#শৈবলিনী—৪৪
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★কারোর অনবরত ডাকে চোখ মেলে তাকালো নূর। চোখ খুলে রেহনুমাকে দেখে একটু হকচকিয়ে উঠে নড়েচড়ে সোজো হয়ে বসলো। রাতে ফ্লোরে বসে কাঁদতে কাঁদতে কখন দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়ালই নেই। এখন এভাবে রেহনুমার সামনে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। রেহনুমা চিন্তিত মুখে বললেন,
–কি হয়েছে বৌমা? এভাবে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছ কেন? আর আদি কোথায়?

রেহনুমার কথায় নূর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিত্য নেই। তবে কি লোকটা সারারাত আর বাড়ি ফেরেনি? এখন রেহনুমার প্রশ্নের কি উত্তর দিবে সে? অপ্রস্তুত ভাবে এদিক ওদিক নজর লুকাতে লাগলো নূর। রেহনুমা নূরের গালে আঙুলের দাগ দেখতে পেল। ফর্সা গালে কালো হয়ে আছে একেবারে। এটা কি তার ছেলের কাজ! কিন্তু আদিতো এমন ছেলে না।নিশ্চয় গুরুতর কিছু হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পেরে নূরকে ধরে উঠিয়ে বিছানায় বসালো রেহনুমা। গ্লাসে পানি ঢেলে নূরকে খেতে বললো। নূরের সত্যিই অনেক গলা শুঁকিয়ে ছিলো। তাই সাথে সাথেই খেয়ে নিলে সে। নূরকে পানি খাওয়ানো শেষে রেহনুমা নূরের হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল,
–কিছু মনে না করলে তোমাকে কিছু কথা বলতাম।

নূর বিনয়ী সুরে বলল,
–জি বলুন না।

–দেখ আমি জানি তুমি আমাকে হয়তো ভালো মনে করোনা। আর এরজন্য দায়ীও আমি। পূর্বে অনেক ভুল করেছি আমি। সবসময় শুধু ছেলে মেয়েই ভুল করে না। অনেক সময় মা বাবাদেরও ভুল হয়। আর এক্ষেত্রে ভুল আমার। যে কারণে আমার এক ছেলে বিপথে গিয়েছিল। আর আরেক ছেলে ছোট ভাইয়ের কর্মের ফল ভোগ করছিলো। আমি জানি সেদিনের জন্য তুমি আদিকে দোষী ভাবো। কিন্তু আসলে ওর কোনো দোষই নেই। ও তো শুধু শুধু শাস্তি পাচ্ছে। সেদিন যখন আদি আদ্রর ব্যপারে জানতে পারলো তখন প্রায় আদ্রকে মেরেই ফেলে ও। তখনই পুলিশের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল ওকে। কিন্তু আমার জন্য পারেনি। আমিই বা কি করতাম। মা যে আমি। সন্তান যেমনই হোক তাকে মরতে তো আর দিতে পারিনা। তাই আমি আদিত্যকে বাধ্য করেছিলাম তার সিদ্ধান্ত পাল্টাতে। আমার কারণে ও রাজি ওদের বিয়ে দিতে। কিন্তু তারপরই আমার ছেলেটা আমাদের উপর রাগ করে বাড়ি ত্যাগ করে। পরিবার ছেড়ে গত আট টা মাস ধরে সে বনবাস কাটছিলো। তোমাকে ছেড়ে ওর জীবন নিঃসঙ্গ মরুভূমি হয়েছিল। বেঁচে থাকা ভুলে গিয়েছিল ছেলেটা। বিনা দোষে এতদিন শাস্তি পাচ্ছিল সে। তাই তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমার ছেলেটাকে শাস্তি দিওনা। শাস্তি দিতে চাইলে আমাকে দাও। তবুও ওকে তুমি মেনে নাও। তোমাকে পেয়ে ছেলেটা আবারও বাঁচতে শুরু করেছে।

