#_মায়ার_বাধঁন
২১তম পর্ব
লেখনিতে-জান্নাত_রুবি
২১.★★★★
কেটে গেছে আরো কয়েকটা দিন।
আর এক সাপ্তাহ পর ডেলিভারির ডেট দিয়েছে ডাক্তার।
ইদানীং আমার শরীরটা একটু বেশীই খারাপ হচ্ছে।আজকেও শরীরটা খুব দূর্বল লাগছে।ডাক্তার আপাকে বলেছিলাম!ডাক্তার আপা বললেন,
সময় তো খুব নিকটে!এসময় এরকম একটু-আধটু সমস্যা হয়।ফুপিকে জড়িয়ে ধরে আবেগাক্রান্ত হয়ে বললাম,
-ফুপি আমি পারব তো আমার সন্তানকে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখাতে?
ফুপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-আল্লাহর উপর ভরসা রাখ রে মা?ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তোকে কষ্টের প্রতিদান দিবেন।
তারপর কুরআন মাজীদের কয়েকটি আয়াত পড়ে শুনালেন,
“হতাশ হয়ো না, উঠো! সিজদাহ করো এবং কাঁদো!” — সূরা ইউসুফ : ৮৬
–
“আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন।”
— সূরা ত্বলাক : ৭
–
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।”
— সূরা ইনশিরাহ : ৬
–
“আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতাগুলো আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি।”
— সূরা ইউসুফ : ৮৬,,
–
চোখ মুছে ফুপিকে বললাম,
-সত্যিই তো ফুপি!আমার আল্লাহ তো হতাশ না হতে বলেছেন তাহলে আমি হতাশ হই কী করে!
আজকে বিকেল থেকে আমার খুব বেশী ব্যথা হচ্ছে।নিজেকে আজ বড্ড একা আর অসহায় লাগছে।
কি করবো না করবো ভেবে পাচ্ছি না আমি।ফুপি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাইরে গেছেন!
বলে গেছেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন!রাফা পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে!রাফাকে কিছুটা উচ্চস্বরে ডাক দিলাম!ও শুনলো কী না বুঝলাম না!ফুপিকে অনেকবার ফোন করলাম!কিন্ত ফুপি ফোন রিসিভ করলেন না!তাই কোন উপায় না পেয়ে আমার শাশুরী মাকে ফোন দিলাম।কিছুক্ষণ পর মা ফোন ধরলেন।আমি কেঁদে কেদেঁ আমার অবস্থার কথা জানালাম মাকে।আমার কান্না শুনে মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
আমি তো তোর ফুপির ওখানে আসতে আসতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে! তুই যদি মনে কিছু না করিস তাহলে সায়ানকে বলি তোদের বাসায় যেতে! ও তোর ফুপির এলাকায় কোন এক প্রয়োজনে গিয়েছে।
আমি মায়ের কথার কোন জবাব দিলাম না!আমার খুব পেইন হচ্ছিলো।মা আমাকে বেশী করে আল্লাহর নাম নিতে বলে ফোনটা রেখে দেন।এদিকে রাফা আমার রুমে এসে আমার এ অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায়।তাড়াতাড়ি ফুপিকে ফোন করে।বার দুয়েক ফোন করার পর ফুপি ফোন রিসিভ করলে ও সংক্ষেপে আমার অবস্থা ফুপিকে জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।আমি চোখ বুঝে পড়ে রইলাম কারো অপেক্ষায়।!
