#শৈবলিনী—৩৬
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★আজ জিদান আর শিখার বিয়ে।রঙবেরঙের লাইটিং আর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে। মেহমান একে একে আসা শুরু করেছে।জিদান আর শিখা বর বঁধুর আসনে বসে আছে। জিদান আর শিখা দুজন তাদের নিজ নিজ প্রিয় ব্যাক্তির অপেক্ষা করছে। জিদান অপেক্ষা করছে তার আদিত্য স্যারের আর শিখা অপেক্ষা করছে ওর প্রিয় বান্ধবী নূরের। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এলো সবাই। প্রথমে নূর এলো ওর পরিবারের সাথে। শিখা খুশি হয়ে নূরকে ডাকলো কাছে। গিয়াস আগেই এসেছিল। বন্ধুদের সাথে ছবি তোলার জন্য গিয়াসকেউ ডাকলো শিখা। গিয়াস ওদের কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে শিখার দিকে ঝুঁকে বলল,
–কিরে শিখাইয়া,শেষমেশ জদু মিঞার কদু হইয়াই গেলি। কি ঝাক্কাস জুটি হইছে তোগো। হাফ আবালের বর হবে ফুল আবাল।রতনে রতন চেনে,আর আবালে চেনে আবাল। বাহ! নজর না লাগে আমগো জাতীয় আবাল জুটির। জদু মিঞা আর কদু মিইল্লা যেইডা পয়দা করবি ওইটা হইবো আলু মিঞা।
বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো গিয়াস। শিখা ওর দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে বলল,
–খালি সামনে ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে দেখে বেঁচে গেলি। নেহাৎ ছবি খারাপ হওয়ার ভয় না থাকলে আজকে তোকে ওই খাবারের বোরহানির ভেতর ঢেলে মিক্সড করে ফেলতাম। এখন এই গু মার্কা দাঁত বের করে হাস। ছবি উঠবো আমরা।
এদের কান্ড দেখে হাসলো নূর। এরা আর সুধরালো না। ছবি তোলা শেষে গিয়াস এবার নূরের দিকে তার স্পেশাল কমেন্ট ছুড়লো। নূরের পোশাকআশাক দেখে সে বলল,
–কীরে ডাইনোসরের শাশুড়ী, তুই কী ডাব্লিউ ডাব্লিউ রেসলিং ম্যাচ থেকে সোজা এইখানে টপকালি? বিয়ে বাড়িতে তো কমছে কম একটু মাইয়া সাইজা আইতি। নাকি মাইয়া সাজতে তোরে ডাক্তারে মানা করছে? আরে অন্য মাইয়াগো দেখ। বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা শুনলে হয়। একবছর আগ থেকে সাজা শুরু করে। পারলে মেকআপের ফ্যাক্টরিতে ঢুইকা পড়ে। যেন এইডা বিয়া বাড়ি না, মিস ইউনিভার্সের প্রতিযোগিতা হইতাছে। আর এক তুই। জিন্স আর কুর্তিতে চইলা আইছোস। আরে এহনতো তোর টাকাও আছে তাও এতো কিপ্টামি করস ক্যা? সত্যি বলছি, নারীজাতি তোকে তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করে দিবে।
নূর বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুই কি টায়ার্ড হসনা? সবসময় এতো ফালতু কথা কীভাবে বলতে করিস?
গিয়াস গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
–এটাতো আমার ট্যালেন্ট। এসব নিয়ে কখনো অহংকার করিনি।
গিয়াসের বলার ভঙ্গি দেখে নূর না হেসে পারলোনা। আর বরাবরের মতোই এই ভুল সময়েই এন্ট্রি আদিত্যর। আদিত্য আর আবির একই গাড়িতে এসে পৌঁছাল। আর আসতেই নূর আর গিয়াসের ওই হাসাহাসির সীন দেখে ফুরফুরে মেজাজটা বিগড়ে গেল। বাহ! এতকিছুর পরিবর্তন হলো, শুধু এই আইটেমটার কোনো পরিবর্তন হলোনা। এটার তো আজ একটা উপায় করতেই হবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্টেজে উঠে এলো আদিত্য আর আবির। নূর গিয়াসের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত ছিলো, আদিত্যকে খেয়াল করেনি সে। হঠাৎ পাশে তাকিয়ে আদিত্যকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে। নূর জানতো আজ আদিত্য আসতে পারে, তাইতো সে আসতে চাইছিলোনা এখানে। কিন্তু না আসলে শিখা মনে কষ্ট পেত। তাছাড়া ওই লোকের জন্য আমি নিজেকে কেন আঁটকে রাখবো? তার থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না আমার। এমনটাই বলে নিজের মনকে বুঝ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে নূর। কারণ তার মন তার যুক্তির সাথে সহমত হচ্ছে না। আদিত্যর উপস্থিতি তার ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। বারবার আরচোখে তাকাচ্ছে নূর। আদিত্য আজ রয়াল ব্লু কালারের কোট প্যান্ট পড়েছে। না চাইতেও ওই সুদর্শন পুরুষের দিকে বেহায়া নজর চলে যাচ্ছে।
আদিত্য জিদান আর শিখাকে অভিনন্দন জানিয়ে পাশে নূর আর গিয়াসের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গিয়াসের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–তুমি গিয়াস না?