বলতে বলতে কেঁদে দিলো রেহনুমা। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো নূর। চোখের পানি তারও টলমল করছে। এসব কি বলছেন উনি? উনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ওই ম্যানেজারের কথা কি ছিলো? তবে কি আমি সত্যিই উনাকে ভুল বুঝলাম? এর মাঝে কি অন্য কাহিনি আছে? রেহনুমা নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
–যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি দেখি আদি কোথায়।
বলে রেহনুমা উঠে গেল। নূরের মন ভীষণ অশান্ত হচ্ছে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে ওর। চোখের সামনে সব গোলগোল ঘুড়ছে। এই গোলকধাঁধা তো সলভ করতেই হবে। নাহলে কোনোকিছু ক্লিয়ার হবে না। আর কীভাবে এটা বের করতে হবে তা জানা আছে নূরের। নূর চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হয়ে নিজের গন্তব্যে রওয়ানা হলো। সেই ডিসকো ক্লাবে এসে পৌঁছাল সে। দিনের বেলায় বন্ধ থাকলেও কর্মচারীরা থাকে তাই নূর সোজা সেই ম্যানেজারের কাছে গেল। ম্যানেজার নূরকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল। নূর সোজা ম্যানেজারের সামনে এসে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–আপনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন সেসব কথা কি সত্যিই? নাকি মিথ্যে বলিছিলেন? মিথ্যে বলে থাকলে কেন বলেছিলেন? সব সত্যি সত্যি বলুন।

ম্যানেজার আমতাআমতা করে বলল,
–কি বলছেন এসব? মিথ্যে কেন বলতে যাবো? সব সত্যি বলেছিলাম।

নূর এবার তার আসল রুপে এলো। ম্যানেজারের এক হাত ধরে পিঠে মুচড়ে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে চোয়াল চিবিয়ে বলল,
–সত্যি বলেছিস তাইনা? ভালোই ভালোই আসল সত্যি বল। নাহলে আজকের পর কিছু বলার যোগ্য থাকবিনা। বল সত্যি কি?

ম্যানেজার নিজের জান বাঁচাতে বলে উঠলো,
–বলছি, বলছি আগে ছেড়ে দিন প্লিজ।

নূর ছেড়ে দিলো। লোকটা বলতে লাগলো,
–আসলে ওসব কথা আমি মিথ্যে বলেছিলাম। আদিত্য স্যার এমন কিছুই করেনি। তিনিতো সেদিন আমাকে একা আলাদা নিয়ে গিয়ে উল্টো হুমকি দিচ্ছিল যে,আমি যদি আপনাকে সিসিটিভি ফুটেজ না দেখায় তাহলে আমাকে অনেক মারবেন। সেই ভয়েই তো আপনাকে ফুটেজ দেখিয়ে ছিলাম।

সত্যের ছুড়ি মুহুর্তেই নূরকে ঝাঁঝরা করে দিলো। স্তম্ভিত, হতবিহ্বল হয়ে গেল সে। শরীর যেন অসার হয়ে এলো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছেনা সে। নিজেকেই আজ দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি মনে হচ্ছে। ও কীভাবে অন্যের কথায় ওর আদিত্য, ওর মিঃ নায়ককে ভুল বুঝতে পারলো। আদিত্য ঠিকই বলেছে আমি আসলেই ওর ভালোবাসার যোগ্য না। নূর এবার অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো ম্যানেজারের দিকে। দুই হাতে কলার চেপে ধরে বলল,
–কেন বলেছিস মিথ্যে? কে বলেছিল তোকে মিথ্যে বলতে? বল?

