_মায়ার_বাধঁন
১৬তম পর্ব
#লেখনিতে-জান্নাত_রুবি
১৬. ★★★★
“চলে এসেছি আমি
পাবে না আমায় আর হয়তো খুঁজে,
তোমার জীবনে কী ছিলাম আমি
সময় হলে নিও তুমি বুঝে,,
.
চিঠির শেষে এই চরনগুলো লিখে চিঠিটা লেখা শেষ করলাম।
আমার শাশুরী মা এসেছিলেন আমাকে দেখতে।উনার হাতে এই চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে কেঁদে বললাম,
-মা এই চিঠিটা উনার হাতে দিবেন আর বলবেন আমি খুব ভালো আছি।
আর উনাকে বলবেন,উনি নিশ্চিন্তে সানাকে নিয়ে সংসার করতে!আমি আর ওখানে ফিরে ওদের মাঝে বাধা হবো না।আমি বাকীটা জীবন না হয় কাটিয়ে দেবো উনার এই চিহ্ন নিয়ে।।
মা আমার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে বললেন,
-তুই কীসের চিহ্নের কথা বলছিস?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মায়ের কথা শুনে আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-মা আমি কনসিভ করেছি।
মা আমার কথা শুনে চমকে উঠে বলেন,
-তুই সত্যিই প্রেগন্যান্ট!
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।
আমার কথা শুনে মা বললেন,
-সায়ান কী এ খবর জানে।
মায়ের কথা শুনে আমি বললাম,
-না মা!আমি তো গতকালকেই জানলাম।আমার তো প্রায় তিন-চার মাস থেকেই এ বিষয়ে কিছুটা ডাউট ছিলো।যদিও মনে করেছিলাম আমার তো প্রায় সময়ে পিরিয়ড দু-তিন মাসে একবার হয়।এ সময়ও হয়তো ওরকমই হবে।
কিন্ত এ কয়েকদিনে শরীরে একেবারেই বল পাচ্ছিলাম না!বমি বমি ভাব করতো!
কিছু খেতেও পারতাম না।গতকালকে তো মাথা ঘুরে ফ্লোরে পড়ে যাই! তারপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করানোর পর জানতে পারি আমি তিন মাসের প্রেগন্যান্ট।
আমার কথা শুনে মা বললেন,
-সায়ানকে এ খবরটি জানানো উচিত।তাহলে হয়তো এ বাচ্চাটার টানে ওর মনটা ঘুরে যেত পারে!
আমি স্লান হেসে বললাম,
– না মা এমনটা হবে না।ও পরিবারে আমার এত অবদান,উনাকে এত ভালবাসার বিনিময়ে আমি উনার কাছ থেকে পেয়েছি শুধু লান্ঞনা!উনি বরাবরই সানাকে সাপোর্ট করেন বেশী!তাছাড়া সানাও তো মা হতে চলেছে।উনি তো অলরেডি সানার সন্তানের বাবা হতে চলেছেনই।তাহলে আমি কেনো আমার সন্তানকে নিয়ে উনার সংসারে বোঝা হতে যাবো।আমি এতোটাও অসহায় হয়ে যাই নি মা!উনি যদি এই বাচ্চাটার কথা ভেবেও আমার সাথে সংসার করেন সেখানে আমাদের মধ্যে ভালোবাসা থাকবে না।এতে না সানা ভালো থাকবে, না আমি ভালো থাকবো।
আমার কথা শুনে মা বললেন,
-আমার মন বলে সায়ানকে একথাটি তোর জানানো উচিত।ওর ও অধিকার আছে।বাকিটা তোর যা ভালো মনে করিস!আমি শুধু আমার মনের কথাটি বললাম।আর তুই সবসময় চিন্তামুক্ত থাকবি!
কারণ এই সময়ে মায়ের মানসিক চাপের কারণে বাচ্চাদের সমস্যা হয়ে থাকে।
আমি মুচকি হেসে বললাম,
-ঠিক আছে মা!আমি আপনার কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করবো।
আমার কথা শুনে মা কেঁদে ফেললেন!
