মিনুর পেটে কারও স্পর্শ। খানিকটা চমকাল সে। কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ পেল না। পাশে অপরিচিত এক বয়স্ক পুরুষ বসা। মুখে কৃত্রিম উদাসীনতা সেঁটে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনযোগ দিয়ে দেখছে। অথচ এদিকে অনবরত কনুই দিয়ে মিনুর পেটে আলতো চাপ দিচ্ছে। মেয়েরা কি প্রথম স্পর্শ এদের মতো চরিত্রহীন পুরুষ থেকেই পায়?
মিনুর মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হলেও নিজেকে সামলে নেয় সে। একদম ঝামেলায় জড়ানো যাবে না, অন্তত এই মুহূর্তে৷ কারণ প্রস্রাবের ভীষণ চাপ পেয়েছে মিনুর। অন্যদিন এদিকটা হেঁটেই চলে যায়। আজ আইরিন ম্যাডামের চেম্বার থেকে বের হয়ে খানিক হাঁটার পরই প্রস্রাবের তীব্র চাপ পেল। এই কারণেই সি.এন.জিতে উঠা। লোকটি কনুই দিয়ে বোধহয় এবার বুকও ছুঁতে চাইছে। মিনুর ভীষণ অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। বুঝতে পারে আর সহ্য করতে পারবে না সে।

-‘ড্রাইবার সি.এন.জি থামান, আমি এখানেই নামবো।’

ড্রাইভার একপাশে সিএনজি দাঁড় করায়।
মিনু গাড়ি ভাড়া চুকিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে। স্টুডেন্টের বাসায় পৌঁছাতে এখান থেকে মিনিট বিশেক লাগবে। সন্ধ্যায় শহরে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসে। চারদিকের উঁচু উঁচু বাসার জানালার ফাঁক গলে কৃত্রিম তারা যেন উঁকি মারছে। এই সময়টাতে বেশ ভালোই লাগে মিনুর। মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। টিউশনিতে গিয়ে তখন এক কাপ চা খেলে দিনের সকল ক্লান্তি চলে যায়। হাঁটতে হাঁটতে একটা গলির দিকে মোড় নেয় মিনু। এদিকে আবছা আলো। রাস্তায় পিছলে পড়েছে উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ছায়া। আচমকা পাশ থেকে মিনুর হাতে হেঁচকা টান দেয় কেউ। তড়িৎ গতিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। মুখোশ পরা। মিনু চিৎকার দেয়। গিলে ফেলতে হল নিজের চিৎকার। শক্তপোক্ত একটা হাত মুখ চেপে ধরে শুন্যে খানিক দূরে রাখা গাড়ির দিকে নিয়ে তাকে ঠেলে সীটে ফেলে দেয়। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটায় মিনু প্রথমে পালানোর তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি।
তবে গাড়ির সীটে মুখোশ পরা দ্বিতীয় লোকটির হাতের মুঠোয় যাবার আগেই মাথা নুইয়ে ঢুকতে থাকা লোকটির মুখে সজোরে লা’ত্থি মারে। বিপদে পড়ে মিনুর শরীরে শক্তি, বুকে সাহস আর মাথার বুদ্ধি খুলে গেল কি-না কে জানে। লা’থি খেয়ে লোকটি মুখে হাত দিতেই সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে নিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। খানিক উঁচু থেকে ধাক্কা দিয়ে ওপরে পড়ায় নিজেকে সামলাতে পারলো না লোকটি। পিচঢালা রাস্তায় পড়ে মুখোশধারীর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেল। মিনু তার ওপরে থাকায় পলকে উঠে দৌড়াতে থাকে। খানিকদূরে গিয়ে বুঝতে পারে লোকগুলো পিছু নিয়েছে৷ একবার পেছন ফিরে তাকায় সে। দু’জন ওর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। সামনে একটি দোকান। দু’জন লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। কিছু বলছে না। তারা হয়তো চোখের সামনে এমন কিছু দেখে ভয় পেয়েছে কিংবা বিস্ময়ে কি করবে ঠিক বুঝ উঠতে পারছে না। আবার হতে পারে এরা বিপর্যয়ে উৎসব খোঁজা বাঙালি। দৌড়ের গতি বাড়ায় মিনু। সঙ্গে চিৎকার। সে কি এই দোকানে আশ্রয় নেবে? লোকগুলো নিশ্চয় ঠেলে বের করে দেবে না। মিনু সেদিকে ছুটে যায়। দোকানের কাছাকাছি যাবার পর দু’জন লোক এগিয়ে এসে মুখোশধারীদের বললো,

– ‘কি হয়েছে ভাই? আপনারা একটা মেয়েকে এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন?’