কিছুক্ষন পর ফুপি আসার আগেই সায়ান চলে আসেন।সায়ানকে দেখামাত্রই আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।আমার দু-চোখ বেয়ে অঝোড় ধারায় পানি পড়তে থাকে। অজানা ভয়ে আমি আঁতকে উঠি।এই মানুষটাকে যে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি।আর উনিই তো আমার সন্তানের বাবা।জীবনে যা কিছু হয়ে যাক না কেনো উনাকে তো আমি না ভুলতে পেরেছি আর না কখনো ভুলতে পারবো!উনার উপর তো আমার কোন রাগ ছিলো না!যা ছিল শুধুই অভিমান!পরিস্থিতির চাপে পড়ে যা কিছুই করেন না কেনো পরে যখন উনার ভুল ভাঙ্গে উনি তো বার বার আমার খোঁজ করেছেন!কিন্ত উনি সফল হতে পারেন নি!একদল মুখোশধারী আমাদের সামনে ভদ্রবেশী সেজে আড়ালে ঠিকই আমাদের সুখের সংসারটিকে ভাঙার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেো!তাই তো এতগুলো মাস ধরে দু-জনের মধ্যে কত দুরুত্ব।তবুও উনি তো হাল ছাড়েন নি!এখনো অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমার অভিমান ভাঙানোর।আমি তো চেয়েছি উনি আবেগের বশবর্তী না হয়ে পুরোপুরি আমাকে যেন মন থেকে মেনে নেন!হ্যা উনার চোখে আজ আমি আমাকে হারানোর ভয় দেখতে পাচ্ছি।উনার মুখে স্পষ্ট
দুশ্চিন্তার চাপ।
আমাকে হসপিটালে আনা হলো।
বাসা থেকে শুরু করে হসপিটাল পর্যন্ত উনার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছি আমি।আমার মনে চলছে হাজারো চিন্তা!আমার কিছু হয়ে যাবে না তো!উনাকে একা রেখে চলে যাবো না তো!এসব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে আমি মনে মনে আল্লাহর নাম নিচ্ছি।হসপিটালে ফুপিসহ আমার শশুর বাড়ির সবাই এসেছেন।
ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে আমার।আমি নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে সান্তনা দিচ্ছেন।
ডাক্তার আপা এলে উনাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।যাবার সময় উনার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না!উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল আমার নয় উনার কষ্ট হচ্ছে!
কিছুক্ষন পর আমি নরমালেই একটা সন্তানের জন্ম দান করলাম।তারপর আমার আর কিছইু মনে নেই।একে তো শারীরিক এত খারাপ অবস্থা! তার উপর মানসিক চাপ!এদুটো মিলিয়ে আমি মুহূর্তেই জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞানযখন ফিরে তখন সায়ানকে দেখি কেবিনে ঢুকতে!
আমি উনার কাছে কোন সঙ্কোচ ছাড়াই জিজ্ঞেস করলাম,
-আমার সন্তান কোথায়?
উনি মুচকি হেসে আমার পাশে বসতে বসতে বললেন,
-আছে তো আমাদের রাজকন্যা!ওর দাদুমনির কাছে!তুমি তো দেখো নি ওকে!দাড়াও আমি নিয়ে আসছি ওকে!
উনি চলেই যাচ্ছিলেন এমন সময় আমি বললাম,
-আপনি খুশি হয়েছেন?
উনি আমার কথা শুনে খুব খুশি হয়ে বললেন,
-খুশী হবো না!আমি তো খুব খুব খুশী আজ।এত কষ্টে মনে হয় রানীকে পেলাম আর সাথে রাজকন্যাও পেলাম।আমার এত দিনের মরুময় জীবনে যে আশার আলো হয়ে এলো!যে আমাদের #মায়ার_বাঁধন কে দৃঢ় করলো তাতে আমি খুশি হবো না!আল্লাহর লক্ষ কোটি শুকরিয়া আদায় করছি!আল্লাহ আমার এত দিনের চাওয়াকে পাওয়াতে পরিনত করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
আমি উনার কথা শুনে বললাম,
-আল্লাহ মানুষের মনের নেক আশা
অবশ্যই পূরণ করেন!শুধু আমাদের উচিত ধৈর্য ধরে আল্লাহর ফায়সালার অপেক্ষা করা আর যেকোনো পরিস্থিতিতে সবর করা।
উনি আমার কথা শুনে বললেন,
-হুম!তুমি ঠিক কথাই বলেছো।তারপর উনি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে অশ্রুসিক্ত হয়ে বললেন,
-তুমি কী আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছো সাফা।নাকি আবারো দূরে চলে যাবে?এবার কিন্ত আমাকে ফেলে চলে গেলে আমি মরে…………
আমি উনার কথার মাঝখানে উনার মুখে হাত দিয়ে উনার কথা আটকালাম।তারপর উনার দিকে তাকিঁয়ে বললাম,
-আপনি আপনার পরীক্ষায় পাশ করেছেন জনাব!আমি শেষবারের মত আপনাকে পরীক্ষা করছিলাম।পরবর্তীতে যদি আবারো কারো প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েন!কিন্ত না আপনি এ কয় মাসে একেবারেই পরিবর্তন হয়ে গেছেন আলহামদুলিল্লাহ ।আপনি যে রোজ ফুপির কাছে কল করে আমার খবর নিতেন!
