#উজানে_ফেরে_নদী (৫,৬)

৫.

বাড়িতে এসে নদীর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বাসায় বসে বসে দাদীমার মাথায় এসব উদ্ভট চিন্তা আসে। আর তিনি যা বলেন, তার ছেলেরা তাতেই মাথা নাড়ায়। আরিফ ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে? এটা তো সে জীবনেও চিন্তা করেনি। কার সাথে কথা বললে এই সমস্যার সমাধান হবে। রাগ এবং দুঃখে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো। দাদীমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে সোজা পুকুর পাড়ে চলে এল। আসাটাই ভুল হয়েছে। না আসলেই এই ঝামেলায় পড়তে হত না। পায়ের শব্দে পেছেনে ফিরে তাকালো। আরিফ ভাই এসে দাড়িয়েছে।

-তুমি এই বিয়েতে রাজি?
-কেন তুই রাজি না?
-কি বলছ এসব? তোমাকে সব সময় বড় ভাইয়ের মত দেখেছি।

আরিফ চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষন। নদীর থেকে সে মাত্র এক বছরের বড়। ছোট বেলা থেকেই এক সাথে বেড়ে ওঠা। কখন যে তার মনে ভালবাসা নামক অনুভূতির জন্ম হল তা তো সে নিজেই জানে না। পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েও সে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল যাতে তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ভাল জবে ঢুকেই নদীকে বিয়ে করে ফেলতে পারে। আচ্ছা দাদীমা কি তার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন? হঠাৎ করেই এমন সিদ্ধান্ত জানালেন? কিন্তু নদীর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওর কেউ গলা চেপে ধরেছে। ওর কি এই বিয়েতে অমত? অন্য কাউকে ভালবাসে নাকি? অনেকের কাছে শুনেছে অবশ্য রাফাত নামের একটা ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করে।

-তুই কি অন্য কাউকে পছন্দ করিস?
-পারলে তুমি মানা করে দাও প্লিজ।
-এটা তো আমার প্রশ্নর উত্তর হল না।
-তুমি মানা করবে না তাই তো? আচ্ছা আমি দাদীমার সাথে কথা বলে নেব।

নদী উঠে চলে যায়। আরিফ সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কি ভেবে রেখেছিল আর এখন কি হচ্ছে? পরিবারের সবার সামনে মুখ দেখাবে কি করে? কালকেই সে ফিরে যাবে।

সন্ধ্যায় দাদীমার ঘরে আরিফের ডাক পড়ল। সে ঘরে ঢুকতেই দাদীমা কাজের মেয়েটাকে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।
-আয় দাদাভাই আমার পাশে এসে বস। তোর সাথে আমার কথা আছে।
আরিফ দাদীমার পাশে গিয়ে বসলো। দাদীমা তার মাথায় হাত রাখলেন।
-জানি দাদাভাই তোর অনেক কষ্ট হবে। কি করবি বল? একটা বিয়েতে তো দুই পক্ষেরই সম্মতি লাগে। জোর করে আর যাই হোক একটা সম্পর্ক টেনে নেয়া যায় না। তোকে তো বোঝানোর কিছু নাই। আমি তো তোর মনটা বুঝি কিন্তু নদী তো তোকে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
-ওর কি অন্য কাউকে পছন্দ?
-তা তো থাকতেই পারে। ওরে ওর মত থাকতে দে।
-ঠিক আছে দাদীমা।
-আরেকটা কথা।
-বল।
-তুই চাইলে হৃদির সাথে তোর বিয়েটা দিই।
-আমাকে একটু সময় দাও দাদীমা।
-সমস্যা নাই সময় নে। তবে হৃদি কিন্তু তোরে খুব পছন্দ করে। ভালবাসাহীন জীবন কাটানোর চেয়ে তোকে যে ভালবাসে তার সাথে জীবন কাটানো কিন্তু অনেক সহজ।
-আমি তোমাকে জানাবো দাদীমা।