মুখোশধারীরা ভালো করেই জানে সাধারণ মানুষদের কীভাবে ভয় পাইয়ে দিতে হয়। কেউই আজকাল উটকো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। মুখোশধারী একজন ধাক্কা দিয়ে দোকানীকে বললো,

– ‘বাই*ঞ্চুদের বাচ্চা পথ ছাইড়া গিয়া দোকানের স্যাটার বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাক। না হলে এখানে ব্যবসা করা তোর পা*ছা দিয়ে ভরে দেব।’

এতো বিপদে থেকেও গালি শুনে মিনুর কান যেন গরম হয়ে গেল। বুকে ধুকপুক বেড়ে গেছে। কিছু মানুষ সারারাত মদ খেয়ে মাতাল হয়েও এসব গালাগাল কাউকে দিতে পারবে না। কিন্তু ওরা কত স্বাভাবিকভাবে কথায় কথা গালি দেয়। মিনু জানে না, গালি হচ্ছে তাদের কাছে ভয় দেখানোর অস্র।
মিনু লক্ষ্য করে দেখে লোক দু’টো কেমন মিইয়ে গেছে। এদের পেছনে দাঁড়ানো কি ঠিক হবে? তাকে দৌড়াতে হবে। আবার দৌড়াতে শুরু করে সে।
খানিকদূরে গিয়ে আচমকা পায়ে ল্যাং মারে কেউ৷ মিনু উড়ে গিয়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তায়। থুতনি আর বুকে লাগল ভীষণ। বুক কি গলে গেছে? থুতনিতে তীব্র ব্যথা। কিন্তু এসবে খেয়াল করার সময় নেই। উঠে দাঁড়ায় মিনু। যেভাবে হোক পালাতে হবে। উঠতে যেয়ে বুঝতে পারে হাঁটুতে আঘাত পেয়েছে ভীষণ। পা টেনে টেনে দৌড়াতে থাকে। হাঁপিয়ে গেছে সে। ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছে।
কেউ কী বাঁচাতে আসবে না? সিনেমায় তো কত হয় এমন! আর পারছে না দৌড়াতে। যা হবার হবে। হাঁটুতে দুই হাত রেখে হাঁপাতে থাকে।
বেশ শক্তপোক্ত একটা হাত মিনুর চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল,

– ‘কা*নকি মা*গী তোর তেজ বের করবো চল।’

এতো অশ্লীল গালাগাল মিনুকে জীবনে কেউ দেয়নি। গালিই প্রমাণ করছে লোকগুলোর ভেতরে মায়া-দয়ার লেশমাত্র নাই। এরা তুচ্ছ কারণে। সামান্য হাজার পাঁচেক টাকার জন্য খু’ন-খারা’বী করার মতো লোক।
মিনু তারপরও ক্ষীণ আশা নিয়ে দূর্বল অসহায় গলায় বলে,

– ‘কেন এমন করছেন আমার সঙ্গে? আপনারা কারা? কি চান? পায়ে পড়ি আপনাদের। ছেড়ে দিন আমাকে।’

লোক দু’টো তাকে টেনে নিতে নিতে বলে,

– ‘মা*গী চল, একটু পরেই বুঝতে পারবি।’

মিনুর শরীরে আর শক্তি নেই। শুধু ক্লান্তি আর ব্যথা। গা ছেড়ে দেয়। লোকগুলো তাকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে নিয়ে তুলে। দ্রুত মুখ-হাত বেঁধে ফেলে কেউ৷ গাড়ি চলতে থাকে। পাশের লোকটি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। কথা শেষ হলে আরেকজন জিজ্ঞেস করলো,

– ‘কি বলছে?’

জবাবে লোকটি বললো,

– ‘ধা’রালো ব্লে’ড দিয়ে মা*গীর চোখ আর ঠোঁট কেটে ফেলতে বললো।’

দ্বিতীয় লোকটি বললো-

– ‘তা পরে কাটা যাবে। মা*গীর চেহারা দেখছিস কত সুন্দর। সিনেমার নায়িকারা মাইয়ার চেহারার কাছে বিনা পয়সার বান্দী হওনেরও যোগ্য না।’