আমি যখন পেছনের বারান্দায় যেতাম আপনি প্রায়ই দেয়ালের উপর বসে আমাকে দেখতেন এসবই আমার জানা হয়ে গেছে।
উনি ধরা পরে গিয়ে হেসে ফেললেন!এমন সময় মা আমাদের মেয়েকে নিয়ে রুমে প্রবেশ
করলেন।উনি মায়ের কোল থেকে আমাদের ছোট্ট প্রিন্সেসকে এক প্রকার ছো মেরেই নিয়ে ওর ছোট্ট মুখটাতে অসংখ্য চুমু দিতে লাগলেন।
উনার কান্ড দেখে শত কষ্টে থাকার পরও মায়ের সাথে সাথে আমিও হেসে ফেললাম।
কিছুক্ষন পর ওকে আমার পাশে শুইয়ে দিলেন।ও মিটিমিটি করে আমার দিকে তাকিঁয়ে আমাকে দেখছিলো।আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিঁয়ে আছি।
হঠাৎ আমার কিছু মনে হওয়ায় আমি উনাকে বললাম,
-ওর কানে কী আযান দেওয়া হয়েছে?
উনি মুচকি হেসে বললেন,
-দেওয়া হয়েছে বেগম সাহেবা!এছাড়াও আমি আপনার ডায়েরী পরে অনেক অজানা কিছু জানতে পেরেছি।আর আপনার মনের বাকী সকল আশাগুলোও পুরন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ!
আমরা অনেকেই সন্তান জন্মের পরের করনীয় কিছু দিক সম্পর্কে জানি না।চলুন না আমরা এ সম্পর্কে কিছু জেনে নেই,,
সন্তান আল্লাহ তা’আলার দেওয়া একটি অমূল্য নিয়ামত। এই নিয়ামতের মূল্য যে কত বেশি তা কেবল তারাই বুঝবেন যারা এ থেকে বঞ্চিত। আর যাদেরকে এই নিয়ামত দিয়ে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন তারা কিছুটা হলেও সেই মূল্য অনুভব করতে পারেন। ইসলাম একটি পূর্ণাংগ জীবনবিধান হিসেবে নবজাতক সন্তানের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য বেঁধে দিয়েছে। একটি নবজাতক সন্তানকে দুনিয়ার বুকে স্বাগত জানানোর কিছু ইসলামিক বিধিবিধান রয়েছে যেগুলো মুসলিম হিসেবে পালন করা আমাদের জন্য জরুরী।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, অনেক দ্বীনদার পরিবারেও নবজাতক সন্তানের ক্ষেত্রে এই বিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করা হয় না। যারা করেন তাদের অনেকেই আবার প্রতিটি কাজের সময়সীমা সম্পর্কে গাফেল। অথচ কোন কাজটি কখন এবং কীভাবে করতে হবে সেই বিষয়ে ইসলামের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন রয়েছে। আমি এখানে সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করব ইনশা আল্লাহ।
(১)
নবজাতকের কানে আযান দেওয়াঃ
