||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ১২||
কারো প্রতি ভালোবাসা মানুষকে দুর্বল করে দেয়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কেবল তার সান্নিধ্যে থাকতে চায়। আর এই চাওয়াটাই এক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। অনামিকা জানে না তার জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। সে শুধু জানে এই মুহূর্তে তার বাদলের ভালোবাসা চাই।
“এই রাইতের বেলা তোমার এইহানে থাকা ঠিক হইতাছে না। তোমারে বাড়িতে খুঁজতাছে হয়তো।”, বাদলের কথায় কিছুটা নড়েচড়ে বসে অনামিকা।
সহসা বলে উঠে, “না, আমি বইলা আসছি আমার আইজ দেরি হইবো যাইতে।”
নিজের কথায় কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করে। অন্যদিকে তাকিয়ে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশ জুড়ে নীরবতার বরফ। বাদল তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছে। কয়েকগুচ্ছ চুল মাথার উপর থেকে কপালে এসে ঢলে পড়লো। অনামিকা সেদিকে ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে বসে রয়। বাদল কীভাবে কথা শুরু করবে কিছুই বুঝছে না।
নীরবতা গুড়িয়ে বলল, “এইহানে ডাকছো ক্যান?”
“আপনে চিঠি পড়েন নাই?”, ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে প্রশ্ন তুলল।
“না, আসলে পড়ার আগেই ওই চিঠিটা হারায়া ফেলছি।”
মিথ্যে বলছে বাদল। কথারা যেন গলায় আটকে আসছে। কিন্তু অনামিকাকে ফেরানোর এর থেকে ভালো মাধ্যম তার মাথায় আসেনি।
“তুমি ফিরা যাও। এই রাতে কেউ আমগোরে একসাথে দেখলে ভেজাল লাইগা যাইব।”
আনন্দে উদ্ভাসিত মুখখানা মুহূর্তেই নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেল। কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। এই চিঠি সে কীভাবে হারালো!
ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বাঁ হাতের তালুটা ঘষতে ঘষতে বলল, “আমি এইহান থেইক্যা যামু না।”
“ক্যান যাইবা না?”, বাদলের স্বর অদ্ভুত শোনালো। ততক্ষণে অনামিকার চোখে জল টলমল করছে। বুকটা ভারী হয়ে এসেছে।
কম্পিত স্বরে বলল, “আপনে আমারে মিথ্যা কইতাছেন। যতক্ষণ না আমারে সইত্য কথা কইবেন ততক্ষণ আমি যামু না।”
“তুমি এহনই এইখান থেইক্যা যাবা। নাইলে আমিই চইলা যামু।”
“না, আমি যামু না।”, অস্ফুটস্বরে বলল।
“তুমি বুঝতাছ না আমার কথা? এমন ছুডো মাইনষের লাহান জেদ করতাছ! ক্যান পাগলামী করতাছ তুমি?”
অনামিকা মাথায়া হেলিয়ে তার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। এক নিশ্বাসে বলল, “আপনারে আমার ভালো লাগে তাই, বুঝেন না ক্যান? আপনারে যে আমি ভালোবাসি। আমি আপনের লগে ঘর বাঁধতে চাই।”
কয়েক মুহূর্ত চারপাশ জুড়ে নীরবতা। আবহাওয়া গুমোট বেঁধে রয়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। অনামিকার নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল। মেয়েটা কাঁদছে৷ বাদল কিছুটা কাছে সরে যায়। হাতের তালু দিয়ে মুখটা তুলে ধরে। চোখের জল গালে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে জল মুছে। আচমকা অনামিকা তার কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।
“আমার আপন কেউ নাই। আমি জানি আপনে আমারে ভালোবাসেন। দোহাই লাগে আমারে ফিরায়া দিয়েন না। আমি আপনার ঘরের এক কোণে পইড়া থাকুম। একাই ভালো বাইসা যামু সারাজীবন। দয়া কইরা আমারে…”, বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে।
কখন যে বাদলের চোখ ভিজে এসেছে সে নিজেও জানে না। অনামিকার মাথায় আলতো করে হাত রাখে।
মৃদুস্বরে বলল, “তৃণলতার গায়ে ঘাসফড়িং লেপ্টে থাকে। ভাঁজে ভাঁজে ধীরে ধীরে হাঁটে আর খুঁইটা খুঁইটা খায়। ভাইবা লও এইবার। পরে না আবাদ পস্তাইতে হয়।”
কান্না থেমে আসে। কেবল হেঁচকি তুলছে থেমে থেমে। বাদলের কথার অর্থ বোধগম্য হতে কিছুটা সময় লাগে অনামিকার। লজ্জায় একদম মিশে যায় তার সাথে। মুখ তুলে তাকানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না। কতক্ষণ যে ওইভাবেই বাদলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে সে সময়ের কোনো হদিস নেই। মনে হচ্ছে এই রাত এখানেই থমকে যাক। আর কিছু চাই না তার। এই সুখটাই তো এতদিন খুঁজে এসেছে। এই শান্তিটা সে মায়ের কোলে পেয়েছে৷ আর আজ তার প্রিয়তমের কোলে।
বাদল তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আর কতক্ষণ এমনে শুইয়া থাকবি পাগলী? রাইত বাড়তেছে তো।”
“তুমি আমার লগে এমনেই কথা কবা। তুই কইরা কইলে আমার আপন আপন লাগে।”
“বউ বউ লাগে, তাই না?”