সবাই মিলে হা-হা-হা করে হেঁসে উঠে।
লোকটির কথা শুনে মিনু ভয়ের সঙ্গে বিস্মিত হয়। ওর ওপর কার এতো রাগ? এমন নির্মম শাস্তি তাকে কে দিতে চায়? কেন দিতে চায়? সাধারণ একটা মেয়ে সে৷ অতীত থেকে পালিয়ে এসে টিউশনি আর আইরিন ম্যাডামের ডেন্টাল চেম্বারে কাজ করে প্রতিবন্ধী ভাই আর অসুস্থ মায়ের মুখে দু’টো ভাত তুলে দেয়। অথচ মিনুর বয়স এখন বান্ধবীদের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় মুখ বাঁ’কা করে সেলফি তোলার। ফেইসবুক স্টোরিতে নানান ভঙ্গিমায় ছবি দিয়ে জ্যাম লাগানোর। কিন্তু সে এখন যে জীবনটাকে যাপন করছে সেখানে এগুলো হচ্ছে অবেলায় ঘুমিয়ে এলোমেলো স্বপ্ন দেখার মতো অবাস্তব। যে স্বপ্নগুলো ঘুম থেকে উঠে মনে করবারও বিন্দুমাত্র প্রয়োজনবোধ করা হয় না। বুক এবং থুতনি থেকে র’ক্ত বেরুচ্ছে৷ ব্যথা করছে ভীষণ৷ কিন্ত সব ব্যথা চাপিয়ে এই মূহুূর্তে প্রস্রাব করা ফরজ হয়ে পড়েছে মিনুর।
—————————————————-
শ্রেয়া খেয়াল করে দেখেছে কিছুদিন থেকে নীলাভ ভাইয়ের ভীষণ মন খারাপ। কেমন বিষণ্নতায় যেন ডুবে আছে মানুষটা।
নীলাভ হচ্ছে ওর মামাতো ভাই। তাদের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করে । শ্রেয়া বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ওর বাবাও থাকেন বিদেশে। তাই শ্রেয়ার মা-বাবা খানিক আগ্রহ নিয়েই নীলাভকে নিজের বাসায় রেখেছেন। একজন পুরুষ মানুষ থাকলে নানান বিপদে-আপদে কাজে লাগে।
তখন থেকেই শ্রেয়ার সমস্ত কিছু যেন নীলাভকে ঘিরে।
সারাক্ষণ অ-কাজে ওর রুমে যাওয়া। সেধে সেধে ঝগড়া করা। বাইরে গেলে হঠাৎ কোনো শার্ট পছন্দ হলে নীলাভের জন্য নিয়ে আসা আরও কত কী..।
কিন্তু নীলাভ সব সময়ই তাকে এড়িয়ে চলে।
এইতো মাস কয়েক আগে শ্রেয়া একদিন ওর বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাবার জন্য খুব সময় নিয়ে সেজেছিল। বাসা থেকে বের হবার আগে কি ভেবে জানি অকাজেই নীলাভের রুমে গেল। তাকে দেখে নীলাভ খানিক্ষণ তাকায়। শ্রেয়া আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ‘কেমন লাগছে আমায়?’

নীলাভ যেন অনেকটা মুখস্থের মতোই বলে দেয়,

-‘শয়*তান্নীর মতো লাগছে। তোর চিকন হাত-পা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে মুরগীর ঠেং। মুখে এসব কি দিয়েছিস! ওয়াক কি বিচ্ছিরি। এতো চিকন করে ভ্রু প্লাক করছিস কেন? এরকম ভ্রু প্লাক করে সিনেমায় অ’ভিশপ্ত ভ’য়ংকর মহিলার আ’ত্মার অভিনয় করে মানুষকে ভ’য় দেখাতে পারবি। আর ওড়না না দিয়ে যে গলার আশপাশ দেখাচ্ছিস। কোনো ছেলে কি তোর এদিকে তাকাবে মনে করছিস? বেয়াক্কল গলার হাড্ডি দেখা যাচ্ছে তোর। মাংস বলতে কিচ্ছু নাই। বি’ড়ালেরও আগ্রহ হবে না। তোর যা শরীর যত ঢাকবি ততই মঙ্গল।’

একটা মেয়েকে এই কথাগুলো যে কি পরিমাণ কষ্ট দিতে পারে নীলাভের হয়তো ধারণা ছিল না। শ্রেয়া বেশ শক্ত মানসিকতার মেয়ে হয়েও কেমন ধুপ করে নিভে যায়। মুখময় রাতের কালো আঁধার নেমে আসে। চুপচাপ নীলাভের রুম থেকে বেরিয়ে যায় সেদিন। নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে কান্নায় বারংবার শরীর কেঁপে উঠে। সেদিন মন খারাপ করে আর বিয়েতে যায়নি শ্রেয়া। পরবর্তী মাস দুয়েক নীলাভেরও মুখোমুখি হয়নি সে। সবসময় কেমন চুপচাপ, মনমরা হয়ে থেকেছে।
তবে ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়।
নীলাভের এমন কঠিন স্বভাব দেখে শ্রেয়া একদিন ওর রুমের সমস্ত থ্রিলার উপন্যাস সরিয়ে প্রেমের কবিতা আর প্রেমে টইটম্বুর সব প্রেমের উপন্যাস রেখেছিল।
সেটা নিয়ে দু’জনের কত ঝগড়াঝাটি। নীলাভ বলে আমার থ্রিলার উপন্যাস ছাড়া কিছুই পড়তে ভালো লাগে না। সুতরাং এগুলো সরিয়ে আমার থ্রিলার উপন্যাসগুলো বের করে দাও।
শ্রেয়া বলে,