সন্তান জন্মের পর প্রথম কাজ হল তার ডান কানে আযান দেওয়া। এটি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত সুন্নাহ। ‘আলিমগণ বলেছেন এর পেছনে হিকমাহ হল একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই সে আল্লাহর একত্বের বাণী শ্রবণ করবে। যদিও পরবর্তী জীবনে জন্মলগ্নের আযানের কথা তার মনে থাকবে না তবুও এর একটি রুহানী প্রভাব শিশুর মনে রয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।
উবাইদুল্লাহ ইবনু আবু রাফে’ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ “ফাত্বিমাহ (রা) যখন আলী (রা) এর পুত্র হাসান (রা) কে প্রসব করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তার কানে সালাতের আযানের ন্যায় আযান দিয়েছিলেন।“
[আবু দাউদঃ ৫১০৫ (তাওহীদ পাবলিকেশন); আলবানী (রহ.) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন]
অনেকেই মনে করেন এই আযান সালাতের আযানের মত উচ্চস্বরে হতে হবে। কিন্তু তা ঠিক নয় বরং বাচ্চার কানের কাছে স্বাভাবিক কণ্ঠে আযান দিলেই যথেষ্ট। এই আযান দেওয়ার কোন সময় বাধ্যতামূলকভাবে নির্দিষ্ট করা হয়নি তবে ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন উত্তম হচ্ছে শিশুর জন্মের পরপরই আযান দিয়ে দেওয়া যেন দুনিয়াবী অনর্থক কথাবার্তার পূর্বেই তাওহীদের বাণী তার কানে প্রবেশ করে। তবে বিন বায (রহ.) শিশুর জন্মের ৭ম দিনে আযান দেওয়াকে মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন-
ﻓﻲ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﺍﻟﺴﺎﺑﻊ ﻳﺴﺘﺤﺐ ﺃﻧﻪ ﻳﺆﺫﻥ ﻓﻲ ﺃﺫﻧﻪ ﺍﻟﻴﻤﻨﻰ ﻭﻳﻘﺎﻡ ﻓﻲ ﺍﻟﻴﺴﺮﻯ
অর্থঃ “ সপ্তম দিনে মুস্তাহাব হল তার ডান কানে আযান দেওয়া এবং বাম কানে ইক্বামাহ দেওয়া।”
নবজাতকের বাম কানে ইকামত দেওয়ার বিষয়ে যে হাদীসগুলি রয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে একদল ‘আলিম প্রশ্ন তুলেছেন। এই ব্যাপারে আবু ইয়ালা ও বায়হাকীতে বর্ণিত হাদীসটিকে আলবানী (র) মাওদ্বূ’ বা জাল এবং ইবনুল কায়্যিম (র) দূর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আহলুল ‘ইলমদের মধ্যে থেকে এক দল এবং বিন বায (রহ.) বাম কানে ইকামত দেওয়ার আমলকে সমর্থন করেছেন। বিন বায (রহ.) বলেছেন-
