ান। ধীর স্বরে আওয়াজ করলাম,
” আমি এসেছি। ভালো আছেন?”
শান্ত হলো রিয়ান। হাসি ফুটলো মুখশ্রীতে। বিছানায় বসা ছিলো। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। স্তব্ধ হয়ে আছে মন শক্ত হয়ে আছে শরীর। কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া অনুভব করলাম।
” তুমি এসেছো প্রিয়া? আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে?”
বিমূঢ় হয়ে আছি। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বলার। আফসোস করছি এখানে আসার। ভুল সিদ্ধান্ত সর্বদা নেই। যার প্রমাণ আজকের পরিণতি।
” কথা বলছো না কেন? মুখ শুকিয়ে আছে কেন? খাওনি বুঝি? তোমার হিটলার বাবা খাবার দেয়নি তাই না? এ আর নতুন কী। সবসময়ই তো এমন করে। তোমাকে কষ্ট দেয়। এখন আর কষ্ট হবে না। আমি অছি না সাথে? সব কষ্ট দূর করে দিবো।”
পাগলের কথার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ছুটে পালিয়ে যাই। বোকার মত হাসছি। নিজের কার্যকলাপে ছি ছি করছি। পুনরায় আবার রিয়ানের স্বর,
” কথা বলছো না কেন? তোমার কথা শুনতে তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি।”
কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। মিনমিন কন্ঠস্বরে বললাম,
” খেয়েছেন?”
” মানুষ বাঁচতে হলে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আমার প্রাকৃতিক অক্সিজেনের সাথে তোমাকে পেয়ে গেছি। আর কিছু চাই না।”
ভরকে গেলাম। ব্যাগ থেকে চকলেট বের করলাম যা রত্নার জন্য কিনেছিলাম। রিয়ান খুশি। অর্ধেক অংশ আমাকে দিয়ে নিজে খাচ্ছে।
” চলে যাবে তুমি? আমি পাগল বলে আমাকে রেখে যাবে?”
” আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি আবার আসবো। ভালোভাবে থাকবেন।”
” কথা দাও?”
হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে। অসহায়ত্বতা ঘিরে ধরেছে আমাকে। হাতে হাত রেখে ওয়াদা করলাম। পরক্ষণে অনুভব করলাম হাতের উপর উষ্ণতা। শরীর কেঁপে উঠলো ভয়ে। হাত ছাড়িয়ে দ্রুত চলে আসলাম ঘর থেকে। পেছন থেকে রিয়ানের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বলছে,
” ফিরে এসো প্রিয়তমা! ওয়াদাবদ্ধ হয়ে আছো কিন্তু। কথা দিচ্ছি বিয়ে করবো তোমাকেই শুধু।”
——-
ভয়ংকর সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এসেছি। হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছি। সন্ধ্যা নেমে এসেছে ধরণীর বুকে। মাগরিবের আজান হচ্ছে পাশের মসজিদে। মুঠোফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার দেখে ধরলাম না। পুনরায় বেজে উঠল। ধরলাম। অপরপাশে নিস্তব্ধতা। নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে শুধু। সময় অতিবাহিত হচ্ছে। অপরপাশের মানুষ যেন ঘুমুচ্ছে। কথা বললাম এবার,” কে বলছেন?” টনক নড়ল যেন। খুক খুক কেশে উওর দিলো, ” কয়টা বাজে? বিকালের নাস্তা বানাতে হবে নাকি? আমরা কী না খেয়ে থাকবো?” বোধগম্য হলো ফোনের অপরপাশে কে? দাঁত চেপে উওর করলাম, ” আসছি।”
মহা বিপদে পড়লাম। রক্ষা পাবো না এই জীবনে। নাম্বার পেয়েছে কোথায়? রত্নার থেকে? আজ রত্নাকে বাড়ি ছাড়া করব। ওর জীবন নরক বানাবো। রাগে কষ্টে রিকশায় চেপে বসে কাঁদতে লাগলাম।
আদৌও কী রেহায় পাবো প্রিয়ম নামক প্রতিবেশীর কবল থেকে?
চলবে……