#উজানে_ফেরে_নদী (৭,৮)

৭.

একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে কোথায় চলে গেল? সেদিনের পর থেকে আর একবারের জন্যও সে নদীকে দেখেনি। ফোনও বেজে যায় কেউ রিসিভ করে না। প্রথমে ভেবেছিল নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হলেই হয়তো দেখতে পাবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ ক্লাস হবার পরও যখন নদী এল না। তখন সে অস্থির হয়ে পড়লো। শরীর খারাপ করেনি তো? রাফাতের কাছে গেলে নিশ্চই খোঁজ পাওয়া যাবে। ছেলেটাকে যদিও তার অসহ্য লাগে। কিন্তু আপাতত কিছু করার নেই।
-কি ব্যাপার বড় ভাই কি মনে করে এখানে?
-তোমার সাথে কথা আছে।
-বলেন, কি বলবেন?
-নদী কোথায়?
-নদী কোথায় তা আমি কি করে বলবো? দেখেন হয়তো কোন সাগরের সাথে পালিয়েছে।
উজান মাথা ঠিক রাখতে পারলো না। ঠাস করে একটা চড় মেরে বসলো। রাফাত কিছুক্ষন চুপ থেকে হেসে ফেলল।
-বড়ভাই মাথা ঠান্ডা রাখেন। আপনার চড়ের জবাব কিন্তু আমি এখুনি দিতে পারি। সামনে নির্বাচন জানেনই তো। এখন প্রকাশ্যে মারামারি করে আমি আমার ইমেজ তো নষ্ট করতে পারিনা। যান মাফ করে দিলাম। আর ওই .. মেয়ের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এরপর আর এই বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করলেই খুশি হব।
-ও খারাপ মেয়ে আর তুই কি দুধে ধোয়া তুলসি? শয়তান তোকে আজ মেরেই ফেলবো।

ওদের আটকাতে অনেকেই এসে পড়লো। দুজনকে আলাদা করতে বেশ বেগ পেতে হল।
উজান আর কোনো কথা না বলে সরে এল। রাগে গা কাঁপছে। এতক্ষন খেয়াল করেনি এখন দেখলো নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। ওয়াশরুমের এসে ভাল করে পানি দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফেলল। ওই শয়তানটার কাছে যাওয়াই উচিৎ হয়নি। ওর বান্ধবীদের সাথে কথা বললে হয়তো খোঁজ পাওয়া যেত। ওয়াশরুম থেকে বাইরে এস দাঁড়াতেই তুলি এসে দাঁড়ালো।
-উজান ভাই।
-কিছু বলবে?
-নদীকে খুঁজছেন?
-হ্যাঁ। তুমি কি জানো ও কোথায়?
-ওর ফুপুর বাসায় মনে হয়।
-তুমি কি ঠিকানা জানো?
-জিগাতলায়। কিন্তু ঠিকানা তো জানি না।
-কোনো ফোন নাম্বার?
-না ভাইয়া। তবে মিতা আপু জানতে পারে।
-থ্যাংক ইউ তুলি।
-ওয়েলকাম ভাইয়া। তবে আপনি রাফাতকে মেরে ভাল করেননি। ও কিন্তু এর প্রতিশোধ নেবেই। সাবধানে থাকবেন।
-সমস্যা নেই। ও কিছু করবে না। ও শুধু ওর নিজের ক্ষমতার কথা জানে।কিন্তু ওর থেকেও ক্ষমতাবান লোকও তো আছে।

তুলি চলে যেতেই সে তার বড় মামাকে ফোন করলো। তার মামা সরকারী দলের মন্ত্রী। হায়দার আলী অসময়ে ভাগনার ফোন পেয়ে বেশ অবাক হলেন। উজানকে উনি অনেক ভালোবাসেন।
-আসসালামুয়ালাইকুম মামা।
-ওয়ালাইকুমআসসালাম। কি খবর রে তোর? এই সময় কি মনে করে?
-একটা সমস্যা হয়েছে মামা। উজান পুরো ঘটনা খুলে বলল।
-আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। আমি বলে দিচ্ছি। আর তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সাথে দেখা করতে আসবি। আগামী দুই দিন সন্ধ্যার পর আমি বাড়িতেই আছি।
-আচ্ছা মামা। আমি আসবো।
-এখন বাড়ি চলে যা।
-ঠিক আছে।

মিতার সাথে তার দেখা হল দুদিন পরে। ওর ডিপার্টমেন্টের অনেকেই তার বন্ধু। ইমনের কাছে ক্লাসের সময় জেনে নিয়ে সে ক্লাসরুমের পাশেই দাড়িয়ে থাকলো। ইমন মিতাকে বলেছে, যে উজান কথা বলতে চায়। তাই মিতা উজানকে দেখেই তার দিকে এগিয়ে গেল।
-কি ব্যাপার বলোতো? আমাকে নাকি খুঁজছো?
-নদীর খোঁজ জানতে চাইছিলাম। তুমি কি জানো?
-ও তো ওর আত্মীয়র মানে ফুপুর বাসায়।
-ঠিকানা জানো কি?
-তা তো জানি না।
-আসছে না কেন?
-অসুস্থ। তাই ওর কাজিন নিয়ে গেছে।

ক্লাসে এসে মিতা কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারলো না। উজানকে অনেকগুলো মিথ্যা বলে ফেলেছে। না বললেই হত। ছেলেটা হয়তো সত্যি ওকে পছন্দ করে। কিন্তু নদী যে ওকে কিছু বলতে মানা করে দিয়েছে।

নদী ঢাকাতেই আছে। সেদিন সে নিজেই ওকে হাসপাতালে নিয়েছিল। প্রচন্ড মানসিক চাপের কারনে মিসক্যারেজ হয়ে গিয়েছিল। নদীর শারিরীক এবং মানসিক অবস্থা খারাপ দেখেই সে বাধ্য হয়ে নদীর ফোন থেকে আরিফকে ফোন করে। তারপর আরিফ প্রতিদিন হাসপাতালে এসেছে। শারীরিক অবস্থা একটু ভাল হতেই সে নদীকে তার ফুপুর বাসায় নিয়ে গেছে। মিতাকে বিশেষভাবে রিকোয়েস্ট করেছে নদীর মিসক্যারেজের কথা যেন কাউকে না বলে।

৮.

বিয়ে বাড়ির হইচই এখন আর নেই। দাওয়াতি লোকজন সবাই চলে গেছে। এখন শুধু আরিফদের নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধু বান্ধবরা আছে। বর বউকে ঘিরে অনেক রকম আয়োজন করা হয়েছে। সেগুলো নিয়েই এখন সবার ব্যাস্ততা। সব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হতেই বাড়ির মেয়েরা বউকে ভেতরে নিয়ে গেল। অন্য সবাই নিজেদের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আরিফ ওর এলাকার বন্ধুদের সাথে বাইরে যাবে। তাই রনিও ওর সাথে গেল। উজানের ভাল লাগছিল না। বকুল গাছটার পাশে এসে দাঁড়ালো। কেন জানি নিজেকে খুব নিসংঙ্গ লাগছে। নিজের ভেতরের কষ্টের পাহাড়টা সময়ের সাথে সাথে সহনীয় হয়ে এসেছিল, সেটা হঠাৎ করেই ভারি হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এখানে এসে তবে কি সে ভুল করল?
গাছের নীচে বসল সে। বেশ সুন্দর বাতাস। সব জায়গার একটা মায়া থাকে। যতদিন বেশী সেখানে থাকবে ততই সে মায়ায় জড়িয়ে যাবে। দুদিনেই এই জায়গাটা কেমন আপন হয়ে গেছে। ফিরে যেতে মন চাইছে না।

-আপনার চা।
দশ বারো বছরের একটা মেয়ে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল।
-আমি তো চা চাইনি। কে পাঠালো চা?
-নদী আপা পাঠাইছে।
-কোথায় তোমার আপা?
-রান্না ঘরে।
-নাম কি তোমার?
-বৃষ্টি। আমি এখন যাই।
-আচ্ছা।