মাথা তুলে সলজ্জ মুখের তাকায় সে। মেয়েদের লজ্জামাখা মুখটা যেন তাদের সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়৷ একজন পুরুষের হৃদয়কে ঘায়েল করতে ওই চাহনিটা যথেষ্ট।
বাদল তাকে কিছুদূর এগিয়ে দেয়। বাড়ির কাছে যায় না। কেউ দেখলে সমস্যা হয়ে যাবে তাই। অনামিকা তার দিকে একদৃষ্টিতে ক্ষণকাল তাকিয়ে থাকে।
“সাবধানে যাইও, কাইল দেখা হইবো।” মৃদু হেসে কথাটা বলল অনামিকা। কিছু ইচ্ছে বুকে চেপে সামনে পা বাডায়। বাদল তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে যতদূর পর্যন্ত তার ছায়া চোখের আড়াল না হয়।
১৫.
পরশ টং দোকানে বসে বিড়ি ফুঁকছে। তার বন্ধু দুলাল মিনমিন করে বলল, “কী মিয়া আসবার পর থেইক্যা একের পর এক বিড়ি টানতাছ। মেজাজ খারাপ নাকি? ভাবির লগে অভিমান চলে নাকি?”
দুলালের দিকে কুপিত দৃষ্টি হানে। পরশের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। আজ বাড়িতে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। আফিয়ার সাথে রাগারাগি করে বেড়িয়ে গেছে পরশ। সেই থেকে গুলবাহার বিবি পুঁথি পড়ছেন বসে। অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক। এই ঝগড়ার মূল কারণ অনামিকা। সে জায়গা বিক্রি করবে না বলে দিয়েছে। আর সে এখন বিয়েও করবে না। পরশ সবার সামনে অনামিকাকে চড় মেরেছে। বলে দিয়েছে তার কথাই শেষ কথা। দলিল নিয়ে আসলে ঠিকমতো দস্তখত যেন করে দেয়। নাহলে আফিয়াকে সে তালাক দিয়ে দেবে। পাত্রপক্ষের সামনে নিজের বড়মুখ ছোট করতে দেবে না।
পুকুর ঘাটে বসে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে। আজ সোনিয়াকে ভীষণ মনে পড়ছে তার। অন্তত একটা মনের কথা বলার মতো মানুষ ছিল। বাদলকে সে এসব কথা বলতেও পারবে না। গালে চড়ের দাগ না বসলেও দাঁত লেগে ঠোঁটের কোণে কেটে গেছে খানিকটা। এটা কীভাবে আড়াল করবে সে। রিনি তার পাশে বসে বরশী দিয়ে মাছ তোলার চেষ্টা করছে। কেঁচো লাগিয়ে পানিতে বরশী দিলেই মাছ ঠুকরে তখন টেনে তুললেই মাছ উঠে আসে।
“দে আমারে দে।”, রিনির থেকে বরশী টেনে নেয় সে।
আনমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। গতকাল বাদলের সাথে একটা সুন্দর সম্পর্কের শুরু হলো আর আজই তাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। ভাবনার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। মাছ ঠুকরে যাচ্ছে একনাগাড়ে। রিনি তাকে বার কয়েক ডাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে কাঁধে হাত দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দেয়।
“মণি, মাছ খাইয়ালাইতাছে তো। তুলো বরশী। টান দেও।”
অনামিকা তড়িঘড়ি করে বরশী তুলে কিন্তু ততক্ষণে মাছ কেঁচো খেয়ে চলে গেছে। অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন মাছের এই কেঁচো খাওয়াতে বড় কোনো দোষ হয়ে গেছে। এই সামান্যতম বিচ্যুতির কারণে নিজেকে ভেতরে ভেতরে বলে যাচ্ছে, “কেন অনামিকা কেন একটু খেয়াল করলি না? আজ তোর ভুলের কারণে মাছটা হাতছাড়া হয়ে গেল।”
রিনিকে বরশী দিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় সে। আজ মনটা কত উৎফুল্ল ছিল। পড়াতে গেলে বাদলের সাথে দেখা হতো। অথচ একটা ভালো দিনেও মন খারাপে যাচ্ছে। তার আনন্দটাকে সে উপভোগ করতে পারছে না শুধুমাত্র পরশের কারণে। নাহ! বাদলকে সবকিছু খুলে বলতে হবে। এর একটা সমাধান বের করলে তবে শান্তি পাবে। আফিয়া রান্না বসিয়েছে চুলোয়। পরশের বলে যাওয়া কথাগুলো মন থেকে সরাতে পারছে না৷ কাজে মন বসছে না তবুও কাজ করতে হবে। এটা তো আর তার বাবার সংসার নয় যে একবেলা ইচ্ছে না করলে কাজ করবে না আরেক বেলা ইচ্ছে করলে কাজ করবে। এটা স্বামীর সংসার, এখানে খেটে খেতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই শাশুড়ির কটু কথা শুনতে হয়৷
১৬.
বাদল হেলালের সাথে রাস্তার মোড়ের বটগাছের নিচে বসে আছে। পুলিশ এখনো শিলার খুনিকে ধরতে পারলো না৷ তবে তার আন্দাজ মিথ্যে না হলে এমন কেউ খুন করেছে যে অনামিকার খুব কাছের অথবা এমন কেউ যে অনামিকাকে এক তরফা পছন্দ করে। এই ধাঁধার সমাধান করতে হলে অনামিকার সাথে কথা বলতে হবে।
চলবে…
লিখা: Bornali Suhana – বর্ণালি সোহানা