||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৮||

আচমকা কারো ধাক্কা খেয়ে ভাবনার ঘোর কাটে অনামিকার। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখে না। কে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল বুঝতে পারছে না। পড়াতে যাবে নাকি যাবে না দ্বিধায় পড়ে গেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই সামনে শিলাকে দেখতে পায়। সবকটা দাঁত বের করে হাসছে। তাকে ধাক্কা দিয়ে শিলাই দুষ্টুমি করছিল। শিলা তাকে নিতে এসেছে। গত দুইদিন পড়াতে যায়নি বলে মা পাঠিয়েছে তাকে। সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকায় অনামিকা। তার ভাবনা ভুল না হলে শিলা এখানে আসার পেছনে বাদলের অবদান অনেকাংশ। আফিয়া এসে তাকে পড়াতে যাওয়ার কথা বলল। পরনের শাড়িটা পালটে একটু ভালো শাড়ি পরে বেরিয়ে যায় সে। শিলার একটা হাত ধরে সরু পথে এগিয়ে যাচ্ছে দুজনে। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। গাছের ফাঁকে রোদের ঝিলিক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মৃদু বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ছে খানিকক্ষণ পর পর।

কিছুদূর আসতেই অনামিকা খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করল। তালগাছটার নিচে বাদল বসে আছে৷ সাইকেলে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধু হেলাল। অনামিকাকে আসতে দেখে হেলাল সাইকেলে চড়ে বসে। শিলার কাছে এসে বলে, “কীরে বাড়ি যাইতেছস? চল তোরে আইজ সাইকেলে লইয়া যাই৷ উঠ, উঠ।”

অনামিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিলা দ্রুত হেলালের পেছনে সাইকেলে উঠে যায়৷ অমনি সে টান দেয়। দেখতে দেখতেই তারা কিছুটা দূরে চলে যায়। তাদের যাওয়ার পথে ধূলো উড়ে যাচ্ছে। অনামিকা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের চলন বন্ধ হয়ে গেছে। কোনদিনে কীভাবে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত আবহাওয়া গুমোট বেঁধে রয়। সোজা কদম বাড়ায়। পায়ের গতি দ্রুত করে বাদলকে এড়িয়ে চলে যেতে চায় সে। তার চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে আর সে আটকাতে পারছে না। কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। আচমকা অনামিকা শাড়ির আঁচলে টান খেয়ে দাঁড়ায়। হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে এসে যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার৷ ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে তাকায়। অপ্রত্যাশিত কিছু হলো না। যা ভাবছিল তাই। বাদলের হাতে তার শাড়ি আঁচল। শরীর খানিকটা দুলে উঠলো। আশেপাশে তাকাচ্ছে বারবার৷ কেউ দেখে ফেললে নির্ঘাত সর্বনাশ ঘটে যাবে। রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে ধান ক্ষেতে কিছু কৃষক আর মাঠে কিছু রাখালের অবয়ব ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাদল বুঝতে পারছে অনামিকার ভয়। কিন্তু সে পীড়াপীড়িতে আর থাকতে পারে না।

“তোমার লগে কিছু কথা আছিলো।”, বাদল বিড়বিড় করে বলল।

বাতাসের তীব্র গতিতে শুকনো পাতা উড়ে এসে অনামিকার চুলে আটকে যায়৷ লম্বা বেনি করা চুলে যেন তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বাদল শুকনো পাতাটা হাত দিয়ে সরাতে চাইলে অনামিকা কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।

“তোমার চুলে পাতা আইটকা আছে, সরাইতে চাইতেছিলাম আরকি।”

অনামিকা তড়িঘড়ি করে দু’হাতে মাথাটা ভালো করে দেখে পাতাটা ফেলে দেয়। বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। চিঠির কথা জিজ্ঞস করলে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

“কী কইবেন তাড়াতাড়ি কন, আমার তাড়া আছে।”

“ছায়ায় আহো। এমনে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াই কেমনে কই! আর এত তাড়া নাই তোমার। আইজ আমি মিছা কথা বইলা তোমারে এইহানে আনাইছি। শিলা পড়ব না আইজকা৷ ওয় দিঘির পাড়ে গেছে।”

অনামিকা ইতস্ততভাবে বলল, “লোকে দেখলে বিষয়িডা খারাপ দেহাইবো।”

“আমার লগে চলো।”

“কই?”

“যেইহানে লোকে দেখবার ভয় পাইবা না।”

অনামিকা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় নিয়ে যেতে চায় তাকে! সে বাদলের এত কথা কেন শুনছে নিজেও জানে না।

কোনো জবাব না পেয়ে বাদল ঈষৎ অপ্রতিভ হয়ে বলল, “একবার বিশ্বাস কইরা দেখ, ঠকবা না।”

সকল দ্বিধাদ্বন্দে সাথে লড়াই করে হেরে যায় অনামিকা। কোনো কথা বলে না। কেবল মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বাদলের সাথে পা বাড়ায়। মূল রাস্তা থেকে নেমে ছোট্ট দিঘির পাড়ে চলে আসে তারা৷ শিলা গোসল করতে নেমে গেছে। হেলালকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলো না। দিঘির পাশ ঘেঁষে ছোট্ট একটা রাস্তা চলে গিয়েছে। রাস্তার অন্যপাশে কবরস্থান। কতশত আপনজন শুয়ে আছেন এই মাটির নিচে। কবরস্থানে অনেকগুলো খেজুর গাছ আর তেতুল গাছ। অনামিকা সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া পড়ে নিল, “আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুরি।”

