#শৈবলিনী—-২৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★আদিত্যর অবস্থা পাগল প্রায়। আজ দুদিন হলো সে নূরের দেখা পাচ্ছে না। দুদিন হলো ভার্সিটিতে আসছেনা নূর। তার থেকে বড় কথা তার কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না । শিখার কাছেও জিজ্ঞেস করেছে। শিখাও তেমন কিছু বলতে পারেনি। শিখার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কাল থেকে ফোন করে যাচ্ছে নূরের নাম্বারে। কিন্তু ফোন প্রথমেতো রিসিভ হলোনা, এখন আবার বন্ধ আসছে। কাল গ্যারেজে গিয়েও পায়নি তাকে। টেনশনে মাথার রগ ফেটে যাচ্ছে আদিত্যর। অস্থিরতায় ছটফট করছে সারা শরীর। কিছুই ভালো লাগছেনা তার। সব ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। এতো কেন নিষ্ঠুর ওই নারী? কেন এতটা অশান্তি দেয় আমাকে সে? একটুও কী আমার জন্য মায়া হয়না তার? সেকি জানেনা তার অনুপস্থিতি কতটা পোড়ায় আমাকে? তার চিন্তায় পাগল হয়ে যাই আমি। একবারও কী ফোনটা ধরে নিজের ঠিক থাকার খবরটা আমাকে দিতে পারতোনা? তাহলে তো এই অস্থিরতা দম বন্ধ করে দিতোনা আমার। শুধু ও ঠিক আছে কিনা এটাইতো জানতে চাইছি। মেয়েটার কিছু হলো নাতো? এই একটা খেয়ালই আদিত্যকে বারবার অশান্ত করে দিচ্ছে। এক সেকেন্ডর জন্যেও শান্তি পাচ্ছেনা সে। শুটিংয়েও মন বসাতে পারছেনা আদিত্য। না পেরে আজকের শুটিং সে ক্যান্সেলই করে দিয়েছে।
তার এই অস্থিরতার মাঝে রেহনুমা বেগম এলো ছেলের ঘরে। ছেলেকে এমন অন্যমনস্ক দেখে তিনি আদিত্যর পাশে এসে বসে শুধালেন,
–কীরে আদি, আজ শুটিংয়ে গেলিনা যে! শরীর খারাপ লাগছে?
আদিত্য জোরপূর্বক ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বলল,
–না না মা,আমি ঠিক আছি। এমনি আজ যেতে ইচ্ছে করছিল না।
–আচ্ছা ঠিক আছে। আয় ব্রেকফাস্ট করে নে।
–মা আমার ক্ষিদে নেই। খেতে ইচ্ছে করছেনা এখন।
–তা বললে হয়! অল্প করে কিছু খেয়ে নাও চলো।
–মা প্লিজ, আমি পরে খেয়ে নিবো।
–পরে টরে কিছু না। এখুনি খেতে হবে, চলো।
আদিত্য এবার একটু বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,
–মা,বললাম তো খাবোনা এখন। কেন জেদ করছ? একবেলা না খেলে মরে যাবোনা আমি।
রেহনুমা ছেলের কথায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে কড়া গলায় বললেন,
–আদি! মায়ের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছ তুমি? ওই থার্ড ক্লাস গুন্ডি মেয়েটার সংস্পর্শে এসে তুমিও আদবকায়দা ভুলে যাচ্ছো? এইজন্য, ঠিক এইজন্যই আমি মানা করছি তোমাকে। সময় থাকতে সরে আসো ওই পথ থেকে। নাহলে ধীরে ধীরে সব শেষ হয়ে যাবে।
কথাগুলো বলেই রেহনুমা উঠে চলে গেল। এমনিতেই অশান্তি আর অস্থিরতায় মাথা কাজ করছে না। তারওপর মায়ের এই তিক্ত কথাগুলো আদিত্যর ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিলো। রাগের বহিঃপ্রকাশ করলো পাশের ফুলদানিটা সজোরে ফ্লোরে সজোরে আছাড় মেরে। ভেতরের অশান্তি বের করতে দুই হাতে মাথার চুল টেনে ধরে ছোট্ট করে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করলো,
–আআআ….