– ‘এগুলো পড়ে পড়েই তুমি একটা পাথর মানব হয়েছো। আজ থেকে এগুলো পড়া বাদ।’

নীলাভ গিয়ে ফুফুর কাছে নালিশ করেও বিশেষ কাজ হয়নি। শ্রেয়ার মাও ভীষণ রোমান্টিক ধাঁচের মহিলা।
তিনি উল্টো নীলাভকে বলে দিলেন,

– ‘দেখ বাবা, এই মেয়ের বিচার তুই আমার কাছে দিস না। যেভাবে পারিস নিজে সামাল নিতে শিখ।’

শ্রেয়ার দৌড় এখানেই শেষ নয়। ক’দিন আগে নীলাভের ভোরে ঘুম ভেঙে যায় বুকে ভারি কিছু অনুভব করে।
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে শ্রেয়া তার বুকে মাথা রেখে খুব নীরবে, আপনে, যতনে শুয়ে আছে।

সে ধাক্কা দিয়ে তুলে বললো,

– ‘এটা কী তোর স্বামীর বুক পেয়েছিস? তোর কী লজ্জা-শরম বলতে কিচ্ছু নেই? আমি কিন্তু ফুফুকে গিয়ে বলবো তোমার মেয়েকে বিয়ে দাও। সে যারতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।’

শ্রেয়া বিস্মিত হয়ে বলল,

– ‘যারতার বুকে মাথা রেখেছি মানে? আমি কী এতো খারাপ মেয়ে নীলাভ ভাই?’

নীলাভ আরও চড়াও হয়ে বলে,

– ‘তো যারতার বুক না? আমি কী তোর বিয়ে করা স্বামী?’

শ্রেয়ার তখন কেমন মুখের ভাষা ফুরিয়ে গিয়েছিল। আসলেই তো নীলাভ ভাই তার বিয়ে করা স্বামী না।

নীলাভ বাইরে। তাই শ্রেয়া এখন তার রুমে এসেছে। ভাবছে মানুষটা কিছুদিন থেকে এতো বিষণ্ণ কেন? রুমে অকারণ এটা-ওটা নাড়ছিল। তারপর বিছানায় শুয়ে নীলাভের বালিশে চুমু খেল। তখনই বালিশের নিচ থেকে দৃশ্যমান হয় একটা ডায়েরি। শ্রেয়া ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে গিয়ে একটা লেখা পড়ে অবাক হয়। যাকে সে পাথর মানব বলে এটা তার লেখা? কিন্তু লেখাটা পড়ে শ্রেয়া ভীষণ অবাক হয়৷ এই লেখা কি সমস্ত মেয়েদেরকে নিয়ে লেখা? “মায়াবতী” না লিখে “মায়াবতীরা” কেন! এটার কারণ কী? এই লেখা কি আসলেই নীলাভের না-কি অন্য কোথাও থেকে লিখে রেখেছে।
শ্রেয়া আবার ডায়েরির লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়ে,