গিয়াস খুশিতে আটখান হয়ে নিজেকে পরিবেশন করে বলল,
–আপনি আমাকে চেনেন? ওয়াও, এটাতো ড্রিম কাম ট্রু ওয়ালা ব্যাপার হয়ে গেল।
আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
–হোয়াই নট,তোমাকে না চিনলে কি হয়? হায় মিঃ গিয়াস, নাইস টু মিট ইউ।
মিঃ গিয়াস!! এতো সম্মান! বেচারা গিয়াসের এতো সম্মানের ওভারডোজ পেয়ে ডায়রিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্য হাত এগিয়ে দিলো গিয়াসের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য। গিয়াসও উৎফুল্ল হয়ে হাত এগিয়ে দিলো আদিত্যর হাতের সাথে মিলানোর জন্য। যেই আদিত্য ওর হাত ধরে হ্যান্ডশেক করলো ওমনি ওর জান গলা দিয়ে ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্য এতো জোরে হাত চেপে ধরেছে যে বেচারা গিয়াসের হাত ক্রাশ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাথায় বেচারা চিৎকার করতে চেয়েও পারছেনা। ইজ্জতের মামলা বলে কথা। তবে গিয়াসের মুখভঙ্গি আর আদিত্যর মনোভাব দেখে নূর ঠিকই বুঝতে পারছে কি করতে চাইছেন উনি। নূর সিচুয়েশন সামলাতে বলে উঠলো,
–শিখা আপনাকে ছবি ওঠার জন্য ডাকছে। যান ওদিকে দাঁড়ান।
আদিত্য নূরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেড়ে দিলো গিয়াসের হাত। বেচারা গিয়াসের হাত একটুর জন্য শহিদ হয়নি। জীবনে আর কারোর সাথে হ্যান্ডশেক করবেনা সে। আদিত্য শিখার সাথে ছবি ওঠার জন্য ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অন্যপাশে আবিরও আছে। নূর স্টেজ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বাঁধা পেল সে। হঠাৎ আদিত্য নূরের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে এনে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
–কোথায় যাচ্ছ নূর! ফটো সেশন এখনো বাদ আছে যে। এতক্ষণ তো খুব হেঁসে হেঁসে ছবি তুলছিলে। এখন কি হলো?
নূর ভড়কে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–কি করছেন এসব? ছাড়ুন আমাকে।
নূর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে নিলে আদিত্য এবার এক হাতে নূরের কোমড় শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
–আঃ আঃ, নড়ে না নূরসোনা। ছবি খারাপ হয়ে যাবে।
নূর কটমটে চোখে তাকালো আদিত্যর পানে। ঠিক সেই সময়ই ফটোগ্রাফার ছবি ক্লিক করে নিলো। দুজনের এই ছোট্ট খুনসুটি মুহুর্ত ক্যামেরায় আবদ্ধ হলো। নূর আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে দ্রুত নেমে এলো স্টেজ থেকে। আদিত্য সেদিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
আজতো আবিরের লটারি লেগে যাওয়ার উপায়। চারিদিকে বাহারি রমনীর মেলা আজ। স্টার্টার,মেইন কোর্স,ডিজার্ট সব ধরনের নারীর ছড়াছড়ি। আজ জিদানের কিছু হোক না হোক আবিরের সময় রঙিন হবে এটা নিশ্চিত। সময় রঙিন করার উদ্দেশ্যে সে সিলেক্ট করলো একজনকে। ম্যাক্স প্রো আল্ট্রা লেভেলের স্টাইলিশ এক রমনীকে দেখলো সে। মিষ্টি কালারের শিফন জর্জেটের শাড়ি পড়েছে সে। ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো স্লিম কোমড়ের অংশ বের করে শাড়ি পড়েছে। সাথে স্লিভলেস ব্লাউজ তার হটনেসে আরও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই আগুনে হাত ছেঁকতে এগিয়ে গেল আবির। চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটার পাশে গিয়ে বসে বলে উঠলো,
–হ্যালো মিস, আপনি কী হার্টের ডাক্তার?