ম্যানেজার ভয়ে ভয়ে সামাইরার নাম বলে দিলো। নূরের সব ক্রোধ এবার একসাথে জমলো সামাইরার উপর। ম্যানেজারকে ছেড়ে সে এবার রওয়ানা হলো সামাইরার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিশ মিনিট পরই সে সামাইরার বাড়িতে এসে উপস্থিত হলে। ভাগ্যক্রমে সামাইরাকে বাড়িতেই পেয়ে গেল।নূরকে দেখে কিছুটা অবাকই হলো সামাইরা। সে জানতে চাইলো নূরের আগমনের উদ্দেশ্য।কিন্তু তাকে দেখেই নূরের ক্রোধ সীমা ছাড়িয়ে গেল। সে সোজা গিয়ে সামাইরার চুলের মুঠি ধরে সোফার উপর হাতলের উপর সজোরে বারি মেরে দিলো। সামাইরার বাড়ির লোক ঠেকাতে চাইলে নূর টি টেবিলে থাকা ফল কাটা চা,কু,টা নিয়ে সামাইরার গলায় তাক করে সবাইকে হুমকি দিলো, কেউ যদি এগিয়ে আসে তাহলে সামাইরাকে মেরে দিবে।সবাই ভয়ে আর এগুতে পারলোনা। নূর সামাইরার মাথা সোফার সাথে চেপে ধরে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
–আমার আর আদিত্যর মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে তুই কি ভেবেছিলি আমি কখনো জানতে পারবোনা? নিজেকে কি ভাবিস তুই? এই চেহারার দমেই ফেমাস হয়েছিস না? আমি চাইলে এখুনি তোর এই চেহারা ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারি। তবে আমি তা করবোনা। কারণ কি জানিস? কারণ আমি তোর মতো নিকৃষ্ট না। আর দ্বিতীয়ত এতে তোর থেকে বেশি দোষ আমার। কারণ আমি আমার আদিত্যকে অবিশ্বাস করেছি। অন্যের কথায় তাকে ভুল বুঝেছি। তাই এবারের মতো ছেড়ে দিলাম তোকে। তবে একটা কথা মাথায় ভালো করে গেঁথে নে। আর কখনো যদি আমার আর আদিত্যর মাঝে কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট করতে এসেছিস তাহলে মনে রাখিস, আজ যে কাজ অসম্পূর্ণ রাখলাম সেদিন সেটা পূর্ণ করে দিবো। জানের ভয় থাকলে আর আমার সামনে নিজের এই কুৎসিত মুখ দেখাবিনা।
বলেই চা,কু ফেলে দিয়ে বেড়িয়ে গেল নূর। বেচারি সামাইরা নিজের জান হাতে পেয়েছে এটাই অনেক।

সামাইরার বাড়ি থেকে নূর কীভাবে বাড়ি ফিরে এলো সেটা নিজেও বলতে পারবেনা নূর। বাসায় এসে দেখলো আদিত্য এখনো ফেরেনি। অপরাধবোধ তার গলা চিপে ধরলো। নূর দৌড়ে নিজের রুমে এসে ফ্লোরে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুই হাতে নিজের দুই গালে ইচ্ছেমতো চড়াতে লাগলো সে। নিজেকে এইমুহুর্তে সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি মনে হচ্ছে। নিজেকে খু,ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওর। কীভাবে পারলো ও? কীভাবে পারলো আদিত্যকে অবিশ্বাস করতে? এতটা মাস ওকে বিনা দোষে শাস্তি দিলো। কতো কথা শুনিয়েছে ওকে। আর কাল! ছিহহ্! কীসব জঘন্য কথা শুনালাম ওকে!কষ্ট পেয়ে নাজানি কোথায় চলে গেছে। যার শুরু থেকে শেষটাই শুধু আমাকে ঘিরে তাকে আমি কীভাবে এতো জঘন্য কঠোর বাক্য বলতে পারলাম? কীভাবে! কীভাবে! কীভাবে! কতো খারাপ আমি। আদিত্য ঠিকই বলেছে, আমি আসলে ওর ভালোবাসার যোগ্যই না। ওর সীমাহীন ভালোবাসার পরিবর্তে শুধু আঘাত ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনি। কতো কষ্ট দিয়েছি আমি ওকে। এখন কি করবে ও? কীভাবে ঠিক করবে সব? আদিত্য কি ওকে কখনো ক্ষমা করবে? কাল যা করলাম, তারওপর ও যদি জানতে পারে আমি সামাইরার কারণে ওকে ভুল বুঝেছিলাম তাহলে নিশ্চিয় আমার মুখও দেখতে চাইবেনা ও। এটাই ডিজার্ভ করি আমি। এটারই যোগ্য তুই নূর। আদিত্যর ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দেওয়ার এরচেয়ে আরও কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার আমার।