জাহানারা শাশুড়ীর ঘরের বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন। আরিফ ঘর থেকে বের হতেই চাচীর সাথে চোখাচোখি হল। সে মাথা নামিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে এল। জাহানারা সোজা নিজের মেয়ের ঘরে এলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। নদী শুয়ে ছিল। মাকে দেখে উঠে বসলো।
-কিছু বলবে মা?
-আমি বলবো কি? বলবি তো তুই? কি বলেছিস তোর দাদীকে? লজ্জা শরম কি ঢাকায় যেয়ে সব ধুয়ে ফেলেছিস?
তিনি উত্তেজিত হয়ে দৌড়ে গিয়ে মেয়ের চুলের মুঠি ধরলেন। তারপর এলো পাথাড়ি মারতে শুরু করলেন। মা যে তাকে মারতে পারে সেটা সে বিশ্বাস করতে পারছে না। নদী চুপ করে গেল। এখন বাধা দিতে গেলেই মা আরও রেগে যাবে। চুপ করে থাকতে দেখেই তিনি নদীকে ছেড়ে দিলেন।
-তুই কাল সকালেই ঢাকা যাবি। আর যেই ছেলেকে পছন্দ করিস তাকে তার পরিবার সহ নিয়ে আসবি। বাড়ির অসন্মান আমি হতে দেব না। তোকে ভাল ভাবে বিয়ে দিয়েই বিদায় দিব। আর তা যদি না পারিস তাহলে হৃদির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এমুখো হবি না। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই এখন যেমন পেয়ে যাস আগামীতেও পাবি। ব্যাগ গুছায় ফেল। নয়ন সকালের বাসে তোরে তুলে দিয়ে আসবে।

জাহানার ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই নদী বাথরুমে ঢুকলো। চেহারায় এর মধ্যেই কালো দাগ পড়ে গেছে। বেশী করে ঠান্ডা পানি মুখ দিয়ে সে আবার শুয়ে পড়ল। রাফাতকে রাজি করিয়ে আনতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

৬.

প্রায় দুই সপ্তাহ হয়েছে নদী ঢাকায় ফিরেছে। এর মাঝে বাড়ি থেকে কেউ তার সাথে যোগাযোগ করেনি। রাফাতের সাথেও তার দেখা হয়নি। ফোনে কথা হয়েছে শুধু। বন্ধুদের নিয়ে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল। আজ ডিপারটমেন্টে আসবে বলেছে। নদী তাই সকাল সকাল চলে এল। ওর সাথে যে কোন মূল্যে আজ দেখা করতেই হবে।

ডিপার্টমেন্টে এসে ঘন্টাখানেক সে একজায়গাতেই দাড়িয়ে থাকলো। বলেছিল তো আসবে তাহলে কি মধুর ক্যান্টিনে আছে? সে কি তবে সেখানে যাবে। ওখানে যদি না থাকে? ফোনটাও তো ধরছে না। উজানকে দেখতে পেল। তাকে দেখে এগিয়ে এল।

-কোথায় ছিলি এতদিন?
-কোথায় থাকবো আবার। এখানেই ছিলাম।
-শরীর খারাপ নাকি ? মুখ চোখ এমন শুকনা কেন? কি হয়েছে বলতো?
-আপনার আমাকে নিয়ে এত চিন্তা না করলেও চলবে।
-আচ্ছা চিন্তা না হয় নাই করলাম। আচ্ছা থাক তাহলে। কোনো কিছুর দরকার হলে ফোন করিস।
-রাফাতকে দেখেছেন?
-আসবার সময় মল চত্বরের ওই দিকে দেখলাম। এখন আছে কিনা জানি না।

উজানের কথা শেষ পর্যন্ত না শুনেই নদী দৈাড় দিল। হাঁপিয়ে গেল একটু এসেই। তবে রাফাতকে পেয়ে গেল।
-তোমার সাথে কথা আছে।
-কি কথা বল।
-একটু এদিকে আসতে হবে।
-আচ্ছা দাঁড়া একটু। সবাইকে বিদাই করে নেই।

নদী একটা গাছের গোড়ায় বসে পড়লো। অনেকদিন পর দৌড়ানোর কারণে নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে নিল।

-কি হয়েছে বল?
-আমার বাসায় তোমার কথা বলেছি। সবাই তোমার বাবা মা আর তোমার সাথে কথা বলতে চায়।
-কেন?
-কেন মানে? আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।
-বিয়ে? তোর কি মাথা খারাপ। এখনই কিসের বিয়ে।
-আমি মজা করছি না রাফাত। আমার বাসায় অনেক সমস্যা হচ্ছে।
-আমিও মজা করছি না। লেখাপড়াই শেষ হল না।
-তাহলে আমি বাসায় কি বলবো?
-সেটা তুই জানিস। তোর বাসার ব্যাপারে চিন্তা তোর করবার কথা। আমার না।
-আমাদের সম্পর্কটা এতই ঠুনকো তোমার কাছে?
-এমন সম্পর্ক তো আমার অনেক আছে ডার্লিং। একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারতি।

রাফাত তাকে রেখে চলে গেল। কি বলে গেল ও? সবাই তাকে অনেক করে বোঝাতো যে রাফাতের অনেক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক। তা তার বিশ্বাসই হতো না। সে হাটতে শুরু করলো। অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে কিন্তু এই ভুল সে শোধরাবে কি করে?

নদী আজকাল নিজের ঘরেই থাকে। বিছানায় মরার মত পড়ে থাকতেই ভাল লাগে। নিজে নিজে আত্মহত্যা করবার অনেক রকম প্ল্যান বানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহস করে উঠতে পারে না। ছুটির দিন দেখে মিতা রান্না করতে বসেছিল। রান্নার গন্ধে তার গা কেমন গুলিয়ে উঠলো। সে বাথরুমের দিকে দৌড় দিল।

-কি হয়েছে তোমার বলোতো নদী? কদিন ধরেই দেখছি কিছু খেতে পারছো না। বমি করছো।
-জানি না আপু। শরীরটা ভাল যাচ্ছে না।
-তোমার পিরিয়ড ঠিকমত হচ্ছে?
-এই মাসেরটা হয়নি আপু।
-তোমার কি রাফাতের সাথে ফিজিকাল রিলেশন আছে?
প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে যায়।
-প্রোটেকশন নিয়েছিলে?
-আমি এমন কিছু করতে চাইনি আপু। ও এমন জোর করেতো মাঝে মাঝে যে আমি বাধা দিয়েও কিছু করতে পারতাম না।
-এখন তাহলে কি করবে?
নদীর কান্না চলে আসে। সামনে কত বড় বিপদ অপেক্ষা করছে সে চিন্তাও করতে পারে না।
-তুমি আগে টেস্ট করো। কনফার্ম হও। তারপর রাফাত কে জানাও দেখ ও কি বলে।

প্রেগন্যান্সি স্ট্রিপ টা হাতে নিয়ে নদী প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে আছে। রাফাতকে বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে। কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। আবার ফোন করলো।
-কি হয়েছে বল? এত বার ফোন করছিস কেন?
-জরুরী কথা আছে রাফাত। একটু আসবে আমার হলের সামনে।
-এখন কোথাও যেতে পারবো না। যা বলার বলে ফেল।
-আমি প্রেগন্যান্ট রাফাত।
-তো আমি কি করবো?
-তুমি কি করবে মানে? তোমার বাচ্চা।
-আমার বাচ্চা? ডিএনএ টেস্ট করিয়ে আন। কার না কার সাথে শুয়েছিস। এখন আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছিস। আমাকে এসবের মধ্যে জড়াবি না। কোনো একটা ক্লিনিকে যেয়ে ফেলে দিয়ে আয়। টাকা লাগলে বলিস। আমি পাঠিয়ে দেব।

ফোনটা রেখে সে উঠলো। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। সে সেখানেই পড়ে গেল। মিতা গোসল সেরে রুমে এসে দেখে নদী মেঝেতে পড়ে আছে। জ্ঞান যদিও আছে কিন্তু মেঝে রক্তে ভেসে গেছে।

চলবে….

এমি।

*কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here