ফোন বের করে ওর গ্যাং এর লোককে ফোন করলো আদিত্য। নূরের বর্তমান অবস্থার খোঁজ নিতে বললো সে। তার সাথে কিছু ঘটেছে কিনা খবর নিতে বলল। দুপুরের পর সেই লোক ফোন করে জানাল,
–স্যার ম্যামকে কয়েকবার পুলিশ স্টেশনে যেতে দেখলাম। পুলিশ স্টেশনে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উনি নাকি রে,প কেস করেছে। কেসের দরকারেই বারবার যাওয়া আসা করছে
রে,প শব্দটা কর্ণ গুহায় পৌঁছাতেই স্তম্ভিত হয়ে গেল আদিত্য। মস্তিষ্ক মুহুর্তেই যেন প্রচন্ড বেগে বারি খেতে লাগলো। র,ক্ত,কণা জমে গেল যেন। কম্পিত স্বরে সে বলে উঠলো,
–রে রেরে,প? কার সাথে হয়েছে?
–ম্যামের বোনের সাথে।
থমকে যাওয়া নিঃশ্বাসটা ছাড়ল যেন আদিত্য। এইটুকু সময়ের ভেতরে জান গলায় আঁটকে গিয়েছিল ওর। কিন্তু পুরোপুরি স্বস্তি পেলনা সে নূর না হলেও, ওর বোনের সাথে এমন অঘটন ঘটেছে এটা জানতে পেরে সে স্বস্তি কীভাবে পেতে পারে। যেকোনো নারীর সাথে এমন অমানবিক কাজ মেনে নিতে পারা আদিত্যর স্বভাব না। সমাজের এসব কীট গুলোকে নিধন করতেই তো আদিত্য ওর গ্যাং তৈরি করেছে। কিন্তু নূরের বোনের সাথে এসব কীভাবে হলো? একারণেই নূর ভার্সিটিতে আসেনি। বোনের এই অবস্থায় নাজানি মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে। যে পরিবারের জন্য ও জান দিয়ে দেয় আজ তাদের এমন বিপদে মেয়েটা নিশ্চয় কতো কষ্ট পাচ্ছে। একা এতসব কীভাবে সামলাবে ও। এসব ভাবতেই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে আদিত্যর। নূরকে এখন দেখাটা তার জন্য আরও বেশি জরুরি হয়ে গেল। নূরকে এই মুশকিলে একা ছাড়বে না সে।কিছুতেই না। আর এক মুহুর্তও দেরি না করে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে গেল আদিত্য । আদিত্যকে এভাবে বের হতে দেখে রেহনুমা পেছন থেকে কয়েকবার করে ডাকলো। কিন্তু আদিত্যর কানে তা পৌঁছাল কিনা জানা নেই। সে সোজা বেড়িয়ে গেল। আদিত্যর এই বেপরোয়া ভাব রেহনুমার মোটেও ভালো লাগছে না। খুব দ্রুতই তাকে কোনো কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে ওই মেয়ের কবল থেকে নিস্তার পাবেনা তার ছেলে।
__
ক্লান্ত আর হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় নিজের রুমে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে নূর। নিজেকে আজ কেমন অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে ওর। এই দুইদিনে অনেক চেষ্টা করেও সে তেমন কিছু খুঁজে বের করতে পারেনি। পুলিশও তেমন আশানুরূপ কিছু জানায়নি।প্রথমে সে অমালিয়ার যেসব বান্ধবী ওর সাথে সেদিন ছিলো। তাদের কাছে গিয়ে তাদের পুলিশের কাছে গিয়ে বয়ান দিতে বলেছিল। কিন্তু তারা সাফ মানা করে দিয়েছে। তারা নাকি এসব পুলিশের ঝামেলায় নিজেদের জড়াতে চায়না। কারণ তাদের সাথে তো আর কিছু হয়নি। তারা কেন শুধু শুধু নিজেদের ঝামেলায় ফেলবে। এরাই নাকি আবার লিয়ার বন্ধু। বিপদ দেখেই সব কেটে পড়েছে। অমালিয়ার কথামত নূর ওই ডিসকো ক্লাবেও গিয়েছিল। সেখানকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চেয়েছিল সে। কিন্তু বিনা কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া ক্লাবের ম্যানেজার তাকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দেয়নি। নূর অনেক চেষ্টা করেও পারেনি দেখতে। পুলিশকে গিয়ে দেখতে বললে তারা জানাল কোন সাক্ষী প্রমাণ ছাড়া এভাবে সার্চ ওয়ারেন্ট চাইলেই পাওয়া যায় না নাকি। আসল কথা হলো সব টাকা খাওয়ার ফন্দি। এখুনি পকেট গরম করে দিলে সব হয়ে যাবে। কিন্তু নূর অন্যায়ের প্রতিবাদ আরেকটা অন্যায় কাজ দিয়ে করবেনা। সৎ পথে চলতে হয়তো অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। তবে একদিম ঠিকই সেটা সফলতা এনে দেয়। দুদিন আগে হোক বা পরে, অপরাধীকে সে ঠিকই খুঁজে বের করবে। কিন্তু মুশকিল শুধু এই একটা না। অমালিয়ার এই কথা লোক জানাজানি হওয়ায়, নানানজন নানানরকম কথা বলছে। আত্মীয় স্বজন এমনিতেতো বারো জনমেও খোঁজ নেয়না কেউ। কিন্তু এই কথা শোনার পর হঠাৎ করেই যেন সবার দরদ উথলায় পড়ছে। কেউ বাসায় এসে আবার কেউ ফোন করে শান্তনার নামে বিদ্রুপ করছে তাদের। নূরতো অসহ্য হয়ে ফোনই বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু ওর মা লতিকা বেগম এসবের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঘরে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। আর এসবকিছু দেখে অমালিয়া নিজেকে অপরাধী মনে করে বারবার সু,ই,সা,ই,ড করতে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে আরেক বিপদ হয়েছে। সবসময় নজর রাখতে হচ্ছে তার ওপর। কখন কী করে বসে কে জানে। সব বিপদ যেন একসাথে ঝেঁপে পড়েছে নূরের ওপর। নূর পেরে উঠছে না আর। নিজেকে সবার সামনে শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠছে সে। তার কষ্টের পাহাড় টা কারোর সাথে শেয়ারও করতে পারছেনা সে। মন চাইছে কারোর কাঁধে মাথা রেখে নিজের কষ্টগুলোকে একটু শেয়ার করতে। নিজের মনটাকে একটু হালকা করতে বোধহয় ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারতো সে। আজকাল নিঃশ্বাস টাও নেওয়া ভারী হয়ে গেছে।
হঠাৎ তখনই পেছন থেকে খুব পরিচিত কন্ঠে কেউ ডাকলো,
–নূর..
চকিত নজরে পেছনে ঘুরে তাকালো নূর। মায়াবী চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সেই প্রেমিক পুরুষকে। নূরের হঠাৎ কী হলো জানা নেই। আবেগের এক প্রলয় যেন উপচে এলো তার ভেতরে। চোখে জমলো নোনাজল। করুন চোখে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে দৌড়ে গিয়ে হামলে পড়লো আদিত্যর বুকে। আদিত্যর বুকের শার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। এই বুকটাই যেন পরম ভরসার জায়গা হয়ে উঠল। যেখানে সে নির্দ্বিধায় নিজের সকল দুঃখ-কষ্ট, অভিযোগের ঝুলি খুলে বসতে পারবে। নূরের এই করুণ কান্না আদিত্যর বুকের ভেতর-বাহির দুইখানেই ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়তমাকে আরও শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে সামিয়ে নিলো।প্রচেষ্টা এই,যেন নূরের সকল যাতনা,সকল বিষ নিজের মাঝে শুষে নিতে পারে সে। প্রিয়তমার চোখের পানির চাইতে যন্ত্রণাদায়ক এমুহূর্তে কোনোকিছুই মনে হচ্ছে না তার। নূর কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্ট সুরে বলল,
–আমার লিয়া….মিঃ নায়ক, আমার লিয়া।
আদিত্য নূরকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মায়াবী কন্ঠে বলল,
–হুঁশশ…এভাবে ভেঙে পড়লে চলবেনা নূর। তুমি জানো, তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বাহাদুর নারী । এভাবে মানায়না তোমাকে। ইউ আর আ ফাইটার। সকল সমস্যার সম্মুখীন করতে পারো তুমি। এই লড়াইয়েও তোমারই জিত হবে নূর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
হঠাৎ হুঁশ এলো নূরের। কান্নার সুর থমকে গেল তার। ছিটকে সরে এলো সে আদিত্যর বুক থেকে। এটা কী করছিলাম আমি? হঠাৎ কী হয়ে গিয়েছিল আমার? উনার সামনে এমন দূর্বল কীভাবে হয়ে পরলাম আমি? যেই আমি হাজার কষ্টেও কারোর সামনে নিজের চোখের একফোঁটা পানি দেখাইনা। এমনকি নিজের পরিবারের সামনেও কখনো কাঁদিনা। সেই আমি এই লোকটার সামনে এভাবে কেমন করে কাঁদতে পারলাম? তাও এমন করে তাকে জড়িয়ে ধরে। কেন করলাম এমন আমি? নূরের মনোভাব শান্ত করতে আদিত্য বলে উঠলো,
–ইটস ওকে নূর, ডোন্ট প্যানিক। তুমি বসো, রিল্যাক্স করো।
আদিত্য নূরের হাত ধরে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। টেবিলের ওপর থাকা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নূরের সামনে ধরে বলল,
–নাও, পানি খাও।
নূর পানির গ্লাসটা নিয়ে একটুখানি পানি খেল।নিজেকে সামলে নিয়ে আদিত্যর উদ্দেশ্যে বলল,
–আপনি এখানে? এখানে কীভাবে এলেন আপনি?
আদিত্য মুচকি হেঁসে বলল,
–ডোন্ট ওয়ারি, ফিল্মি হিরোদের মতো পাইপ বেয়ে ব্যালকনি বা জানালা দিয়ে আসিনি। ভদ্রলোকের মতো দরজা দিয়ে এসেছি। ড্রয়িং রুমে ইভান বসা ছিলো। ওকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ও তোমার রুম দেখিয়ে দিলো।
নূর মলিন সুরে বলল,
–ওহ,আপনার কাজেতো দুদিন যাওয়া হয়নি। আম সরি, আপনার কাছে আমি ঋণী আছি। তাই আপনাকে না বলে কাজে যাওয়া বন্ধ করা ঠিক হয়নি আমার। আপনি চাইলে এরজন্য বাড়তি ফাইন ধরতে পারেন।
আদিত্য আহত কন্ঠে বলল,
–নূর,প্লিজ! এতটাও ছোট করোনা আমাকে যে,নিজেই নিজের কাছে ঘৃণিত হয়ে যাই। তোমার সত্যিই মনে হয়, আমি এখানে তোমার কাজে না যাওয়ার জন্য বলতে এসেছি? তুমি জানো, কাল থেকে আমি ততবার নিঃশ্বাস নেইনি যতবার তোমার চিন্তায় ব্যাকুল হয়েছি। একেক টা সেকেন্ড কাঁটার মতো বিঁধছিলো। তুমি ঠিক আছ কিনা সেটা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তাইতো আজ আর কোনোকিছু না ভেবে সোজা চলে এসেছি। তোমাকে এই অবস্থায় আমি একা কীভাবে ফেলতে পারি।
নূর কপাল কুঁচকে বলল,
–এই অবস্থায় মানে? আপনি কি তাহলে লিয়ার ব্যাপারে…
–হ্যাঁ, জানি আমি। জিজ্ঞেস করোনা কীভাবে। ব্যাস জেনেছি আমি। জানার পর আর একমুহূর্তের জন্য তোমাকে না দেখে থাকতে পারিনি আমি। তুমি চিন্তা করোনা নূর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–কী ঠিক হয়ে যাবে। বললেই কী সব ঠিক হয়ে যায়? আমার বোনটার যে ক্ষতি হলো সেটা ফেরত আসবে? ওর জীবনে যে একটা ভয়ানক স্মৃতি হলো সেটা কী কখনো ভুলতে পারবে ও? আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে পারবে ও? আর এসব করে যে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে এখনো পর্যন্ত কিনা সনাক্তই করা গেলনা। তাহলে এখানে কোনটা ঠিক দেখলেন আপনি? এসব বলা সহজ। যার সাথে ঘটে সেই বুঝতে পারে কেমন লাগে। আজ আমি বেঁচে থাকতেও আমার বোনের সম্মান রক্ষা করতে পারলাম না। এটাযে কতবড় গ্লানিদায়ক তা আপনি বুঝবেন না।
বলতে বলতে গলা আবার ধরে এলো নূরের। নিজের কান্না চেপে নিতে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। আদিত্য উঠে এসে নূরের সামনে নিচে হাঁটু গেড়ে বসলো। নূরের হাত দুটো জোরা করে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। নূর তাকালো আদিত্যর পানে। আদিত্য নূরের পানে মায়াময় নজর মেলে বলতে লাগলো,
–তুমি জানো নূর, তোমাকে আমি কী নামে ডাকি? শৈবলিনী (নদী), হ্যাঁ তুমি হলে সেই শৈবলিনী যে সকল পরিস্থিতিতে নিরন্তর বহমান। নদী যেমন তার গভীরে সকলকিছু সামিল করে নিয়েও, থেমে না গিয়ে অনবরত বয়ে চলে যায়। তুমিও ঠিক তেমনি । সাহসী সৈনিকের ন্যায় সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যাও। তাই আমি জানি, এই পরিস্থিতিও তুমি ঠিকই জয় করে নিবে।
নূরের থমকিত নজর স্থির হয়ে রইল আদিত্যর মুখপানে। মায়াজালে আবদ্ধ হলো যেন সে। আজপর্যন্ত এতটা গভীরভাবেতো নূর নিজেকেউ কখনো পর্যবেক্ষণ করে দেখেনি। আর এই লোকটা কীভাবে তার ব্যক্তিত্বর এতো সুন্দর, অর্থবোধক একটা সংজ্ঞা দিয়ে দিলো! সত্যিই কী সে এতটাই বোঝে আমাকে? এতটা মায়াময় কেন লাগছে তার কথাগুলো। যেন এত কষ্টের মাঝে প্রশান্তির এক শীতলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কথায়। অজানা এক ভরসা খুঁজে পাচ্ছে তার মাঝে।
হঠাৎ ঘোর কাটলো নূরের। সে আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নজর সরিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–কী জয় করবো? এখনও পর্যন্ত ওই অপরাধীকেই ধরতে পারলাম না। যে আমার বোনের ক্ষতি করে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
–তো কী হয়েছে? তুমি চিন্তা করোনা। আমরা দুজন মিলে অপরাধীকে খুঁজবো। দেখবে খুব শীঘ্রই ধরে ফেলবো ওই রা,স্কে,ল টাকে।
নূর ভ্রু কুঁচকে বলল,
–এক মিনিট! আমরা মানে? দেখুন এটা আমার লড়াই। আমাকে একাই এই কাজ করতে হবে। আপনাকে এসবে পড়ার কোনে দরকার নেই। আর তাছাড়া এসব পুলিশি ঝামেলায় জড়ালে আপনাকে নিয়ে শুধু শুধু নিউজ তৈরি হবে। তাই প্লিজ আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন। আমারটা আমি দেখে নিবো।
আদিত্য এবার একটু শক্ত গলায় বলল,
–দেখ নূর, ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়া ভালো। তাই বলে কারোর সাহায্য নিলে তুমি ছোট হয়ে যাবে এই ধারণা পোষণ করা নেহাৎই বোকামী। কারো সাহায্য নেওয়ার অর্থ এই না যে,তুমি সেই কাজে অক্ষম। আমি জানি তুমি পারবে। কিন্তু আমরা দুজন মিলে করলে কাজটা আরও দ্রুত হয়ে যাবে। এমনিতেও তোমাকে অশান্তিতে দেখে আমি চাইলেও কোনো কাজে মন বসাতে পারবোনা। তাই আমি তোমার সাহায্য করছি। অ্যান্ড দ্যাট ইজ ফাইনাল। নো মোর আরগুমেন্ট অন দিস টপিক।
নূর আর কোনো প্রতিত্তোর করতে পারলোনা। সে উপরে উপরে না বললেও, সে নিজেও বুঝতে পারছে তার এমুহূর্তে একটা ভরসাজনক সাপোর্ট দরকার। যে মেন্টালি আর প্রাক্টিক্যালি তাকে একটু সাহায্য করতে পারবে। আর এরজন্য আদিত্যর চেয়ে ভালো কেউ তার চোখে পড়ছেনা।এই প্রথম মনে হচ্ছে কোনো পুরুষকে সে চোখ বুজে ভরসা করতে পারবে। যে তার ভরসাকে অক্ষুণ্ণ রাখবে। কখনো তার বিশ্বাস ভাঙবে না। যার হাত ধরে সে অজানা পথে নিরন্তর পথচলতে পারবে। হারাতে পারবে কোন এক অচিন মায়াপুরিতে।
চলবে……