#শৈবলিনী—৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★হঠাৎ করেই সব কোলাহল থেমে গেল। আদিত্যর উচ্চারিত বাক্যে থমকে গেল নূর। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে অনেক টা থতমত খেয়ে গেল সে। সাথে বেড়ে গেল তার ক্রোধের মাত্রা। কপাল ভাজ করে আদিত্যর পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল,
–কী বললেন আপনি?
আদিত্য নিজের দুই হাত পেছনে ঘুরিয়ে পিঠে নিয়ে বাঁধলো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে নূরের মুখের সামনে মুখ নিয়ে ধীর গতিতে বলল,
–আই সেড আই….লাভ….ইউ..। বাংলায় বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি মিস নূর।
রাগে কড়মড় করে উঠলো নূর। দুই হাতে আদিত্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
–হাউ ডেয়ার ইউ! আপনাকে আগেই বলেছি আমি বাকিদের মতো না। তাই আমার সাথে এইসব লুচ্চামি করতে আসবেন না। তারপরও এইরকম বেহুদা আচরণের মানে কী?
আদিত্য স্মিথ হেঁসে বলল,
–কাউকে ভালোবাসার কথা বলা বেহুদা আচরণ হয় সেটা জানতাম নাতো। আই থিংক তোমার জেনারেল নলেজ বোধহয় উইক আছে। তাইতো ভুলভাল জানকারি পেয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছো। ব্যাপার না, আমার সাথে থাকলে ধীরে ধীরে সব নলেজই ঠিক হয়ে যাবে তোমার।
নূর আদিত্যর সামনে আঙুল তুলে শাসিয়ে বলল,
–ব্যাস,অনেক হয়েছে। বন্ধ করুন আপনার ফালতু বয়ান৷ নাহলে কিন্তু আপনার জন্য আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
–অন্য কেউ চাইও না আমার। আমার শুধু তুমি হলেই চলবে। “অন্তরালের ভেতর বাহিরের দাবি শুধু একটাই, তুমি বন্ধু শুধু আমার হওয়া চাই।”
–বুঝেছি আপনি এভাবে মানবেন না। গুষ্টি কিলায় আপনার কাজের। আমি আজই প্রিন্সিপালের কাছে আপনার এই কু কৃতীর কথা বলবো।
–ওকে বলো গিয়ে। কিন্তু বলবে কী? আদিত্য আমাকে আই লাভ ইউ বলেছে এটা বলবে? ওকে ফাইন, বলো। ভালোবাসার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলেও মাথা পেতে নেবো। সরি, একটু ফিল্মি লাইন হয়ে গেল তাইনা? কী করবো চলচ্চিত্র শিল্পী তো, তাই মাঝে মধ্যে একটু ফিল্মিগিরী তো চলেই আসে। ধীরে ধীরে তুমিও অভ্যাস্ত হয়ে যাবে।
নূর বুঝতে পারলো এই লোকের সাথে কথা বলা বেকার। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকলে এই লোকের খুনের দায়ে জেল খাটতে হবে ওকে। যেটার ইচ্ছে ওর মোটেও নেই। রাগে গজগজ করতে করতে নূর নিজের হ্যান্ড ব্যাগটা কাঁধে তুলে ধুপধাপ পা ফেলে বেড়িয়ে গেল সে। নূরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আদিত্য। খুব শীঘ্রই এই প্রস্থানোদ্যত পদধ্বনিকে অভিমুখী করবো আমি নূর। রেগে যাওয়ার অনুমতি আছে তোমার, দূরে যাবার নয়। ভালোবাসার অনুমতি আছে আমার, ভুলে যাবার নয়।
কিছুক্ষণ পর আদিত্য ভ্যানের বাইরে বেড়িয়ে এলো জিদানকে খোঁজার জন্য । তবে বাইরে এসে জিদানকে মাটিতে চার হাত পা ছড়িয়ে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল সে। নিচে ঝুঁকে জিদানের গালে আলতো করে চাপড় মেরে ডাকতে লাগলো ওকে। তবুও জাগছেনা সে। আদিত্য এবার পানির গ্লাস এনে কিছু পানি জিদানের মুখে ছিটিয়ে দিলো। নাহ তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আদিত্য এবার পুরো জগ ভর্তি পানি জিদানের মুখের ওপর ঝপাৎ করে ঢেলে দিলো। এবারে ধড়ফড়িয়ে উঠলো জিদান। হা-হুতাশ মার্কা চোখ করে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। সামনে আদিত্যকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
–স্যার, জানেন আমি না একটু আগে কী ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছি। বাপরে আমার জীবনে এতো ভয়ংকর স্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি। আমার তো কলিজা,ফোপরা,কিডনি,লিভার সব একসাথে মিক্সড হয়ে ফালুদা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমার এক্ষুণি মটকা বাবার কাছে যেতে হবে। তিনিই একমাত্র তার কেরামতি ঝাড়ফুঁকের এন্টিডট দিয়ে আমার এই ভয় দূর করতে পারবে। নাহলে এই ভয় আমার কলিজা বসতবাড়ী করে বংশবিস্তার করে ফেলবে।
বিরক্তিতে চোয়াল চিবিয়ে আদিত্য ধমকের সুরে বলে উঠলো।
–জাস্ট শাট আপ। কী আবোল তাবোল বলছ? আর দিনদুপুরে কী স্বপ্ন দেখলে তুমি?
–না স্যার এই স্বপ্ন মুখেও আনা যাবে না। যদি সত্যি হয়ে যায় তখন? বাপরে ভাবতেই আমার হার্ট,প্যান্টের ভেতর ঢুকে গেছে।
–তুমি বলবে নাকি আমি অন্য ব্যবস্থা নিবো?
–না স্যার বলছি। কিন্তু শোনার আগে আপনি মানুষিক ভাবে শক্ত থাইকেন। হার্টের নাট বল্টু ভালো করে টাইট দিয়ে নিয়েন। এমন দুর্ধর্ষকর কথা শুনলে হার্ট খুলে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাহলে তৈরিতো স্যার? আমি বলতে যাচ্ছি সেই ধরনী কাঁপানো, শ্বাসরুদ্ধকর কথাটা। আসলে আমি দেখলাম আপনি ওই কুমিরের সরদারনীরে আই লাভ ইউ বলছেন।
চোখ বুজে এক নিঃশ্বাসে জিদানের ভাষ্যমতে সেই সাংঘাতিক স্বপ্নের কথাটা বলে সে আদিত্যর প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় তার পানে তাকালো। ভাবলো,স্যার নিশ্চয় এখুনি দুই কানে হাত রেখে গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলবে,নাআআআআ….এটা হতে পারে না। এটা তুমি কী শুনালে। এটা শোনার আগে আসমান ভেঙে পড়লো না কেন,জমিন ফেটে গেলনা কেন। কিন্তু জিদানের এই ঐতিহাসিক ভাবনার ওপর বালতী না, পুরো সুইমিং পুল ঢেলে দিয়ে আদিত্য ভাবলেশহীন ভাবে ভ্যানের ভেতরে চলে গেল। এটা কী হলো! স্যার কোনো রিয়্যাকশন দিলোনা কেন? মাত্রাতিরিক্ত শক পেয়ে স্যার পাথর হয়ে গেল নাতো। এতো বড়ো ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে স্যার আবার কোমায় চলে যায় যদি? স্যারের চিন্তায় আকুল হয়ে পড়িমরি করে ভেতরে দৌড়ালো জিদান। ভেতরে এসে দেখলো আদিত্য সোফায় রিল্যাক্স হয়ে বসে আছে। কি যেন ভেবে একা একাই মুচকি হাসছে। এখনতো জিদান কনফার্ম ওর স্যার শক খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। এটা আমি কী করলাম? আমার কারণে স্যারের এই অবস্থা হয়ে গেল।
—স্যারররররর…….
চিৎকার করে আদিত্যর নাম ধরে ডেকে দৌড়ে আদিত্যর কাছে এসে বসলো জিদান। আদিত্যর দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
–স্যার,, ও স্যার কী হলো আপনার? হুঁশে আসেন স্যার। দেখেন স্যার আমি আছি আপনার সাথে। কিচ্ছু হবে না আপনার । একদম স্ট্রেস নিয়েন না। ওটাতো শুধু স্বপ্ন ছিলো। আর স্বপ্ন তে স্বপ্নই হয়। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয়না। তাও বেশি ভয় পেলে আমি মটকা বাবার কাছ থেকে আপনার জন্যেও তাবিজ নিয়ে আসবো। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। মটকা বাবা অনেক আলৌকিক বাবা। উনার পন্থা কখনো বিফল যায়না। উনি সব করে দিতে পারেন।
আদিত্য রাগলো না, আর না বিরক্তি প্রকাশ করলো। শুধু শান্ত সুরে প্রশ্ন করলো,
–আচ্ছা? তোমার মটকা বাবা সব করতে পারে?
–জি স্যার, সব পারে।
–নূরের মনে আমার নাম লিখে দিতে পারবে? ওর হৃদজমিন টা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দিতে পারবে?
এবার শক পেল জিদান। ক্যাবলাকান্তের মতো বলল,
–জিহ??
–এক্সুয়ালি থাক, এটাতো আমার দায়িত্ব তাইনা। তো এই কাজ আমি নিজেই করে নিবো।
–মানে?
–মানে জিদান মিঞা, তুমি কোনো স্বপ্ন দেখোনি। ওটা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সত্যি। আই অ্যাম ইন লাভ জিদান। আই লাভ নূর।
জিদানের হার্টের ভেতর ঠাস ঠাস করে মিসাইল রকেট পড়তে লাগলো। চোখের মনি স্প্রিং হয়ে লাফিয়ে বেড়িয়ে আসছে। মুখের হা বড়ো হয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে। কোনরকমে বলার চেষ্টা করলো।
–মা মানে, ওই কুমিরের সরদার…..
এবার আদিত্য রাগ দেখালো। চোখ গরম করে বলল,
–জিদান, তোমাকে বলেছি না নূরের নাম ঠিক করে সম্মানের সহিত উচ্চারণ করবে। ভুলে যেওনা সে তোমার ভবিষ্যত ভাবি হতে চলেছে।
জিদানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো নূরের প্রতিচ্ছবি। যেখানে নূর জোরে জোরে উচ্চস্বরে ভিলেনী হাসি হাসছে। ব্যাস কোমল হৃদয়ের অধিকারী জিদান আর নিতে পারলোনা। অতঃপর দ্বিতীয় বার জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান স্কয়ার ক্রিয়া সম্পূর্ণ করলো।
__
পরদিন ভার্সিটিতে এসে নূরকে দেখতে পেল না আদিত্য। এমনকি ওকে সহযোগিতার কাজেও আজ আসেনি। খুব একটা অবাক হলো না আদিত্য। কালকের পর এমন কিছু হওয়ারই সম্ভাবনা ছিলো জানতো সে। আদিত্য হাসলো মনে মনে। তুমি কী ভেবেছ নূর, এভাবে আমার থেকে দূরে যেতে পারবে? উহুম,কখনোই না। তুমি জানোই না এই আদিত্য কতোবড় উন্মাদ। ব্যাপার না, ধীরে ধীরে জেনে যাবে। শুটিং শেষ করে ফেরার পথে আদিত্য গাড়িতে জিদানের উদ্দেশ্যে বলল,
–আচ্ছা জিদান তুমি জানো গাড়ি কীভাবে নষ্ট করতে হয়?
আদিত্যর কথায় জিদান একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভাবলো স্যার ভুলে বলে ফেলেছে। জিদান বলল,
–স্যার, আপনি বোধহয় গাড়ি ঠিক করতে পারি নাকি এটা বলতে চেয়েছেন তাইনা?
–যা শুনেছ তাই বলেছি। এখন বলে পারো কিনা? আচ্ছা থাক, তোমার বলতে হবে না।
আদিত্য ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল,
–শফিক, তুমি নিশ্চয় জানো গাড়ি কীভাবে নষ্ট করতে হয়?
–জি স্যার, জানি।
–ঠিক আছে। সামনে কিছুদূর পর একটা গ্যারেজ আসবে। তার কাছাকাছি গিয়ে যেকোনো ভাবে গাড়ি নষ্ট করবে বুঝতে পেরেছ?
–কিন্তু কেন স্যার?
–এতো জানতে হবে না। যা বললাম তাই করো।
–ঠিক আছে স্যার।
আদিত্যর কথামতো নূরের গ্যারেজের কাছাকাছি এসে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ইঞ্জিনে কিছু কারসাজি করে গাড়ি নষ্ট করে দিলো। আদিত্য ওদের গাড়ি ঠেলে গ্যারেজের সামনে নিতে বলল। আর নিজে নেমে গিয়ে আগে আগে হেঁটে যেতে লাগলো। বেচারা জিদান কিছুই বুঝতে পারছে না। তার স্যারের মাথায় কী কলেরা হলো নাকি? এমন অদ্ভুত কাজকাম কেন করছে? নাহ মটকা বাবার কাছ থেকে একটা তাবিজ আনতেই হবে স্যারের জন্য। স্যারের ওপর নিশ্চয় জ্বিনে ভর করেছে। শুনেছি সুন্দর ছেলেদের ওপর নাকি পরী ভর করে। তাহলে কী স্যারের ওপরও পরি ভর করলো?
গ্যেরেজের ভেতর এক কোনে খুবই মনোযোগী হয়ে গাড়ির কিছু পার্টসপাতি নিয়ে কিছু কাজ করছে নূর। পল্টু নূরের সামনে চায়ের কাপটা রেখে বলল,
–ওস্তাদ,রোজ কী করেন এইগুলা। এতো মনোযোগ দিয়া কী এমন করেন? এইডা তো কোনো কাস্টোমারের গাড়ির পার্টসও না। তাইলে এইগুলা কীসের লাইগা? মাঝে মধ্যেই দেহি এইসব নিয়া নাড়াচাড়া করতে।
নূর তার হাতে থাকা পার্টসগুলোর ওপর নজর রেখেই বলে উঠলো।
–স্বপ্ন বুনছি বুঝেছিস? বুনতে বুনতে এটাকে একদিন পরিপূর্ণ রুপ দিবো।
–কি কন ওস্তাদ? সবতো ছাঁদের ওপর দিয়া গেল। এই নাদানের মাথায় ধরে এমন সহজ কইরা কন।
–আচ্ছা শোন,আমার একটা স্বপ্ন আছে। আমার ইচ্ছে আছে এমন একটা গাড়ি বানানোর যা কম খরচে হাই কোয়ালিটি গাড়ির সুবিধা দিবে। মানে কম দামে ভালো মানের গাড়ি। যাতে খুব সহজেই মানুষ নিজের একটা গাড়ি কেনার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। সেটারই একটু একটু করে চেষ্টা করি মাঝে মধ্যে।
–ছত্যি? আপনে পারবেন ওস্তাদ?
–হুমম,এতো সহজ না। এটার পেছনে অনেক শ্রম,রিসার্চ আর ইনভেস্ট দরকার। শ্রম নাহয় আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিতে পারি। তবে অন্য গুলো এতো সহজ না। এইজন্যই আমার একটা ল্যাপটপের বিশেষ দরকার। এসব বিষয়ে রিসার্চ আর বিজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য।
–ওস্তাদ, ওই মমিন মেকানিকের দোকানে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপের কথা কইছি। ও কইলো পাইলে আমারে জানাইবো।
–ঠিক আছে।আচ্ছা শোন তোর ছোট বোনের পড়ালেখা কেমন চলছে? ওকে আবার বাসায় কাজ করতে পাঠাসনি তো?
–না না ওস্তাদ। বোইন এহন স্কুলে যায়,পড়ালেখা করে। বোইন আমার খুব খুশি। জানেন, বোইন এহন পটর পটর করে এককেজি কইইবার পারে।
নূর হালকা হেঁসে বলল,
–আরে এককেজি নারে গাধা, ওটা ইংরেজি।
–ওই হইলো আরকি। বোইনরে আমি অনেক বড়ো মানুষ বানামু। নিজে জীবনে যা করতে পারিনাই, বোইনরে দিয়া সেই স্বপ্ন পূরণ করমু।আর এইসব আপনের কারণেই হইতে পারছে। আপনি ওর পড়ালেখার খরচ চালান বলেই বোইন আইজ পড়তে পারে। আপনার এই ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারমুনা। আপনি অনেক ভালো ওস্তাদ। আমি চাই আমার বোইন বড়ো হইয়া আপনার মতোই হোক।
–হইছে হইছে এতো সেন্টি খাওয়া লাগবেনা। আর তোরে না কইছি এইসব বাংলা সিনেমার ফালতু ডায়লগ ঝাড়বিনা। আমার অসহ্য লাগে।
–মানুষ জীবনে যেটা সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে। সেটাই তার ভাগ্যে থাকে। তাকি জানেন মিস নূর?
উক্তি প্রদানকারী ব্যাক্তিকে দেখার উদ্দেশ্যে দরজায় চোখ রাখে নূর। আদিত্যকে সেথায় উপস্থিত দেখে ভ্রুকুটি কুঁচকে আসে তার। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে ক্যামেরাম্যান তাকে পোস দিতে বলেছে। “বুর্জ খলিফা” সমান বিরক্তিতে ছেয়ে গেল নূর। কিছু বলতে যাবে তখনই পল্টু আশ্চর্যান্বিত হয়ে আদিত্যর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–আরে আদিত্য স্যার! আপনে আবার আমগো এহেনে আইছেন।
আদিত্য নূরের মুখপানে নজর টিকিয়ে রেখেই পল্টুর উদ্দেশ্যে বলল,
–হ্যাঁ পল্টু,তোমাদের হসপিটালিটি আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। তাইতো আবারো চলে এলাম।
পল্টু মাথা চুলকিয়ে বেকুবের মতো বলল,
–হসপিটাল? কিন্তু এইডা তো গ্যারেজ, হাসপাতাল না।
এবার নূরের থেকে নজর সরিয়ে হালকা হাসলো আদিত্য।পরমুহূর্তে আবারও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নূরপানে। নূরের দিকে তাকিয়ে হেয়ালি করে বলল,
–কে বলেছে এটা হাসপাতাল না? দেখনা সকাল থেকে বুকে অনেক ব্যাথা করছিলো। এখানে আসতেই আমার বুকের ব্যাথা একাবারে সেরে গেল। তাহলে ভাবো কতো ভালো হাসপাতাল তোমাদের।
পল্টু বেচারা আদিত্যর কথার পূর্ব পশ্চিম কিছুই বুঝতে পারলোনা। এবারে নূর তেড়ে এলো ওদের সম্মুখে। পল্টুকে বলল,
–এই তোর কাজ নেই? যা গিয়ে কাজ কর।
নূরের ধমকে পল্টু দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করলো। আদিত্য নূরের আরেকটু কাছাকাছি এসে দুষ্টু ভঙ্গিতে বলল,
–ভালোই করেছ ওকে পাঠিয়ে দিয়ে। দুজন লাভবার্ডস এর মধ্যে কাবাবে হাড্ডি হচ্ছিল শুধু শুধু। এরজন্যই তোমাকে এতো ভালো লাগে আমার। কেমন আমার মনের ভাষাটা বুঝে গেলে। একেই বলে দিলের টান।
নূরের ক্রোধের মাত্রা বাড়তে বাড়তে যেকোনো সময় ব্লাস্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম। আদিত্যর সামনে আঙুল তুলে দাঁতে দাঁত পিষে রাগী কন্ঠে বলল,
–আপনি? আপনি এখানে কী করছেন? আপনার সাহস কী করে হলো এখানে আসার? আপনাকে তো আমি…
নূরের উগ্রতার রেলগাড়ী মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আদিত্য বলে উঠলো।
–আঃ আঃ আ, টেক ইট ইজি নূর। এতো হাইপার হলে বিপি বেড়ে যাবে। আর থাকলো আমার সাহসের কথা, সেটাতো বরাবরই বেশি। সময়ের সাথে জেনে যাবে। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু এখানে তোমার গ্যারেজের কাস্টোমার হয়ে এসছি। আমার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে সেটাই দেখাতে এসেছি। আর কাস্টোমারের সবসময় সম্মান করতে হয়। এতটুকু ম্যানার্স শেখনি তুমি?
আদিত্য যে গাড়ি নষ্টের বাহানা করে এখানে ইচ্ছেপূর্বক টপকেছে সে বিষয়ে ভালোমতোই অবগত নূর। তবে কথাতো সত্য, কাস্টোমারকে কখনো অবজ্ঞা করতে নেয়। সেই যেই হোকনা কেন। নূর ওর বাবার কাছ থেকে শুনেছে এই কথা। পার্সোনাল ইস্যু ধরে নিজের কাজের লোকসান করানোর মতো বোকা না নূর। নূর রাগের মাত্রা সামান্য কমিয়ে বলল,
–ঠিক আছে গাড়ি রেখে যান। আমি ঠিক করে রেখে দিবো। কাল ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েন গাড়ি নিতে।
নূরের কথায় আদিত্য মিছে আৎকে উঠার ভঙ্গিতে বলল,
–নোওওওওও…।নট এল অল। আমার এই গাড়ি টা আমার জানের থেকেও বেশি প্রিয়। আমি তাকে কিছুতেই একা ছাড়তে পারবোনা। আমার কলিজা ছিঁড়ে যাবে। আর তাছাড়া তোমার কী ভরসা! আমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার গাড়ির পার্টসগুলো চুরি করে নিলে। তখন আমার গড়ির কী হবে?
দুনিয়াতে যতরকম বিরক্তি আছে সব এসে হামলে পড়লো নূরের মস্তিষ্কে। মন তো চাচ্ছে ব্যাটাকে এখুনি গাড়ির ডিকিতে বন্ধ করে অজানা সমুদ্রে ছুঁড়ে দিতে। শুধু কাস্টোমার দেখে সহ্য করে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু প্রশমিত করে নিয়ে নূর বলে উঠলো।
–দেখুন আমি জানি আপনি এসব ইচ্ছে করেই করছেন। এসব করে কোনো লাভ হবে না। তাই বিরক্ত না করে আপনি যান এখান থেকে।
আদিত্য যাওয়ার পরিবর্তে আরও একটু নিকটে চলে এলো নূরের। নূর অপ্রস্তুত হয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। আদিত্য ফট করে তার ফোন বের ক্লিক করে নূরের একটা ফটো নিয়ে নিলো। নূর ভড়কে উঠে বলল,
–এই এই ছবি তুললেন কেন আমার? ডিলিট করুন এখুনি।
আদিত্যর নূরের কথা মানার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সে সযত্নে ছবিসহ ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলল,
–সরি তোমার এই আদেশ মানতে পারছিনা। আসলে আমি তোমার ভীতু চেহারাটা দেখতে চেয়েছিলাম। তোমার মতো ঝাঁসির রানিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি এটা কী কম কথা নাকি! তাইতো প্রুভ হিসেবে এই ছবিটা রেখে দিলাম। এটা আমাকে আশ্বাস দিবে যে মিস নূর সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যকে ভয় পেয়ে গেছে।
নূরের দমে রাখা ক্রোধটা এবার বিস্ফোরণ আকার ধারণ করলো। নূর দুই হাতের মুঠো শক্ত করে বলল,
–হোয়াট? ভয়? তাও আবার আপনাকে? হাঁহ্..জোক্স অফ দ্য ইয়ার। নিজেকে কী ভাবেন আপনি? আরে আপনাকে তো আমার ঘরের তেলাপোকা গুলোও ভয় পাবে না, থাকতো আমি । নূরের এতো খারাপ দিন আসেনি যে আপনাকে ভয় পাবে। নিজেকে অনেক ভুল ধারণায় ঘিরে রেখেছেন আপনি।
–আচ্ছা তাই নাকি? তাহলে আজ ভার্সিটি এলে না কেন? আমার ভয়েই তো আসোনি তাইনা? কারণ ভার্সিটি আসলে আমার সামনে আসতে হতো তাইনা?
–মিঃ নায়ক, নিজেকে ইম্পর্ট্যান্স দেওয়া ভালো কথা। তবে এতটাও দেওয়া উচিত না যে অন্য কিছু নজরেই না পরে। সবসময় সবকিছু শুধু আপনার কারণে হয়না। আপনার অবগতির জন্য জানিয়ে দেই আমি রোজ ভার্সিটি যাইনা। ইম্পর্ট্যান্ট কিছু থাকলে তবেই যাই। নূর কখনো কারোর জন্য নিজের পথ পরিবর্তন করে না।
–তারমানে কাল যাবে নিশ্চয়। কারণ কাল তোমাদের ডিপার্ট্মেন্টে একজন নামকরা গেস্ট লেকচারার আসবে। তো তুমি নিশ্চয় সেটা মিস করতে চাইবে না। তুমি যেহেতু আমার সাথে কাজ করছ, তাই ভাবলাম তোমাকে এই তথ্যটা দিয়ে দেই।
–দেয়ার ইজ আ স্মল কারেকশন মিঃ নায়ক। আমি আপনার সাথে কাজ করি না, কাজ করতাম। কালকের পর আপনি ভাবলেন কী করে যে, এরপরও আমি আপনাকে হেল্প করবো? আমি কালকেই জানিয়ে দিয়েছি, আমি আপনার সাথে কোনো কাজটাজ করছিনা।
–হুমম,তারমানে তো আমার কথাই সত্যি হলো। তুমি ভয় পেয়ে গেছ। এইজন্যই তো আমার সাথে কাজ করতে চাও না। কারণ তুমি বুঝতে পেরেছ যে,আমার সাথে থাকলে তুমি আমাকে ভালো না বেসে থাকতে পারবেনা।আমার প্রেমে পড়ে যাবে। সেই ভয়েই আমার সাথে কাজ করতে চাওনা তুমি।
নূর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
–ভালবাসবো? এই নূর প্রেমে পড়বে আপনার? একজন সিনেমার নায়কের? ইউউউউ…শুনতেই বমি আসছে আমার। এমন কথা মজাতেও বলবেন না কখনো? দ্বিতীয় বার নিতে পারবোনা। আপনি যদি দুনিয়ার শেষ ছেলেও হয়ে থাকেন তবুও আমি ভালোবাসবো না আপনাকে।
ওদের থেকে কিছুটা দূরে জিদান দাঁড়িয়ে ছিলো। নূর গলা উঁচু করে আদিত্যের পেছন থেকে জিদানকে ডাকলো। জিদান এগিয়ে এলো ওদের কাছে। নূর জিদানকে দেখিয়ে আদিত্যকে বলল,
–কানের ময়লা পরিষ্কার করে ভালো করে শুনে নিন আর মনের ভেতর পিনআপ করে রাখুন মিঃ নায়ক। আমি দরকার হলে একবারের জন্য আপনার এই সেক্রেটারি নামক পাতিহাঁস টাকেও ভালোবাসতে পারি। তবুও আপনাকে কখনোই না।
নূরের এমন অভিব্যক্তি শুনে জিদান যেন হাওয়া ফুলানো বেলুনের মতো আসমানে উড়তে লাগলো। এই প্রথম স্যারের পরিবর্তে কেউ জিদানকে সিলেক্ট করেছে। এটা কী চারটে খানি কথা নাকি! এটাতো সব টিভির পর্দা কাঁপানো ব্রেকিং নিউজ বলা চলে। এখুনি হয়তো হাজারটা মিডিয়া ক্যামেরা আর মাইক হাতে হামলে পড়বে জিদানের ওপর। ছবি আর ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যাবে। তারা জিজ্ঞেসকরবে স্যার আপনার অনুভূতি টা বলেন? আপনি এই অসাধন সাধন করে কেমন অনুভব করেছেন? আমি কী বলবো তখন? আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি রাইটারকে দিয়ে একটা ভালো দশ পৃষ্ঠার স্পিচ লেখাবো। তারপর প্রোপার একটা প্রেস ব্রিফিং রাখবো। যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়। জিদানের খেয়ালী বিরিয়ানি পাকানো প্রায় শেষই হচ্ছিল। তখন নূর নিজের ঠোঁট দুটো চোখা করে ছোট্ট করে শিস বাজিয়ে জিদানের দৃষ্টি নিজের দিকে ফেরালো। জিদান নূরের দিকে তাকাতেই নূর বলে উঠলো।
–ওই পাতিহাঁস, বেশি উড়ার দরকার নেই। জাস্ট এক্সজাম্পল দিচ্ছিলাম।
জিদান আদিত্যের দিকে তাকাতেই আদিত্যের এক ভ্রু উঁচান তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সম্মুখীন হলো। আদিত্যর ওই অগ্নি দৃষ্টি পানে তাকাতেই জিদানের হাওয়ায় উড়িয়ে যাওয়া বেলুনটার ফুসস করে হাওয়া বেড়িয়ে গেল। অবস্থার গাম্ভীর্য বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎ কেটে পড়লো সে ওখান থেকে। আদিত্য এবার নূরের উদ্দেশ্যে বলল,
–তুমি যতযাই বলো। এগুলো সব হলো বাহানা, আমার থেকে বাচার। সত্যি তো এটাই যে তুমি আামার কাছে থাকতে ভয় পাও। কারণ তুমি আমার প্রতি দূর্বল হয়ে গেছ।
–কী বারবার একই কথা বলে যাচ্ছেন? আমি কাউকে ভয় করিনা বুঝতে পেরেছেন?
–ঠিক আছে তাহলে প্রমান করে দেখাও।কাল থেকে ত্রিশ দিন যাবৎ তুমি রোজ আমার সাথে কাজ করবে। আমার আশেপাশে থাকবে। তারপরও যদি তোমার আমার প্রতি কোনো অনুভূতি না হয় তাহলে আমি কথা দিচ্ছি। ত্রিশ দিন পর আর কোনোদিন তোমার সামনে আসবোনা।
–এমন কিছুই করবোনা আমি। আপনাকে কোনো কিছু প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন আমি মনে করিনা।
–আসল কথা বলো যে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। কারণ তুমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছ আমার আশেপাশে থেকে আমাকে ভালো না বেসে তুমি থাকতেই পারবেনা। তাই তুমি আমার চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করতে ভয় পাচ্ছ। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি অনেক সাহসী মেয়ে। বাট ইউ ডিসিপয়েন্ট মি নূর। শেষমেশ তুমিও বাকিদের মতোই বের হলে। সো স্যাড।
নূরের এবার ইগো নড়েচড়ে উঠলো। কেউ তাকে ভীতু ভেবে নিবে সেটাতো কোনমতেই হতে দিবেনা সে। এই লোকটাকে তো ভুল প্রমাণ করেই দেখাতে হবে। তখনই বুঝবে কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছিলো এই লোকটা। নূরও অতি দাম্ভিকতার সহিত বলল,
–ঠিক আছে, চ্যালেঞ্জ মেনে নিলাম। এই নূর কাউকে ভয় পায়না। শুধু ত্রিশ দিন কেন,ত্রিশ জনমেও আপনার প্রতি কোনো প্রেম আসবেনা আমার।
বাকা হাসলো আদিত্য। সে জানতো নূরের সাথে এই কৌশলটাই কাজ করবে।
–ঠিক আছে। তাহলে কাল থেকে সময়মত চলে এসো।
–তার আগে আমার একটা শর্ত আছে।
–কী শর্ত?
–আপনি আমাকে কোনোরকম ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। আমার সাথে উল্টো পাল্টা কিছু করার চেষ্টা করবেন না। যদিও আমি সেটা কখনো সেটা হতেও দিবোনা। তবুও বলে রাখি, যদি কোনরকম লু,চ্চা,মি করার চেষ্টা করেন তাহলে সেদিনই আমাদের মাঝের এই চ্যালেঞ্জও শেষ হয়ে যাবে।
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আদিত্য। মেয়েটা কী সত্যিই তাকে এতো খারাপ ভাবে? নিজের হতাশা লুকিয়ে বলল,
–ঠিক আছে। কাল আমি অপেক্ষা করবো তোমার। এখন আসি। বাই।
চোখে সানগ্লাস টা লাগাতে লাগাতে বেড়িয়ে গেল আদিত্য। তার হাতে শুধু ত্রিশ দিন আছে। এই ত্রিশ দিনে নূরের মনে নিজের জায়গা করতে হবে। নাহলে যে নূরকে চিরতরে হারিয়ে ফেলতে হবে ওকে। যেটা সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না। নূর বিনা জীবন যে এখন কেবলই মৃ,ত্যু সমান।
চলবে……