‘একলার রাতে ভীষণ ইচ্ছে করে নষ্ট হতে।
ইচ্ছে করে জগতকে জটিল করা সমস্ত নিয়ম-কানুন ভেঙে অবাধ্য হতে।
চারপাশে চোখভরা মায়া নিয়ে এতো এতো মায়াবতীরা ঘুরে বেড়াবে অথচ নিজের লোভাতুর মনকে প্রতিনিয়ত শাসন করতে হবে এটা কোনো কাজের কথা নয় যে।
কী হয় যদি হঠাৎ একদিন কোনো মায়াবতীর সামনে লাল টুকটুকে একটি ফুল নিয়ে পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলি, ‘তোমার এলোকেশে নাক ডোবানোর অধিকার চাই।
আমার হাতের লাল টুকটুকে ফুলের পাপড়ির মতোন তোমার যে মাতাল করা দু’টি ঠোঁট আছে, সেখানে আমার প্রেমহীনতায় ফেটে যাওয়া শুকনো ঠোঁট ছুঁয়ে দেবার অধিকার চাই।
না না বড্ড বেশি হয়ে গেল, ঠোঁট থাক। তোমার কপালে পবিত্র গ্রন্থের মতোন চুমু খাবার অধিকার চাই।
জানেন? ভীষণ তাড়া পাচ্ছি ভেতর থেকে। বেলা যে কম হয়নি।
ফজর চলে গেল কবে, জোহর দরজার কড়া নাড়ছে।
আমার কী নষ্ট হবার ইচ্ছে করে না বলো?
জগতে কেন এতো এতো মায়াবতী থাকতে প্রেমহীনতায় আমার হৃদয় মরুভূমির মতোন ফেটে যাবে?
আমার ভীষণ দুষ্টু হতে ইচ্ছে করে।
কোনো শাড়ি পরিহিত মানবী জানালার ওপাশের আকাশটা আনমনে দেখবে, আচমকা পিছু থেকে আমার দুষ্টু হাত তার পেট চেপে ধরে জড়িয়ে নেবে।
একলার রাতে আরও কতকিছু ইচ্ছে করে।
ইচ্ছে করে খুব যতনে, আপনে, নীরবে কোনো মানবীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বেঘোরে ঘুমোতে।”

এই মানুষটার মাথায় বুঝি এতোকিছু নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অথচ তার সামনেই কেবল রসকষহীন, নির্লিপ্ত ভাব।

শ্রেয়া আর দেরি করলো না। তাড়াতাড়ি বাইরে গিয়ে একটি খয়েরী রঙের শাড়ি আর লাল টুকটুকে ফুল নিয়ে বাসায় ফিরে এলো।

নীলাভ ভার্সিটি থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে।
শ্রেয়া শাড়ি পরে ফুল হাতে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে পর্দা ফাঁক করে দেখে মানুষটা বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে আছে।
শ্রেয়া ধীরে ধীরে বিছানার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে,

– ‘নীলাভ ভাইয়া।’

নীলাভ হকচকিয়ে তাকায়। তার সামনে জগতের সবচেয়ে সুন্দর একটি দৃশ্য।
যুবতী একটা মেয়ে খয়েরি রঙের শাড়ি পরে তার সামনে লাল টুকটুকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু নীলাভ ভাবলেশহীন হয়ে বললো,

– ‘কী হয়েছে?’

শ্রেয়া ফুলটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘আমার চোখে কী মায়া নেই? মাথায় কী এলোকেশ নেই? তুমি এই লাল ফুল নিয়ে আমার পথ আগলে যা ইচ্ছে হয় তার অধিকার চাও।’

নীলাভ সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলে শ্রেয়া তার ডায়েরি পড়েছে।
মেজাজ খারাপ হলেও নিজেকে সামলে বললো,

– ‘লুকিয়ে কারও ডায়েরি পড়া ঠিক না। যাইহোক, এখন এসব পাগলামি ছেড়ে রুম থেকে যা, এমনিতেই মন মেজাজ ভালো নেই।’

শ্রেয়া মন খারাপ করে রুম থেকে চলে যাচ্ছিল। নীলাভ ডাক দিল,

– ‘শ্রেয়া শোন।’

শ্রেয়া হাসি হাসি মুখে বলল,

– ‘কি?’

– ‘তুই একটু আগে কি বললি। তোর চোখে কি মায়া নাই। মাথায় কি এলোকেশ নাই। তার উত্তর হচ্ছে, আসলেই নাই। বিন্দুমাত্র নাই। যা এবার।’

শ্রেয়ার মন আরও খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু নীলাভ মনযোগ দিল না। কারণ তারও আজ মন খারাপ।

কোনোভাবেই মিনুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। ওর কাছের বান্ধবীরাও কিছু জানে না। তবে মিনুর বান্ধবীরা বলেছে কিছুদিন আগে সমকামীতায় ধরা পরে যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ইমাম না-কি মিনুর বাবা। সেদিন থেকে মিনুর কোনো অস্তিত্ব নেই। ঠিকানা নিয়ে ওর গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছিল নীলাভ।
মিনুর বাবা গলায় ফাঁ’স দিয়ে মরেছেন। প্রতিবন্ধী এক ভাই আর মা সহ মিনু হঠাৎ করে গ্রাম থেকে উধাও। গ্রামের কেউ-ই জানে না তারা কোথায়। শেষ যেদিন মিনুর সঙ্গে নীলাভের ফোনে কথা হয়। তখন মিনু কেন যেন শ্রেয়ার নাম্বার চেয়েছিল৷ কিন্তু শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে এখনও মিনু ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।
__ চলবে__
__ঘাসফড়িং ১ম পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here