আমি উনার চোখের জল মুছে দিলাম।
উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
-সব সময় তোকে পুত্রবধু কম মেয়ের চোখেই বেশি দেখেছি!আর আজকে আমার এই মেয়ের এ হাল আমি দেখতে পারছি না।আমার নষ্ট ছেলের কারনেই তোর এই হাল!আর তোর তো ঐ দজ্জাল বোন তো ওর সাথে আছেই।আমার ছেলে হীরাকে কাঁচ ভেবে ফেলে দিলো।দেখিস রে মা একারনে ও খুব পস্তাবে।ঐ সানা তো তোর নখেরও যোগ্য নয়।
আমি মায়ের কথাগুলো শুনে বললাম,
-ঐ সব বিষয়ে কথা বাদ দেন তো মা।আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
মা চোখে জল নিয়ে বললেন,
-হ্যা রে!তোর জন্য আর আমার অনাগত নাতি/নাতনী যেই হোক না কেনো তার জন্য আমার দোয়া সব সময় থাকবে।আর শোন যাদের জন্য তোর এই অবস্থা তাদেরকে উচিত শিক্ষা দিতে তোকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে।আর পারলে তোর জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়ার জন্য এই মাকে ক্ষমা করে দিস।
মায়ের কথা শুনে আমি বললাম,
-মা এসব কী বলছেন।আমাকে সব সময় মেয়ে হিসেবে দেখেছেন,ভালোবেসে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন তাহলে আবার মেয়ের কাছে মাফ কেন চাইছেন।আমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তা আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো।
আমার কথাগুলো শুনে মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-মারে আমার সাথে সব সময় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করিস। আর কোন ধরনের সমস্যা হলে আমাকে জানাস।
আর এই দোয়াটি সব সময় পড়তে চেষ্টা করিস!আল্লাহ তোকে সব সময় দ্বীনের পথে চলতে সাহায্য করবেন।এই দোয়াটি রাসূল (সা.) সবচেয়ে বেশি করতেন!
.
রাসূল (সা.) এর অন্যতম জ্ঞানী স্ত্রী উম্মু সালামাহ (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “রাসূল (সা.) যখন আপনার কাছে থাকতেন তখন কোন দু’আটি অধিক পরিমাণে করতেন?”
উম্মু সালামাহ (রা.) বলেন, বেশিরভাগ সময় তিনি এই দু’আ করতেন, “ইয়া মুক্বাল্লিবাল ক্বুলূব, সাব্বিত ক্বালবী ‘আলা দীনিকা”
.
অর্থাৎ, হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অবিচল রাখো।
[তিরমিযি, রিয়াদুস সালিহিন, হাদিস নং ১৪৮৯, হাদিসটি হাসান তথা ভালোমানের]
.
দু’আটির আরবি পাঠ :
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْب، ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلٰى دِيْنِكَ
।
দু’আটির অর্থটি খেয়াল করেছেন? অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের জন্য। কারণ আমাদের অন্তর খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায়। হাদিসে এসেছে, “অন্তরের উদাহরণ হলো একটি পাখির পালকের ন্যায়, যা গাছে ঝুলন্ত আছে। আর বাতাস সেটিকে এদিক-সেদিক ঘুরাচ্ছে।” (সহিহ আল জামি’, হাদিস নং ২৩৬৫)
.
একসময় তাহাজ্জুদ রেগুলার পড়া অনেক ব্যক্তিই এখন ফরয নামাযটাও পড়ে না। পাজামা-পাঞ্জাবি, টুপি-দাড়িওয়ালা অনেককেই এখন হাফ প্যান্ট পড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
সুতরাং খুব সাবধান রে মা! তোর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো ঈমান আর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন (নিয়ামত) হলো হিদায়াত। এই হিদায়াত যে পেয়েছে সে ধন্য হয়ে গেছে। শয়তান তার সর্বশক্তি ব্যয় করে হিদায়াতপ্রাপ্ত মানুষকে পথভ্রষ্ট করে দিতে। অতএব এ ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধান থাকতে হবে। উপরের দু’আটি বেশি বেশি করে পড়বি। নির্দিষ্ট কোন নিয়ম দরকার নেই। যখন সুযোগই পাবি তখনই পড়তে চেষ্টা করবি।
আমি মায়ের কথায় সায় দিলাম।
পরিশেষে আমাকে আরো কিছু উপদেশ দিয়ে মা চলে যান।
মা বিদায় নেয়ার পর আমি আমার রুমে চলে যাই।রুমে গিয়ে মাগরীবের নামায আদায় করে রান্নাঘরে ভাবির কাছে গেলাম।ভাবিকে রান্নার কাজে সাহায্য করছিলাম।হঠাৎ ভাবি নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলেন,
-আচ্ছা সাফা তোর শাশুরী কী বললেন?তোর যাওয়ার ব্যাপারে কিছু কী বলেছেন?
