অতঃপর মৃত্যু
মান্নাত মিম
|১|
জনমানবহীন পাহাড়ি এলাকা। তুষারপাতের বরফের আবরণে ঢাকা সবকিছুই। সেই বরফের সাদা অংশে ছড়িয়ে আছে লাল রঙ। রক্ত হবে ওটা। কেননা এরভিন মাত্রই একটা হরিণের শিকার করল। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো সে। এগিয়ে গেল মৃত হরিণের দিকে। নিজের বানানো কাঠের তৈরি বাহন নিয়ে এলো মৃত হরিণের সামনে। হরিণের শরীরটাকে তুলে নিলো বাহনে। অতঃপর টেনে নিয়ে চলতে শুরু করল বাড়ির দিকে যেখানে সে থাকে।
পাহাড়ের ওপরে কাঠের তৈরি বাড়িটা এরভিনের। এখানের দূরদূরান্তেও জনমানবশূন্য। লোকালয় ছেড়ে একাকী এরভিনের বসবাস এখানেই। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে শক্ত কাঠের তৈরি টেবিলে হরিণটাকে রাখল। বাইরে রাখা পানির পাত্র থেকে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করে এলো সে। এবার হরিণের চামড়া ছুলার জন্য প্রস্তুতি নিলো। মূলত হরিণ শিকারে তার লাভ অনেক। একে তো হরিণের চামড়া ও শিং বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করবে। দ্বিতীয়ত হরিণের মাংস খেতে পারবে।
জঙ্গলের থেকে জোগাড়কৃত কাঠদ্বারা আগুন জ্বালিয়ে রাতের ভোজন শেষে বিছানায় শয়ন গ্রহণ করল এরভিন। একা থাকার দরুন তার কাজকর্ম নেই বেশি একটা। নিজের মতো খায়-দায়, ঘুম যায়। কাল তার কাজ আছে বিধায় আজ একটু দ্রুততার সহিত ঘুমের এই প্রস্তুতি গ্রহণ করা। লোকালয়ের বাজারে যেতে হবে হরিণের চামড়া ও শিং বিক্রির জন্য। তাও আবার সেখানে যাওয়ার সময়কাল পুরো দু’দিন। সারা পথের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণের খাবার-দাবার সংগ্রহ করে ব্যাগ গুছানো রয়েছে। এখন শুধু ভোর হওয়ার অপেক্ষা।
______
গ্রামে মাটির রাস্তায় এরভিনের পদধূলি পড়ল অবশেষে দু’দিনের যাত্রায়। কাঙ্ক্ষিত দোকানে গিয়ে হরিণের চামড়া ও শিং রাখল। দোকানের মালিক এখনো উপস্থিত হয়নি সেখানে। অনন্যোপায় হয়ে সেখানে থাকা, কর্মচারী দিয়ে খাবার আনায়। দোকানের মালিক জনাথন এসে দেখতে পান এরভিনকে খাবার খাওয়ারত অবস্থায়। জনাথন আগে থেকেই চিনেন বাউণ্ডুলে, ভবঘুরে বেড়ানো এভরিনকে। সাথে জানেন সে যে ঘাড়ত্যাড়া, একরোখা ধরনের স্বভাবের পুরুষ। কর্মচারীকে ডেকে বললেন,
“নাও, খাবারের বিলটা দিয়ে এসো।”
জনাথনের গলার স্বর শোনেও মুখ উঁচিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করল না এরভিন। নিজের মতো করে খাবারে মগ্নতাকে প্রাধান্য দিলো। এদিকে টেবিলে পড়ে থাকা হরিণের চামড়া ও শিং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে জনাথন। ভালোমানের যে এগুলো বুঝেই তাঁর চোখ চকচক করছে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলেন না। ধপ করে নিভে গেল চোখে-মুখের খুশির আভা।
“এবারে চামড়ার দাম বেশি দিতে হবে। বাজারে দাম বেড়েছে চামড়ার।”
জনাথন চুপ করে রইল। এরভিন যে সব খবর নিয়েই এসেছে বোঝে গেলেন নিমিষেই। তাই তর্কাতর্কি কিংবা দাম নিয়ে দর কষাকষি করা নেহাতই বোকামি। রাজি হয়ে চামড়ার দামটা দিয়ে দিলো এরভিনকে।
মোটামুটি খাওয়া শেষে হরিণের চামড়া ও শিং বিক্রয়ের অর্থ নিয়ে গ্রামে ঘুরার প্রস্তুতি নিলো এরভিন। অবশ্য এখানে আসা আগেও বহুবার হয়েছে। তবে সারাদিন তো পড়ে রয়েছে। এখন সাথে সাথেই নিজের বাসস্থানে ফেরত যাওয়ার কোনো মানে হয় না। ঘুরতে ঘুরতে বৃদ্ধ দেখতে একজন মুদির দোকানের সামনে দাঁড়াল এরভিন। বৃদ্ধ রাক্সেল বিপত্নীক মানুষ। ছোটো একখানা দোকান দিয়ে কোনরকম দিন গোঁজা করেন।
“চাচা!”
এরভিন বৃদ্ধকে চাচা বলে ডাকে। তার সাথে পরিচয় আগে থেকেই।
“এসো ব্যাটা এরভিন।”
বৃদ্ধ দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে দাঁড়ানো এরভিনের কাঁধ জড়িয়ে পাশে থাকা ছোট্ট কুটিরে নিয়ে গোল কাঠের তৈরি খাবারের টেবিলে বসালেন। মুখোমুখি হয়ে আসা দু’পাশে দু’জন।
“কী খবর এতদিন পর এলে?”
“চামড়া ও শিং নিয়ে এসেছিলাম বিক্রি করতে।”
“সারাদিন আছো তাই না?”
“আছি।”
এরভিনের সাথে টুকটাক কথা বলার ফাঁকে চেয়ার ছেড়ে ওঠে গিয়ে কুকিজ নিয়ে ফিরে এলেন। খেতে খেতে একফাঁকে এরভিনের অপছন্দনীয় কথা বলে ফেললেন।
“ব্যাটা এরভিন! আর কতো একা থাকবে? এবার অন্তত সঙ্গিনী খোঁজো।”
কিয়ৎপল থম ধরে রইল এরভিন। অর্ধাঙ্গিনী কিংবা সঙ্গিনী যাইহোক না কেন তাতে খুবই এলার্জি এরভিনের। চল্লিশ বসন্ত পেরিয়েছে একাকী জীবন তবুও সঙ্গিনীর অনুভব করেনি, ধরতে গেলে অনুভব হলেও সেটা আমলে নেয়নি। কারণ তার যেখানে অবস্থান সেখানে কোনো মেয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হবে না; যেটা সে ভাবে। তবে যৌনতার তাড়নায় গ্রামেরই বেশ কয়েক মেয়ের সাথে প্রয়োজনীয়তা মিটিয়েছে অর্থকড়ির বদৌলতে। বর্তমানে সেখানেই রওনা দিলো এরভিন।
“কতদিন পরে এলে দেখি তো।”
ব্যস্ত হাতে শার্টের বোতাম খুলতে থাকা এরভিনের হাত থেমে গেলো এপর্যায়ে। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, লং ফ্রক পরিধানকৃত সাশা এগিয়ে গিয়ে নিজ উদ্যোগে এরভিনের পোশাক খুলতে সাহায্য করল।
“এবার বেশিদিন হয়ে গেছে তাই না?”
এরভিনের কথায় মনমরা অবনত মুখ তুলে তাকালো সাশা। তা দেখে এরভিনের কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা বোধ হলো। সাশার মাথার স্কার্ক খুলতে খুলতে এরভিন ফের বলল,
“কী করব বলো তো ঠান্ডার কারণে পশু মেলা ভার। এজন্যই দেরিটা হলো।”
বুঝতে পারা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সাশা। বর্তমানে দু’জনে সাশার কুকিজ তৈরির কারখানায় অবস্থান করছে। কারখানা বলা চলে না অবশ্য। ছোটো একটা ঘরের মতো সেটা, কর্মচারী নেই, একা হাতে সামলায় সবটা সাশা। তার মা নেই, বাবা জুয়ারি। ছোটো একটা বোন আছে। দু-বোন’ই অত্যাধিক সুন্দরী। তবে ছোটো বোনকে লেখাপড়া করায় সাশা নিজে অর্থোপার্জন করে। সেই অর্থোপার্জনের মাধ্যম এই কুকিজের কারখানা। এখানেই একা থাকে সাশা। রুম রয়েছে ছোটো-খাটো একটা। সেখানে এরভিনের সাথে বর্তমানে অন্তরঙ্গতায় মেতে সাশা।
_____
ফিরে আসা হলো এরভিনের নিজস্ব ভিটেতে। ক্লান্তিতে শরীর কোনরকম ফ্রেশ করেই বিছানায় ঝুঁকলো সে। রাত যতই গভীর হচ্ছে না কেন, ততই যেন তার মনমস্তিষ্কে দূর্বলতা বোধ করছে। এখানে ফিরে আসার দুদিনের কারণে হওয়া শারীরিক ঝক্কির কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, আজ কেন জানি তার একাকীত্ব বোধে বাঁধা প্রাপ্ত হচ্ছে। এতদিনের একাকী ভাবের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে দোনোমনা। আসলেই এবার একজন সঙ্গিনীর প্রয়োজনবোধ করছে এরভিন। ভাবছে… আর এই ভাবনাতেই পেরিয়ে গেল সপ্তাহখানেকের মতো।
চলবে…