কবরস্থান পেরিয়ে আসতেই বিশাল এক সুপারি বাগান পায় তারা। একচালা একটা খড়ের ঘর। উপরে চাল নেই। অথচ ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। অদ্ভুত লাগে বিষয়টা। হয়তো এখানে আগে কেউ থাকতো কিন্তু এখন কেউ থাকে না। সামনে ছোট্ট একটা পুকুর। গাঢ় সবুজ পানি। বাঁশে বাঁধানো সিঁড়ি করা ঘাট। বাদল ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে কোনো জন মানব নেই। মাঝেমাঝে দু-একটা পাখি ডাকছে। জায়গাটায় এত শান্তি যে এখানে কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলে মন্দ হতো না। না জানি এখানে রাতের দৃশ্যটা কেমন হয়। অনামিকা এখানে কোনো এক রাতে আসতে চায়।

“আমার চিঠির কোনো উত্তর দিলা না যে।”, মৃদু গলায় বলে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে বাদল।

এই প্রথম এতটা সময় অনামিকার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে চোখের পলক ফেললেই হারিয়ে ফেলবে তাকে। কিছুটা কাছে এসে আরো ভালো করে দেখতে লাগে। উত্তর পাবে কি না সে জানে না কিন্তু সে তার তৃণলতাকে দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না।

অনামিকার মনে সংকোচ কাজ করছে। তার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ভয় পাচ্ছে। কারো চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে নেই। নাহলে মায়ায় পড়ে যায় মানুষ। সমস্ত দেহ কুঁচকে একটুখানি হয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমার বিয়ার কথা চলতাছে৷ আপনে আমারে ভুইলা যান।”

“ভুইলা যাওন তো সম্ভব না। তোমারে আমি বিয়া করবার চাই। তুমি খালি একবার কও আমারে ভালোবাসো। আমার অন্ধকার ঘরে আলো ছড়ানের লাইগ্যা তোমারে বউ কইরা নিয়া আসুম।”

এক পলক তৃপ্তিভরা শান্তচোখে তাকিয়ে বলল, “তা হইবো না বাদল মিয়া।”

আর্তনাদ করে উঠে বাদলের হৃদয়। কথাটা যেন কলিজায় তীরের মতো বিঁধে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আসে তার। কয়েক কদম সরে পেছন ফিরে তাকায়। চোখের কোণে জল জমেছে। সেই জল আড়াল করার মিছে চেষ্টা। পেছনে ঘুরে তাকাতেই দেখল অনামিকা বেশ কিছুদূর চলে গেছে।

বাদল চিৎকার করে বলল, “তোমার মন কঠিন হইবার পারে, তাই বইলা পাত্থর না যে গলান যাইবো না।”

একবারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকায় না অনামিকা। জীবনের প্রথম প্রেমটা বোধহয় অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে তার৷ হ্যাঁ সে বাদলের প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়েছে সেদিন যেদিন থেকে বাদলের চোখে নিজেকে দেখতে পেয়েছে। চোখের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে সে৷ আজ ভীষণ অভিমান হচ্ছে নিজের উপর। কেন সে এতটা অসহায়।

৯.
পরশ জমিনের কাগজ ঠিক করতে গঞ্জে গিয়েছিল৷ বিক্রি করার জন্য লোকও দেখছে৷ ভালো দাম পেলে বিক্রি করে দেবে। আফিয়া আর অনামিকা সই দিলেই হয়ে যাবে। পাত্রপক্ষ ততদিন অপেক্ষা করবে। তাদের কোনো সমস্যা নেই। পাত্র এখনো তাকে দেখেনি তাই একবার দেখতে আসতে চায়। পরিবারের সবার পছন্দ হয়েছে বলে সেও রাজী৷ পরশসহ আরো কয়েকজন গিয়ে পাত্রের বাড়িঘর, কারবার সবকিছুর খোঁজ নিয়ে এসেছে। এত আদর যত্ন সে আর কোথাও পায়নি৷ খুব পছন্দ হয়েছে সবকিছু। পরশের মুখে সব কথা শুনে আফিয়া স্বস্তি পায়। তার বোনটা একটা ভালো পরিবারে যাবে তাহলে।

অনামিকা তাড়াহুড়ো করে দিঘির পাড়ে এসে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়৷ শিলা কিছুক্ষণ আগেও ছিল এখন সেখানে নেই। দ্রুত পা বাড়ায় বাড়ির দিকে আজ আর পড়াতে যাবে না সে।

বাদল বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরে আসে। রেহানা তাকে একা দেখে জিজ্ঞেস করে, “কীরে শিলারে দেখছস? সেই যে গেল আর তো আইলো না এহনো।”

বাদলের এখন খেয়াল হয় শিলাকে তো সে দেখেনি। সন্ধ্যা নেমে এলো মেয়েটা গেল কই! এত সময় তো বাইরে থাকে না সে। খেলাধুলা করলেও সন্ধ্যে নামার আগেই বাড়ি ফিরে আসে। খোঁজ করার জন্য সামনে পা বাড়াতেই দেখল হেলাল সাইকেল নিয়ে এসেছে৷ হাতে বাজারের ব্যাগ। কিন্তু সেও একা। শিলা তার সাথেও নেই।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here