আমি ভাবির দিকে তাকিঁয়ে বললাম,
-না ভাবি।মা কিছু বলার আগেই আমি বলেছি আমি ওখানে আর ফিরবো না।আমার সাথে যেনো উনি এবিষয়ে কোন জোড় না করেন।তাই মাও এবিষয়ে আর কথা বাড়ান নি।
ভাবি এ কথাটি শুনে মুখ কালো করে বললেন,
-পুরো জীবনটাই তোর পড়ে আছে।একবার ভেবে দেখ।তোর কথা না হয় বাদই দিলাম!কিন্ত তোর এই অনাগত সন্তানকে কার পরিচয়ে বড় করবি।আমাদের সমাজের
কিছু মানুষ কাউকে অকারণেই কষ্ট দিতে মজা পায়।
আমি স্লান হেসে বললাম,
-ভাবি এসবে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।আমার পরিবার থেকেও তো কত কথা শুনছি।আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ আছে যারা অন্যকে কষ্ট দিতে ভালোবাসে।
ওদের জ্ঞান এতই লোপ পায় যে দুনিয়াতে ওরা শুধু আনন্দই খুঁজতে থাকে হোক সেটা অন্য কে কষ্ট দিয়ে।
অথচ আল্লাহ বলেছেন:
“আর আমি সৃষ্টি করেছি দোযখের জন্য বহু জ্বিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত; বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হল গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।
(সূরা আল আরাফ: ১৭৯)”।
আজ আমাকে ওরা অপবাদ দিচ্ছে ঠিক আছে!তবে কাল যে ওদের সাথে আরো খারাপ কিছু ঘটবে না তার কী কোন নিশ্চয়তা আছে।কারণ ওরাও হয়তো জানে না আল্লাহ বলেছেন:
“তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না।(সূরা আল বাকারা: ৪২)”
ন্যায়বিচারেও কিন্ত এসব দেখা যায় না।
“” হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।
(সূরা আন নিসা: ১৩৫),,
রান্নার কাজ শেষ হলে আমি চলে আসছিলাম এমন সময় ভাবি বললেন,
-তোর ভাইয়া ফোন দিলেই তোর কথা জিগ্যেস করেন!তোর ওখানে ফিরে যাওয়ার কথাও বলেন!
আমি উনাকে তোর বিষয়ে চিন্তা করতে মানা করি।একে-তো প্রবাসে থাকেন!তার উপর ওখানে কত কাজ এসব নিয়ে চিন্তা করার কোন মানেই হয় না।
আমি নিরবে ভাবির সবকথা শুনলাম।
আমার নিরবতা দেখে ভাবি বললেন,
-তুই আবার আমাকে বা তোর ভাইয়াকে খারাপ ভাবিস না !তোর জীবন তুইই ভেবে দেখ!নিজে বাঁচি না নিজের জ্বালায়!তোর কথা ভাবার সময় আমাদের আছে নাকি!
ভাবির কথা উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে আসি।খুব অসহায় লাগছে।কী করবো,কোথায় যাবো চিন্তা করে কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না।আজকাল ভাবিও আমাক বিভিন্নভাবে কথা শোনাচ্ছে।ভাইয়াও তো একবার আমার সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না।বিয়ে দিয়েই যেনো ওরা আমাকে পর করে দিয়েছে।ভাবি তো পরের মেয়ে নিজের ভাইয়ের এরকম ব্যবহার মেনে নেয়া যায় না।কথাগুলে ভেবে
আমার খুব অস্থির লাগছে,কান্না পাচ্ছে। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে ওজু পড়ে নামাযে দাড়ালাম।একমাত্র আমার আল্লাহর সান্ন্যিধ্যই পারে আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে।
।
।
চলবে ইনশাআল্লাহ