মেয়েটি থতমত খেয়ে বলল,
–নাতো,কেন?
আবির তার ফ্লার্টিং আন্দাজে বলে উঠলো,
–তাহলে আপনাকে দেখে আমার হার্টবিট থেমে গেল কেন? এইযে দেখুন না হার্ট চলছেনা।
আবির মেয়েটির হাত ধরে তার বুকের বামপাশে রেখে দেখালো। মেয়েটি হেঁসে দিয়ে বলল,
–আচ্ছা তাই? তো হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেলে আপনি এখনো বেঁচে আছেন কীভাবে?
–এটাতো আপনার কামাল। আপনার মতো মহীয়সী নারীর একটু সান্নিধ্য পাওয়ার অদম্য আশায় এই নির্জীব দেহে এখনো প্রাণ চলছে। এইযে আপনার হাত আমার বুকে ছুঁয়ে দিলো। এখন আমার সব ঠিক হয়ে গেছে। এমনি এমনিই কী আপনাকে হার্টের ডাক্তার বললাম।
মেয়েটি আহ্লাদী ভঙ্গিতে হেঁসে বলল,
–আপনি সত্যিই অনেক মজার লোক।
আবির দুষ্টু স্বরে বলল,
–এটাতো কিছুই না বিউটিফুল, একবার এই পেশেন্টের ডাক্তার হয়েই দেখোনা। তারপর দেখবে আরও কতো মজা দিতে পারি আমি। বাইদাওয়ে, বান্দাকে আবির রায়হান বলে। আর আপনার বিউটিফুল নামটা?
মেয়েটি মুচকি হেঁসে বলল,
–আমি রিয়ানা। মডেলিং এ চেষ্টা করছি। আর আপনি?
–এমনিতেতো ফ্যাশান ডিজাইনিং করি। তবে পার্ট টাইম মেয়েদের জন্য টিস্যু পেপারের কাজও করি। আপনি চাইলে আমাকে ইউজ করতে পারেন। আমাকে ইউজ ফেলে দিন। আমি মাইন্ড করবো না। নারীর সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ।
মেয়েটি আবারও হাসলো। আবির বাঁকা হেসে বলল,
–হাসি তো, ফাসি। ♬ মেরে পেয়ার কা রাস জারা চাখনা,ওই মাখনা ওই মাখনা…..
আহানা ওর পরিবারের সাথে মাত্রই এসেছিল। ভারী লেহেঙ্গা পড়ে হাঁটতে সময় লাগছিল ওর। বাকিরা আগে চলে গেছে। আর ও দুই হাতে লেহেঙ্গা ধরে আস্তে আস্তে আসছে। ভেতরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম আবিরের এই রাসলীলাই চোখে পড়লো তার। বিরক্তিতে মন মেজাজ তিক্ত হয়ে গেল। সব জায়গায় কেন এই লোকটাই সামনে পড়তে হয়? জাস্ট অসহ্যকর। বিরক্ত হয়ে আহানা চলে যেতে নিলেই আবির দেখে ফেললো তাকে। রিয়ানার কাছে এক মিনিট সময় নিয়ে, এসে দাঁড়াল আহানার সামনে। ভ্রু নাচিয়ে বিদ্রুপের সুরে বলল,
–কিরে ফ্রী খাবার খেতে এখানেও চলে এসেছিস? এতো হাবাতে কেনরে তুই? দেশের বাজারের এই মূল্য বৃদ্ধি আজ নির্ঘাত তোর কারণেই হয়েছে। খেতে খেতে দেশকে খালি করে দিয়েছিস একদম।
আহানা বিরক্তির সপ্তমে উঠে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
–আমিতো নাহয় খেয়ে খেয়ে দেশ খালি করেছি। কমছে কম আপনার মতো তো না, নিজের আর অন্যের ইজ্জত খালি করছি।
–বাহ! ডায়লগবাজি এন অল। নট ব্যাড। তা এমন সার্কাসের জোকার সেজেছিস কোন দুঃখে? যাত্রাপালা ছেড়ে কী এখন সার্কাস দল জয়েন করেছিস নাকি? ভালোই উন্নতি হচ্ছে তোর। জরিনা বানু থেকে প্রমোশন হয়ে এবার জোকার।
বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো আবির। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আহানার। রাগের বহিঃপ্রকাশ করে সে বলল,
–একটা খু,ন যদি মাফ হতো তাহলে আই সোয়্যার, আমার হাতে আপনার খু,ন নিশ্চিত ছিলো।
আবিরের নজর স্থির আহানার পানে। ইনটেন্স নজরে তাকিয়ে আহানার মুখের সামনে হালকা ঝুঁকে সে আমোদিত কন্ঠে বলে উঠলো,
–সত্যিই? তুই সত্যিই খু,ন করবি আমাকে? জানিস এটা হবে আমার লাইফের বেস্ট গিফট।অন্যদের কথা জানিনা তবে আমি তোকে এই খু,নের অনুমতি দিলাম। তুই যখন যেখানে মারতে চাস আমি চলে আসবো। আই প্রমিজ কেউ জানবেনা এই খবর। বল তাহলে কবে এই শুভ কাজ করতে চাস? কান্ট ওয়েট ফর দিস।
আহানা বুঝতে পারলো এই লোকের সাথে কথা বলা মানে নিজের মাথায় নিজে বারি মারা। তাই রাগে কড়মড় করতে করতে ধুপধাপ পা ফেলে সরে গেল সে। আবির বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,
–আই উইশ তুই এমন করতি আন্নি। আই সোয়্যার, জন্ম নেওয়া সার্থক হয়ে যেত আমার।
গিয়াসও এই সুবর্ণ সুযোগ মিস করতে চাচ্ছে না। লেগে আছে কাউকে না কাউকে পটানোর ধান্দায়। একটা মেয়েকে একা একপাশে বসে থাকতে দেখে নিজের লাক ট্রাই করতে লেগে পড়লো সে। মেয়েটির কাছে গিয়ে হাসিমুখে নিজেকে প্রেজেন্ট করে বলল,
–হ্যালো মিস,আমি গিয়াস। কনের বন্ধু। আর আপনি?
মেয়েটিও সৌজন্যতার খাতিরে বলল,
–জি ইরিন।
গিয়াস বেকুবের মতো দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
–ওয়াও, জি ইরিন। নাইস নেম। ভেরি আনকমন।
মেয়েটি বলল,
–না না জি ইরিন না, শুধু ইরিন।
–আচ্ছা, শুধু ইরিন। এটাও সুন্দর নাম।
–আরেহ, শুধু ইরিন মানে অনলি ইরিন।
–নাইস টু মিট ইউ, অনলি ইরিন।
মেয়েটা এবার ভীষণ বিরক্ত হয়ে আর নিজের নাম ঠিক করার প্রয়াস ছেড়ে দিলো। গিয়াস বলে উঠলো,
–বাইদাওয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফাইনাল ইয়ারে। আর আপনি?
–আমি মাসাজ পার্লারে কাজ করি।
–ওয়াও,দ্যাটস গ্রেট। মাসাজ তো আমারও নেওয়া দরকার। আমিও আসবো মাসাজ নিতে।
–জি না, এটা শুধু মেয়েদের জন্য। মেনস আর নট এলাউড।
–কেন? কেন? ছেলেরা আসতে পারবেনা কেন? সব জায়গায় ছেলেদের সাথে কেন এই অবিচার হয়? ছেলেরা গার্লস টয়লেটে যেতে পারবেনা, ছেলেরা মাসাজ নিতে পারবেনা তো যাবে কোথায় ছেলেরা?সরকার বলে ছেলে মেয়ে সমান অধিকার। অথচ ছেলেরা সব জায়গায় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন কি দুনিয়া ছেড়ে দেবো আমরা? এ কেমন বিচার?
মেয়েটা এবার চরম বিরক্ত হয়ে বলল,
–আপনি কি পাগল?
