#_মায়ার_বাধঁন
৯ম পর্ব
লেখনিতে-জান্নাত_রুবি
★★★★
কেটে গেছে আরো কয়েকটা মাস।
দিনগুলো আগের মতই চলছে।সায়ানের আমাকে এড়িয়ে চলা,সানার কারনে অকারনে ঝগড়া তো আর আছেই।ইদানিং রামিসা ভাবি,বাবা আমাকে বিভিন্নভাবে কথার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন যে সানাই এ পরিবারের যোগ্য বউ!সানাও বাবার সাথে উনার বন্ধুদের বাসায়,বিভিন্ন পার্টিতে নিজেকে বাহারী রুপে সাজিয়ে এটেন্ড করে!
আমি এসব দেখে মনে মনে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ি।
বারান্দায় বসে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় সিয়াম এসে জানালো বাবা আমাকে ডাকছেন।
আমি বাবার কথা শুনে তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমে গেলাম।কারন এসময় বাবা টিভিতে খবর দেখেন।
আমি বাবার পাশে গিয়ে বললাম,
-বাবা আমাকে ডেকেছেন!
বাবা আমার কথা শুনে টিভি অফ করে দিলেন।
এমন সময় সানা,রামিসা ভাবি সেজেগুজে বাবার পাশে এসে বসলেন।
বাবা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-আমি দুইও বউমাকে নিয়ে আমার এক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনে যাচ্ছি।তুমিও চাইলে যেতে পারো!
আমি বললাম,
-দুঃখিত বাবা!আমি যেতে পারবো না।বাবা আমরা অনেকেই জানি না জন্মদিন সম্পর্কে ইসলাম কি বলে বা এটা পালন করা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?
ইসলামে জন্মদিন বা জন্মদিন পালন বলতে কিছুই নেই।বছরের যে দিনটিতে কেউ জন্মগ্রহণ করেছে,সেই দিনকে তার জন্য বিশেষ কোন দিন মনে করা বা এই উপলক্ষে আনন্দ ফুর্তি করা অথবা কোন আমল করার বিষয়ে কুরআন সুন্নাহর কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না।
-আহ বউমা থামো তো!তোমার এই সব নীতিবাক্য শুনার জন্য আমার এতো সময় নেই।তুমি থাকো তোমার এসব নীতিবাক্য শুনতে ভালো লাগে না!
রামিসা, সানা ওদের কাছ থেকে কিছু শিখো!রামিসা বাদ দাও তোমার বোন সানার দিকে তাকাও!ও যেন সাক্ষাৎ একজন মডেল যেমন রূপ তেমনি গুন সম্পন্ন একজন স্বাধীন নারী।
না চাইতেও তোমাকে বলেছিলাম যাওয়ার জন্য!নিজের কাছেই কী রকম লাগছিলো তোমাকে বাসায় একা রেখে যেতে!তোমার শাশুরীও বাসায় নেই।
বাবার কথা শুনতে খুব কষ্ট
হচ্ছিল! উনার কথা শেষ হলে আমি স্লান হেসে বললাম,
-বাবা আপনি মনে কষ্ট নিবেন না!আমি যা জানি তাই আপনাদের জানাতে চেষ্টা করলাম।জানেন বাবা-
যে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করতে পারবে, সে কখনো সফলতা থেকে বঞ্চিত হবে না।হয়তে বা সফল হবার জন্য তার একটু বেশি সময় লাগতে পারে।”—– আলী ইবনে আবু তালিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)”,
তাহলে আমি কেনো ধৈর্যধারণ করে এ পরিবারের সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিতে পারবো না। আমি সব সময় ধৈর্যধারণ করে সবাইকে আল্লাহর প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখার জন্য বলবো।কারন
হযরত আলী (রা) আরো বলেছেন,
“সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান যিনি পরম করুণাময় আল্লাহর দয়ার ব্যাপারে আশা ও আত্মবিশ্বাস না হারানোর জন্য মানুষকে উপদেশ দেন,,
আমিও সদা এই সরল সঠিক পথে থাকবো আর আপনাদের সবাইকেও বলবো এ পথে চলতে।
আমার বিশ্বাস ইনশাআল্লাহ আপনারা সবাই একদিন পুরোপুরি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিবেন।
সায়ান এসে বাবার সাথে আমার এরকম কথা বলা দেখে রেগে যান।তাই উনি রাগের মাথায় দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,
-বাবার সাথে এতো তর্ক করছো কেনো!কি যোগ্যতা আছে তোমার বাবার সাথে এতো তর্ক করার!শুধু পারো কতগুলো রান্না করতে!সারাদিন শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়াতে।কোন পার্টিতেও যাও না। বন্ধুদের সামনে বের হওয়া তো দূরের কথা ফোনে ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলো না!কতটা বিব্রত হতে হয় আমাকে তুমি জানো। যখন আমার বন্ধুরা বলে তোর বউটা বড্ড সেকেলে।
উনি সবার সামনেই আমাকে এ কথাগুলো বলে বাইরে চলে গেলেন!