ﻭﻟﻜﻦ ﺟﺎﺀ ﻋﻨﻪ ﻓﻲ ﺑﻌﺾ ﺍﻷﺣﺎﺩﻳﺚ ﺍﻟﺘﻲ ﻓﻴﻬﺎ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﻀﻌﻒ ﺍﻷﺫﺍﻥ ﻓﻲ ﺃﺫﻥ ﺍﻟﺼﺒﻲ ﻭﺍﻹﻗﺎﻣﺔ ﻓﻲ ﺍﻟﻴﺴﺮﻯ ﻣﻦ ﺃﺫﻧﻴﻪ، ﻓﺈﺫﺍ ﻓﻌﻠﻪ ﺍﻹﻧﺴﺎﻥ ﻓﻼ ﺑﺄﺱ، ﻭﻗﺪ ﻓﻌﻠﻪ ﻋﻤﺮ ﺑﻦ ﻋﺒﺪ ﺍﻟﻌﺰﻳﺰ ﻭﺟﻤﺎﻋﺔ ﻣﻦ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﻌﻠﻢ، ﻻ ﺑﺄﺱ، ﻭﺇﻥ ﺗﺮﻙ ﺫﻟﻚ ﻭﺳﻤﺎﻩ ﺑﺪﻭﻥ ﺃﺫﺍﻥ ﻭﻻ ﺇﻗﺎﻣﺔ ﻓﻼ ﺑﺄﺱ
অর্থঃ “কিন্তু কিছু হাদীসে সন্তানের ডান কানে আযান দেওয়া এবং বাম কানে ইক্বামাহ দেওয়ার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোতে কিছুটা দূর্বলতা রয়েছে। তবে যদি কেউ তা করে তবে তাতে কোনও সমস্যা নেই এবং ‘উমর ইবনে আবদুল আযীয এবং আহলুল ‘ইলমদের একটি দল এটি করেছে। এতে কোন সমস্যা নেই। আর কেউ যদি এটা না করে আযান-ইকামাত ছাড়াই সন্তানের নাম রাখে তাহলেও কোনো সমস্যা নেই”।
ইবনুল কায়্যিম (র) তাঁর “তুহফাতুল মাওদুদ বি আহকামিল মাওলুদ” গ্রন্থে নবজাতকের কানে আযান দেওয়ার বেশ কিছু তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি হল-
(ক) দুনিয়াবী অনর্থক কথাবার্তার পূর্বেই তাওহীদের বাণী তার কানে প্রবেশ করবে।
(খ) জন্মলগ্নে শয়তানের অনিষ্ট থেকে হেফাযত করবে।
(গ) দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে ইসলামের দাওয়াত তার কাছে পৌঁছে যাবে।
(২)
তাহনীক করা ও শিশুর বরকতের দুয়া করাঃ
শিশুর জন্মের পর সম্ভব হলে খেজুর চিবিয়ে অথবা অন্য কোন উপায়ে চটকে তার সামান্য রস শিশুর মুখে দেওয়াকে বলা হয় তাহনীক। খেজুর না থাকলে মধু বা যে কোন মিষ্টি জাতীয় খাদ্য দিয়েও তাহনীক করা যায়। এটিও রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত সুন্নাহ।
আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, “আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবী (সা) এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহীম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দূয়া করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। সে ছিল আবূ মূসার সবচেয়ে বড় ছেলে।“ [বুখারী (ইসলামিক ফাউণ্ডেশন): ৪৯৫৮]
উত্তম হল কোন ‘আলিম বা পরহেযগার ব্যক্তি অথবা তা সম্ভব না হলে শিশুর পিতা/মাতার দ্বারা তাহনীক করা। ইমাম নববী (র) বলেছেন, “তাহনীকের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে প্রমাণিত সুন্নাহ এবং এই বিষয়ে ‘আলিমগণের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”।
এই তাহনীকের জন্য উত্তম সময় হল শিশুর জন্মের পরপরই।
(৩)
শিশুর নাম রাখাঃ
.
