||অনামিকার সাক্ষ্য|| ||অংশ: ০১||
১.
কোনো প্রিয় মানুষ যখন জঘন্যতম ঘৃণার পাত্র হয় তখন তাকে খুন করতেও কষ্ট হয় না। যাকে সে ভেতরে ভেতরে শতবার হত্যা করেছে, আজ নিজ হাতে তার পরপারের টিকেট কেটে দিয়েছে। প্রাণহীন দেহটা পড়ে আছে উঠানের দখিন ধারে৷ গলা দিয়ে রক্তের ধারা অল্প গতিতে বইছে। মাটিতে জমে লাল থেকে হয়ে গেছে কালো। লাউয়ের মাচার নিচে শুভ্র চাঁদের আলো সাপের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। কুয়াশার কাছে হেরে যায়নি এই জোছনা। আবছা অন্ধকারেও রাজত্ব করছে। এলো চুলে লাশের পাহারাদারি করছে আফিয়া। বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখের কাজল গালের সাথে লেপ্টে হয়েছে কালিমালিপ্ত। পলক পড়ছে না তার। আজকের রাতটা দীর্ঘ এক রাত হতে চলেছে। হিসেবের খাতায় এই রাতের ওজন ভারি হয়ে থাকবে। হো হো শব্দে বিরতি টেনে হাসছে অনামিকা। এই হাসিটা খুব বিশ্রীরকমের। যার কোনো অর্থ নেই আবার গভীরতা অনেক ভয়ানক। আজ তার হাত রক্তে রঞ্জিত হলেও আত্না তৃপ্ত। ধারালো ধান কাটার কাস্তের মাঝে লাল রক্ত জমাট। বেশ কিছুদিন ধরে যত্ন করে রেখেছিল নতুন ধান কাটার জন্য। আজ ব্যবহারে এসেছে। কয়েক কোপে শ্বাসনালী কেটে ফেলেছে৷ গলগল করে রক্তে ভরে গেছে তার হাত। মুখে রক্তের ছিঁটেফোঁটা এখনো তাজা। গোঙাতে গোঙাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতেই চেহারার উজ্জ্বলতা নিভে যায়। মানুষের প্রাণপাখি কত সহজেই ধোঁকা দেয়। সকাল হলেই পাড়ায় হত্যার কথা জানাজানি হবে। লোকজন দেখতে আসবে। পুলিশ আসামী ধরবে। আর অনামিকা সেখানে নীরব দর্শক৷ ইতিহাসের পাতায় আরো একবার লেখা হবে বিশ্বাসঘাতকতার কথা।

দীর্ঘ রাতটাও কেটে যায়। হত্যার খবর তীব্র বাতাসের মতো বেগতিক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের মেম্বার পুলিশকে খবর দিয়েছে। অনামিকা এখনও নির্বিকারভাবে মাটিতে বসে। পরনের শাড়িটার আঁচল বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। রক্তের ছোপ লেগে আছে বুকের উপর। আফিয়া বহুবার বলার পরেও সে পালায়নি। যদি পালিয়ে যাওয়ারই হতো তাহলে অনেক আগেই ঘর বাঁধতো বাদলের সাথে। বাদলের কথা মনে হতেই অনামিকার মনে একটা শীতল হাওয়া বয়ে যায়। চোখের কপাট বন্ধ করে। তার চেহারাটা স্পষ্ট ভেসে আসে সামনে। কানের ভেতর তার বলা কথাটা বারবার গুঞ্জন তুলছে, “তৃণলতা, খরিদ করি নিয়া যাব না তোরে!একবিঘা জমি মোহরানা দিয়া একবারে বউ কইরা নিয়া আসবনি”

শরীরটা কেঁপে উঠে অনামিকার। মনের মধ্যে বাদলের অস্পষ্ট আবছা ছায়া অনুভব করছে। ঠোঁটের হাসিটা প্রশস্ত হয়ে আসে। মনে পড়ছে গ্রামের মেঠোপথের বাঁকে সেদিন তাদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা।