হাঁটুর ভেতর মুখ গুঁজে কাঁদছে নূর। হঠাৎ দরজায় নক পড়লো। নূর তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে আগমনকারীকে ভেতরে আসতে বলল। দরজা ঠেলে শিখা ভেতরে ঢুকলো। ঢুকতে ঢুকতে হাসিমুখে বলল,
–কিরে মিসেস সাদমান শাহরিয়ার আদিত্য! একা একা বিয়ে করে ফেললি! একবারও এই বন্ধুকে জানালিনা! কিন্তু আমি তোর মতো পাষাণ না। দেখ ঠিকই তোর খবর নিতে চলে এলাম।

শিখাকে দেখে নূর আবেগপ্রবণ হয়ে গেল। সে দৌড়ে গিয়ে শিখাকে জড়িয়ে ধরে আবারও কেঁদে উঠলো। শিখা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
–কিরে, কাদছিস কেন? কি হয়েছে?

নূর কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছিরে শিখা। ভুল না, পাপ করেছি আমি। মিঃ নায়ককে কষ্ট দেওয়ার মতো ভয়াবহ পাপ করে ফেলেছি। আমি কীভাবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো? আমার ম,রে যেতে ইচ্ছে করছে।

–হুঁশশ, শান্ত হ আগে। কান্না থামা।
শিখা নূরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নরম সুরে বলল,
–কান্না থামা এখন। আর ঠিক করে বল কী হয়েছে?

নূর কোনোরকমে নিজের কান্নার রেশ কমিয়ে শিখাকে সব খুলে বলল। সব শুনে শিখা বলল,
–আমি আগেই বলেছিলাম তোকে নূর। আদিত্য ভাইয়া এমন লোক না। তুই ভুল বুঝছি। কিন্তু তুইতো আমার কথা শুনতেই চাইলিনা তখন। আর রাগ উঠলে তো তোর হুঁশই থাকেনা।

–কারণ আমি যে খারাপ মানুষ। তাইতো সৌভাগ্যকে পায়ে ঠেলে দিয়েছি। এখন আমি কী করবো শিখা? উনিতো আমাকে এখন ঘৃণা করবে। আমাকে যদি তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেয় তাহলে কী করবো আমি? উনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবোনা আমি। গত আটটা মাস উনাকে ছাড়া কীভাবে বেঁচে ছিলাম তা শুধু আমি জানি। আবারও সেই যন্ত্রণা পোহাতে পারবোনা আমি। উনাকে ছাড়া ম,রে যাবো আমি শিখা।

–শান্ত হ, এমন কিছুই হবেনা। ভুল যখন করেছিস৷ সেটাকে শুধরানোর দায়িত্বও এখন তোর। আদিত্য ভাইয়া যতোই রেগে থাকুক। কিন্তু তোকে ছাড়া সেও থাকতে পারবেনা। তুই নিজের ভুল স্বীকার করে ভাইয়ার কাছে মাফ চা।একবার না মানলে বারবার চেষ্টা কর। দেখবি একসময় ভাইয়া তোকে ঠিকই মাফ করে দিবে।

–সত্যিই বলছিস! মাফ করে দিবে আমাকে! হ্যাঁ মাফ চাইবো আমি। দরকার হলে উনার পায়ে পড়ে মাফ চাইবো। উনি যে শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো। তবুও তাকে মানিয়েই ছাড়বো। আঘাত যখন আমি দিয়েছি সেটা ঠিকও আমিই করবো। তারজন্য যা করতে হয় করবো আমি।

–দ্যাটস লাইক মাই গার্ল। এখন কান্না কাটি বন্ধ করে নিজেকে একটু পরিপাটি কর। নাহলে ভাইয়া তোকে দেখেই ভয়ে পালিয়ে যাবে।

নূর অশ্রুভরা চোখে হালকা হাসলো। তারপর বলল,
–তুই বস, আমি তোর জন্য চা আনছি ।

–আরে না, তার দরকার নেই। আমি চলে যাবো। আসলে সকালে জিদান আদিত্য ভাইয়ার কাছেই আসছিল। তাই আমাকেও নিয়ে আসতে বললাম। তোকে একটু দেখে যাবো এজন্য। এখন আমি একটু মায়ের বাসায় যাবো। আসি এখন। ভালো থাকিস।
__