শিশুর নাম রাখার জন্য উত্তম সময় হল জন্মের সপ্তম দিন। তবে প্রথম দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে যে কোন সময় রাখা যায়।
আয়িশাহ (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) সপ্তম দিনে হাসান এবং হুসাইন এর আক্বীকাহ করেছিলেন এবং তাদের নাম রেখেছিলেন।“ [ইবনু হিব্বান এবং হাকিম থেকে বর্ণিত। ইবনু হাজার আসকালানী তাঁর ‘ফাতহুল বারী’তে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন]
বিন বায (রহ.) বলেছেন-
ﻓﻲ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﺍﻟﺴﺎﺑﻊ ﻳﺴﺘﺤﺐ ﺃﻧﻪ ﻳﺆﺫﻥ ﻓﻲ ﺃﺫﻧﻪ ﺍﻟﻴﻤﻨﻰ ﻭﻳﻘﺎﻡ ﻓﻲ ﺍﻟﻴﺴﺮﻯ ﻭﻳﺴﻤﻰ ﻓﻲ ﺍﻟﻴﻮﻡ ﺍﻟﺴﺎﺑﻊ
অর্থঃ “ সপ্তম দিনে মুস্তাহাব হল তার ডান কানে আযান দেওয়া, বাম কানে ইক্বামাহ দেওয়া এবং নাম রাখা।”
নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘আলিমগণ এভাবে ক্রম অনুসরণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন-
(ক) আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান (এই দুটি নাম আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়) অথবা আল্লাহর যেকোন নামের আগে ‘আবদ’ যোগ করে নাম রাখা।
(খ) নবীগণের নামানুসারে নাম রাখা।
(গ) সাহাবাগণের নাম অথবা সাহাবাগণ যেসব নাম পছন্দ করতেন সে অনুসারে নাম রাখা।
(ঘ)কোন ‘আলিম অথবা পরহেযগার ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করে নাম রাখা।
আর এই ধরণের নামগুলি ‘আলিমগণ রাখতে নিষেধ করেন-
(ক) অমুসলিমদের কালচার অনুযায়ী কোন নাম
(খ) অমুসলিমদের দেব-দেবীকে উপস্থাপন করে এমন কোন নাম
(গ) শির্ক/কুফরী/অনৈসলামিক রীতি প্রকাশ পায় এমন কোন নাম (যেমন- গোলাম রসুল যার অর্থ রাসূলের গোলাম)
(ঘ) ইসলামী অর্থবোধক হলেও মানুষের গুণের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন/কল্পনা প্রকাশ পায় সেসব নাম। (যেমন- মুহিউদ্দীন যার অর্থ দ্বীনের পুনর্জীবনদানকারী, জাহাঙ্গীর যার অর্থ দুনিয়া ধারণকারী ইত্যাদি)
(৪)
আক্বীকাহ করাঃ
.
আক্বীকাহ করার সুন্নাহ সম্মত সময় হল শিশুর জন্মের সপ্তম দিন। তা সম্ভব না হলে ১৪ তম অথবা ২১ তম দিনেও করা যায়। এমনকি ইবুন কুদামাহ (র)-এর মতে, সপ্তম দিনের আগেও কেউ যদি কোনো কারণে আক্বীকাহ করে ফেলে তাহলেও তা যথেষ্ট হবে। (আল-কাফী, খণ্ড-০২, পৃষ্ঠা-৪৯৮)
এগুলো বাধ্যতামূলক সময়সীমা নয় বরং মুস্তাহাব। আক্বীকাহ ওয়াজিব না সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ তা নিয়ে ‘আলিমগনের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে যার সামর্থ্য আছে তার জন্য অবশ্যই উচিত হবে আক্বীকাহ করা। ছেলে শিশুর পক্ষ থেকে দুটি ছাগল বা ভেড়া এবং মেয়ে শিশুর পক্ষ থেকে একটি ছাগল বা ভেড়া জবাহ করতে হবে। আমাদের দেশে কুরবানীর গরুর সাথে ভাগে আকীকা দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে তা সুন্নাহসম্মত নয়। আর সামর্থ্য থাকার পরেও নির্দিষ্ট সময়ে আকীকা না দিয়ে কুরবানীর সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা সুন্নাহবিরোধী কাজ।