সময়টা ১৯৮৯ সালের পৌষের প্রারম্ভ। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে একটি লাগাতার ছাত্র আন্দোলন চলছে। দেশের দায়িত্ব আর তার হাতে দিতে চায় না জনগণ। ঢাকা শহর থেকে বাদল নৈহাটি গ্রামে এসেছে আজ দু’দিন হলো। এটা তার আপন গ্রাম। যে গ্রামে শৈশব থেকে কৈশোর পাড়ি দিয়ে যৌবনের বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছে৷ কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে গ্রাম জুড়ে। গ্রামের আকাশে বাতাসে যেন এক অজানা স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে। প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়া যায়। এখানে পাখিরাও তার সাথে কথা বলে। বাদল আবারো আন্দোলনে যোগ দেবে। এক ফাঁকে গ্রামের সবাইকে দেখে যেতে চায় সে। কে জানে এই আন্দোলন মৃত্যু অবদি যদি নিয়ে যায় তবে হয়তো সে আর ফিরে নাও আসতে পারে। পড়াশোনাও শেষের পথে তার। ডিগ্রি শেষ করে চাকরি করার প্রবল ইচ্ছে নিয়েই শহরে পড়তে পাঠিয়েছেন তার বাবা বাছিদ মাস্টার। গ্রামের একমাত্র উচ্চ শিক্ষিত বলে তাকে সবাই চেনে। অন্য সব সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন। সে দিক দিয়ে বাদলেরও বেশ পরিচিতি আছে গ্রামে। সবাই বেশ আদরের চোখে দেখে তাকে। যতদিন গ্রামে ছিল ততদিন সে সবার ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়িয়েছে। সে যাওয়ার পর অনেকের পড়া বাদ দিয়ে কাজে লেগে গেছে। আবার অনেকে এখনো পড়ছে।

বাদল বাই-সাইকেলে করে আজ গ্রাম ঘুরতে বের হয়েছে। অনেকদিন সাইকেলে করে ঘোরাঘুরি হয় না তার। বাড়িতে আসার পর একবারের জন্যেও বের হয়নি। বাবা-মা আর একমাত্র বোনের ছেলেমেয়েদের সাথেই সময় কাটাচ্ছিল। শহরে যাবার আগে বাই-সাইকেল কিনেছিল বাদল। গ্রামে সবার সাইকেল কেনার ক্ষমতা নেই। বাছিদ মাস্টার অনেক কষ্ট করেই কিনে দিয়েছেন ছেলেকে। ফরিদ মিয়ার বরই গাছের নিচে একজন মেয়ের অবয়ব দেখে আচমকা সে থমকে দাঁড়ায়। ভর দুপুরে বরই কে চুরি করছে! অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে মেয়ের কর্মকাণ্ড। শাড়ির আঁচল মেলে গাছের নিচ থেকে বরই কুড়িয়ে নিচ্ছে৷ তার দিকে ফিরে তাকাতেই যেন চোখজোড়া প্রশান্তি খুঁজে পায়। সাইকেল আরেকটু কাছে নিয়ে যায় সে। রোদের ঝিলিক চোখে-মুখে পড়তেই যেন তার সৌন্দর্য আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। খোঁপা করা নিকষ কালো চুল আচমকা খুলে যায়। তার কোমর ছুঁয়ে গেছে। বাতাস এসে এলোমেলো করে দেয়। চোখের সামনে বারবার চলে আসছে। হাতের উলটো পাশে চুল সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরত।

দূর থেকে কেউ একজন আওয়াজ দেয়, “অনু এহনি চলে আয়। ভাবি ডাকতিছে। চাচি আম্মা দেহিস বেশি কতা কবেনে।”

অনামিকা বসা অবস্থায় সোনিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তার চোখেমুখে বিরক্তির ভাব। এটুকু বরইয়ে কী আর ভর্তা হয়! কিন্তু কিছুই করার নেই৷ গুলবাহারের তিক্ত কথা থেকে বাঁচতে হলে তাকে এখনই বাড়ি যেতে হবে। হনহনিয়ে বাদলের পাশ কাটিয়ে চলে যায় অনামিকা। বাদল পেছন থেকে বলে, “ও বরই চোর শুনি যা।”

যেতে পথে একবার থমকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করে সে। বাদলের কথা শোনার সময় নেই তার। বাড়ি ফিরতে হবে এখনই। যাওয়ার সময় তাকে বারকয়েক ফিরে দেখে। চোর বলার সাহস করেছে তাকে! সুযোগ পেলে দেখে নেবে ভালো করে। বাদল সাইকেলে বসে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। গ্রামে এই মেয়েকে তো সে কখনো দেখেনি। সোনিয়াকে সে ভালো করেই চেনে। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে মেয়েটার কথা। যেখানে গ্রামের মেয়েদের বয়স কৈশোরে পা দিতে না দিতেই বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগে সেখানে এই মেয়েটা প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে গেছে। মেয়েটা কী বিবাহিত! না, বিবাহিত হলে এভাবে ছুটে বেড়াতো না। উদ্ভট সব ভাবনা এসে বাদলের মনে হানা দেয়। মেয়েটার চোখে মুখে দারুণ ত্যাজ। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক যুবতী। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের গায়ে কলাপাতা রঙের শাড়িতে যেন প্রকৃতি কন্যা মনে হচ্ছে তাকে। নাকে নথ, দু’হাতে চার জোরা কালো রঙের চুড়ি। খালি পায়ে হেঁটে দৌড়ে চলেছে একদম ঘাস ফড়িংয়ের মতো৷ বাদলের ইচ্ছে করছে ছুঁ মেরে এই ঘাস ফড়িংকে ধরে ফেলতে। কিন্তু এই ঘাস ফড়িং এখানে কোথা থেকে উড়ে আসলো খোঁজ নিতে হবে।

