||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০৬||
যেখানে বাদল চতুর্থ বারের মতো প্রেমে পড়েছে সেখানে অনামিকা একবারও প্রেমে স্বাদ নিতে পারেনি। যদিও এর আগে বাদল কেবল প্রেমে পড়েছে, প্রেম করতে পারার সৌভাগ্য তার হয়ে উঠেনি। কিন্তু অনামিকা তো আজ অবধি কারো প্রেমেও পড়েনি। যে জীবন সে কাটাচ্ছে, সে জীবনে প্রেম আসে না। সত্যি আসেওনি। সেজন্যে সে আরো বেশি পাকাপোক্ত।
শিলা বইয়ের ভেতর ময়ূরের পালক রেখেছে আজ পনেরো দিন। তার ধারণা বড় পালক থেকে ছোট পালক বাচ্চা হয়। প্রতিদিন একবার করে বই খুলে দেখে৷ কিন্তু এতদিনেও একটাও বাচ্চা দেয়নি। পরিণতি শূন্যের কোটায়। মন খারাপ করে বসে আছে দুয়ার গোড়ায়। বই খুলছে আবার বন্ধ করছে। কখনো যদি পালকের বাচ্চা দেখতে পায়। বাদল জানালা দিয়ে তার এসব কর্মকাণ্ড দেখছে। একবার ভাবল ডেকে জিজ্ঞেস করবে পরক্ষণেই আবার কবিতার একটা লাইন মনে পড়ে যায়। নোটবুকের পাতায় কলমের আঁচড়ে তুলে নিচ্ছে।
অনামিকা দাঁড়িয়ে আছে শিলার সামনে। মুখ ভার করে বসে আছে দেখে সে তার সামনে বসে পড়ল। ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল, “মনে হইতাছে আইজ সবগুলা মেঘ তোমার মুখে আইসা জইমা রইছে।”
অনামিকার কণ্ঠ বাদলের কানে পৌঁছাতেই নোটবুক রেখে জানালা দিয়ে তাকায়। শিলা ফিক করে হেসে দেয়। মানুষের মুখে আবার মেঘ জমা হয় নাকি! এমন অদ্ভুত কথা সে এর আগে কখনো শোনেনি। অনামিকাও নিঃশব্দে হাসছে৷ বাদল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তাদেরকে।
“আপামনি তুমি বেশ মজা কইরা কথা কও৷ কিন্তু আমি বড় টেনশুনে পইড়া গেছি তো।”
শিলার টেনশুনে পড়ার কথা শুনে অনামিকা ওর থুতনিতে ধরে বলল, “ওইডা টেনশুনে না টেনশনে।”
সে আবারো মুখ ঢেকে হাসে। এতক্ষণ যে মেয়ের মন ভার ছিল এখন সে কথায় কথায় হেসে দিচ্ছে। বাচ্চাদের এই অদ্ভুত ব্যাপারটাই অনামিকাকে টানে। যদি আবার ছোট হওয়া যেত। সে কখনো বড় হতে চাইত না। এই বয়সে এসে যত তিক্ততা সে দেখেছে ছোটবেলায় তা বুঝেই আসেনি। তখন কেবল খেলা নিয়েই ভাবনা ছিল। কখন স্কুল ছুটি হবে আর কখন এক দৌড়ে খেলার মাঠে যাবে। স্কুল থেকে ফিরে তাড়াহুড়ো করে কোনোরকম চারটে ভাত মুখে দিয়ে দৌড় লাগাতো নদীর ধারে। তাদের খেলার আসর ওখানেই জমতো। ছেলেমেয়ে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই একসাথে মিলে গোল্লাছুট খেলত। মাঝেমধ্যে কানামাছি। কিন্তু সমস্যা হয়ে যেত বৃষ্টি দিলে। আল্লাহর কাছে কত প্রার্থনা যে করত খেলার সময় যেন বৃষ্টি না আসে। তবে স্কুলে যাওয়ার সময় তা উলটো দেখা যেত। কত করে চাইত যাতে স্কুলে যাওয়ার সময়টায় যেন বৃষ্টি থাকে। কিন্তু