গিয়াস সিনেমাটিক ভঙ্গিতে মাথা হেলিয়ে মেলোড্রামা করে বলল,
–আজকাল কেউ সরল মনে হাসিমুখে দুই কথা বললেই লোক তাকে পাগলি বলে ম্যাডাম।
মেয়েটা এবার বিরক্ত হয়ে উঠেই গেল ওখান থেকে। গিয়াস ভাঙা মনে নূরের পাশে এসে বসে নূরের ওড়নার কোণা দিয়ে মিথ্যে চোখ মোছার অভিনয় করে নেকামো করে বলল,
–ইয়ার, সবসময় আমার সাথেই কেন এমন হয়? কি কমতি আছে আমার মাঝে?
গিয়াসের এই ড্রামা দেখে নূর হেঁসে পারলোনা। গিয়াস আরও দুঃখীয়ারি হয়ে নূরের কাঁধে মাথা হালকা করে এলিয়ে দিয়ে বলল,
–তুইও হাসছিস? তুইও আমার কষ্ট বুঝলিনা। আব মেরা কেয়া হোগা?
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখতে পেল আদিত্য। এবারে তার রাগ সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেল।কতবড় সাহস,আমার নূরের কাঁধে মাথা দেয়! আজতো এই নমুনাটার একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়বেই সে। শরীরের মাঝে রাগের তুফান জমিয়ে নিয়ে নূর আর গিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মুখে ফেক হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–আরে গিয়াস তোমার সাথে একটু কথা ছিলো আমার সাথে এসোতো।
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–ওর সাথে আবার কি কথা? যা বলার এখানেই বলুন।
–আরে এটা আমাদের ম্যান টু ম্যান টক। তোমার সামনে বলা যাবে না। চল গিয়াস।
বলেই এক হাতে গিয়াসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে নিয়ে যেতে লাগলো। গিয়াসও বেকুবের মতো খুশি খুশি আদিত্যর সাথে গেল। ভাবছে আদিত্য বুঝি ওকে বন্ধু ভাবছে। কিন্তু নূরের কাছে আদিত্যর ভাবসাব ঠিক মনে হচ্ছে না। আদিত্য কি করতে চাইছে তা বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে না ওর। তাই সেও ওদের দিকে এগিয়ে গেল। আদিত্য গিয়াসকে নিয়ে ছাঁদে চলে এলো। ছাঁদের কিনারায় নিয়ে যেতে যেতে শান্ত সুরে বলল,
–তুমি জানো গিয়াস, আমার না একটা বাজে অসুখ আছে। আমার প্রিয় জিনিস কারোর সাথে শেয়ার করতে পারিনা। সে যতোই আপন লোক হোকনা কেন। আমার ভীষণ রাগ হয়। রাগে মাথা ফেটে যায় আমার। আর আমার রাগ অনেক ভয়ানক। রাগ উঠলে আমি মানুষকে ছাঁদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেই। আর এখন আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নূর। তো বাকিটা তো তুমি বুঝতেই পারছ। তো বলো তুমি কী এই কম বয়সে ছাঁদ থেকে পড়ার অভিজ্ঞতা করতে চাও?
বেচারা গিয়াস আদিত্যর হুমকি বুঝতে পেরে আতঙ্কে অর্ধেক জান এমনিতেই বেড়িয়ে গেল ওর। ভয়ে আৎকে উঠে হঠাৎ গলা ছেড়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না শুরু করে দিলো। গিয়াসের এহেন কান্ডে আদিত্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। গিয়াস মরা কান্না করতে করতে বলল,
–এ্যাঁ…….মাম্মি……খেলমু না আমি। স্যার প্লিজ মাইরেন না আমারে। এখনোতো বিয়েই হলোনা আমার।
এসব আবোলতাবোল বলে কাঁদতে লাগলো সে। তখনই নূর ওখানে দৌড়ে এলো। গিয়াসকে কাঁদতে দেখে বলল,
–কী হচ্ছে এখানে? কি করেছেন আপনি ওর সাথে? শুধু শুধু ওকে কেন ভয় দেখাচ্ছেন আপনি?