রাত বারোটা বাজে। আদিত্য এখনো ফেরেনি। নূর অনেক বার ফোন করেছে কিন্তু ফোন ধরেনি আদিত্য। উল্টো ফোন বন্ধ করে রেখেছে। এতে খুব একটা অবাক হয়নি নূর। কালকের পর এমন ব্যবহারই স্বাভাবিক। নূর পরে জিদানের কাছে ফোন শুনেছে, আদিত্য নাকি শুটিংয়েই ব্যস্ত আছে। পাঁচ দিনের কাজ নাকি সে আজকেই করবে তাই জানিয়েছে। এসব যে আদিত্য বাড়ির বাইরে থাকার জন্য করছে তা বুঝতে পারছে নূর। ব্যাপার না,একবার শুধু ফিরে এসো মিঃ নায়ক। আমি আপনার সব রাগ ভাঙ্গিয়ে দেবো। আর কখনো কষ্ট দেবোনা, আই প্রমিজ। ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবো। শুধু একবার ফিরে আসুন। ডিভানে হাঁটু ভাজ করে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে আদিত্যর অপেক্ষায় বসে বসে এসব ভাবছে নূর। সারাদিন কিছু খায়নি সে। বাড়ির লোক বারবার খেতে বললেও সে খায়নি। কারণ সে জানে, আদিত্যও নিশ্চয় মনের কষ্ট নিয়ে না খেয়ে আছে। আদিত্য ফিরলে তার সাথে খাবে এমনটাই আশা করে বসে আছে নূর। যদিও তার ভয় হচ্ছে আদিত্য আদও ওকে মাফ করবে কিনা।

বসে থাকতে থাকতে রাত একটাও পার হয়ে গেল। আদিত্যর এখনো আসার নাম নেই। ঘুমের ভারে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছে নূর। তবুও নিজেকে আবার জাগনা রাখার চেষ্টা করছে। তাকে যে ঘুমিয়ে পড়লে চলবেনা। রাত প্রায় পনে দুইটার দিকে আদিত্য বাড়ি ফিরলো। ক্লান্ত, ভারাক্রান্ত আর বিষন্ন মনে দরজা খুলে রুমে ঢুকলো সে। নূর বসে বসে ঝিমচ্ছিল। দরজা খোলার শব্দে হকচকিয়ে উঠলো সে। আদিত্যকে দেখতে পেয়ে ঠোঁটে তার অনাবিল প্রশান্তিময় খুশির ঝলক দেখা গেল। ঝট করে দাঁড়িয়ে আদিত্যর দিকে এগিয়ে যেতে নিলে আদিত্য নূরকে পুরোপুরি ইগনোর করে দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। যেন নূরকে তার চোখেই পড়েনি। আদিত্যর উপেক্ষা নূরকে কষ্ট দিলেও তা হাসির আড়ালে হজম করে নিলো সে। এখনো যে ওকে অনেক কিছু সইতে হবে। আদিত্যকে দেওয়া কষ্টের সামনে এটাতো কিছুই না। আদিত্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে হাতের ঘড়ি খুলতে লাগলো। নূর সেদিকে তাকাতেই খেয়াল করলো আদিত্যর হাতে ব্যান্ডেজ। নূর আৎকে উঠে দ্রুত আদিত্যর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে উদ্বীগ্ন কন্ঠে বলল,
–এটা কি হয়েছে আপনার হাতে? কীভাবে হলো এটা?