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি!উনি আমাকে এসব কি বলে গেলেন।উনি দিন দিন এতো পরিবর্তন হচ্ছেন।আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।
উনার কথাগুলো শুনতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।
আমি কোন কথা না বলে চোখের জল মুছে নিরবে স্থান
ত্যাগ করলাম।
।
আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলাম।
ঘড়িতে সময় দেখলাম দশটা বাজে।ফজরের নামাযের পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সায়ানের কথাগুলো মনে করে সারা রাত ঘুমাতে পারি নি।নামাযের পর বুকের হাহাকারটা একটু কমেছিলো।তাই চোখটা একটু লেগেছিলো।
মনে মনে ভাবছি বাইরে কী হচ্ছে কে জানে!এত বেলা করে উঠেছি হয়তো কত কথা শুনতে হবে।ইদানিং রামিসা ভাবি রান্নাঘরে ঢুকলে যা নয় তা বলে বেড়ান।কথাগুলো শুনলে খুব কষ্ট লাগে।উনাদের সবার ব্যবহারে মনে হয় আমি এ পরিবারের আশ্রিতা বৈ আর কিছু নয়।সবার ব্যবহার যেমন তেমন!কিন্ত স্বামীই যখন স্ত্রীর খেয়াল রাখে না!খারাপ ব্যবহার করে তখন এই কষ্ট
আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে বলা যায় না।
আনমনে এসব কথা ভাবছিলাম!হঠাৎ কুরআন মাজীদের এই আয়াতটির কথা মনে পড়ে,
“ভেঙে পড়ো না , নিরাশ হয়ো না, সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা! জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে,,
[সূরা-বাকারা:২১৪]
এই আয়াতটি মনে পড়ায় মনে মনে অনেক শক্তি পেলাম।
আল্লাহ তায়ালা কাউকে সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কাউকে সম্পদ না দিয়েও পরীক্ষা করেন। এটাই বড় পরীক্ষা। যারা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তাঁরাই সফলকাম হবেন। কারো দু-মুঠো ভাত জোগাড় করতে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। কারো অপচয় করতে কোন কষ্ট হয় না।আল্লাহ আমাকেও নিশ্চয়ই পরীক্ষা করছেন।
হ্যা এটাই মানবজীবন। সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন।
তাই আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না।আমাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।আল্লাহর দেয়া পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।
একমাত্র আল্লাহই পারেন আমাদের ক্ষীণ হয়ে আসা আশার আলোকে সূর্যের মত প্রজ্জ্বলিত করতে! একমাত্র তিনিই পারেন আমাদের চাওয়াগুলোকে বাস্তবে রূপ দান করতে!
হ্যা! আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে পৃথিবীর কিছুই তা প্রতিহত করতে পারেনা। আর আল্লাহর সাহায্য বা নিয়ামত ছাড়া কেউ কিছু সংঘটিত করতে পারে না।
তাই আমাদের বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।দোয়াকে দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ বানিয়ে ফেলতে হবে । কারণ আল্লাহ বান্দার এই গুনটা খুব পছন্দ করেন। তিনিই তো একমাত্র দোয়া কবুলকারী।
এসব ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে চলে এলাম।রান্নাঘরে এসে দেখি সানা আর ভাবি মিলে সকালের রান্নার কাজ শেষ করে ফেলেছেন।
আমি ওদেরকে জিজ্ঞেস করলাম,কোন কাজ করা বাকী আছে কীনা!আমার কথা শুনে রামিসা ভাবি চেতে উঠে বললেন,
-সায়ানের বন্ধু আসছে ওর বউ নিয়ে আর তুই দুপুর পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস।
আর এদিকে আমরা দু-জন সেই সকাল থেকে খেটে মরছি।আমি উনার কথা শুনে খুব কষ্টে নিজেকে সামলালাম কোনো তর্কে গেলাম না।নয়তো কী বলতে কী বলে ফেলবো।
রাসুল সাঃ এর এই হাদীসের কথা মনে করলাম,
রাসূল সাঃ বলেছেন, আমি সেই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের দ্বারপ্রান্তে একটি বাড়ির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে সঠিক হওয়া সত্ত্বেও তর্কে লিপ্ত হয় না। (সুনানে আবু দাউদ, ৪৮০২),,
এ কয়দিন শাশুড়ী বাসায় না থাকায় বুঝলাম একজন নারীর স্বামীর বাড়িতে ঠিকে থাকতে উনাকে কতটা দরকার।সব শাশুড়ীরা খারাপ হয় না!দু -একজনের কারনে সব শাশুরীকে খারাপের কাতারে ফেলা যায় না।একজন নারী যদি স্বামীর বাড়িতে গিয়ে প্রথমেই শাশুড়ীর মন জয় করে নিতে পারে তো সে পুরো পরিবারের মন জয় করে নিতে পারে বলে আমি মনে করি।
এতদিন ধরে আমার শাশুরী মা আমার পাশে ছায়ার মত ছিলেন বলে কেউ কিছু বলার সাহস পায় নি! কিন্ত মা উনার বাবার বাড়িতে প্রায় এক মাস ধরে থাকায় এ কয় দিনে আমার উপর অনেক ঝড়-তুফান বয়ে যাচ্ছে।মনে মনে দ্রীর্ঘশ্বাস ফেললাম।আর আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলাম।জীবনের দুঃখ-কষ্টের সময়গুলোতে সবর আর ধৈর্যের উপর অটল থাকুন।দেখবেন খুব শ্রীঘ্রই সকল দুঃখ কেটে দেখা মিলবে সোনালী সূর্যের।”আল্লাহ কষ্টের
পর স্বস্তি দিবেন,,(সূরা আত ত্বালাকঃ৭)
।
।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,