নূরকে দেখে গিয়াস উঠে নূরের পেছনে লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–নূর প্লিজ বাঁচা আমারে। স্যারকে বলনা তুই আমার সাত জনমের বোইন লাগোস। চাইলে এখুনি রাখি বান্ধাই নে। দরকার হলে জাতির ভাই বানায় দে। তাও বাঁচা আমারে।
নূর গিয়াসকে বলল,
–তুই যা এখান থেকে। আমি দেখছি।
গিয়াস জান হাতে নিয়ে ছুটে পালালো ওখান থেকে। নূর আদিত্যর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–দেখুন নিজের পাওয়ার দেখানোর ইচ্ছে হলে গিয়ে রেসলিং ম্যাচে যোগ দিন। বেচারা বোকাসোকা গিয়াসের ওপর নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার দরকার নেই।
বলেই উল্টো ঘুরে চলে যেতে লাগলো নূর। কিন্তু তা হতে দিলোনা আদিত্য। আদিত্য নূরের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে ছাঁদের দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।নূরের দুই হাত দেয়ালের সাথে আঁটকে ধরে নূরের মুখের সামনে ঝুঁকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–কেন?খুব মায়া হচ্ছে বুঝি ওর জন্য? একদম উতলে পড়ছে মায়া। এতো মায়া ওর জন্য? দুনিয়ার সবার জন্যই তোমার মায়া উতলে পড়ে। শুধু এই আমিটাই তোমার চোখের কাটা তাইনা? আমার জন্য কোনো মায়া হয়না তাইনা?
নূর তপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
–মায়া ভালো মানুষের জন্য হয়। বেঈমান ব্যাক্তির জন্য না।
–আচ্ছা আমি নাহয় বেঈমান। তাহলে তুমি কি? তুমিতো সৎ মানুষ। তাহলে তুমি কেন মিথ্যে বললে? কেন সেদিন বললে আমাকে ভালোবাসনা? ছেড়ে যাওয়ার আগে অন্তত সত্যিটা বলারতো সাহস দেখাতে। তোমার কাছ থেকে মিথ্যের আশা করিনি।
নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–আশা নিরাশার কথা আপনার মুখে মানায় না। আর আমি আপনাকে কোনো মিথ্যে বলিনি। যা বলেছি সেটাই সত্যি।
আদিত্য নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কন্ঠে বলল,
–মিথ্যে,আবারও মিথ্যে বলছ তুমি। বাসো, অনেক বেশি ভালোবাসো। প্লিজ আজতো মনের কথাটা সত্যি করে বলো। জানি তোমাকে অনেক আঘাত করেছি। কিন্তু তারজন্য শাস্তিও তো কম দাওনি। আজ আটটা মাস হলো বিনা হৃদয়ে বেঁচে আছি আমি। এবারতো মাফ করে দাও আমাকে। মাফ না হয় নাই করলে। অন্তত সেই সত্যিটা তো বলো। যা শোনার পর মরে গেলেও আপসোস থাকবেনা।
নূরের বুকের মাঝে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চেপে রাখা অনুভূতিগুলো কান্না হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু না,আরও একবার এই লোকের মায়াজালে আবদ্ধ হবেনা সে। নূর নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–মনে হচ্ছে আপনি অনেক ভুল ধারণা পোষণ করছেন। আমি আজ আবারও বলছি, আপনি নিজেকে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভাববেন না। আপনি না আগে আমার জীবনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি ছিলেন আর না এখন আছেন। আপনি আমার জন্য শুধুই একজন সাধারণ ব্যক্তি। যার প্রতি কোনরকম অনুভূতিই কাজ করেনা। তাই না রাগ,না ঘৃণা আর না ভালোবাসার মতো কোনো অনুভূতি আছে আপনার জন্য। তাই এসব ভুল ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসুন। আর বারবার নিজেকে আমার সামনে ছোট করতে আসবেন না। আপনি হয়তো বিবেকহীন হতে পারেন। তবে আমার বিবেকে বাঁধে।
বলেই আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে আদিত্যকে হালকা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলো নূর।কিন্তু তার আগেই আদিত্য পেছন থেকে নূরের হাত টেনে ধরে নূরের পানে তাকিয়ে থেকে মায়াবী কন্ঠে বলল,
“আমি হয়তো এতটাও ভালো হতে পারনি যতটা তুমি চেয়েছ,
তবে এতটাও খারাপ না,যতটা তুমি নিজের মনে বানিয়ে নিয়েছ।”
আবারও সেই অসহনীয় কম্পন ঘটলো নূরের বুকের মাঝে। সে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল নূর।এই লোকের সামনে বেশিক্ষণ থাকলে সে আবারও নিজেকে ধরে রাখতে পারবেনা। ভেঙে গলে পড়বে। যা নূর কোনমতেই করতে চায়না।ছেড়ে এসেছি সেই গলি,যেখানে কখনো আপনার ছায়া ছিলো। ফেলে আসা গলিতে আর ফিরে যাবেনা নূর।
চলবে….