শাইখ বিন বায (র)-এর মতে, অতিথি বেশি হওয়ার কারণে বা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য কারণে আকীকার পশু বেশি কম করলে কোনো সমস্যা নেই। এই বিষয়টি প্রশস্ত। আর আকীকার গোশত শিশুর মা-বাবাসহ সবাই খেতে পারবে। কাউকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো যায়, কিছু নিজেরা রেখে কিছু আত্মীয়-স্বজন বা ফকীর-মিসকীনদের হাদিয়া দেয়া যায়। (আল-হাদইউন নাবাবী ফী তারবিয়াতিল আওলাদি ফী যাওয়িল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, ড. সাঈদ আল-কাহতানী, পৃষ্ঠা- ৬৭)
সামুরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আকীকার সাথে শিশুর বন্ধক। তার পক্ষ থেকে সপ্তম দিনে পশু জবেহ করা হবে। তার নাম রাখা হবে। তার মাথা মুণ্ডণ করা হবে।” [সহীহ ইবনু মাজাহঃ৩১৬৫, তিরমিযীঃ ১৫২২ (আল মাদানী প্রকাশনী)]
ইমাম তিরমিযী (রহ.) এই হাদীসের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “এই হাদীসটি হাসান সহীহ। আলিমদের এতদনুসারে আমল রয়েছে। তারা শিশুর পক্ষ থেকে সপ্তম দিন আকীকা করা মুস্তাহাব বলে মত প্রকাশ করেছেন। সপ্তম দিন যদি প্রস্তুত না হয় তবে চৌদ্দতম দিনে, সে দিনে প্রস্তুত না হতে পারলে একুশতম দিনে আকীকা দিবে। কুরবানীতে যে ধরণের ছাগল জবাই করা যায়েয, আকীকাতেও সে ধরণের ছাগল না হলে তা জবাই করা যথেষ্ট বলে গণ্য হবে না।”
ইবনুম কায়্যিম (র) তাঁর “তুহফাতুল মাওদুদ বি আহকামিল মাওলুদ” গ্রন্থে আক্বীকাহ-র কয়েকটি তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন-
(১) এর মাধ্যমে নবজাতক আল্লাহর নিকটবর্তী হয়।
(২) শয়তানের অনিষ্ট থেকে হিফাজতে থাকে।
(৩) শিশু সন্তান তার বাবা-মার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করার সুযোগ লাভ করে।
“আকীকার সাথে শিশুর বন্ধক”- হাদীসের এই অংশের বাখ্যায় অনেক উলামায়ে কিরাম বলেছেন- এর অর্থ হল বাবা-মা যদি সন্তানের জন্য আক্বীকাহ না করে তবে সন্তান ঐ বাবা-মার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে পারবে না।
(৪) আল্লাহ যেমন ইসমাঈল (আ) এর মুক্রিপণস্বরূপ দুম্বা প্রেরণ করেছিলেন তেমনি আক্বীকাহ হল নবজাতকের জন্য মুক্তিপণস্বরূপ।
আক্বীকাহ-র আরেকটি উপকারিতা হল এর ফলে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে “Halaal Gathering” হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি ভিত্তিহীন কুসংস্কার হল আক্বীকাহ-র গোশত শিশুর বাবা-মা খেতে পারবে না। এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট কুসংষ্কার। আক্বীকাহ-র গোশত কুরবানীর গোশতের মতই সবাই খেতে পারবে ইনশাআল্লাহ।
এছাড়াও শিশুর আক্বীকাহ তার নানা-নানী/দাদা-দাদী করতে পারে। বাবা-মাকেই করতে হবে এমনটা জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ (সা) হাসান বিন আলী (রা) এর আক্বীকাহ করেছিলেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তবে আমাদের সমাজে নবজাতকের নানা-নানীর উপর আক্বীকাহ-র খরচ চাপিয়ে দেওয়ার যে বাধ্যতামূলক রীতি দেখা যায় তা নিন্দনীয় ও বর্জনীয়।
আক্বীকাহর পশু কুরবানি সংক্রান্ত অনেক মাস’আলা রয়েছে যেগুলো কোন নির্ভরযোগ্য ‘আলিমের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
(৫)
মাথা কামিয়ে দেওয়াঃ
.
