||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১৩||

মানুষ স্বার্থের পেছনে ছুটে। যে-কোনো ছোট বড় কাজের পেছনেও কোনো না কোনো স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। বাদলকে এই হুমকি বার্তা পাঠানোর পেছনেও কারো গভীর স্বার্থ রয়েছে। কেউ একজন আছে যে চায় না বাদল অনামিকার সাথে মিশুক বা কোনো সম্পর্ক রাখুক। এতে নিশ্চয়ই তার কোনো স্বার্থ রয়েছে।

আজ বিকেলে পড়াতে আসেনি অনামিকা। বাদল বেশ চিন্তিত হয়ে যায়। অপেক্ষা করতে করতে সন্ধ্যায় বাজারে চলে যায়। রাত করে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ করে ভাবলো অনামিকাকে দেখে গেলে কেমন হয়! কিছুটা ভয় কাজ করছে। অবশ্য ভয়কে জয় করাই তো প্রেমিকের কাজ। নাহলে সে কীসের প্রেমিক হলো! খুব আস্তে করে বাড়িতে ঢুকে, যাতে কোনো শব্দ না হয়। কিন্তু সে তো জানে না অনামিকা কোন কামরায় থাকে কেবল ঘরটা চেনে। এসে বিপদে পড়ে গেল। চেষ্টা করতে দোষের কোথায়। প্রথম যখন চিঠি পাঠায় তখন সোনিয়া বলেছিল, জানালা দিয়ে চিঠি দিবে। তার মানে অনামিকার কামরার পাশে জানালা আছে৷ ঘরের পেছন দিকে যেতেই দুইটা জানালা দেখতে পায়। আল্লাহর নাম নিয়ে একদম প্রথম জানালাতে এসে ঠকঠক শব্দ করে।

অনামিকা শুয়েছিল। শব্দ শুনে কেঁপে উঠে। সোনিয়া তো বাড়িতে নেই। তাহলে এই রাতে কে এখানে! চুপচাপ বসে বোঝার চেষ্টা করছে আদৌও কেউ ডাকছে নাকি এটা তার মনের ভুল। ওদিকে বাইরে বাদলকে মশার সৈনিক ঘেরাও করেছে৷ কিছুক্ষণ পরপর পায়ে, হাতে, মুখে থাবা মারছে। আবার জানালায় ঠকঠক শব্দ হয়৷ এবার অনামিকা নিশ্চিত যে কেউ একজন আছে বাইরে। এক হাতে হারিকেন নেয় অন্য হাতে লাঠি। চোর হলে একটা মেরে মাথা ফাটিয়ে দেবে৷ আলতো করে জানালার কপাট খুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে যায়। হারিকেন এগিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে আছে। অমনি বাদলে মাথা তুলে উঁকি দেয়৷ অনামিকা লাঠি এগিয়ে মারতে চাচ্ছিল তখনই সম্পূর্ণ মুখ দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। লাঠি একপাশে রেখে দ্রুত কাছে যায়।

একটু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এইহানে আইছো ক্যান? কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।”

“তোমারে দেখবার মন চাইতাছিল তাই আইছি। একটু বাইরে আহো না।” আবদারের সুরে বলল বাদল।

একদম মুখটা ছোট বাচ্চাদের মতো কাচুমাচু হয়ে এসেছে তার। এত রাতে বাইরে যেতেও ভয় করছে। তাছাড়া পরশ সেই যে বেরিয়ে গেছে এখনো বাড়ি ফিরেনি। যদি হুট করে আসে তবে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাদলের কথাও ফেলতে পারছে না। আসছি বলে জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে তার ঘরের দরজা খুলে বাইরের দিকে বন্ধ করে বেরিয়ে আসে৷ কতবার যে আল্লাহ, রাসূলের নাম নিয়েছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই৷ পা টিপে টিপে ঘরের পেছনে যায়। তাকে দেখেই বাদল একগাল হেসে দেয়৷ সীমাহীন অন্ধকারে ঢাকা চারপাশ। বাদল পকেট থেকে ছোট্ট লাইটটা বের করে আলো জ্বালিয়ে অনামিকার মুখের সামনে ধরে। হঠাৎ আলো এসে পড়তেই চোখ বন্ধ করে নেয়।

“সবাই তো সবাইরে মন ভইরা দেখে। আমি তোরে পেট ভরে দেখুম।”, বাদলের কণ্ঠ অপূর্ব শান্ত শোনালো।