অনামিকা আসতেই সোনিয়া তার সাথে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়। তাদের বাড়িটা বেশ বড়। প্রবেশ পথের দু’ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দুইটা তালগাছ। তারপরে সরু পথটায় সারি বেঁধে লাগানো আছে সুপারি গাছ। প্রতি বছর অনেক সুপারি পাওয়া যায়। পথটার ইতি টেনেছে একদম বাড়ির মাঝ বরাবর এসে। বাড়িতে ঢুকলেই দেখা যায় দুই ধারে একের পর এক ঘর সাজানো। দখিন ধারের দুই ঘর পেরিয়ে পরশদের ঘর। বাড়ির পশ্চিমে পুকুর পেরিয়ে আমের বাগান। পুকুরের পানিতে নিজেকে দেখা যায়৷ আয়নার মতো পরিষ্কার নয়, অনেকটা সবুজ পানি। গাছগাছালি অনেক থাকায় পানি গাঢ় সবুজ হয়েছে। আমের ফলনও বেশ ভালো হয়। প্রতি বছরে পরশ অনেক আম বিক্রি করে৷ বাড়ির একটা কাঠ বিড়ালকেও সে আম খেতে দেয় না, মানুষ তো বহুদূর। নিজের ঘরের লোক কেবল খেতে পায়। কিন্তু এত বড় বাড়িতে একটা বরই গাছ নেই।

অনামিকা আর সোনিয়া বাড়িতে ঢুকতেই গুলবাহার বিবিকে দেখতে পায় উঠানে বসে বরবটি কাটছেন। গুলবাহার তার বড় বোন আফিয়ার শ্বাশুড়ি। অনামিকা ছ’মাস হলো এই গ্রামে এসেছে। বাবা জমসেদ খাঁ মারা যাওয়ার পর সে আর ওই বাড়িতে একা থাকার সাহস করেনি। এমনিতেই গ্রামের অনেকের খারাপ নজর ছিল তার উপর। মা তো আরো দুই বছর আগেই মারা গেছেন। নাহলে মায়ের সাথে থাকতে পারতো। আফিয়া অনেক কাকুতিমিনতি করে পরশকে রাজী করিয়েছে অনামিকাকে তার সাথে রাখার জন্য। পরশের রাজী হয়ে যাওয়া মানে গুলবাহার বিবিরও সম্মতি। তবে গুলবাহার বিবির একটা বিশাল বড় শর্ত ছিল। বছরে যা ধান পায় এখানেই দিতে হবে। তার পরিবর্তে অনামিকাকে এখানে রাখবেন তিনি। পরশও নির্বিকার শুনে গিয়েছিল সেই শর্ত। তারও যে সম্মতি ছিল না এমনটা নয়। পরের মেয়েকে বসিয়ে খাওয়ানোর মতো রাজার হাল নয় তার। তলে তলে গুলবাহার বিবি তাদের ভিটেমাটি হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দিতে আছেন। অনামিকার পড়ালেখা তখনই বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ দিতে পারেনি সে। শেষ পরীক্ষার দিনই বাবা মারা যান। পড়ালেখা সেখানেই অসমাপ্ত থেকে যায়। এখন আর পড়ালেখা নিয়ে ভাবছে না সে। এখানে আসার পর দুইটা ছোট ছোট বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করেছে। মাস শেষে ষাট টাকা বেতন পাবে। সেটাও বা কম কিসে! এই পরিবারে টিকে থাকতে হলে নিজের খরচ তো নিজেকেই বের করতে হবে তার।

আফিয়া অনামিকাকে নারকেল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকায়৷ পরিবেশ বেশ শান্ত। মনে হচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস। কিন্তু এই ঝড় থামানোর সাধ্য কেবল একজনেরই আছে। কিন্তু সে কী এই সময়ে বাড়িতে থাকবে! অনামিকার চোখ আড়াল থেকে তাকেই খুঁজছে।

#চলবে…

লেখা: বর্ণালি সোহানা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here