নবজাতক পুত্র সন্তানের মাথা কামিয়ে দেওয়ার উত্তম সময় হল তার জন্মের ৭ম দিন, যেমনটা সামুরা (রা) থেকে বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসে দেখা যায়। মাথার চুল কামিয়ে তা ওজন করে সমপরিমাণ স্বর্ণ অথবা রূপা অথবা তার সমতুল্য মূল্য সাদাকাহ করে দিতে হবে। যেহেতু এই চুলের ওজন খুব কম থাকে তাই সঠিক ওজন নির্ণয় করতে না পারলে কাছাকাছি অনুমান করে সমপরিমাণ মূল্যের টাকা সাদাকাহ করে দিতে হবে। নবজাতক কন্যা সন্তানের মাথা কামানোর প্রয়োজন নেই বরং শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (রহ.) এর মতে তা মাকরুহ। তিনি বলেন-
It is not Sunnah to shave a girl’s head on the seventh day as is the case for boys. With regard to shaving it for a reason, as referred to in the question, if that is true, the scholars say that it is makrooh to shave the head of a girl, but it may be said that if it is proven that this is something that will make the hair grow and become thick, then there is nothing wrong with it, because it is well known that what is makrooh is no longer regarded as makrooh if there is a reason for it.
(৬)
খৎনা করাঃ
.
ছেলে শিশুর জন্য খৎনা করা সুন্নাতুল ফিতরাহ এর অন্তর্ভুক্ত।
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, নাবী (সা) বলেছেন, “ফিতরাহ পাঁচটি অথবা বলেছেন, পাঁচটি কাজ হল ফিতরাহ এর অন্তর্ভুক্ত- খৎনা করা, ক্ষুর দ্বারা নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা, বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা এবং গোঁফ কাটা।”
[সহীহ মুসলিম (হাদীস একাডেমি): ৪৮৫]
বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যেকোন সময় খৎনা করা যায়। তবে একেবারে বালেগ হওয়ার আগে আগে খৎনা করলে তা সন্তানের জন্য আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ হয়। তাই বুঝ হওয়ার পূর্বেই খৎনা করে ফেলা ভাল। এতে সন্তান মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পায়।
.
এই ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়। এর যা কিছু সঠিক তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর যা কিছু ভুল তা আমার পক্ষ থেকে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে নেককার সন্তান দান করুন, পরিপূর্ণ সুন্নাতী পন্থায় নবজাতক সন্তানকে বরণ করে নেওয়ার তাওফীক দিন, আমাদের সন্তানকে পরিপূর্ণ বয়সে পৌঁছে দিন এবং আমৃত্যু আমাদের ও তাদেরকে দ্বীন ইসলামের উপর অটল ও অবিচল থাকার তাওফীক দিন। আমীন।
।
একে একে আমার ফুপি,রাফা,ভাবি,বাবা সবাই এসে আমাকে দেখে গেলেন।ভাবির সাথে সাথে বাবাও আমার কাছে উনার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইলেন!আমার ভাসুর সিয়াম-কিয়ামের বাবা বিদেশ থেকে বার বার ভিডিও কল দিয়ে উনার একমাত্র ভাতিজিকে তৃপ্তি ভরে দেখছিলেন।সবার দেখা-সাক্ষাৎ শেষে সায়ান কেবিনে ঢুকে আমার কপালে একটা চুমু দিয়ে উনার মেয়ের কপালেও একটা চুমু দিলেন।উনি একদৃষ্টিতে আমাদের প্রিন্সেসটার দিকে তাকিঁয়ে বললেন,
-আমার ‘মা’টা তো অনেক মায়াবী।
আমি বললাম,
-হুম।রঙ তো পেয়েছে আমার কিন্তু দেখতে ঠিক আপনার মতো কত্ত মায়াবী বলে ওকে আমি জড়িয়ে ধরলাম।
সায়ানও একদৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখছিলেন!আমিও উনার দিকে তাঁকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলাম।
।
।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,
.