হঠাৎ করে তাকে চা পাঠাতে গেল কেন? ভাবতে ভাবতেই চায়ের কাপে চুমুক দিল।
-চা কই পেলি?
-ওহ্ তুই। গেলিনা আরিফের সাথে?
-নাহ টায়ার্ড লাগছে। তোর কি হয়ছে সেটা বল?
-কিছু না।
-না বললেই হল। কিছু তো একটা নিশ্চই হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই দেখছি তুই কেমন অন্যমনস্ক। মনে হচ্ছে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিস? কাকে খুঁজছিস।
-নদীকে।
বলেই উজান মাথা নিচু করলো। বলে মনে হয়ে ভুল করে ফেলল। আরিফের কানে গেলে ব্যাপারটা হিতে বিপরীতও হতে পারে।
-নদী? আরিফের কাজিনের কথা বলছিস?
-আমি ঠিক জানি না। আমি যাকে খুঁজছি এ সেই নদী কিনা।
-তোর পরিচিত হলে নিশ্চই চিনতে পারতি। মনে হয় সে না।
-আমিও সেটাই ভাবছিলাম। তবুও মনটা কেন খচখচ করছে।
-আচ্ছা আয়।
-কোথায়?
এ বাড়ির রান্না আর খাবার ঘর উঠানের উল্টা দিকে। রনি তাকে টেনে রান্না ঘরের সামনে নিয়ে এল। ওদের দেখে জাহানারা বেরিয়ে এল রান্না ঘর থেকে।
-কিছু লাগবে বাবা?
-না তো চাচী। নদী নাকি চা পাঠিয়েছিল। চা খুব ভাল হয়েছে বলে উজান ওকে ধন্যবাদ দিতে চায়।
-ও তো এর চা নিয়ে উপরে ওর ঘরে চলে গেছে। সমস্যা নেই ধন্যবাদ দিতে হবে না। তুমি চা খাবে?
-না চাচী।
-তোমাদের খাবার রেডি করছি। আরিফ আসলেই খাবার দিয়ে দেব।
চায়ের কাপটা জাহানারার হাতে দিয়ে তারা দুজনে নিজেদের ঘরে এল। রনি এসেই শুয়ে পড়লো।
-কি মনে করলেন উনি?
-ধুর.. কি মনে করবে? যেই জন্য গেলাম সেই কাজ তো হল না।
-তোর মাথায় যে কি করে এইসব বুদ্ধি আসে। এখন নিজের জিনিসগুলো গুছিয়ে ফেল। সময় বেশী নেই।
উজান নিজের জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে ফেলল। তারপর যেই কাপড়গুলো পরে যাবে সেগুলো নিয়ে গোসলে ঢুকলো। জার্নি করবার আগে গোসল করলে বেশ আরাম লাগে।

-কি রে শুয়ে পড়েছিস যে? আরেকজন কই?
রনি ইশারায় বাথরুম দেখালো।
-তোরা কিন্তু আরও একদিন ছুটি নিয়ে আসলেই পারতি?
-হমম, তাহলে বস আর নিজের বিয়ের ছুটি দিত না।
-রেডী হয়ে নে তাহলে।

উজান আর রনি কে বিদায় দিয়ে আসার পথে আরিফ লক্ষ্য করলো নদী পুকুর পাড়ে অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গেল।
-এখানে কি করিস এই সন্ধ্যাবেলা?
-এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন ওনারা?
-ছুটি নেই।
-তোমার কেমন বন্ধু? ওনাদের পরিবার কোথায় ? একা এসেছিলেন যে?
-এত প্রশ্ন কেন?
-এমনিতেই।
-ওদের কেউ বিয়ে করেনি। ভাল বন্ধু না হলে নিশ্চই আসতো না। আর কিছু?
-নাহ।
-তোর ঔষধগুলো ঠিক মত খাচ্ছিস তো?
-হমম।
-আচ্ছা ভেতরে যা।

নদীর পেছনে পেছনে আরিফ বাসায় ঢুকলো। তার ঘরের সামনে যেতেই সব কাজিনরা মিলে দরজার সামনে দাঁড়ালো। ওদেরকে টাকা না দিলে তাকে ঘরে ঢুকতে দেবে না কিছুতেই।
-মা বাবা… চাচু চাচী.. এরা কি পেয়েছে বলোতো? কথায় কথায় এদের টাকা দিতে হবে। দুপুর থেকে কতবার টাকা দিলাম বল।

-দিয়ে দে বাবা। কতদিন পর সবাই মিলে আনন্দ করছে বল। নদী অসুস্থ্য হবার পর তো সবাই হাসতেই ভুলে গিয়েছিল।
-আমার কাছে আর টাকা নেই। তুমি দিয়ে দাও।
-এই তোরা আয় আমার সাথে। ওকে যেতে দে।
আনোয়ারা বেগম নিজের ঘরের দিকে যেতেই সবাই তার পিছু নিল।

চলবে…..

এমি।

*কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here