অনামিকা ধীরে ধীরে চোখ খুলে বলল, “লাইট বন্ধ করো। কেউ দেখলে আমার ইজ্জত যাইবো। তোমারে তো কেউ কিস্যু কইবো না।”

“দেখলে কী হইবো? দেখলে দেখুক। বাদল মিয়া এইসব তোয়াক্কা করে না।”

“দেখলে পরে শাদি কইরা নিয়া যাইতে হইবো মিয়া, বুইঝা লও।”

বাদল অনামিকার আরো কাছে এগিয়ে আসে। সে দুই কদম পেছনে সরে যায়।

বাদল মৃদু হেসে বলল, “ডর দেখাও? এই বাদল এইসব ডরায় না। কিন্তু তুমি আমারে ঠিকই ডরাইতাছো।”

“জি না, আমি ক্যান ডরামু? আমিও ডরাই না।” অপ্রস্তুত গলায় বলল।

তার কাছের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “তাইলে পেছনে সরতাছ ক্যান?”

কোনো শব্দ করে না অনামিকা। কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরেকটু আলো থাকলে বাদল দেখতে পারতো তা লজ্জায় রক্তিম হয়ে আসা মুখখানা। লজ্জা মাখা মুখ না দেখতে পারলেও ঠোঁটের কোণে কেটে যাওয়া নজরে পড়ে যায়। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় ক্ষতস্থানে। অনামিকা আবারো পেছনে সরে যায়।

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এইহানে কাটলো কেমনে? কী হইছে? আইজ পড়াইতেও যাও নাই।”

সে কোনো উত্তর দেয় না। কথা আড়াল করতে চায়। কিন্তু বাদল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তার একটা হাত টেনে মাথার উপর রেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, “আমার কসম লাগে, সইত্য কথা কও। নাইলে খুব খারাপ হইয়া যাইবো।”

টান দিয়ে হাত সরিয়ে নেয় সে। প্রিয় মানুষের মাথা ছুঁয়ে মিথ্যা কসম কীভাবে করবে! গাল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বাদলের চোখের আড়াল হয় না সেই জল। অনামিকা তাকে সবকিছু খুলে বলে। তার চোখেমুখে আগুন ঝরছে। এখন যদি সে পরশকে সামনে পায় তাহলে খুন করে ফেলবে। তার কলিজায় হাত দিয়েছে সে।

“তার এতবড় সাহস! তোমার গায় হাত দিছে! আমি তারে খুন কইরা জেলে যামু।”

অনামিকা বাদলের গালে হাত রেখে বলে, “দেখ, আমার কিস্যু হয় নাই। তুমি হুদাই পেরেশান হইতাছ। এমন অধৈর্য হইলে পরে আমার কী হইবো? খুন কইরা তো তুমি জেলে চইলা যাইবা আর আমি কী করুম এইহানে?”

রাগে ফুসফুস করছে বাদল। রাগের মাথায় সে কিছু নষ্টও করতে চায় না। নিজেকে শান্ত করার জন্য লম্বা করে নিশ্বাস ফেলে। আচমকা পরশের কণ্ঠ শুনতে পায় তারা।

“আফিয়া, আফিয়া, ঘুমাইছস? দরজা খোল।”, পরশের কণ্ঠ পেতেই বাদল হাতের লাইট বন্ধ করে দেয়।

অনামিকা বাদলের দিকে সরে এসে একদম গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সারা গা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে যায়। ভয়ার্ত চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আসে। বাদলের একটা হাত শক্ত করে ধরে তার দিকে তাকায়। সে আলতো করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। বাদলের শরীরের উষ্ণতা অনুভব হতে শিউরে উঠে অনামিকা। হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দটা তীব্র গতিতে বাড়তে থাকে। বাদলের কানে স্পষ্ট সে শব্দটা যেন সুরের ঝংকার তুলছে।

আফিয়া তন্দ্রাঘোরে এসে দরজা খুলে দেয়। পরশ ভেতরে যেতেই বলে, “ভাত বাড়তাছি। মাদুর পাইরা বসো।”

“না খামু না আমি। গিয়া ঘুমাইতেছি। তুই তোর ঘুমা যা।”, তার কণ্ঠ তিক্ততায় ভরা।

আফিয়া আলতো করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এক কথাতেই চোখের ঘুম উড়ে গেছে।

১৭.
অনামিকা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায়। চাঁদের আবছা আলোয় মুখটা খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে। তার চোখে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে সে৷

চলবে…

লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here