হাজার দোয়াও কাজে লাগতো না। সারা সকাল বৃষ্টি দিয়ে স্কুল যাওয়ার সময়টাতেই আকাশ ফকফকা পরিষ্কার। মাটিও যেন শুকিয়ে কাঠ। মনেই হতো না বৃষ্টি দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেও। তারপর আর কী বৃষ্টিকে একগাদা গালি দিতে দিতে স্কুলের বস্তা কাঁধে ঝুলিয়ে স্কুলের দিকে কদম বাড়াতো। কেউ কেউ আবার বগলে করে বই নিয়ে যেত। সবার বস্তা কেনার সামর্থ্য নেই। খালি পায়ে ছুটে যেতে হতো স্কুলে। তখন স্কুলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরাই খালি পায়ে যেত। মাঝেমধ্যে কারো পায়ে চপ্পল দেখা যেত। অবশ্য কেউ একদিন চপ্পল পায়ে দিয়ে আসলে বাড়িতে তা আর পায়ে দিয়ে যেতে পারতো না। চপ্পল ছেঁড়ার এই সুকাজটা খালি পায়ে আসা দল মিলে করতো।
“ওই হইলো একডাই।” খানিক হেসে বলল শিলা।
অনামিকা শিলার সমস্যা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। এই সমস্যাটা তার কাছেও বিরাট মনে হলো। এই কাজ যে একসময় সেও করেনি তা নয়। তবে সময়ের সাথে বুঝে গেছে যে ময়ূরের পালকের বাচ্চা হয় না। এখন শিলাকেও সে বুঝিয়ে দিতে হবে।
বই খুলে টেবিলে বসে আছে মিলন। একদম বাধ্য ছাত্রের মতো। পড়ায় মনোযোগ নেই শিলার। তার যেন এই কঠিন সত্যটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। তাহলে সবার বইয়ে যে বাচ্চা করে তা কী মিথ্যে! বাদল জানালার কপাটে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। অনামিকা তাকে দেখেও না দেখার ভান ধরে আছে। এই মানুষটার তাকানো তার কাছে সুবিধার ঠেকে না। কে জানে মনের মধ্যে কী খিচুড়ি পাকায়। পুরুষ মানুষকে সে বিশ্বাস করতে চায় না। সোনিয়ার ভাষায়, “এ যুগের পোলাপান, বিশ্বাস করা মুশকিল। ভালোবাসার কথা মিঠা কথা কইয়া তিতা নিম পাতা খাওয়ায়।”
সেলিমের সাথে সোনিয়ার বেশ ভাব ছিল। এক বছর তারা চিঠি বিনিময় করেছে। কিন্তু সেই যে সেলিম চাকরির জন্য ঢাকা শহরে গেল আর একেবারে বিয়ে করে ফিরে আসে। অথচ যাওয়ার আগে বলেছিল সে টাকা জমিয়ে তার জন্য টুকটুকে লাল বেনারসি কিনে নিয়ে আসবে। বেনারসি সে ঠিকই কিনেছে কিন্তু আরেকজনের জন্য। তারপর থেকে সোনিয়া আর কাউকে বিশ্বাস করে না। এখন পাশের বাড়ির হামিমের সাথে ভাব লাগিয়েছে। তাদের ছাতের কাজ করানোর সময় হামিম এসেছিল কাজে। তখন সে মাঝেমধ্যে এসে চা, পান দিতে যেত। সেই থেকেই তাদের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। এখন তাদের চিঠি লেনদেন হয় বুলুর মাধ্যমে। সোনিয়ার আপন ছোট ভাই বুলু। তাকে চার আনার একটা চকলেট দিলেই সে দুনিয়ার যেকোনো কাজ করতে রাজী। তার থেকে কোনো কথা বের করতে হলে চার আনার চকলেটই যথেষ্ট।
৭.