আদিত্য নূরের দিকে না তাকালো,না তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো। সে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে চলে যেতে লাগলো। কিন্তু যেতে দিলোনা নূর। আদিত্যর অন্য হাতটা নিজের দুই হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরলো। হাতটা ধরে কান্না জড়িত,অপরাধী কন্ঠে বলল,
–আমার ভুল হয়ে গেছে মিঃ নায়ক।অনেক বড়ো অপরাধ করে ফেলেছি আমি। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। প্লিজ মাফ করে দিন আমাকে। প্লিজ কথা বলুন আমার সাথে। দরকার হলে শাস্তি দিন আমাকে। মারুন, বকুন যা খুশি করুন।চাইলে আ,গু,নে পুড়িয়ে দিন। আমি টু শব্দ করবোনা। তবুও এভাবে চুপ করে থাকবেন না প্লিজ। আপনার নিরবতা সইতে পারছিনা আমি৷ প্লিজ মাফ করে দিন আমাকে। কথা বলুন আমার সাথে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ…
বলতে বলতে আদিত্যর হাত ধরেই ফ্লোরে বসে পড়লো নূর। আদিত্যর হাতটা নিজের কপালে ঠেকিয়ে বারবার কাঁদতে কাঁদতে করুণার স্বরে আদিত্যর কাছে মাফ চাইতে লাগলো। কিন্তু আদিত্যর মাঝে কোনো ভাবান্তর হলোনা। সে নূরের দিকে তাকিয়েও দেখলোনা। শক্তি প্রয়োগ করে ঝট করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কাবার্ড থেকে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। নূর ওখানেই বসে বসে মুখে হাত চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো। আদিত্য কি সত্যিই কখনো মাফ করবেনা ওকে?

কিছুক্ষণ পর আদিত্য বেরিয়ে এলো ফ্রেশ হয়ে। নূর দ্রুত চোখের মনি মুছে উঠে দাঁড়াল। আদিত্যর পেছন গিয়ে বলল,
–আপনার খাবার হটপটে রেখে দিয়েছি। চলুন খেয়ে নিবেন।

আদিত্য আবারও কোনো প্রতিত্তোর করলোনা। বিছানার কাছে গিয়ে একটা বালিশ আর একটা চাদর হাতে নিয়ে দরজার দিকে যেতে লাগলো। নূর কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরে বলল,
–কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

আদিত্য জবাব না দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। নূর এবার আদিত্যকে ঠেকাতে দৌড়ে এসে পেছন থেকে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরলো। স্থির হয়ে গেল আদিত্য। নূর দুই হাতে পেছন থেকে আদিত্যর পেট পেঁচিয়ে ধরে পিঠে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলতে লাগলো,
–প্লিজ এভাবে যাবেন না আমাকে ছেড়ে। মাফ করে দিন প্লিজ। শুধু একটা বার মাফ করে দিন। এরপর আপনি যা বলবেন তাই করবো। আপনার কোনো কথার অবাধ্য হবোনা। একদম না। প্লিজ এভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। প্লিজ,প্লিজ…

নূরের আকুতি মিনতি আদিত্যর মন গলাতে পারলোনা। শক্ত পাথরের মতো সে নূরের হাত দুটো ছাড়িয়ে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো। ঝোঁক সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে গেল নূর। আদিত্য পেছনে না তাকিয়ে দরজার বাইরে বেড়িয়ে গেল। নূর দ্রুত উঠে আদিত্যকে ডাকতে ডাকতে ওর পেছন পেছন দৌড়াল। আদিত্যকে পাশের গেস্ট রুমে ঢুকতে দেখে নূরও সেদিকে যেতে নিলো। কিন্তু দরজা পর্যন্ত আসতেই ভেতরে ঢোকার আগেই আদিত্য ঠাসস করে নূরের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো৷ নূর দরজা চাপড়ে আদিত্যকে বারবার ডাকতে লাগলো। ডাকতে ডাকতে একসময় দরজা ঘেঁষে বসে পড়লো নূর। বসে থেকেই দরজা চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
–প্লিজ, এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবেন না মিঃ নায়ক ।দরজা খুলুন। কথা বলুন আমার সাথে। শাস্তি দিন আমাকে। তবুও এভাবে আলাদা করে দিয়েন না আমাকে। খুলুন প্লিজ…
ভেতর থেকে কোনো সারাশব্দ এলো না। নূর ক্লান্ত শরীরে ওখানেই দরজায় হেলান দিয়ে বসে রইলো। আদিত্যকে বুঝি সত্যিই হারিয়ে ফেলল সে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here