#শৈবলিনী—৩২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★শুভ্রতায় মুড়ে স্বপ্নময় ভেলায় চড়ে এলো এক স্নিগ্ধ সকাল। ঘুম থেকে জেগে জানালার পর্দা খুলে দিতেই শীতল দমকা পবন এসে লাগলো নূরের মুখাবয়বে। আজ প্রথম সকালটাকে এত সুন্দর লাগছে নূরের। তার কাছে এখন সবই সুন্দর লাগে। জানালার পাশে কাঠগোলাপ গাছটাতে একজোড়া শালিক বসে আছে। নূর আবেশিত মনে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। বুঝতে চাইলো তারা কী আলাপ করছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো নূর আজই প্রথম এই কাঠগোলাপ গাছটাকে খেয়াল করলো। এর আগে সে খেয়ালই করেনি যে,এটা কী গাছ। তার কাছে শুধুই একটা গাছ ছিলো যার ডাল-পালা, পাতা আছে। কিন্তু আজ নূরের রঙিন ভুবনে সব মনোরম বস্তুই তার চোখে দৃশ্যমান হচ্ছে। মন হারালে বুঝি এমনই হয়। নিজেকে কেমন হাওয়ায় ভাসমান মনে হয়। সে ভাসতে চায়, ভাসতে চায় তার মিঃ নায়কের সাথে। তার হাতে হাত রেখে ভেসে যেতে চায় অচীন দেশে। নূরের মোহময় ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কারোর চিৎকারের আওয়াজে ধড়ফড়িয়ে উঠলো নূর। খেয়াল করলো এটা অমালিয়ার কন্ঠ। নূর ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়ে গেল অমালিয়ার রুমে। সেখানে এসে দেখলো অমালিয়া বিছানার উপর থাকা ওর ফোনটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে কাঁপছে। নূর দ্রুত ওর কাছে গিয়ে অমালিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে বলল,
–কী হয়েছে লিয়া? চিৎকার করলি কেন? এভাবে ভয় পাচ্ছিস কেন, বল আমাকে?

অমালিয়া ভয় নূরের সাথে মিশে গিয়ে ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে ফোনের দিকে দেখালো। নূর ভ্রু কুঁচকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদিত্যর ছবি। ছবিতে তার পাশে একটা সুন্দর মেয়ে আর অন্য আরেকটা ছেলেও আছে। নূর ক্যাপশনের লেখা দেখে বুঝলো আদিত্যর ভাই বোন এরা। কোনো পার্টি থেকে তোলা ছবি।আদিত্যর ফেইসবুকে পোস্ট করা হয়েছে। ছবি দেখে নূর বলল,
–এটাতো মিঃ নায়কের ছবি। তুই এটা দেখে ভয় পাচ্ছিস কেন?

অমালিয়া আতঙ্কিত কন্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
–ও ও ওটাই সেই জা,নো,য়া,র,টা।

–মানে? কার কথা বলছিস তুই?

–ওইযে আদিত্যর পাশে যে ছেলেটা। ওই আমাকে সেদিন…….

আর বলতে পারলোনা অমালিয়া। কাঁদতে লাগলো সে। নূর স্তব্ধ হয়ে গেল। তারমানে সেই অপরাধী আর কেউ নয়, মিঃ নায়কের ভাই? মাথা ঘুরতে লাগলো নূরের। এ কেমন গোলকধাঁধা! আদিত্য যাকে খুঁজে বের করে আনার জন্য আমাকে ওয়াদা করেছে সেই অপরাধী কিনা ওরই ভাই! এক মিনিট, আদিত্য কি এসব আগে একবার জানে? সে কি জেনে শুনেই আমার সাথে খেল খেলছে? না না, কী ভাবছি আমি? আদিত্য এমন করতে পারে না। আমার বিশ্বাস আছে ওর ওপর। ও নিশ্চয় ওর ভাইয়ের কথা জানে না। জানতে পারলে সে অবশ্যই অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিবে। আমাকে দেওয়া ওয়াদা ভাঙবেনা সে। কিন্তু ভাইয়ের কথা জানতে পারলে কী সে তার ওয়াদা পূরণ করতে পারবে? অবশ্যই করবে। বিশ্বাস যখন করেছি তখন কোনো দ্বিমত রাখবোনা। আদিত্য ওর কথা অবশ্যই রাখবে। অন্যায়কারীকে সে নিশ্চয় ছাড়বেনা।আমি এখন কী পুলিশকে সব জানাবো? না না, আগে আমি নিঃ নায়ককে জানাবো।দেখি কী হয় উনার সিদ্ধান্ত। তারপর নাহয় পরের কার্যবিধি করা যাবে। নূর অমালিয়াকে কোনোরকমে শান্ত করে ওকে শুইয়ে দিয়ে বাইরে এলো।এসব কথা ফোনে বলা ঠিক হবে না।তাই আদিত্যকে মেসেজ করে বাসায় এসে দেখা করতে বলল নূর। হঠাৎ তখনই গ্যারেজ থেকে পল্টুর ফোন এলো। সে জানালো গ্যারেজে নাকি একটা ভেজাল হয়েছে। এক কাস্টমার এসে নাকি গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে ফেলেছে। নূরকে ইমার্জেন্সি যেতে হবে সেখানে। নূর তাই দ্রুত বেড়িয়ে পড়লো গ্যারেজের উদ্দেশ্যে। ভাবলো আদিত্য আসতে আসতে সে ভেজাল টা সেরে আসুক।

ঘন্টা দুই পরেই ফিরে এলো নূর। অনেক জলদি জলদি এসেছে সে। আদিত্য নিশ্চয় চলে এসেছে এতক্ষণে। তার সাথে দেখা করতেই দ্রুত এসেছে সে।এবং তড়িঘড়ি করে বাসার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল সেই কাঙ্ক্ষিত মানবটিকে। পেছন থেকে তাকে দেখতে পেয়েই ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো নূরের। তবে যখনই সে সামনে এগুতে নিলো। ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো। কারণ সোফায় শুধু আদিত্য একা বসে নেই। তার সাথে আরও কিছু লোক বসে আছে। আর তাদের সামনে নূরের মা আর ইভান বসা। কোনো অশুভ কিছুর আভাস হতে লাগলো নূরের। বুকের ভেতর টা কেমন ধুকপুক করতে লাগলো তার। সেটা আরও বৃদ্ধি পেল যখন সে সামনে এসে লোকগুলোর মুখ দেখতে পেল। নূর দেখলো আদিত্যর পাশের মহিলাটা আর কেউ নয় বরং সেদিনের সেই মহিলা। আদিত্যর মা তিনি, তা চিনতে এক মুহুর্তও সময় লাগলো না নূরের। আর উনার পাশে একজন ভদ্রলোক বসা, হয়তো আদিত্যর বাবা হবে। আর তার পাশে যে বসা আছে তাকে দেখতেই পায়ের র,ক্ত তড়াৎ করে মাথায় উঠে গেল নূরের। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ ক্রোধে ছেয়ে গেল। এই বা,স্টা,র্ড টার সাহস কী করে হলো এখানে আসার! রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নূর কাঁধের হ্যান্ডব্যাগ টা ছিটকে ফেলে তেড়ে গিয়ে দুই হাতে আদ্রর কলার চেপে ধরে টেনে তুলে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলতে লাগলো,
–ইউ ব্লাডি রে,পি,স্ট, তোর সাহস কী করে হলো এখানে পারা দেওয়ার! এখানে এসে তুই নিজের মৃ,ত্যু ডেকে এনেছিস। আজ তোকে আমি….

নূরের হঠাৎ আক্রমণে আদিত্য বাদে সবাই ঘাবড়ে গেল। আদিত্য মাথা নুইয়ে বসে আছে। আজ যে নূরের দিকে তাকানোর মুখ নেই তার। নূরকে আটকাতে লতিকা বেগম ছুটে এলো। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে সরিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলল,
–নূর, কী করছিস এসব! ছাড় ওকে।

নূর রাগী কন্ঠে বলল,
–মা, তুমি জানোনা এই বদমাইশকে। জানোনা ও কী করেছে। ওই সেই অপরাধী, যে আমাদের লিয়াকে…..

–জানি আমি।

কথার মাঝেই মায়ের এই বাক্যে থমকে গেল নূর। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সে মায়ের দিকে। বিস্মিত কন্ঠে বলল,
–জানো মানে? জেনে শুনেও তুমি ওকে বসিয়ে আত্মীয়র মতো কেন ট্রিট করছ? দাঁড়াও আমি এখুনি পুলিশকে ফোন করছি।

বলেই নূর ওর ফোন বের করে ফোন করতে নিলেই লতিকা বেগম আবারও আঁটকে দিলো তাকে। নূর অবাক হয়ে বলল,
–আটকাচ্ছ কেন মা! পুলিশকে ডাকতে হবে এক্ষুনি।

লতিকা বেগম বলে উঠলো,
–কাউকে ডাকতে হবে না।

–মানে?

–তুই আয় আমার সাথে। কথা আছে।
লতিকা বেগম নূরের হাত ধরে রুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। নূর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা।যেতে যেতে একবার পিছে তাকিয়ে সে আদিত্যর দিকে তাকালো। কিন্তু আদিত্য ওর দিকে তাকাচ্ছে না কেন? অপরাধীর মতো নজর কেন লুকাচ্ছে সে? কী চলছে এখানে? কেমন অদ্ভুত একটা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে নূরের মনে। অশুভ কিছুর আভাস যেন আরও জেঁকে বসছে। লতিকা বেগম নূরকে রুমের মাঝে নিয়ে আসলো। নূর অধৈর্য হয়ে বলল,
–এসব কী হচ্ছে মা?আমাকে টেনে আনলে কেন? আর ওই অপরাধীকে ওভাবে আদর করে বসিয়ে রেখেছ কেন?এটা কি তার শশুর বাড়ি?

লতিকা বেগম বলে উঠলেন,
–শশুর বাড়ি না, তবে হতে চলেছে।

তীব্র বেগে বাজ পড়লো যেন নূরের ওপর। বিস্ফোরিত, হতভম্ব নজরে তাকালো সে মায়ের পানে। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
–হোয়াট!! কি বলছ এসব তুমি মা! মাথা টাথা ঠিক আছে তো! তুমি ওই রে,পি,স্টাকে জামায় বানাতে চাচ্ছো?

লতিকা বেগম শক্ত গলায় বলে উঠলেন,
–হ্যাঁ চাচ্ছি,দেখ আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর। লিয়ার সাথে যা হয়েছে তাতো হয়ে গেছে, সেটা কোনোকিছুর বিনিময়ে ফেরত পাওয়া যাবে না। কথার কথা যদি আমরা কেস জিতেও যাই তবুও ওর ক্ষতি পূরণ হবে না। ওর বদনামী ঘুচবে না। সমাজ ওকে এক ধ,র্ষি,ত নারী হিসেবেই জানবে। যার কারণে ওর ভবিষ্যত অন্ধকারে ডুবে যাবে। কোনো ভালো ঘরে বিয়ে হবে না ওর। তারচেয়ে এটাই সবচেয়ে ভালো হবে। ওরা নিজের দোষ শিকার করে লিয়াকে তাদের ঘরের বউ করে নিতে চায়। আর আমার কাছেও এটাই সঠিক উপায় মনে হয়েছে। এতে করে লিয়ার জীবন একটু হলেও শুধরাবে। তাই তাদের প্রস্তাবে আমি রাজি হয়ে গেছি। আর তুইও কোনো দ্বিমত করিসনা।

নূর স্তম্ভিত হয়ে গেল তার মায়ের কথায়। আহত স্বরে সে বলল,
–মা তুমি এসব কীভাবে মেনে নিতে পারো? অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে তার হাতে মেয়ের হাত দিয়ে দিতে চাচ্ছ? তাও শুধু সমাজের সামনে সম্মান রক্ষার জন্য? তুমি কীভাবে করতে পারলে এমনটা মা! আমি আমার পরিবারকে এতটা দূর্বল কখনো ভাবিনি। তোমার মতো কিছু মানুষের কারণেই সমাজে এসব অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যখন ধরা খাওয়ার ভয় পায় তখনই এই বিয়ে নামক জাল ফেলে আবারও ছাড় পেয়ে যায়। তুমি ওদের ষড়যন্ত্রে পা দিওনা মা। প্লিজ এটা হতে দিওনা।

–দেখ নূর, এসব আদর্শ কথা শুনতেই ভালো শোনা যায়। বাস্তবে এসব কেউ দেখেনা। নীতিকথা দিয়ে জীবন চলেনা। আর সমাজকে শুধরানোর দায়িত্ব আমাদের একার না। সমাজে থাকতে হলে সমাজকে এরিয়ে চলা যায়না। তাই আমার কাছে এটাই সবচেয়ে উত্তম উপায়। এতে করে দুই পক্ষরেই উপকার হবে।

–কিন্তু মা,ওই ছেলের সাথে লিয়া ভালো থাকবে কিনা তার কী গ্যারান্টি আছে?

–যেমন থাকে থাকবে, এমনিতেও এসব ওর দোষেই হয়েছে। তাই ভালো মন্দ যেমনই হোক ওটাই ওর ভাগ্য। দেখ, আমি যদি সত্যিই তোর মা হয়ে থাকি তাহলে আমার সিদ্ধান্তে বাঁধা দিবিনা তুই ।

বাকরুদ্ধ হয়ে গেল নূর। প্রতিত্তোর করার ভাষা খুঁজে পেলনা সে। ধরা গলায় শুধু একটা কথাই বলল,
–আর লিয়া? ও কী রাজি?

–সেটা তুই নিজেই জিজ্ঞেস করে দেখ।
অমালিয়াকে ডেকে আনলো লতিকা বেগম। নূর ওকে জিজ্ঞেস করলো,
–তোর কী মতামত এই বিষয়ে। তুইও কী এটাতে রাজি? দেখ কোনো ভয় নেই। তোর মত না থাকলে আমাকে বল। আমি কিছুতেই হতে দিবোনা এই বিয়ে।

লিয়া মাথা নিচু করে বলল,
–না আপু, আমি রাজি। আমি ভেবে দেখলাম এটাই ভালো হবে। এমনিতেও সমাজে বদনামী তো হয়েই গেছে। তাই যার অপরাধ তার ঘাড়েই পড়াই ভালো। এতে করে সব ঝামেলা চুকে যাবে।তাছাড়া এতবড় পরিবারের বউ হতে পারলে আর কী লাগে।

নূর আরও একবার ধাক্কা খেল। এটাই কী ওর পরিবার? কাদের জন্য লড়াই করছে ও? যেখানে ওর পরিবারই অন্যায়ের সামনে নত হয়ে যাচ্ছে। সেখানে আর কিই বা বলতে নূর। হতবিহ্বল হয়ে গেল সে। ব্যাথিত মনে আস্তে করে বলল,
–ঠিক আছে, কর যা খুশি তাই।
বলেই বেড়িয়ে গেল নূর। বাইরে আসতেই আদিত্যর দিকে নজর গেল তার। এই লোকটাও তাহলে এসবে সামিল আছে! বাহ্, আর কতো ধাক্কা খেতে হবে তাকে। নূর আর থাকতে না পেরে দ্রুত নিজের রুমের দিকে চলে গেল।

রেহনুমা কাজী ডেকে এখনই বিয়ে পড়াতে চাইলেন। লতিকা বেগমও তাতে সায় দিলেন। ইভান কে বলে কাজী ডেকে আনালেন তিনি। ঘন্টাখানিকের মধ্যেই বিয়ে পড়ানোর কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেল। এসবের মাঝে নূর আর বাইরে এলোনা। আদিত্য অপরাধী চোখে বারবার নূরের রুমের দরজার দিকে তাকালো। নূর একবারের জন্যেও এলোনা। সে যে কতটা হার্ট হয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই আদিত্যর। হৃদয় টা পুড়ছে তার। সেও পারলে এখানে আজ আসতো না। কিন্তু নিজের শাস্তি থেকে সে পালাবেনা সে। আজ যে সে জীবনের কঠিনতম শাস্তি পেতে চলেছে।নূরের বিশ্বাস ভঙ্গ করার মতো যে অপরাধ সে করেছে, তার শাস্তি যে তাকে পেতেই হবে। সেই শাস্তির ভয়াবহতা যে কতটা বৃহৎ হবে তা ভাবতেই আদিত্যর হৃদপিন্ড চিপে আসছে।

বিয়ের কার্যক্রম শেষে বিদায়ের পালা এলো। যাওয়ার আগে অমালিয়া বড়ো বোনের সাথে দেখা করার জন্য দরজায় নক করলো। নূর দরজা খুলে বের হলো। অমালিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
–আপু আমি যাচ্ছি। একটু কথা বলবিনা আমার সাথে?

নূর নিজের ভেতরের কষ্ট লুকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–যাচ্ছিস যা,তবে একটা কথা জেনে রাখিস। আজকের পর তুই তোর বড়ো বোনকে হারিয়ে ফেললি। তুই সবসময়ই আমাকে ডিসিপয়েন্ট করেছিস। তবে আজকের এই কাজে তুই চিরতরে আমার কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে গেলি। এটা তোরও বাবার বাড়ি। সবার মতো তোরও সমান অধিকার আছে এই বাড়িতে। তাই তোকে এবাড়িতে আসতে মানা করার অধিকার নেই আমার। তবে আমার কাছে আর কখনো বোনের অধিকার নিয়ে আসবিনা। যা এখন, আশা করি ভালো থাকবি। বাকিটা তোর ভাগ্য। যা তুই নিজেই চুজ করেছিস।

বোনের কঠোর বানীতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অমালিয়া। সে সত্যিই আজ তার বাবার জায়গায় থাকা বোনকে হারিয়ে ফেললো। উপরে উপরে শক্ত থাকলেও ভেতরে ভেতরে কী তুফান চলছে তা শুধু নূরই জানে। নূর এবার আদিত্যর পানে তাকালো। আদিত্য তিব্র কাতর আর অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে নূরের দিকে। নূরের চোখের চাহুনি দেখে বুকের মাঝে হাজার টা ছু,রি,র আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগলো আদিত্যর হৃদয়। ওই চোখের চাহুনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আজকের পর আর আমার মুখও দেখতে চায়না সে। চিরতরে হারিয়ে ফেলল বুঝি নূরকে সে।

দেখতে দেখতে অমালিয়াকে নিয়ে চলে গেল আদিত্যর পরিবার। লতিকা বেগম বসে বসে কাঁদছেন। ইভান তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। নূর এসব আর দেখতে পারলোনা। দরজা আঁটকে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে গুমরে কেঁদে উঠলো সে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল নূরের। আর ফোন রিসিভ করতেই আজকের সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা খেল সে। যা তার হৃদয়টাকে ভেঙে হাজার খন্ডে খন্ডিত করে দিলো। যখন ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি বলে উঠলো,
–ম্যাম,আমি *****ডিসকো ক্লাবের ম্যানেজার বলছি। ওইযে সেদিন আপনারা যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে এসেছিলেন।

নূর একটু সচেতন হয়ে বলল,
–হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। বলুন কী বলবেন?

–আসলে ম্যাম আপনাকে একটা সত্য ঘটনা জানাতে চাই। আসলে আপনার বোনের কথা জানতে পেরে আমার খুব খারাপ লাগছিলো। খুব অপরাধ বোধ হচ্ছিল। তাই না জানিয়ে থাকতে পারলাম না। আসলে সেদিন সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব ছিলোনা বরং সেটাকে ইচ্ছে করে আপনার সামনে গায়েব দেখানো হয়েছিল।

নূর কপাল কুঁচকে বলল,
–মানে? কে এমন করেছে?

–আপনার সাথে যে লোকটা এসেছিল সেই এসব করেছে। তখন আমাকে একা নিয়ে গিয়ে উনি আমাকে অনেক গুলো টাকার অফার দিয়ে বলেন ফুটেজ এডিট করে দিতে। আমিও টাকার লোভে তখন রাজি হয়ে যাই। কিন্তু পেপারে যখন আপনার বোনের ঘটনার সম্বন্ধে জানতে পারি। তখন আমার খুব অপরাধবোধ হয়। তাই আপনাকে সত্যটা জানিয়ে দিলাম। যাতে আপনি ষড়যন্ত্রের শিকার না হন। আপনার বিশ্বাস না হলে আমি সেই ফুটেজ আপনার ফোনে পাঠাচ্ছি।আমার কাছে কপি ছিলো। আপনি নিজেই দেখে নিন।

লোকটা ফুটেজ পাঠালো। আর তাতে আদিত্যর ভাইয়ের ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবী থমকে গেল নূরের সামনে। স্তব্ধ পাথরের মতো হয়ে গেল সে। হাত থেকে ফোনটা ঠাস করে নিচে পড়ে গেল। অনুভূতি শূন্য হয়ে গেল সে। শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে নিচে বসে পড়লো সে। ধোঁকা! এতবড় ধোঁকা হলো তার সাথে! এই সবকিছুই তাহলে ধোঁকা ছিলো! আদিত্যর এখানে আসা দেখে ভেবেছিল হয়তো ভাই আর পরিবারের মায়ায় পড়ে সে এখানে এসেছে। কিন্তু এসবকিছুই যে প্রথম থেকেই একটা ষড়যন্ত্র ছিলো তা কল্পনাও করতে পারেনি নূর। ওই লোকটার ওসব কথা সবই তাহলে মিথ্যে ছিলো! সব ছলচাতুরী ছিলো! সে আমার সাথে খেলছিলো। কত্তবড় স্টুপিট আমি, পুরুষের স্বভাব জানা সত্বেও এই ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম আমি। আমার মনটাকে নিয়ে এমন বিশ্রী ভাবে খেললো সে। জীবনের প্রথম কাউকে বিশ্বাস করলাম,কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলাম, কাউকে মনে জায়গা দিলাম আর সেই এতবড় ধোঁকা দিলো! সব আমার দোষ। আমি কী করে তার ফাঁদে পা দিলাম! কী করে তার মিথ্যে মায়াজালে ফেঁসে গেলাম! এতো গুন্ডি সেজে থেকেও কী লাভ হলো! সেইতো এক ছলনাকারী পুরুষের কাছে হেরে গেলাম আমি। কী করে পারলাম! কী করে…কী করে…
রাগে,দুঃখে অসহনীয় যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠলো নূর। চিল্লিয়ে বিছানার চাদর টেনে নিচে ছুঁড়ে ফেললো। মনের মাঝে বইতে থাকা তুফানে তছনছ করতে লাগলো ঘরের ভেতরটা।

অন্যদিকে ফোন কেটে দিয়ে সম্মুখের ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বলে উঠলো,
–কাজ হয়ে গেছে ম্যাম। আপনি যা বলেছিলেন ঠিক তেমনই বলে দিয়েছি।

বিশ্ব জয়ের সয়তানি হাসি ফুটলো সামাইরার ঠোঁটে। পার্স থেকে টাকার বান্ডিল বের করে ম্যানেজারকে তার কাজের উপহার দিলো। ম্যানেজার তা পেয়ে খুশিমনে চলে গেল। মনে মনে পৈ,শা,চি,ক আনন্দে নাচতে ইচ্ছে হলো সামাইরার। আজ সে তার কাজে সফল হয়ে গেছে। আদিত্য আমাকে রেখে ওই থার্ড ক্লাস মেকানিকের পিছনে পড়েছিল। আমাকে অবজ্ঞা করেছিলো আদিত্য। এখন দেখবো কীভাবে সে ওই মেয়েকে পায়। সেদিন নূরকে পুলিশের সাথে ডিসকো ক্লাবে আসতে দেখেছিল সামাইরা। সেদিন থেকেই খোঁজ লাগিয়ে সব জানতে পারে সে। আর তার হাতে লাগে এই সুবর্ণ সুযোগ।তাইতো সে আগে থেকেই ম্যানেজারকে হাত করে রেখেছিল। ফুটেজ ওই ডিলিট করিয়েছিলো।আর আজ সেই ফুটেজ ব্যবহার করে সে আদিত্যকে ওই মেয়েটার নজরে চিরজীবনের জন্য ঘৃণার পাত্র করে দিয়েছে। সামাইরাকে উপেক্ষা করার শাস্তিতো তাকে পেতেই হতো। দ্যাট লাভ স্টোরি ইজ এন্ড নাও।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here