হাঁসগুলো প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে উঠছে। বাদল তার পরিকল্পনা মতো অনামিকার সাথে প্রতিদিন বিকেলে দিঘির পাড়ে যায়। অনামিকা তার হাঁসগুলোকে দেখে আর সে তাকে দেখে। মনের কথা বলার সাহস এখনো যোগাতে পারেনি সে। এমনি হাজার আলাপ করতে পারে কিন্তু যখনই ভালোবাসার কথাটা বলতে যায় কে যেন তার মুখ চেপে ধরে। তখন আর কথা বেরোয় না। আজ মন খারাপ করে একা বসে আছে বাদল। অনামিকা আজ দুই দিন হলো পড়াতেও আসেনি, হাঁস দেখতেও আসেনি। দিঘির জলে তাকিয়ে বুক পকেট থেকে ছোট্ট নোটবুকটা বের করে কবিতা লিখতে বসেছে সে।
“যাহার পানে আঁখি পথ চাহি রয়,
তাহার টানে হৃদয় ক্ষণে ক্ষণে ভারি হয়।”
এর বেশি সে আর কিছু লিখতে পারলো না। কলম আর নোটবুক দূর্বাঘাসের উপর রেখে দেয়। এক হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে পড়ে। চোখের উপর ডান হাত রেখে আলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। চোখে তন্দ্রাভাব চলে এসেছে তার। সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। পশ্চিমাকাশে হলদে নীলাভ রঙের খেলায় পৃথিবীতে নেমে এসেছে রক্তিম ভাব। মনে হচ্ছে প্রবল বেগে বৃষ্টি হতে পারে।
অনামিকাকে গতকাল বরপক্ষ দেখে গেছে৷ কনে অপছন্দ হওয়ার কিছুই নেই। একদম খুঁতিয়ে দেখেছে তাকে। মাথার ঘোমটা ফেলে বাঁধা চুলগুলো খুলে দেখাতে হয়েছে। তাতে অবশ্য লাভ হয়েছে। তার ঘনকালো লম্বা চুল খুব পছন্দ হয়েছে বরের। শাড়ি উঁচিয়ে পা দেখেছে ঠিকঠাক আছে নাকি। ধবধবে পা দেখে বর একদম খুশিতে গদগদ। আজকে তারা জানিয়েছে তারা তেমন কিছুই চায় না কেবল বরের যাতায়াতের জন্য বাই সাইকেল চায়। বাড়িতে শুনশান নীরবতা ছেঁয়ে আছে। পরশ বাড়িতে এসে কেবল জানিয়েছে কথাটা৷ অনামিকা জানালার পাশ ঘেষে এলোমেলো চুল নিয়ে বসে আছে। দমকা হাওয়ায় উড়ছে চুল। মুখের উপর এসে পড়েছে। একবারও সরাচ্ছে না সে। অদূরে তার দৃষ্টি। নিষ্পলক চোখে জল চিকচিক করছে। পলক ফেললেই তা গাল পার করবে। রিনি বেশ কয়েকবার কথা বলার জন্য এসেছে কিন্তু কোনো সায় পায়নি। জবাব না পেয়ে সে খেলতে চলে যায়।
আফিয়া ধীর পায়ে অনামিকার ঘরে ঢুকে। ঘরে চাপা নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ। বাইরে বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে।
“ওই ধর ধর, বল মার।”
“কানামাছি ভোঁ ভোঁ যেইডারে পাবি হেইডারে ছোঁ।”
আফিয়া যে এসেছে অনামিকার সেদিকে খেয়ালই যায়নি। তার দৃষ্টি এখনো দূরের মাঠে। যেখানে বাচ্চারা খেলা করছে। কেউ কেউ আবার ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ বসে আছে গরু আর ছাগল চড়িয়ে। আহা! মানুষের কত সুখ। সুখ যেন অনামিকাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। সে ধরতে গেলেই পালিয়ে যায়।
#চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা