#উজানে_ফেরে_নদী (শেষ পর্ব)
১৪.
জ্ঞান ফেরবার পর বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল বলেই ডাক্তার নদীকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। হৃদি নদীর পাশেই বসে রইলো। নদী কিছুতেই আসতে চায়নি প্রথমে। আরিফ আর তার জোরাজুরিতেই এল। আর কাকতালীয় ভাবে কিনা আজকেই ওই ছেলেটা সামনে এসে হাজির হল। এর কোনো মানে হয়।
উজানরা হাসপাতালের সামনেই অপেক্ষা করছিল। আরিফ আসতেই সবাই মিলে উপরে এল। জাহানারা ভেতরে যেতেই হৃদি বেরিয়ে এল।
-এখন কেমন আছে?
-অস্থির হয়ে ছিল অনেক। ডাক্তার ঔষধ দিলেন। তারপর ঘুমিয়েছে।
আরিফের পাশেই উজান আর রনি দাড়িয়ে।
-তোরা যাবি দেখতে?
-এত লোক যাওয়া কি ঠিক হবে? তুই বরং উজানকে নিয়ে যা।
দুজনে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে আসে। জাহানারা মেয়ের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে দোয়া পড়ছেন। উজান চমকে উঠলো। এ কোন নদীকে দেখছে সে? একদম চেনাই যায় না। উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়েটা হাসপাতালের বিছানার সাথে মিশে আছে। নার্স এসে তাদের বাইরে পাঠিয়ে দিল। বাইরে আসতেই উজান আরিফকে একপাশে টেনে নিয়ে আনলো।
-কি হয়েছিল নদীর? এমন তো ছিলনা ও?
-তুই ওকে চিনিস?
-চিনি তো। কতদিন ধরে খুঁজছি ওকে। কিন্তু কোনো ভাবেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তুই যখন বললি তোর নদী নামের একটা কাজিন আছে তখন ও চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখা পেলাম না। আজকে রাফাত বলাতে বুঝতে পারলাম আমি যাকে খুঁজছি ও সেই।
-ওই শয়তানটার কথা বলবি না। ওর জন্য পুরো জীবনটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার।
-কি হয়েছে আমাকে পুরোটা বল?
-কি আর হবে? যা হয় আজকালকার দিনে। ভালবাসা নিয়ে খেলেছে আর কি? তারপর নদী প্রেগন্যন্ট হলো যখন তখন ওকে দূর করে দিয়েছে। আর সেই মানসিক চাপে বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে ও মরতে বসলো। তারপর তো পুরোই মানসিক রোগী। স্বাভাবিক অবস্হায় আনতে কত সাধনা করতে হল। আজ তো আবার সেই অবস্হা।
উজান দেয়ালে হেলান দিল। দাড়িয়ে থাকবার শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে।
-বাচ্চার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলিস না। আমি কাউকে কিছু জানায়নি।
-তুই নিশ্চিন্তে থাক। আমি কাউকে কিছু বলবো না। তবে আমার কিছু বলার আছে।
-কি?
-তোদের পরিবারের আপত্তি না থাকলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।
-তোর কি মাথা খারাপ? এখন এই সিদ্ধান্ত কি নেয়া যায়। ওর শরীরের অবস্হা দেখেছিস? আর মানসিক ভাবেও ও স্টেবল না।
-তাতে কি? আমি তো স্টেবল।
-এমন করে হয় না রে। তুই বাসায় যেয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাব। তোর পরিবারের মতামতের বিষয় আছে। আর নদী সুস্থ হোক আগে। ওর অবস্হা কেউ না জানুক আমি জানি।
-আমি ভেবেই বলছি। নতুন করে ভাবার কিছু নেই। বাসায় আমি ম্যানেজ করবো। আর সুস্থ তো ওকে হতেই হবে। কোন রকম সাহায্য লাগলে জানাস আমাকে। আমি চলে আসবো। এখন হাসপাতালে ভীড় না বাড়াই।
হাসপাতাল থেকে দুজনে বেরিয়ে এল। বাইকে বসেই রনি বলল,
-এই তাহলে তোর নদী?
-হমম।
-খুঁজে পেয়ে গেলি শেষ পর্যন্ত।
-তা তো পেলাম।
-আমিও একটা ইনফরমেশন পেলাম।
-কি?
-রাহেল কে ওই ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম। ও বলেছে ওটা আরিফের নামে রেজিস্ট্রেশন করা।
-মানে?
-মানে সিম কার্ডটা আরিফের হলেও ওটা নদী ব্যবহার করে। আমি হৃদির কাছ থেকে কনফার্মড হয়েছি।
-কেন এমন হল বলতো?
-তা তো জানি না দোস্ত। জীবনটা আমাদের ঠিকই তবে তার নিয়ন্ত্রন সবসময় আমাদের হাতে থাকে না। চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
উজানকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে রনি চলে গেল। যাবার সময় যত তাড়া ছিল সিঁড়ি ভেঙ্গে নামার এখন ঠিক উল্টো হয়ে গেল। বাসাতেই যেতে ইচ্ছা করছে না। সে রাস্তায় চলে এল। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটলো কিছুক্ষন। তারপর ফিরে এল। যাবার কোনো জায়গা নেই।
১৫.
নদীকে আজ বাসায় আনা হয়েছে। জাহানারা ঠিক করেছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নদীকে নিয়ে ফিরে যাবেন। ভাল মেয়েটাকে নিয়ে এলেন। আর কি থেকে কি হয়ে গেল। প্রথম কদিন তো মেয়েটা কাউকে চিনতেই পারছিল না। শুধু মাত্র উজান নামের ছেলেটা যখন এসে বলল, “আমি কে বলতো।” তখন কি করে যেন চিনে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক হতে শুরু করেছে। তার নিজের ছেলে থাকলে, তিনি এমন একটা ছেলের মত ছেলেই চাইতেন। প্রতিদিন অফিস শেষে হাসপাতালে এসেছে।
মেয়েকে গোসল করতে বলে তিনি রান্না ঘরে এলেন। রান্না ঘরের অবস্হা ভয়াবহ, দেখে তিনি মাথায় হাত দিলেন। সব কিছু এলোমেলো। এ কদিন হৃদি রান্না করেছে। কবে যে মেয়েটা গুছানো শিখবে। তিনি জিনিসগুলো গুছাতে শুরু করলেন।
গোসল শেষ করে এসে নদী তার হ্যন্ডব্যাগটা খুঁজে পেল না। কোথায় রাখলো? উজানের আসবার কথা ছিল হাসপাতালে আজ। এল না কেন?
-হৃদি এই হৃদি?
-কি হয়েছে আপু?
-আমার ব্যাগটা কই দেখতো?
-কি লাগবে বল?
-আমার ফোনটা এনে দে।
-কাকে ফোন দেবে?
-সেটা দিয়ে কি হবে? এনে দে।
-জানি কাকে ফোন করবে।
-তাহলে তো ভালই।
হৃদি ফোনটা চার্জে লাগিয়ে দিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখলো।
-আগে চার্জ হতে দাও। তারপর যত খুশি কথা বল।
-তুই যা তো।
-এখন তো যেতে বলবেই। পরে ডাকলে কিন্তু আসবো না।
-আসিস না।
হৃদি চলে যাওয়া মাত্রই সে ফোনটা নিল। ম্যাসেজ করলো সাথে সাথেই।
“কোথায় আপনি? আজ এলেন না যে?”
“আমাকে তো সহ্যই করতে পারতি না আগে? আমি আসলেই কি আর না আসলেই কি।”
“আপনার মত আজব মানুষ আমি কখনোই দেখিনি আগে। আগেও যেমন অদ্ভুত ছিলেন এখনও তেমনটাই আছেন”
“আজবের কি দেখলি? অফিসের জরুরী কাজে আটকে গেছি। কাল আসবো।”
“তোমাকে দেখলে ইচ্ছে করে শুরু থেকে শুরু করি আমার জীবন।
তোমাকে দেখলে ইচ্ছে করে মরে যাই, মরে গিয়ে পুণ্য জল হই
কখনও তৃষ্ণার্ত হলে তুমি সেই জল যদি ছুঁয়ে দেখো।”*
“বুঝলাম। এখন রেস্ট নে। বাসায় আছিস বলেই যা ইচ্ছা করবি তা কিন্তু না। অযথা চিন্তা ভাবনা করা ছেড়ে দে। এখন আর কোনও ম্যাসেজ না। আর একটা ম্যাসেজ পাঠাবি তো কাল আর আসবো না।”
“আসার দরকার নেই।”
“মাইর খাবি কিন্তু।”
“এত সহজ নাকি?”
“সেটা আসলেই দেখতে পাবি।”
জাহানারা হৃদি আর আরিফকে টেবিলে খাবার দিয়ে নদীর জন্য খাবার নিয়ে ঘরে এলেন।
-আমি টেবিলেই খাব মা। বিছানায় বসে খেতে খুব বিরক্ত লাগে।
-তাহলে আয়। ওরাও খেতে বসেছে।
অনেকদিন পর সবাইকে একসাথে বসতে দেখে জাহানারার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
-উজান এলনা কেন আজ আরিফ? এ কদিন তো হাসপাতালে ঠিকই আসতো।
-ওর আজকে ঢাকার বাইরে একটা কাজ পড়ে গেছে। তা না হলে তো আমিই নিয়ে আসতাম।
-ছেলেটা কদিনেই কেমন আপন হয়ে গেছে। মনে হয় যেন এ বাড়িরই ছেলে।
নদী বিষম খেল এই কথায়। আর হৃদি হিহি করে হাসতে শুরু করলো। জাহানারা নদীকে তাড়াতাড়ি করে পানি এগিয়ে দিলেন।
-তুই হাসছিস কেন? হাসির কি বললাম?
-কিছু না মা। এমনি।
-তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। সবসময় শুধু হাহা হিহি।
১৬.
গাজিপুর থেক ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল উজানের। বাসায় শুধু উর্মি জেগে। দরজা খুলে দিয়ে উর্মি রান্না ঘরে গেল।
-আমি খেয়ে এসেছিরে।
-তাহলে আমি সব তুলে রাখছি। ক্ষুধা লাগলে বাহির করে নিও ফ্রিজ থেকে।
-আচ্ছা। তুই ঘুমিয়ে পড়।
সারাদিন বাইরে ঘুরতে হয়েছে। গা ঘেমে আর ধুলাবালিতে চটচট করছে। ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করতেই ক্লান্তি সব উধাও হয়ে গেল। বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ফোনটা চেক করলো। সে মানা করবার পর নদী আর ম্যাসেজ পাঠায়নি। রাগ করেছে নাকি আবার? মেয়েদের বোঝা বড় কঠিন ব্যাপার।
“আমার বুকের ভেতর একটা ছোট্ট নদী ছিল
সেই নদীতে অনেক “তবু, কিন্তু, যদি” ছিল।
উথালপাতাল ঢেউয়ের মত অল্প কিছু গল্প
সবটুকু তার লিখব কখন জীবন বড়ই স্বল্প
দিনের শেষে সূর্য যখন পালাবে টুপ করে
তুমি তখন কানটি পেতো গোপনে চুপ করে।
সব কোলাহল থামলে পরে শুনবে সে চুপকথা
ছোট্ট নদীর ঢেউয়ের মাঝে কতই না রূপকথা।”*
“আমার মাঝে কোনো রুপকথা নেই। আছে কিছু কলুষতা। আপনাকে বলা হয়নি। বললে হয়তো ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবেন। তবুও আমি বলতে চাই। কাউকে বলতে না পেরে আমি আরও হাপিয়ে উঠছি।”
“তোকে কিছু বলতে হবে না। আমি জানি সব। তুই কি রাফাতের সাথে কথা বলতে চাস? ওর নাম্বার আমার কাছে আছে।”
“কখনই চাই না।”
“তাহলে আর কি। সব ভুলে যা নদী। দেখিস আমরা খুব ভাল থাকবো।”
নদী কোনো উত্তর দেয় না। সত্যি কি সে ভাল থাকতে পারবে আর কখনও? ছোট্ট ছিমছাম একটা সংসারের স্বপ্ন তো তার বহুদিনের।
“চুপ হয়ে গেলি কেন? এই জন্যই তো বলি চিন্তা ভাবনা বাদ দে। এখন ঘুমা। কাল সকালেই চলে আসবো।”
পাশে কেউ ধপ করে এসে বসতেই নদীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। হৃদি এসে বসেছে। হেসে গড়িয়ে পড়ছে তার গায়ে।
-কি হয়েছে ? এত সকালে এই ঘরে তোর কি কাজ?
-অনেক জরুরী কাজ। তোর ঘরের বারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে তাকা তাহলেই বুঝতে পারবি।
-মানে?
-মানে মানে পরে করিস। লুকিয়ে দেখে আয় আগে।
নদী উঠে গিয়ে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়ালো। রাস্তার ওপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে উজান দাঁড়িয়ে। সে ঘড়ির দিকে তাকালো। সাতটা বাজে মাত্র। এত সকালে এখানে দাড়ায় থাকার কারণ কি? সে ফিরে এসে বিছানায় বসলো।
-দেখেছিস তোর মজনু কে?
-বয়সে বড় কাউকে নিয়ে এমন ফাজলামি কেউ করে নাকি হৃদি।
-হিহিহি। ফাজলামি করবো না তো কি করবো? একমাত্র দুলাভাই বলে কথা।
-তুই দেখতে পেলি কিভাবে?
-মা রান্নাঘরের বরান্দা থেকে দেখতে পেয়ে আমাকে ডাক দিল। হিহিহি। বাসায় আসতে বল আপু। বেচারার ডেঙ্গু হয়ে যাবে। আল্লাহ জানে কখন থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
ফোন হাতে নিতেই ম্যাসেজটা দেখে। কিছুক্ষন আগে পাঠিয়েছে।
“তোমায় ছাড়া পৃথিবী বর্ণহীন,
আলো ঝলমলে দিনগুলি পানশে লাগে…
মনের আকাশে মেঘ জমে যায়।
তোমায় ছাড়া সব অসম্পূর্ণ,
মন বসে না কোন কাজে…
সময় থেমে যায়।
তোমায় ছাড়া প্রকৃতি কুয়াশার চাদর জড়ানো,
আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অলসতা …
আলো নিভে যায়।
তোমায় ছাড়া জীবন বিস্বাদ,
স্বপ্নগুলো ভয়ঙ্কর হতে থাকে…
জীবন প্রদীপ নিভে আসে,
অন্ধকারে ঢেকে যায়।
তোমায় ছাড়া মরণও স্হবির,
শ্বাস চলতে থাকে…
নিভুনিভু জীবন প্রদীপ…
দমকা বাতাসের অপেক্ষায় থেকে যায়।”*
সে ফোন করে।
-হ্যালো
-কোথায় আপনি?
-তোমার আশেপাশেই আছি।
-এত সকালে আশেপাশে কি করেন?
-ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম চলে আসি।
-এখন তো মনে হচ্ছে আমার মাথায় সমস্যা না। সমস্যা আপনার মাথায়।
-ঠিকই বলেছ। তোমার জন্যই তো হল।
-বাসায় আসেন। বাইরে দাড়িয়ে থাকা লাগবে না।
-এত সকালে যাব? সবাই কি মনে করবে?
-সবাই জানে আপনি বাইরে দাড়িয়ে আছেন।
-হায়হায়। কি লজ্জা কি লজ্জা। আমি তাহলে চলে যাই। পরে আসবো।
-পরে না এক্ষুনি আসেন।
-আসতে পারি একটা শর্তে।
-কি শর্ত?
-আজীবন আমার সাথে থাকবে বল।
-আমি তো থাকতেই পারি তবে আপনাকে অনেক রকম ঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে।
-তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
-আচ্ছা ঠিক আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর কথা বলতে হবে না। বাসায় আসেন।
-এক্ষুনি আসছি। চাচী থুক্কু মানে হবু আম্মাজানকে নাস্তা রেডী করতে বল। ক্ষুধায় মারা যাচ্ছি।
-আপনি পারেনও।
-পারি তো বটেই। তবে আপনি বলা বন্ধ না করলে আসবো না। বাহিরেই দাড়িয়ে থাকবো।
-অনেক ঢং হয়েছে। এবার আসোতো।
-এইতো লক্ষী মেয়ে।
ফোনটা রাখা মাত্র কলিংবেল বাজলো।
সমাপ্ত।
এমি।
*প্রথম কবিতা-তসলিমা নাসরিন।
*দ্বিতীয় কবিতা- মৌলী আখন্দ।
* শেষেরটা আমার লিখা।
* কপি করা নিষেধ।